ভেলানথিয়া রাজ্যের রাজপ্রাসাদটা ছিলো এক নির্জন জায়গায়, যেখানে চারপাশে ঘন জঙ্গল আর ফুলের সুবাসে ঘেরা সরু পাথরের পথ। জঙ্গলের কারণে সহজেই কোন শত্রুপক্ষের জন্য প্রাসাদ খুঁজে পাওয়া বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার ছিলো। প্রাসাদের দোতলায় থাকতো রাজকন্যা আয়রা। সে ছিল অপূর্ব রূপবতী, যার চোখে ছিলো তীরের মত তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। আর ঠোঁটে ছিল মায়াবিনী হাসি। কিন্তু তার কোন ভাষা ছিলো না। জন্ম থেকেই সে ছিলো বোবা। প্রতিদিন সে জানালার পাশে একা বসে বসে জঙ্গল দেখতো। আর সেই সময় তার লম্বা সোনালী চুলগুলো জানালা দিয়ে ছেড়ে দিতো। সেই চুল বাতাসে দুলতো, আর পৌঁছে যেতো নিচতলার অর্ধেক পর্যন্ত।
একদিন সন্ধ্যাবেলায়, সেই প্রাসাদের পাশে পাথরের পথ দিয়ে ঘোড়া নিয়ে যাচ্ছিলো রাজকুমার রেভান। চলতে চলতে হঠাৎ ঘোড়া থামিয়ে দিলো। কোন একটা অদ্ভুত ঘ্রাণ তার নাকে আসছে। যেটা সে আগে কোনদিন পায়নি। ধীরে ধীরে ঘোড়াকে সেদিকে নিয়ে যেতে লাগলো। ঘ্রাণের খুব কাছাকাছি রেভান তার ঘোড়া থামালো। সে দেখতে পায় না, জন্ম থেকেই অন্ধ। কিন্তু মনে মনে বললো, "এই গন্ধ, এই স্পর্শ, কিছু একটার নেশা যেন লেগে আছে এতে। ঘোড়া আরেকটু এগিয়ে নিয়ে গেলো। হঠাৎ তার কপালে ছুঁয়ে গেলো নরম রেশমের মতো কিছু, যেটা ছিলো আয়রার চুল। সে অনেক অবাক হলো, "এই জঙ্গলের ভেতরে চুল আসবে কোথা থেকে? তাও আবার এত সুন্দর আগে মাতোয়ারা।"
রেভান একহাতে চুল স্পর্শ করে সেই ঘ্রাণ নিতে লাগলো।
আয়রা এতক্ষণ ওপর থেকে সবকিছু দেখছিলো। সে বেশ ভয়ে ভয়েই লোকটার ভাবগতিক পর্যবেক্ষণ করছিলো।
কিন্তু যখন চুল স্পর্শ করলো, তখন সে উঠে যেতে উদ্ধত হলো। হঠাৎ চুলে নাড়া লাগতেই রেভান বলে উঠলো, "কে তুমি? এখানে কি করছো?" কোন জবাব নেই।
রেভান আবার বললো, "তুমি যদি এটাকে ফাঁদ হিসেবে ব্যবহার করো, তবে ভুল করছো। আমার তলোয়ারের একটা আঘাতে তুমি ঘায়েল হয়ে যাবে। ভেবো না আমি অন্ধ বলে আমি দুর্বল। আমার ঘ্রাণশক্তি আর শ্রবণশক্তি অত্যন্ত প্রখর।" আয়রা এতক্ষণ বুঝতেও পারেনি লোকটা অন্ধ। কারণ তার চলাচলের মাঝে এমন কিছুই প্রকাশ পায়নি। অন্ধ অথচ লোকটার চলাচল কতটা নিখুঁত। রেভান তলোয়ার বের করতেই আয়রা সেখান থেকে দৌড়ে ভেতরে চলে গেলো। রেভান আয়রার চুলগুলোকে ফাঁদ ভেবে কেটে ফেলতে চেয়েছিলো। সে বেশ কিছুক্ষণ সেখানে থাকার পরে প্রস্থান নিলো।
রাতে রেভানের ঘুম হলো না। সেই অচেনা ঘ্রাণের নেশা যেন তার পুরো শরীর জুড়ে লেগে আছে। এপাশ ওপাশ করেও যখন ঘুম হলো না। তখন সে উঠে প্রাসাদের ছাদে গিয়ে হাটাহাটি করতে লাগলো। আকাশে জ্যোৎস্না, অথচ এই সৌন্দর্য অবলোকন করার ক্ষমতা তার নেই। কিন্তু বাতাসের সুঘ্রাণ আর আর তরঙ্গের স্পন্দন সে খুব স্পষ্টভাবে পায়। তার মনে হলো, দূর থেকেও যেন জঙ্গলে পাওয়া সেই ঘ্রাণ তার নাকে আসছে। রেভান তার সহচর পওলিনকে ডাকে।
"আগামীকাল সন্ধ্যায় আমার সাথে একটা স্থানে যেতে হবে। তৈরি থেকো।"
"জ্বি অবশ্যই! এটা কি কোন যুদ্ধ?"
"না, তবে যুদ্ধের মতই। শত্রুর খোঁজে।"
"আপনি তাহলে শত্রুকে খুঁজে যুদ্ধ করবেন রাজকুমার?"
"হ্যাঁ তাই। আমি নিশ্চিত হতে চাই ওটা কোন শত্রু কিনা?"
"ঠিক আছে, আমি তৈরি থাকবো।"
"তবে যাবো শুধু আমরা দু'জন। আর কোন সৈন্যের প্রয়োজন নেই। শত্রু কিনা নিশ্চিত হতে পারলে আমি নিজেই যুদ্ধ করতে পারি। কিন্তু আমি জানিনা সেটা কি! এজন্য তোমাকে সাথে নিতে চাই।"
T পরদিন সন্ধ্যা শেষ হওয়ার পরে রাজকন্যা আয়রা দুর থেকে দু'জনকে ঘোড়া নিয়ে প্রাসাদের দিকে আসতে দেখলো। সে দৌড়ে গিয়ে তার পরিচারিকা এমিওনকে ডেকে আনলো। এখন দু'জন মিলে জানালার পাশে বসে দেখতে লাগলো। অনেক দূর থেকে দেখার পরও আয়রা গতকাল আসা যুবককে চিনে ফেললো। সে ইশারায় এমিওনকে সেসব বললো। এমিওন তাকে আজকেও চুল নামিয়ে বসে থাকার জন্য বললো তাদের উদ্দেশ্য বোঝার জন্য। এরপর এমিওন আড়ালে লুকিয়ে রইলো।
প্রাসাদের থেকে বেশ খানিকটা দূরে এসে রেভান তার যোড়া থামিয়ে বললো, "পওলিন, ঘ্রাণ পাচ্ছো?"
"হ্যা রাজকুমার। আমি মরা ফুলের পঁচে যাওয়া গন্ধ পাচ্ছি।"
"দেখো, হয়তো তোমার নাকটাই পঁচে গেছে। আশেপাশে কিছু দেখতে পাও কিনা আমাকে জানাও।"
"কিছুটা সামনে বিশাল একটা প্রাসাদ। আর হ্যাঁ, একটা সুন্দরী দোতলার জানালা দিয়ে চুল ছেড়ে বসে আছে। অনেক লম্বা আর সোনালী রঙের চুল। অপূর্ব সুন্দর!"
"হয়তো বা সে এই প্রাসাদের রাজকন্যা হবে। চলো আরও কিছুটা এগিয়ে যাই।"
পওলিন কিছুটা দুরে দাঁড়িয়ে, রেভান এগিয়ে গেলো চুলের খুব কাছাকাছি। চুলে স্পর্শ করলো। বুক ভর্তি করে ঘ্রাণ নিলো। এরপর রাজকন্যাকে উদ্দেশ্য করে বললো, "কে তুমি? কি নাম তোমার?" কোন উত্তর নেই।
রেভান পওলিনকে ডাকলো।
"দেখো তো সে কি করছে?"
-"সে মুখটা একহাতে ভর দিয়ে আপনার দিকে তাকিয়ে আছে। কোন কথা বলছে না।"
"সে বোবা, কথা বলতে পারে না।" রাজকন্যার পাশ থেকে একটা উত্তর ভেসে এলো। পওলিন আর রেভান দুজনেই চমকে উঠলো! রেভান বলে উঠলো, "তুমি কে?"
"আমি রাজকন্যা আয়রার পরিচারিকা এমিওন।"
-"কি অদ্ভুত! আমি চোখে দেখতে পাই না। আর সে কথা বলতে পারে না। সে কখনোই আমাকে কিছু বলবে না, আর আমি তাকে দেখতে পাবো না। অথচ তার প্রতি আমি ভীষণ টান অনুভব করছি।"
পওলিন পাশ থেকে বললো, "আপনি কি না দেখেই তার প্রেমে পড়েছেন রাজকুমার?"
"হয়তো তাই। তার ঘ্রাণ আমাকে এই পর্যন্ত টেনে এনেছে।"
আয়রার পরিচারিকা বললো, "বিষয়টা আপনাদের জন্য প্রাণঘাতী হতে পারে। কারণ রাজা ইলিসান কখনও এই ব্যাপারে সম্মত হবেন না। উল্টো আপনাদের প্রাণ কেড়ে নেবেন। I
পওলিন এগিয়ে বললো, "ওহে বালিকা, জেনে রাখো। রেভানও ইলথেনিয়া রাজ্যের রাজকুমার। তোমার রাজা জানলে আরও খুশি হবেন।"
জবাবে এমিওন বললো, "মোটেও সেরকম কিছু হবে না। রাজকুমার যদি সত্যিই আমাদের রাজকন্যা আয়রাকে ভালোবাসে, তবে তার জন্য পরীক্ষা দিতে হবে। আমাদের রাজ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী দানবাকৃতির একজন যোদ্ধা আছে। এই রাজ্যের সাথে কেউ সম্মন্ধ করতে আসলে তাকে সেই যোদ্ধার সাথে তলোয়ার যুদ্ধ করতে হয়। জিতলে স্বাগতম, হারলে পরলোকগমন।" এইটা শোনার পরে পওলিন চিন্তায় পড়ে যায়। কিন্তু রেভান বলে, "আমি রাজি। তোমার রাজাকে জানিয়ে দাও, আমি যুদ্ধ করতে প্রস্তুত।" রাজকন্যা আয়রা রেভানের সাহসীপূর্ণ কথা শুনে বেশ খুশি হয়। একটা বোবা মেয়েকে পাবার জন্য সে অন্ধ হয়েও জীবনবাজি রাখতে প্রস্তুত।
পরদিন ভেলানথিয়া রাজ্যে খবরটা ছড়িয়ে গেলো। বোবা রাজকন্যার জন্য একজন অন্ধ রাজকুমার যুদ্ধ করবে। রাজ্যের সবখানে কানাকানি শুরু হলো, যেমন বোবা রাজকন্যা, তেমনি অন্ধ রাজকুমার। বেশ মানাবে!! রাজা ইলিসান এসবে পাত্তা দিলেন না। তিনি বললেন, "আমি চাই বীরপুরুষ। যে বীরত্ব দেখাতে পারবে, আমি তার হাতে আমার মেয়েকে তুলে দেবো।"
একটা নির্দিষ্ট দিনে একক যুদ্ধের আয়োজন করা হলো। সবাই দূর-দুরান্তের রাজ্য থেকে ভেলানথিয়ায় এসেছে অন্ধ রাজকুমারের যুদ্ধ দেখতে। যুদ্ধের জন্য মঞ্চ প্রস্তুত।
একপাশে দাড়িয়ে রাজকুমার রেভান, গায়ে যুদ্ধের পোশাক, হাতে স্বর্ণের হাতলযুক্ত তলোয়ার। চোখে কালো কাপড় বাধা। যেন একজন নির্ভীক তরুণ যোদ্ধা। যার মৃত্যু ভয় নেই!
অপর প্রান্তে দাড়িয়ে সেই দানবাকৃতির যোদ্ধা লিওনথিস। সম্পূর্ণ চুলবিহীন মাথা রোদে চকচক করছে। কপালে কাপড়ে মোড়ানো বন্ধনী। গায়ে লোহার পোশাক। হাতে ঢেউ আকৃতির এক বিশাল তলোয়ার। চোখ দুইটা রক্তিম বর্ণের। রাজার আদেশের অপেক্ষায় আছে দু'জন। রাজার একপাশে তার বিশ্বস্ত সেনাপতি আর একপাশে রাজকন্যা আয়রা। আয়রার চোখেমুখে উচ্ছলতা, যেন চাইছে রাজকুমার জিতে যাক। দর্শকদের বেশিরভাগ মানুষই জানে রাজকুমার যুদ্ধে লিওনথিসের সাথে পারবে না। কারণ এর আগে যারা তার সাথে যুদ্ধে নেমেছে। কেউ বেঁচে ফেরেনি। তারপর আবার সে অন্ধ। কিভাবে সম্ভব? তবু যেন মনে মনে চায় কোন অলৌকিক শক্তিতে রাজকুমার জিতুক।
রাজার আদেশে যুদ্ধ শুরু হলো। লিওনথিস একটু এগিয়ে এসে পা দিয়ে মাটিতে আঘাত করতেই মাটি যেন খরখর করে কেঁপে উঠলো। এদিকে রেভান আত্মরক্ষার কৌশলে দাড়িয়ে গেলো। তার শ্রবণশক্তি আর ঘ্রাণকে খুব I ভালোভাবে ব্যবহার করতে হবে এখন। সে বাতাসে লিওনথিসের তলোয়ার এগিয়ে আসার শব্দ শুনতে পেলো। মুহুর্তেই শরীর ঘুরিয়ে নিতেই তলোয়ারের কোপটা মাটিতে পড়লো। রেভানের ঠিক এক ইঞ্চি পাশ দিয়ে। এবার রেভান এগিয়ে গিয়ে লিওনথিসের হাটুতে আঘাত করলো।
লিওনথিস আবার আঘাত করার প্রস্তুতি নিলো। এবার সে তলোয়ারটা ডান দিক থেকে বাম দিকে চালালো। রেভান লাফিয়ে পড়তেই তলোয়ার তার পায়ের নিচ দিয়ে চলে গেলো। এরপরের আঘাতে রেভানের ডান হাতের কিছুটা অংশ কেটে রক্ত ঝরতে লাগলো। সে মাটিতে পড়ে গেলো। এবার লিওনখিস দুই হাতে তলোয়ার উঁচু করে রেভানের বুকের বরাবর আঘাত করতেই রেভান নিজের তলোয়ার বুকের ওপর পেতে দিলো। আর লিওনথিসের তলোয়ারটা তার ওপর লাগলো। সেই সময় রেভান দুই পা দিয়ে সজোরে লিওনথিসের বুকে লাথি দিতেই লিওনথিস মাটিতে পড়ে গেলো আর তার তলোয়ার ছিটকে অন্যদিকে চলে গেলো। রেভান ঠিক সেই সুযোগেই লিওনথিসের গলার তার তলোয়ারটা চেপে ধরলো।
চারিদিকে রেভানের নামে সবাই জয়ধ্বনি দিতে লাগলো। অনেকে প্রশংসা করতে লাগলো, "রাজকুমার এমন বীরের মত যুদ্ধ করলো, যেন সে চোখে দেখা লোকেদের থেকেও বেশি দেখতে পায়।" রাজা ইলিসান বেশ অবাক হলেন। কারণ এর আগে কেউ লিওনথিসকে হারাতে পারেনি। এদিকে রাজকন্যা আয়রার চোখে পানি। হয়তো সেটা আনন্দের এবং ভালোবাসার। একজন অচেনা বীরপুরুষ তার জন্য কতটা সাহস নিয়ে যুদ্ধ করেছে। যেন সে তার জন্যই পৃথিবীতে এসেছে।
রাজা ইলিসান সবার মাঝে রেভানের জয়কে বীরত্বের সাথে প্রকাশ করলেন এবং সেই সাথে রাজকন্যাকে বিয়ের জন্য আরেকটা শর্ত জুড়ে দিলেন। তাকে আরেকটা লড়াই করতে হবে। যেটা জঙ্গলের মধ্যে। আর সেটা একটা বিরাট অজগরের সাথে। এবার চারিদিক থেকে গুঞ্জন শুরু হলো। রাজাকে অনেকে বেইমান বলে আখ্যা দিলো। অনেকে বললো, "রাজার এটা কেমন খেয়াল খুশি? রাজকুমার অন্ধ বলে যা ইচ্ছা তাই শর্ত দেবে? এটা করা একদমই উচিত হয়নি তার।" আরও অনেকে অনেক কথা বললো। কিন্তু সবার সমালোচনাকে উড়িয়ে দিয়ে রাজকুমার রেভান ঘোষণা দিলো যে, "আমি যাবো অজগরের সাথে যুদ্ধ করতে। প্রাণ গেলেও আমি পিছপা হবো না। শুধু আমি রাজকন্যাকে একবার স্পর্শ করতে চাই। তাহলে আমার আর কোন আফসোস থাকবে না।" রাজকন্যা বারবারই রেভানের জন্য অবাক হচ্ছিলো। আর তাতে তার ভালোবাসাও বেড়ে যাচ্ছিলো রেভানের প্রতি।
I
সে তার চাওয়া পুরণ করতে একমুহূর্ত বিলম্ব করলো না। দৌড়ে এলো রেভানের দিকে। রক্তমাখা রেভানের শরীরটা জড়িয়ে ধরলো। সে আয়রাকে বললো, "আমি জানি রাজকন্যা। তুমি আমাকে কিছু বলতে পারছো না। কিন্তু আমি বুঝে নিয়েছি। আর তোমাকে পাওয়ার জন্যই আমি পৃথিবীর সমস্ত শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করতে প্রস্তুত।" এই কথার পরে সে আয়রার কপালে চুম্বন করে। তখন আয়রাও রেভানের কাটা হাতের ক্ষত জায়গায় চুম্বন করে নিজের ঠোঁটে তার রক্ত মাখিয়ে নেয়।
পরদিন রেভান পওলিনের সাথে অজগর যুদ্ধের ব্যাপারে আলোচনা করে। পওলিনকে জানায়, "আমি রাতে জঙ্গলে যাবো যুদ্ধ করতে। কারণ দিন-রাত সবকিছুই আমার জন্য সমান।"
- "আমি তাহলে আমাদের রাজ্যে খবরটা জানিয়ে দিই।"
-"তার প্রয়োজন নেই। আমি মারা গেলে আমার বাবা ইলিসানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামবে। আর অজগর যুদ্ধের কথা জানলে সৈন্য পাঠাবে। তাহলে আমার যুদ্ধ বলে কিছু থাকবে না। যেহেতু পুরো সিদ্ধান্তটাই আমার ছিলো। তাই আমিই সবকিছু ঠিক করে নিতে চাই।" পওলিনও জানে রাজকুমার রেভান কত দৃঢ় আর সাহসী। তাই সে আর কিছু বললো না।
রেভানকে রাতে যুদ্ধে যাওয়ার জন্য সমস্ত কিছুর ব্যবস্থা করে দিলেন রাজা ইলিসান। সাথে একটা নতুন তলোয়ার দিয়ে বললেন, "আমি জানি, তুমি সৎ, সাহসী আর বুদ্ধিমান। তবে এই তীক্ষ্ণ ধারালো তলোয়ারটা রাখো। এটা তোমার কাজে লাগবে। সবাই হয়তো আমাকে শর্ত ভঙ্গের জন্য অন্যায়কারী ভাবছে। কিন্তু তুমি যুদ্ধ থেকে ফিরে আসলে বুঝতে পারবে, কেন আমি এই শর্ত দিয়েছি তোমাকে। জয়ী হও!"
রাজা রেভানকে বিদায় জানালো। রেভান ঘোড়ায় চেপে আস্তে আস্তে জঙ্গলের ভেতরে যেতে লাগলো। এই রাতের বেলায়ও অনেক লোক রেভানকে দেখতে এসেছে। তার বীরত্বের জন্য বাহবা দিচ্ছে। এমন সাহসী বীরপুরুষ যেন একশোটা রাজ্য খুঁজলেও পাওয়া যাবে না।
রেভান একসময় গভীর জঙ্গলের মধ্যে প্রবেশ করলো। কিন্তু তেমন কোন অদ্ভুত আওয়াজ পেলো না। বেশ কিছু শুকনো পাতা ছাড়া। তবে কিছু ফুলের ঘ্রাণ আর পুরোনো গাছের গন্ধ নাকে এলো। অনেকক্ষণ পর একটা গন্ধ তার কাছে ধীরে ধীরে তীব্র হতে লাগলো। সে খুব সাবধানে ঘোড়াকে থামিয়ে দিয়ে নেমে দাড়ালো। গন্ধটা যেন আরও বাড়তে লাগলো। যেদিক থেকে গন্ধটা আসছে, সেদিকে ঘুরে দাড়িয়ে তলোয়ারটা উন্মুক্ত করে নিলো। এরপর সে গভীর নিশ্বাসের শব্দ শুনতে পেলো। নিশ্চয়ই এইটাই সেই অজগর। রেভান শব্দ সংকেত দিয়ে ঘোড়াটাকে সরে যেতে আদেশ দিলো। এরপর সে নিজে একটা বড় গাছের আড়ালে লুকিয়ে পড়লো। তার আণ আর শ্রবণশক্তি পুরোপুরি সক্রিয়। খুব কাছেই অজগরের নিশ্বাস এসে পড়লো। রেভান বাম হাত বাড়িয়ে স্পর্শ করার চেষ্টা করতেই অজগর তার বিশাল লেজ দিয়ে রেভানের লুকিয়ে থাকা গাছটায় আঘাত করলো। এতই শক্তি দিয়ে আঘাত করলো, যেন আরেকটু হলে গাছ ভেঙে যেতো। রেভান জানে, এই যুদ্ধে হেরে গেলে সে তার ভালোবাসাকে হারিয়ে ফেলবে। যার জন্য এই যুদ্ধে আসা।
সে সাহস করে একেবারে অজগরের সামনে গিয়ে দাড়িয়ে হাতের তলোয়ারটা ঘুরাতে শুরু করলো। অজগর তখন তীব্র গতিতে মাথা দিয়ে আঘাত করতেই রেভান ছিটকে অনেক দূরে গিয়ে পড়লো। চোখে বাধা কাপড়টা খুলে পড়ে গেলো। সে তার কোমরে আর পিঠে প্রচন্ড আঘাত পেলো। যার কারণে সে উঠে দাড়াতে পারলো না। কিন্তু হাতের তলোয়ারটা ছিলো। বুঝতে পারলো অজগরটা তার দিকে এগিয়ে আসছে। সে মাটিতে থাকা অবস্থায় আরেকটা কোপ দিলো, কিন্তু অজগরের যেন কিছুই হলো না। অজগরটা মুখ হা এগিয়ে এলো। তার জিহবার লালা রেভানের চোখে আর মুখের ওপর পড়ে জ্বালাপোড়া শুরু হলো। সে একহাতে তার মুখ থেকে লালা মুছতে মুছতে অজগর তাকে কামড়ে উঠিয়ে নিয়ে মুখের মধ্যে নিয়ে ফেললো। রেভানের যেন সব শেষ। এখনই দম বন্ধ হয়ে মারা যাবে সে।
ওই মুহূর্তে তার মনে পড়লো রাজকন্যা আয়রার স্পর্শের কথা। নিমেষেই যেন বুদ্ধি শক্তি দুটোই পরিপূর্ণ হয়ে উঠলো। সে হাতের তলোয়ার দিয়ে অজগরের গলার ভেতরের দিকটায় আটকে দিলো, যাতে সে গিলতে না পারে। গিলতে গেলেই তলোয়ারের চাপে গলা চিরে যাবে। এরপর দুই পা ধাক্কা দিয়ে হালকা একটু উপরে উঠে আসলো। একহাতে অজগরের জিহবা আন্দাজ করে একটা মাপ নিয়ে, এক পা তলোয়ার রাখা জায়গায় রেখে নিজেকে ঠেকিয়ে নিলো। এরপর তলোয়ার উঠিয়ে এনে জিহবার গোড়ায় এক কোপ দিয়ে গোড়া থেকে জিহবা আলাদা করে ফেললো। অজগর যন্ত্রণায় সেই মুহুর্তে মুখ হা করে প্রচন্ড জোরে গর্জন করে উঠলো। সেই সাথে রেভান লাফিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো এবং মাটিতে পড়েই জ্ঞান হারিয়ে ফেললো সে।
পরদিন ভোর থেকেই জঙ্গলের বাইরের রাস্তা এবং আশপাশ দিয়ে বেশ ভীড় জমে গেছে। সবাই রেভানের ফেরার অপেক্ষা করছে। রাজকন্যা আয়রা এবং এমিওন দাঁড়িয়ে আছে একপাশে। এমিওন বলছে, "রাজকুমারী, সে হয়তো ফিরবে না।"
"আমার বিশ্বাস সে ফিরে আসবে। সত্যিই আসবে।"
"কিন্তু আপনি যে গতকাল রাত থেকেই কথা বলতে পারছেন, এটা কি তাহলে তারই কোন আলামত?"
"এই রহস্যটা শুধুমাত্র আমার বাবা জানে। সে কাউকে কোনদিন বলেনি এই ব্যাপারে।"
"দেখুন তো রাজকুমারী, ওটা রেভান কিনা? কিন্তু হাতে কি নিয়ে আসছে?"
"হ্যা হ্যা এমিওন, ওটা আমার রেভান। সে ফিরে আসছে।" বলেই দৌড়াতে লাগলো তার দিকে। রেভানের একহাতে ঘোড়ার দড়ি, অন্যহাতে বিরাট অজগরের কাটা মাথা। সবাই তাকে দেখে ভীড় জমে যাওয়ার আয়রা রেভানের কাছে যেতে পারে না। I
কেউ তার প্রশংসায় ব্যস্ত, কেউ তাকে বুকে জড়িয়ে ধরছে, কেউ হাত ধরছে, কেউ এগিয়ে অজগরের মাথা দেখছে। রাজা সবাইকে সরে যেতে আদেশ দিয়ে রেভানকে এগিয়ে আসতে দিলেন। রেভান প্রচন্ড ক্লান্ত আর দুর্বল ছিলো। সে রাজার পায়ের কাছে এনে অজগরের মাথাটা ফেলে দিয়ে বললো, "এই নিন মহারাজ। আমি আপনার শর্ত পূরণ করেছি।"
"তোমার জন্য আর কোন শর্ত বাকি নেই। তুমি আমার মেয়ে আয়রাকে গ্রহণ করতে পারো।" রাজা ইলিসান সেখান থেকে প্রস্থান করলেন। আয়রা এগিয়ে গিয়ে রেভানকে জড়িয়ে ধরে বললো, "তুমি আমাকে জেতার জন্য পুরো পৃথিবী জিতে নিয়েছো। আর আজ আমি তোমাকেই জিতে নিলাম।" রেভান তখন প্রচন্ড অবাক হয়ে বললো,
"তুমি কথা বলতে পারছো কি করে? নাকি আমি ক্লান্তিতে ভুল শুনছি?" পাশ থেকে এমিওন জবাব দিলো, "রাজকন্যা গতরাত থেকেই কথা বলতে পারছে। কিভাবে এটা হলো কেউ জানেনা। তবে রাজা নাকি এই রহস্যটা জানে।"
রেভান আয়রার দিকে ঘুরে বললো, "তুমি এতটা সুন্দর! আমার দেখা সবচেয়ে সুন্দর হচ্ছো তুমি।"
আয়রাও অনেক অবাক হয়ে প্রশ্ন করে, "তুমি কিভাবে বুঝলে আমি সুন্দর?"
"হাতের স্পর্শে বুঝেছি।"
"তুমি কি সত্যিই হাতের স্পর্শে বুঝেছো? তাহলে তোমার দৃষ্টি এত নিখুঁত হলো কিভাবে?"
"সকালে জ্ঞান ফেরার পরেই বুঝলাম আমার চোখে দৃষ্টি এসেছে। পাশে দেখলাম অজগরটা পড়ে আছে।
ওইভাবে ফেলে রেখে আসলে যদি আবার বেঁচে ওঠে, তাই ওর মাথা কেটে আলাদা করে সাথে নিয়ে এলাম। কিন্তু চোখে দৃষ্টি কিভাবে আসলো আমি এখনও বুঝতে পারছি না। তবে কি ওই অজগরে কোন রহস্য...!"
"হতে পারে। তুমি প্রাসাদে ফিরে চলো। তোমার বিশ্রাম প্রয়োজন।"
রাজা ইলিসান সমস্ত আত্মীয় এবং রাজকর্মচারীদেরকে নিমন্ত্রণ করেছেন রাতের খাবারে। সাথে ইলখেনিয়া রাজ্যেও খবর দেওয়া হয়েছে। রাতের খাবারের আগ মুহুর্তে রাজা সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলতে লাগলেন, "এই পর্যন্ত রেভানের সাথে যা কিছু হয়েছে। সবই আমার স্বপ্নে দেখা পরিকল্পনা অনুযায়ী।" কথাটা সবাইকে বেশ অবাক করে দিলো। তিনি আবার বলতে শুরু করেন, "রাজকন্যা আয়রার জন্মের পূর্বে আমার একজন জাদুকরের সাথে পরিচয় হয়। সে ছিলো প্রচন্ড লোভী। কিন্তু সেটা আমি প্রথমে বুঝতে পারি না। সে আমাকে ইলখেনিয়া রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধের পরামর্শ দেয়। কিন্তু আমি রাজি হইনা। এরপর তার সাথে এই নিয়ে বেশ বাকবিতণ্ডা হয়। একপর্যায়ে সে আমার গর্ভবতী রানীর ওপরে জাদু করে, যাতে বাচ্চার ক্ষতি হয়। এরপর রাজকন্যার জন্ম হয়। প্রথমে কোন ক্ষতি হয়নি ভাবলেও পরে বুঝতে পারলাম সে বোবা।
ধ এরপর একদিন স্বপ্নে দেখলাম, কোন এক যাজক আমাকে বলছে কিভাবে এই জাদু থেকে মুক্ত হওয়া যায়। সে আমাকে নির্দেশ দেয়, জাদুকর রাজকন্যার কন্ঠ একটা অজগরের জিহবার মধ্যে রেখে দিয়েছে। আর অন্য কোন একটা বাচ্চার চোখের দৃষ্টি তার গলার মধ্যে। এই সাপটাকে মেরে ফেললে এই জাদু থেকে দুজনেই মুক্তি পাবে। তাছাড়া আমার রাজকন্যার খোঁজে কোন একটা অন্ধ রাজকুমার আসবে। যে এই অসাধ্য কাজটা করতে পারবে। আমি রোভানের কথা জানতে পেরে তাকে পরীক্ষা করার জন্য লিওনথিসের সাথে যুদ্ধে নামাই। এবং সে সফল হয়। এই পুরো কথাটা স্বপ্নে সেই যাজক কাউকে বলতে নিষেধ করেছিলেন। কারণ বললেই সমস্ত কিছু নষ্ট হয়ে যাবে। রাজকন্যা আর তার ভাষা ফিরে পাবে না।"
এতকিছু শুনে সবাই স্তব্ধ হয়ে গেলো। সেই মুহূর্তে রেভানের বাবা রাজা আরডান বলে ওঠে, "সেই জাদুকরের সাথে আমারও পরিচয় হয়েছিলো যখন রাজকুমার রেভানের বয়স ৪ বছর। সে আমাকেও এই রাজ্য আক্রমণের পরামর্শ দেয়। আমি তাকে আমার রাজ্য থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার পরদিন থেকে রেভান অন্ধ হয়ে যায়।" রেভান বললো, "তাহলে অজগরের লালার ভেতরেই এমন কিছু ছিলো যেটা আমার চোখে পড়ার কারণে আমি দৃষ্টি ফিরে পাই।"
সমস্ত রহস্য সবার সামনে উন্মুক্ত হওয়ার পরে সবাই জাদুকরের উদ্দেশ্য আর ক্ষতির ব্যাপারটা জেনে আতংকিত হলো। আবার এদিকে রাজকন্যা আর রাজকুমার তাদের সুস্থতা ফিরে পাওয়ায় তার চেয়ে বেশি আনন্দিত হলো। রাজা ইলিসান রাজা আরডানের সম্মতি নিয়ে সকলের সামনে রাজকুমার রেভান ও রাজকন্যা আয়রার বিয়ের ঘোষণা দিলেন। এই আনন্দে যেন চারিদিকে উৎসবের আমেজ ছড়িয়ে গেলো। রেভান একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আয়রার দিকে। এদিকে আয়রা ফিসফিস করে বলছে, "এতদিন না দেখার তৃষ্ণা আমাকে দেখেই মেটাতে হবে?" "সত্যিই তাই। স্বার্থক আমার দৃষ্টি ফিরে পাওয়া। সারাজীবন ধরে তোমাকে দেখে গেলেও দেখা শেষ হবে না।" "আমারও অনেক কথা আছে তোমার সাথে। সারাজীবন কেটে যাবে, তবুও হয়তো শেষ হবে না।" এরপর আয়রা তার মাথাটা রেভানের কাধে রাখে।