আজীবনের অকম্মা, আমড়া কাঠের ঢেঁকি বাউন্ডুলে ছেলেটা যে এমন সংসারী হয়ে যাবে তার ওর বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন তো দূর, খোদ পরিবারের লোকজনই ভাবে নি। বলছি উবায়েদের কথা। পড়ালেখায় কোনোকালেই মন ছিল না। লোকাল কলেজ থেকে অনার্সের পর মাস্টার্সও করে বসল। কিন্তু এখন মাস্টার্স সার্টিফিকেটধারী পিয়ন-মেসেঞ্জারও আছে, উবায়েদ আর কী ভালো জব পাবে! ব্যাংকের ক্যাশিয়ারের চাকুরিটা ওর জন্যে অনেক।
বিয়ের পর উবায়দের রিয়েল ট্রান্সফরমেশন ঘটল। পুরদস্তুর সংসারীই শুধু না, ভবিষ্যৎ নিয়ে পরিকল্পনার কথা ভাবে! উবায়েদের বাপ-মা খুশি হয়, আর ভাবে যদি ছোটবেলা থেকে এভাবে ফিউচার নিয়ে ভাবত তাহলে ছেলেটা কতদূর যেত! জ্ঞানবুদ্ধি তো নেহায়েত খারাপ না!
বিয়ের পর স্ত্রী মালঞ্চকে নিয়ে উঠেছে একটা অতি সাধারণ ফ্ল্যাটে। তবে ঢাকা শহরের ফ্ল্যাট তো, বেতনের এক-তৃতীয়াংশ মাস শেষ না হতেই উবায়েদের হাত থেকে বাড়িওয়ালার পকেটে চলে যায়। বাকিটা নিয়ে খেয়েপড়ে বাঁচা যায়, কিন্তু আসতে চলেছে ওদের সন্তান, তার জন্যে তো প্রস্তুতির ব্যাপার আছে!
উবায়েদ-মালঞ্চ গুনে গুনে টাকা খরচা করে। ডেলিভারির আগে-পরে ম্যালা খরচ! উবায়েদ অবশ্য আরো দূর পর্যন্ত ভেবে রেখেছে। সন্তান মানুষের জন্যে সাধ্যমত খরচ করবে। ওর বাবা-মা সন্তানের চাওয়া পূরণে যে কার্পন্য করেছে তা সে নিজের সন্তানের বেলায় হতে দেবে না। তা হোক খেলনা কিংবা লেখাপড়া।
উবায়েদের স্বপ্ন অনেক বড়, কিন্তু বাস্তবতার সাথে কুলিয়ে উঠতে কষ্ট হয়। জিনিসপত্রের যা দাম! বছর শেষে যে ইনক্রিমেন্টটা জোটে, তা দিয়ে আসলে বেতন বাড়ে না। বরং দ্রব্যমূল্য হিসাব করলে ওই টাকার অর্থমূল্য বছর বছর কমে। তাও তো কিছু সাপোর্ট হয়! কিন্তু সেই সাপোর্টও বন্ধ হয়ে গেল এক ভুলে।
ইদানিং উবায়েদ অনাগত ভবিষ্যৎ নিয়ে এতটা ভাবিত থাকে যে ক্যাশ পেমেন্ট পাঁচ হাজার টাকা ভুলে বেশি করে ফেলেছে। দিন শেষে হিসাব মেলাতে গিয়ে ধরা পড়েছে গরমিল। ফোন পেয়ে কাস্টমার সিধা অস্বীকার করেছে। অগত্যা পুরো টাকাটাই শুধু উবায়েদকে পকেট থেকে দিতে হলো না, এক মাসে এরকম দুই ভুলের সাজাও পেল। ম্যানেজার এইচআরের কাছে মেইল দিয়ে উবায়েদের পরিবর্তে নতুন ক্যাশিয়ার চেয়েছে। এইচআর নেপথ্য কারণ জানার পর কাঁচি চালিয়েছে ইনক্রিমেন্ট লিস্টে। উবায়েদের এই বছরের ইনক্রিমেন্ট বন্ধ!
পকেট থেকে নগদ পাঁচ হাজার আর ইনক্রিমেন্ট বাবদ মাসান্তে তিন হাজার- উবায়েদের বুকের ভেতর মরিচের মতো জ্বলতে লাগল এতগুলো টাকা খেসারত দেয়ার কারণে। এই ঘাটতি মিটবে কীভাবে?
অফিস শেষে বাসায় ফিরতে ফিরতে উবায়েদ পূর্বাপর না ভেবেই একটা ডিসিশন নিয়ে ফেলল- একটা এক্সট্রা ইনকামের সোর্স বের করতে হবে।
উবায়েদদের ব্যাংক দুই বছরের EMI-তে মোটর বাইক লোন দেয়। ডাউন পেমেন্টের চল্লিশ হাজার টাকা পিএফের এগেইনস্টে স্টাফ লোন দিয়ে পে করবে। আর মাসে মাসে হাজার পাঁচেক টাকা কিস্তি। দুই বছর পর বাইক নিজের! তার আগেই এটা দিয়ে বাইকের দামের কয়েকগুণ উশুল করা যাবে।
উবায়েদ বাইকটা ভালো চালায়। আর ঢাকার অলিগলি তলিতল্লাট সব ওর মুখস্ত। বাইক রাইড শেয়ারের কাজ শুরু করে তাই ওর বেগ পেতে হলো না। ওদের এই বাসায় নিচে বাইক রাখা সেইফ না বিধায় পাশের বিল্ডিংয়ে দারোয়ানের সাথে মিলতাল করে বাইক রাখার ব্যবস্থা করেছে। মাস শেষে পাঁচশ টাকা লাগলেও বাইক তো নিরাপদ!
………….
প্রথম দিনই তেলখরচ বাদে হাজারখানেক টাকা আয় হয়ে গেল। মালঞ্চের প্রিয় বাকালাভা মিষ্টি নিয়ে বাসায় ফিরল উবায়েদ। মালঞ্চ হ্যাপি, উবায়েদও হ্যাপি। নতুন স্বপ্নের জাল বুনে চলে দুজন।
সকালে অফিসে ঢোকার আগে ঘণ্টা দুই আর অফিস শেষে ঘণ্টা চার- নয় ঘণ্টা অফিসের বাইরে আরো ছয় ঘণ্টা বাড়তি কাজের শারীরিক মানসিক ধকল উবায়েদ হাসিমুখে সয়ে নেয় অনাগত ভবিষ্যতের কথা ভেবে। আস্তে আস্তে মালঞ্চের গর্ভে বেড়ে উঠছে ওদের সন্তান। কমে আসছে ঋণের বোঝা। সুস্থসবল বাচ্চা কোলে এলে আর লোনটা শোধ হয়ে গেলে তখন চাপ অনেক কমে যাবে।
কিন্তু জীবনের হিসাব কি এত সরল?
কিছুদিন পর মালঞ্চের গর্ভকালীন শারীরিক জটিলতা দেখা দিলো। গর্ভের পানি শুকিয়ে যাওয়ায় গর্ভপাত হয়ে গেল। উবায়েদ মনটা শক্ত করে স্ত্রীর মুখের দিকে চেয়ে। আল্লাহ এবারে দেয় নাই তো কী, সামনের বার দেবে!
জীবনের হিসাবটা দুজন আবার নতুন করে শুরু করে।
আবারো মালঞ্চ কনসিভ করে। কিছুদিন পর সেই একই জটিলতা- গর্ভের পানি শুকিয়ে যায়। স্ত্রীকে ভালো ডাক্তার দেখায়। ডাক্তার কিছু ওষুধ প্রেসক্রাইব করে। উবায়েদ হিসেব করে দেখে ডেলিভারি পর্যন্ত ডেইলি মেডিসিন আর সাপ্তাহিক ইঞ্জেকশনবাবদ এক্সট্রা প্রায় পাঁচ হাজার টাকা বাড়তি গুনতে হবে। ওর মুখটা শুকিয়ে আসে বাড়তি খরচের বহর দেখে। কিন্তু করতে তো হবে!
………
মালঞ্চের ডেলিভারির সময় এগিয়ে এসেছে। নরমাল ডেলিভারি চায় মালঞ্চ। কিন্তু ডাক্তার পই পই করে বলেছে এটা খুব রিস্কি। তবু মালঞ্চ শেষ পর্যন্ত দেখবে। ওকে মানাতে না পেরে অবশেষে ডাক্তার বলল তারা চেষ্টা করবে। তবে সি-সেকশনের প্রস্তুতি যেন ওরা নিয়ে রাখে।
এক্সট্রা খরচের জন্যে হাতে টাকা তেমন জমছে না। তার ওপর এখন স্ত্রীকে এই অবস্থায় রেখে বেশি রাত অব্দি বাইক চালাতে পারে না। চোখে অন্ধকার দেখে উবায়েদ, কিন্তু ওকে বুঝতে দেয় না। নিজের গচ্ছিত টাকার পাশাপাশি বন্ধুর কাছ থেকে হাজার পঞ্চাশ ধার নিয়ে রাখল সেইফটির জন্যে।
আজ অফিস থেকে বেরিয়ে উবায়েদ সবার আগে গেল ফার্মেসিতে। মালঞ্চের ওষুধ শেষ। ওষুধগুলো ব্যাগের সাইড পকেটে রেখে গেল প্লাস্টিক আসবাবপত্রের দোকানে। বাসায় লো কমোড, মালঞ্চের জন্যে এটা ব্যবহার করা কষ্ট, রিস্কিও। একটা কমোড চেয়ার দেখে রাখল, যাওয়ার সময় নেবে। দোকানে ওরকম চেয়ার একটাই ছিল। দোকানদার চেনে বিধায় ওর জন্যে রেখে দিলো ওটা।
কাল শ্বশুর-শাশুড়ি আসবে। উবায়েদ মুদি দোকান থেকে পোলাও চাল, সেমাই, চিনি কিনে রাখল। এই দোকানিও চেনা। দামটা বাসায় ফেরার সময় দিলেও চলবে।
আসলে ওষুধ কেনার পর এই বাড়তি খরচ দেয়ার সামর্থ্য এই মুহূর্তে নেই। বাইক চালিয়ে যা মিলবে সেটা দিয়ে পে করতে হবে।
………….
আজ ভালো রোজগার হয়েছে। নয়টা বাজতেই যাত্রীকে নামিয়ে বাসায় ফেরার পথ ধরল উবায়েদ। কিন্তু পথে এক লোক ধরে বসেছে, তাকে ভুতের গলিতে নামিয়ে আসার জন্যে। উবায়েদ কোনোভাবেই তাকে নেবে না। ওদিকে রাস্তায় আর কোনো বাইক নেই। লোকটা উবায়েদের হাত জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল। বাসা থেকে খবর এসেছে স্ত্রীর লেবার পেইন উঠেছে। দেরি হলে অঘটন ঘটতে পারে। নিজের অনাগত সন্তানের কথা ভেবে উবায়েদ রাজি হলো।
এন্তার জ্যাম ঠেলে ভুতের গলি পৌঁছাতে রাত বাজল দশটা। বাসায় ফিরতে ফিরতে এগারটা পেরিয়ে যাবে। দোকানপাট বন্ধ হয়ে যাবে। মুদি বাজার বাসায় এখন নিতে না পারলে কাল ঝামেলা হবে। কারণ রান্নাটা উবায়েদ বৌকে দিয়ে করাবে না, নিজে করবে। বৌয়ের জন্যে কষ্টের হয় এমন কিছুই করতে সে নারাজ।
বৌ অলরেডি দু’বার ফোন করেছে। ওর নাকি সন্ধ্যা থেকে শরীর কেমন কেমন করছে। এখন কী অবস্থা কে জানে? রাতের ওষুধটা তো এখনো খাওয়া হয় নি, ওটার জন্যে কিনা?
উবায়েদ তাড়াহুড়ো করছে কোনোমতে যাত্রীকে গন্তব্যে পৌঁছে দিয়ে দ্রুত ফেরার। কিন্তু গন্তব্যে পৌঁছে একটা চূড়ান্ত শক অপেক্ষা করছিল উবায়েদের। যাত্রীরূপে পেছনে এতদূর বয়ে আনা লোকটার সব গল্প বানোয়াট! লোকটা আসলে যাত্রীর ছদ্মবেশে ছিনতাইকারী! গন্তব্যে অপেক্ষা করছিল তার আরো দুই লোক। বুকটা ফেটে গেলেও উদ্যত ছুরির সামনে কিস্তির টাকায় কেনা মোটরবাইক আর ব্যাগটা নির্বিবাদে সঁপে দিলো ওদের হাতে।
………………
উবায়েদের বুকটা ভারী হয়ে আছে। যেন একশ টন বোঝা চেপে বসেছে বুকে! বাসায় ফিরতে ইচ্ছে করছিল না। ইচ্ছে করছিল এই অন্ধকার গলিপথে হারিয়ে যায়। তবু মালঞ্চের কোমল মুখটে ওকে ফেরাল। যখন বাসায় পৌঁছাল ততক্ষণে মধ্যরাত।
উবায়েদের ফোনটা ওরা নিয়ে গেছে। মালঞ্চ কলের পর কল করে ফোন বন্ধ পেয়েছে। টেনশনে ছটফট করেছে এতক্ষণ। স্বামীকে ফিরতে দেখে আশ্বস্ত হয়েছে। তারপর মনে পড়েছে সন্ধ্যা থেকে ওর ব্যাথার কথা।
“আপনে এত দেরি করলেন ক্যান? আমার ওষুধ আনেন নাই?”
উবায়েদ প্রাণপণে কান্না সংবরণের চেষ্টা করছে, পারছে না। চোখ দিয়ে ফোটায় ফোটায় পানি গড়াচ্ছে। উবায়েদ মাথাটা নিচু করে ফেলল। কিন্তু স্ত্রীর কাছ থেকে কান্না লুকাতে পারে নি। মালঞ্চ অস্থির হয়ে গেল উবায়েদকে কাঁদতে দেখে। মানুষটা তো সহজে ভেঙে পড়ে না!
“কী হইছে আপনের? আপনি কান্দেন ক্যান? ওষুধ আনতে পারেন নাই, দোকান বন্ধ আছিল? অসুবিধা নাই তো, কাইল আনলে হবে!”
মালঞ্চ উবায়েদের মাথাটা বুকে জড়িয়ে ধরল। উবায়েদ কী জবাব দেবে? কী বলবে বৌকে?
বাইক না, লোকগুলো আসলে ওর স্বপ্নকে ছিনতাই করেছে!
কোত্থেকে আসবে বাইক লোনের কিস্তি? কীভাবে মেটাবে সে বন্ধুর থেকে নেয়া কর্জ? রোজকার খরচ, স্ত্রীর সি-সেকশনের টাকা, সন্তানের সুন্দর ভবিষ্যৎ, একটা গোছান সংসার…
এত এত বোঝা, আগামীকাল থেকে এই বোঝা নিয়ে জীবনের পথে কতটা দূর যেতে পারবে সে?
লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা
ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য
একজন মানুষের স্বপ্ন ভঙ্গের হতাশা নিয়ে লেখা হয়েছে এই গল্পটা।
২৫ নভেম্বর - ২০২৩
গল্প/কবিতা:
১৩ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ অক্টোবর,২০২৫