-বাবা ওরা এসেছে।আমায় নিয়ে যেতে এসেছে। ঘাড়ে বাবার হাতের ছোঁয়া পেয়ে কম্পিউটারের সামনে বসে থাকা অংকুর ওঠে দাঁড়ায়।মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে।বাবার দিকে তাকাতে পারেনা। সেটা কি ভয়,লজ্জা নাকি ঘৃণার কারণে। সে বুঝতে পারেনা বুঝতে চায়ও না।বাবা ঘর হতে বেরুতে থাকে। মনে মনে অংকুর বলে, বাবা জানি না তোমার বিচার হবে কিনা! তবে এটুকু সান্ত্বনা পাব, কয়দিন যাবত যে কষ্ট আমি বুকে বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছিলাম আজ কিছুটা হলেও সে চাপ থেকে মুক্ত হতে পারব। ছোটবেলায় কখনো ভয় পেলে কিংবা দুষ্টুমির কারণে কারো হাতে মার খাওয়ার ভয় থাকলে তোমার কোলে এসে মাথা গুঁজতাম। তুমি পরম মমতায় আমায় জড়িয়ে ধরতে।আমি মুক্তি পেতাম। অথচ আজ মনে হচ্ছে কখন তোমার কাছ থেকে মুক্ত হতে পারব।আজ তোমার আশ্রয় আমার দম বন্ধ করে দিচ্ছিল।
দোতলার ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ায় অংকুর। পুরো বাড়িটা পুলিশ ঘিরে রেখেছে। অনুভব করতে পারে অংকুর। সে সময় নিশ্চয়ই প্রতিটি বাড়ি পুলিশ ঘিরে রাখত। নিজেকেই আবার নিজে শুধরে নেয়,না প্রতিটি বাড়ি কেন। পুরো দেশটাইতো পুলিশ, সেনাবাহিনী দিয়ে ঘিরে ফেলা হয়েছিল। নিরস্ত্র বাঙালী কি ভয় পেয়েছিল ? কি করে বলবে সে ,সেতো আর মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি। নিজেকেই নিজে ধিক্কার দেয়।আপনমনেই হেসে ওঠে সে। আরে বোকা ছেলে! স্বাধীন দেশে জন্ম নিয়ে,স্বাধীন দেশে বাস করে বলছিস বাঙালী কি ভয় পেয়েছিলো। আরে ভয় পেলে কি স্বাধীনতা আসতো!স্বাধীন হোত এ দেশ? ছোটবেলায় কখনো দাদাবাড়ি যাওয়া হয়নি তার।কেন হয়নি সেটা জানতে পারেনি সে। এখনতো দাদা বাড়িতে কেউ নেই। দাদা চাচারা কেউ বেঁচে নেই। সে বাড়ির সাথে কখনোই যোগাযোগ ছিলনা ।মার কাছে জেনেছিল দাদা চাচারা বাবাকে পছন্দ করতেন না। কেনইবা পছন্দ করতেন না সেটাও কিশোর অংকুরের কাছে একটা রহস্যই রয়েছিল। আজ আর সেটা রহস্য নয় তরুণ অংকুরের কাছে। দাদু বাড়ির গ্রামে এসে সে তার বাবা সম্পর্কে জেনেছে।অবাক হয়েছে। বাবার প্রতি ঘৃণা জন্মেছে।ক্ষোভ বেড়েছে।
-কে আপনি? পুলিশের লোক? সাংবাদিক ? উকিল? -দেখুন আমি এসবের কেউ না। -তাইলে এতো জিগাচ্ছেস কেন? তিনদিন আগে হলে হয় তো আগ বাড়িয়ে প্রতিষ্ঠানের পরিচয় ছাপিয়ে নিজের পিতৃপরিচয় দিতে চাইতো,বলতো এ গ্রামেই তার দাদুর বাড়ি। তখন তার সংকোচ থাকতো না । এখন যদি বলে সে এ গাঁয়ের সোবাহান রহমানের ছেলে তাহলে তাকে হয়তো তারা ঘৃণা ভরে দূরে ঠেলে দেবে। তাই সে নিজের পিতৃ পরিচয় গোপন রেখে বলে আমি আসলে মুক্তিযুদ্ধের সময়কার এষানকার ইতিহাস জানতে এসেছি। নিজেকেই তিন চারদিনে সহপাঠীদের কাছ থেকে অনেকটাই সংকুচিত করে ফেলেছে সে। ভার্সিটি থেকে যখন তারা এ্যাসাইনমেন্ট পেল, সে সাগ্রহে রাজি হয়ে গিয়েছিল।বন্ধুদের বলেনি যে এ গ্রামেই তার দাদুর বাসা। কেননা যে কখনো আসেনি তার দাদুর বাড়িতে, তার বাবাকে পছন্দ করতো না দাদু। সে কি করে সহপাঠীদের কাছে তার দাদু বাড়ির পরিচয় দেবে।
যতই সে এখানকার মুক্তিযুদ্ধের সময়কার গল্প শুনছে,আঁতকে উঠছে। তার শরীরে রাজাকারের রক্ত।
-কি হল এখানে একা একা বসে কি করছিস? -এই এমনি ভাল লাগছেনা। ভাবছি ঢাকা ফিরে যাব। -কেনরে সেকি! টাস্ক কমপ্লিট না করেই চলে যাবি। -বললামতো ভাল লাগছে না। -কি হয়েছে তোর বলতো।আমরা যখন টাস্কগুলো নিয়ে আলোচনা করি তুই অনেকটাই অন্যমনস্ক থাকিস। -কই নাতো! -তুই কিছু একটা লুকোচ্ছিস.. -কেন? লুকোবো কেন? -বারে আমরা মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি। সে সময়কার ঘটনার কথা শুনে শিউরে উঠতে হয়। কি সাহসী না এদেশের মানুষগুলো ছিল।যতই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস শুনছি ততই শিহরিত হচ্ছি। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধায় মাথা নুয়ে আসছে। কত কষ্টই না করেছে তারা।জীবনকে বাজি রেখে যুদ্ধ করেছে। আমার মনে হয় ইস সে সময় যদি আমার জন্ম হয়ে থাকত আমিও যুদ্ধে যেতাম। তারপর একটু থেমে পাপন বলে, তুই যেতি না ? যুদ্ধ করতি না? সে কথার জবাব না দিয়ে নিজেই নিজেকেই প্রশ্ন করে-কি হে অংকুর তুমি কি করতে মুক্তিযুদ্ধ ? তোমার শরীরেতো রাজাকারের রক্ত। যারা এদেশে জন্ম নিয়ে, বড় হয়েও দেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে নেমেছিলো। তাদের রক্ত । -কিওে আবার কি ভাবছিস? -কই কিছু নাতো!
পুরো গ্রাম জুড়ে আগুন জ্বলছে।নারী পুরুষের আর্ত চিৎকার ছাপিয়ে এদেশীয় দোসর রাজাকার আলবদরদের অট্টহাসি শুনতে পাচ্ছে অংকুর। সোবাহান রহমান পাকিস্তানী সৈন্যদের সাথে ঘুরছে। মুক্তিসেনাদের বাড়ি দেখিয়ে দিচ্ছে। পাকিস্তানীরা মুক্তিযোদ্ধাদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে। অসহায় মানুষগুলো বাঁচার চাইতে দেশের স্বাধীনতা চেয়েছে।বছরের পর বছর ধরে পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর অত্যাচার ,নির্যাতন বৈষম্য শোষণ থেকে মুক্তি পেতে চেয়েছিল এদেশের জনগণ।তাদেরকে দমিয়ে রাখা যায়নি।একদিন দু"দিন একবছর পাঁচবছর হয়তো দমানো যায়।কিন্তু বছরের পর বছর দাবিয়ে রাখা যায়না।অত্যাচারিত নিষ্পেষিত শোষিত হতে হতে একসময় মুক্তি পেতে মরিয়া হয়ে ওঠে তারা।তখন কোন কিছুই তাদের ভয়ের কারণ হয়না। শত্রুপক্ষের অস্ত্র,গুলী তাদের মুক্তি ঠেকাতে পারেনা। এদেশেরই কিছু মানুষ সেইসব পাকিস্তানী শোষকদের সাথে হাত মিলায়।এদেশীয় রাজাকার,আলবদর,আলশামস নিজের দেশের মুক্তিকামী জনতার দাবীকে মেনে নিতে না পেরে তাদের ধরিয়ে দেয় পাকিস্তানীদের হাতে।সেই সব মানুষদের মাঝে সে সোবাহান রহমানকে দেখতে পায়। লাফ দিয়ে বিছানায় ওঠে বসে অংকুর। হাঁপাচ্ছে। পাশের বিছানায় ঘুমিয়ে থাকা বন্ধু কাজল জেগে ওঠে। অংকুরের বিছানার কাছে উঠে আসে। কি হয়েছে? কোন খারাপ স্বপ্ন দেখছিস? -হ্যাঁ। বলে চুপ করে থাকে অংকুর।মনে মনে সে বলে,সেতো এতক্ষণ জেগেজেগেই স্বপ্ন দেখছিল। তার বন্ধুরা জানেনা, যে সোবাহান রহমানের মুক্তিযুদ্ধের সময়কার তথ্য তারা পেয়েছে সেই সোবাহান রহমানের ছেলে তাদের বন্ধু অংকুর। যখন তারা জানবে তারা তাকে ঘৃণা করবে।সে মুক্তি পেতে চায়। সে পালাতে চায়।
সকালে কাউকে কিছু না বলে সে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। শুধু এক ফাঁকে কাজলকে ফোন করে জানায় সে ঢাকা চলে যাচ্ছে। গাড়িতে বসে সে ভাবতে থাকে, সে যা করছে এটা কি ঠিক ? পালালে কি মুক্তি পাওয়া যায়?
একাত্তরে বাঙালীরা পালালে কি মুক্তি পেতো ? তাহলে কি স্বাধীনতা আসতো। অংকুরের মত এ প্রজন্মের সন্তানেরা কি স্বাধীন দেশ পেত?এখনো স্বাধীনতার স্বাদ সকল মানুষ পায়নি। তবুও স্বাধীনতাতো পেয়েছে। মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার মত ঠাঁই পেয়েছে। পেয়েছে মানচিত্র। পেয়েছে স্বাধীন ভূমি। পালানো কোন কিছুর সমাধান নয়। সে নিজেও পালাতে চায় না। পালাচ্ছে না। ফিরে আসছে সত্যের মুখোমুখি হতে। মুক্তি পেতে।
ড্রইং রুমে বসে আছেন তার বাবা। -তোর না আরো দু"দিন পর ফেরার কথা ছিল । ফিরে আসলি যে! ভাল আছিস তো! একটু থেমে সে কথার জবাব না দিয়ে দোতলার নিজের ঘরে চলে আসে অংকুর।কম্পিউটার টেবিলের চেয়ারটায় গিয়ে বসে।
থানা থেকে পুলিশ আসতে এতক্ষণ সময় লাগারতো কথা নয়। হয়তো অতিরিক্ত ফোর্স নিয়ে আসছে। নীচে কয়েকটি গাড়ি থামার শব্দ শুনতে পায়।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
সেলিনা ইসলাম
আমাদের দেশে অংকুরের মত ছেলের বড় বেশী প্রয়োজন এখন ...ওরাই পারবে নিজেদের কলুষিত শিকড়কে উপড়ে ফেলে নতুন উদ্যোমে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করতে ...খুব সুন্দর থিম ,অসাধারণ গল্প । ধন্যবাদ
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।