সবার ঈদের স্মৃতি প্রায় একই রকম - চাঁদরাতে চাঁদ উঠার জন্য অপেক্ষা করা, চাঁদ উঠলে চাঁদ দেখা, বিটিভি তে ঈদের গান শুনে আনন্দে আত্মহারা হওয়া, হাতে মেহেদী দিয়ে সারারাত অপেক্ষা করা, সকালে গোসল করে নতুন পোশাক পরে ঈদগাহে যাওয়া, বন্ধুদের সাথে ঘুরতে বের হওয়া....ইত্যাদি.... ইত্যাদি।
কিন্তু নাদিয়ার ঈদ স্মৃতি কখনোই এমন সুখকর ছিল না!!
জীবনে মাত্র একবার নিজের মতো করে ঈদ উদযাপন করতে পেরেছিল নাদিয়া ; তাও সেটা তার নানার বাড়িতে!! তখন নাদিয়া ক্লাস থ্রিতে পড়ে। ঘটনাচক্রে নানার বাড়িতে প্রথমবারের মতো ঈদ উদযাপন করার সৌভাগ্য হয়েছিল নাদিয়ার।
সেবছর ২৯ শে রমজানের সন্ধ্যায় ইফতারের পর নাদিয়ার মামাতো ভাইবোনেরা তাকে নিয়ে পাড়ার বাচ্চাদের সঙ্গে ধানক্ষেতের দিকে রওনা দিলো। সবার হাতে কাগজ দিয়ে বানানো পতাকা ; আর তাতে " ঈদ মোবারক " লেখা । আজ চাঁদ উঠবে এটাই তাদের বিশ্বাস!! টর্চলাইট হাতে নিয়ে তাই আলো আঁধারে ধানক্ষেতের দিকে তারা অগ্রসর হলো । পুকুর পাড়ের ঝোপঝাড়ে জোনাকি পোকারা তখন লুকোচুরি খেলছে। ঝিঁঝি পোকারা ডাকছে। গ্রামে থাকার পরও এমন দৃশ্য এর আগে কখনো দেখা হয়নি নাদিয়ার!! ধানক্ষেতে গিয়ে পশ্চিমাকাশের দিকে তাকিয়ে সবাই অধীর আগ্রহে চাঁদের জন্য অপেক্ষা করছে। এক একটা মুহূর্ত যেন এক একটা যুগ!! কখন চাঁদ উঠবে, আদৌও চাঁদ উঠবে কি না সেটা নিয়ে সবার মাঝে চরম উত্তেজনা। এমন উত্তেজনা নাদিয়া কখনো অনুভব করেনি!!
' অথচ এমনই চাঁদরাত এর আগেও কতবার তার জীবনে এসেছে। নাদিয়া সবসময় দেখে এসেছে তার দাদার বাড়িতে চাঁদরাতে ইফতার করার পর তার দাদাভাই বিটিভি চ্যানেলে দিয়ে বলতো, " চাঁদ উঠলে এই চ্যানেলে ঈদের গান প্রচার করা হবে। বাইরে গিয়ে অযথা দাঁড়িয়ে থাকার কোন দরকার নেই!! রাত ৮ টার খবরে চাঁদের ভিডিও ফুটেজ দেখাবে সেখান থেকেই চাঁদ দেখে নিস!!" নাদিয়ার বাড়ির পশ্চিম দিকে গাছপালা থাকায় বারান্দা থেকে ঈদের চাঁদ দেখা যেত না। তাকে বাইরেও যেতে দিত না!! সদর দরজায় তালা দিয়ে রাখতো। তাই ইচ্ছে থাকা স্বত্ত্বেও
কখনোই ঈদের চাঁদ দেখার সৌভাগ্য তার হয়ে উঠে নি!! বিটিভিতে ঈদের গান শুনে, বিটিভির খবরের ভিডিও ফুটেজে সে চাঁদ দেখতো!! নাদিয়াকে হাতে মেহেদী দিয়ে দিলে সযত্নে তা আগলে রাখতে রাখতে একসময় সে ঘুমিয়ে পড়তো। সকালে ঘুম থেকে উঠে মজার মজার খাবার খেয়ে গোসল করে নতুন জামা পরে ভাইদের জন্য অপেক্ষা করতো। ঈদগাহ থেকে ফিরে আসলে বাড়ির সবাইকে সালাম করতো, সালামি নিতো। আর সারাদিন টিভিতে ঈদের অনুষ্ঠান দেখে সময় কাটাতো। তাদেরকে কোথাও ঘুরতেও নিয়ে যেত না!! '
যাই হোক, অনেক অপেক্ষার পর অবশেষে চাঁদ উঠলো আর নাদিয়াসহ সবাই আনন্দে চিৎকার করে উঠলো। আর " ঈদ মোবারক " বলে একে অপরের সাথে কোলাকুলি করলো। ঈদের চাঁদ যে এত সুন্দর হয় তা নাদিয়ার জানা ছিল না!! যেন এক ফালি চাঁদ মেঘের আড়ালে লুকোচুরি খেলছে। মেঘের আড়াল থেকে উঁকি দেওয়া সেই চাঁদ যেন তাদের দিকে তাকিয়ে হাসছিল!! চাঁদের স্নিগ্ধ আলোয় চারদিক আলোকিত হয়ে উঠেছে। " ঈদ মোবারক " লেখা পতাকা নিয়ে ঈদের গান গাইতে গাইতে তারা সবাই পুরো পাড়ায় ঘুরে বেড়ালো। ঈদের চাঁদ দেখার মাঝে যে এত আনন্দ আছে সেটা নানার বাড়িতে না আসলে হয়তো নাদিয়া কখনো জানতেই পারতো না!!
তারপর নাদিয়া ও তার মামাতো ভাইবোনেরা বাড়ি ফিরে আসলো। এবার মেহেদী দেবার পালা। রাতে নাদিয়াকে তার আম্মু খাইয়ে দিলে মেহেদী হাতে নিয়ে অনেক কায়দা করে মেহেদী আগলে সে ঘুমিয়ে পড়ে।
সকালে ঘুম থেকে উঠেই সবার প্রথমে নাদিয়া দেখলো তার মেহেদীরাঙা হাত ; কতো সুন্দর গাঢ় রং হয়েছে!! তারপর সে মামাতো ভাইবোনদের ডেকে তুললো। কার মেহেদীর রং সবচেয়ে বেশি গাঢ় হয়েছে সেটা মিলিয়ে দেখে খুশিতে নেচে উঠলো সবাই মিলে। গোসল করে নতুন জামা পরে পায়েস, সেমাই খেয়ে বোনেরা তাদের ছোট ভাইদের নতুন পায়জামা - পাঞ্জাবি পরিয়ে চুল আঁচড়ে ঈদগাহে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত করে দিলো। তারপর নাদিয়া ও তার বোনেরা সাজগোছ করতে বসে গেলো। ছেলেরা নামাজ পড়ে আসার পর সবাই মিলে একসাথে পরিবারের সবাইকে সালাম করলো। বড়রা তাদের দোয়া করলেন এবং তাদের সালামি দিলেন।
তারা সবাই বন্ধুদের বাড়িতে গিয়ে অনেক আনন্দ করলো, মজার মজার খাবার খেলো। তারপর নাদিয়া জীবনে প্রথমবার তার মামা ও মামাতো ভাইবোনদের সাথে চিড়িয়াখানা, শিশু পার্কে ঘুরতে গেলো। সারাদিন সবাই অনেক মজা করলো। চিড়িয়াখানায় বাঘ, চিতাবাঘ, সিংহ, ভাল্লুক, অজগর, হাতি, ঘোড়া, ময়ূর, বানর, হনুমান , গন্ডার , জলহস্তীসহ আরো নাম না জানা কত পাখি দেখলো তার হিসেব নেই। ফেরার সময় তারা মেলা থেকে মাটির পুতুল, পাখি, বেলুন, বাঁশি আরো অনেক কিছু কিনে নিয়ে আসলো। বাড়ি ফিরতে ফিরতে তাদের সন্ধ্যা হয়ে গেল। এর আগে ঈদের দিন এত আনন্দ নাদিয়া কখনো পায়নি!!
' অথচ এতবছর ধরে ঈদের দিন নাদিয়া ও তার ভাইকে সারাদিন ঘরে বসে থেকে টিভি দেখে সময় কাটাতে হতো!! বন্ধুদের বাড়িতে যেতে দিতো না!! কোথাও ঘুরতে নিয়ে যেত না!! বলতো, " রাস্তায় প্রচুর ভিড়। ছেলেধরা নিয়ে যাবে। হারিয়ে যাবি। তার চেয়ে বরং টিভি দেখ!!" সময় যেন স্তব্ধ হয়ে থাকত। খুব বিরক্ত লাগতো তাদের!! ঈদের দিনও ছিল তাদের জন্য বোরিং একটা দিন!! কেন যে ঈদ এলো সেটাই বুঝতে পারতো না নাদিয়া!! '
কিন্তু সেই বছরের ঈদ ছিল জীবনের সবচেয়ে সুন্দর আর অন্যরকম একটা দিন। সত্যিকারের ঈদের দিন। সালটা ছিল ২০০৭। যে আনন্দ, আবেগ, ভালোবাসা নাদিয়া পেয়েছে সেই ঈদের দিনে তা আর কখনো নাদিয়ার পাওয়া হয়নি এ জীবনে!!
লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা
ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য
নাদিয়ার স্বপ্নপূরণ গল্প হলো পরিবারের অতিরিক্ত শাসনে একাকিত্বে ভোগা, নিঃসঙ্গ হয়ে পড়া এক ছোট্ট মেয়ের গল্প। যে কখনোই তার জীবনের ছোট্ট ছোট্ট ইচ্ছা, শখ পূরণ করতে পারেনা পরিবারের অতিরিক্ত শাসন ও রক্ষণশীল মনোভাবের কারণে। অতিরিক্ত শাসন ও রক্ষণশীল মনোভাব শিশুদের শৈশব নষ্ট করে দেয়। কিন্তু গল্পের চরিত্র নাদিয়া ঘটনাচক্রে জীবনে প্রথমবার তার মনের মতো করে ঈদ উদযাপন করতে পেরেছিল। নাদিয়ার অপূর্ণ এক স্বপ্ন অবশেষে পূরণ হলো। স্বপ্নপূরণের এমনই এক ভিন্ন ধাঁচের গল্পই ' নাদিয়ার স্বপ্নপূরণ' ।
০৫ মে - ২০২৫
গল্প/কবিতা:
১ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ জুন,২০২৫