পরিত্রাণ

শীতের সকাল (জানুয়ারী ২০২৪)

Sunil Akash
  • 0
  • ৬৫
বাইরে আজ হাড় কাঁপানো শীত; কনকনে বাতাস কাল কেউটের মতো গায়ে ছোবল মারে। ভারী কুয়াশা পর্দার মতো ঝুলছে, দশ হাত দূরের জিনিসটাও দেখা যাচ্ছে না। এর মধ্যেই জসীম ঝুপড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ল সকাল সকাল। বেসরকারি একটা সংস্থা শীতার্তদের ত্রাণ দেবে। শীতের কাপড়। গেল সপ্তায় ওদের বস্তিতে দিয়েছে, এবার আরেকটা বস্তিতে। একটু দূরে, সকাল সকাল না গেলে নাও পেতে পারে। ও আর সবুজ এবেলা ময়লা কুড়াতে যাবে না।
একটু সামনে গিয়েই আবার ফিরে এলো। পাশের ঝুপড়ি ঘরটার বেড়া ঘেঁষে একটু কুকুর কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছে। শীতে হিহি করে কাঁপছে। এভাবে থাকলে তো মারা যাবে! রুকসানা বেগম পায়ের নিচ থেকে ছেড়া বস্তাটা ছেলের দিকে বাড়িয়ে দিল। পাকঘরে বস্তাটা বিছিয়ে কুটাবাটা করে সে, কিন্তু ওর থেকে এই মুহূর্তে কুকুরটার প্রয়োজন বেশি।
কুকুরটার গায়ে বস্তাটা জড়িয়ে দিয়ে সবুজদের ঘরে গিয়ে ঢুকল। সবুজের মনে হয় অত গরজ নেই! ডাকাডাকি করে তুলতে হলো। দুজনের কারোরই সকালের খাওয়া হয় নি। অমন কত সকাল না খেয়ে কাটিয়েছে ওরা!
বস্তি ছেড়ে বেরোতেই জসীম বুঝল পুরনো সোয়েটার পড়ে আসাটা ভুল হয়েছে। ফাঁকা রাস্তায় হাওয়ার দাপট বেশি। সোয়েটারের জায়গায় জায়গায় দু'চারটা ফুটো, সেখান দিয়ে বাতাস ঢুকে গায়ে যেন কামড় বসাচ্ছে! কিন্তু নতুন জ্যাকেটাটা দেখলে যদি ওরা আরেকটা শীতবস্ত্র না দেয়? গায়ের ওই ছোট্ট সম্বলটুকু নিয়ে ঠান্ডা বাতাসের সাথে যুদ্ধ করতে করতে এগোলো মেইন রোড ধরে। রাস্তাঘাটে আজ মানুষ নেই বললেই চলে। কে চায় এমন শীতে লেপ-কম্বলের আরাম ছেড়ে বেরুতে! উপরন্তু আজ শুক্রবার।
জসীম ওর মা আর ছোট ভাইকে নিয়ে বস্তির ঝুপড়ি ঘরটায় থাকে। একটাই ঘর, সেখানেই রান্না-খাওয়া-ঘুম। ওর বাবা আরেকটা বিয়ে করে চলে গেছে জসীমের ছোট ভাইটা যখন কোলের বাচ্চা। সেই থেকে ওদের সংগ্রামী জীবন। মা অন্যের বাসায় কাজ করে, জসীম টোকাই। ময়লা ঘেঁটে জীবনের রসদ খোঁজাই ওর কাজ। সবুজ ওর সমবয়সী। ওরও বাবা নেই। দুই বন্ধু একসাথে প্রতিদিন প্লাস্টিক বোতল কুড়ায়। দিনশেষে দশ টাকা কেজি দরে বেঁচে।
মিনিট পনের হাঁটার পর দুই বন্ধু স্কুল মাঠে পৌঁছাল। হাতে গোনা অল্প ক'জন মাঠে। ত্রাণদাতাদের কেউ এখনো আসে নি। এত শীতে নিজের খেয়ে বনের মেষ তাড়াতে আসবেটা কে!
এদিকটায় আসতে আসতে ওরা খবর পেল আজকেই নাকি সরকারি ত্রাণ দেবে। খাবার টাবার আরকি। আশ্চর্য! দুনিয়ার সব মানুষ জানে, অথচ ওরা খবরই পায় নি! খালি একটা পাবলিক বাসে উঠে পড়ল দুজন। বাসে যাত্রী কম থাকলে ওরা পথশিশুদের ফ্রিতেও নেয়। স্কুলমাঠে যেতে যেতে কুয়াশা ভেদ করে সূর্যের আলো ফুটেছে। ম্যাড়ম্যাড়ে রোদ, তবু তো শীত কিছু কমবে!
মাঠভর্তি মানুষ। এবার বোঝা গেল ওদিকে আজ ত্রাণপার্থী এত কম কেন!
এই শহরে এত অভাবী মানুষ! ত্রাণ বিতরণ শুরু হয়ে গেছে। চাল ডাল তেল সবজি আর ডিম। বাজারভর্তি ব্যাগের দিকে লোভাতুর নজর সবার। জসীম আর সজীব ভিড়ের মধ্যে ঠেলেঠুলে সামনের দিকে এগোনোর চেষ্টা করছে। বিতরণকারীদের ওপর সহস্র মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। ব্যাগ নিয়ে রীতিমত কাড়াকাড়ি। ভিড় সামাল দিতে এক পর্যায়ে শুরু করল লাঠিচার্জ। দু' ঘা ছেলে দুটোর গায়েও পড়ল। মানুষ অবশ্য তাতেও দমল না। লুটতরাজের দশা! অবস্থা বেগতিক দেখে শেষতক ত্রাণ বিতরণই বন্ধ করে দেয়া হলো। দুই বন্ধু ততক্ষণে ঠেলাধাক্কা খেয়ে অনেকটা পিছে পড়ে গেছে।
নাহ! আজ কপালটাই খারাপ। কখন আবার ত্রাণ দেয়া শুরু হবে তার ঠিক নেই। ওদিকে শীতবস্ত্র বিতরণ হয়ত শুরু হয়ে গেছে। গায়ের লাঠিপেটা খাওয়া জায়গাগুলো ডলতে ডলতে দুজন ফিরে গেল আগের স্কুল মাঠে।
না, ওরা এখনো আছে! ভিড়ভাট্টাও কম। দুজন হাফ ছেড়ে বাঁচল যেন। খালি হাতে তাহলে ফিরতে হচ্ছে না! কিন্তু একী! শীতবস্ত্রের নামে এটা কী দিয়েছে? পুরনো জ্যাকেট সোয়েটার! দুজনের মনটাই খারাপ হয়ে গেল। হয়ত অন্যদের দানের মাল। ত্রাণ দিতে দেয় নি, দিয়েছে স্রেফ ডাম্পিংয়ের জন্যে! জসীম যে সোয়েটারটা পেয়েছে ওটার গায়ে একটা ছিদ্রও আছে। ওটাই হাত ভরে নিতে নিতে ওর চোখ গেল ত্রাণ বিতরণকারী একজনের পায়ের কাছে একটা চটের বস্তার দিকে। বস্তাটা নতুন। জসীম চেয়ে নিল বস্তাটা। মাকে দেবে। ঠান্ডার মধ্যে পায়ের নিচে একটা বস্তা পেলে কাটাকুটি আর রান্নার কাজে সুবিধা হয়।
নতুন জ্যাকেটটা রেখে আসা আসলেই ভুল হয়েছে। গায়ে মোটা জ্যাকেট থাকলে লাঠির বাড়িটা অন্তত কম লাগত! কিন্তু গেল সপ্তায় ত্রাণের জ্যাকেটটা বাসায় এনে আদরের ছোট ভাইটাকে যখন পড়িয়ে দিয়েছিল তখন খুশীতে ওর চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। বোবা ছেলে, পা সোজা করে হাটতেও পারে না। ছোটবেলায় পোলিও হয়েছিল। ওর গালভরা হাসি দেখে জসীমের ইচ্ছে হয় নি ভাইয়ের গা থেকে জ্যাকেটটা খুলে নিতে।
ঝুপড়ি ঘরে ফেরার পথে কুকুরটা। এখনো আছে, বস্তার নিচে ঘুমাচ্ছে। বস্তার গায়ে অনেকগুলো ফুটো। ফুটো দিয়ে ঠান্ডা বাতাস ঢুকছে, কুকুরটা থেকে থেকে কেঁপে কেঁপে উঠছে। জসীম নতুন বস্তাটাও কুকুরের গায়ে জড়িয়ে দিল। একটা মানুষকে শীত থেকে বাঁচাতে গায়ের কাপড় বিলিয়ে দেয়ার জন্যে আরেকটা মানুষ আছে, হোক না সে পুরনো ছেঁড়াফাটা কাপড়। কিন্তু অবলা এই প্রাণীদের কিছু দিতে মানুষ ছাড়া যে কেউ নেই!
শীতের নির্দয় সকালে সামান্য একটা বস্তা অসামান্য পরিত্রাণ হয়ে একটা অবলা প্রাণীর শীত নিবারণ করছে- মন্দ কী!
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
ডায়মান্ডা সান ভালো হয়েছে
ভালো লাগেনি ১৫ জানুয়ারী, ২০২৪
ধন্যবাদ
ভালো লাগেনি ১৬ জানুয়ারী, ২০২৪
ফয়জুল মহী চমৎকার লিখেছেন মুগ্ধ ও বিমোহিত
ভালো লাগেনি ৬ জানুয়ারী, ২০২৪
ধন্যবাদ
ভালো লাগেনি ৬ জানুয়ারী, ২০২৪

লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য

বাইরে আজ হাড় কাঁপানো শীত; কনকনে বাতাস কাল কেউটের মতো গায়ে ছোবল মারে।

২৫ নভেম্বর - ২০২৩ গল্প/কবিতা: ৭ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪