হৃদয়ের চোঁরা কুঠুরিতে

ছোটবেলা (জানুয়ারী ২০২৫)

মাহাবুব হাসান
  • ৯০
১.
“Come, tell us something about your childhood”
ইয়র্কশায়ারে আমাদের প্রথম ক্লাসটা ছিল পরিচিতিমূলক। প্রফেসর মিজ শেরিলের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ক্লাসের অর্ধেক শিক্ষার্থীই তাদের ছোটবেলার স্মৃতিচারণ করল।
জার্মান তরুণ ফ্রেডরিক বলল ট্যুরগাইড বাবার সাথে ঐতিহাসিক স্থানগুলোতে ঘোরার স্মৃতি।
চাইনিজ মিষ্টি মেয়ে অ্যান ছোটবেলায় আর্টিস্ট জুফুর (মান্দারিনে জুফু মানে দাদা) কাছে আঁকাআঁকি শিখেছে আর তার অনেক চিত্রকর্মের ‘সাবজেক্ট’ হয়েছে।
রাশিয়ান ব্লন্ড অ্যালেক্সান্ডারের কাহিনীগুলো সিনেমাকেও হার মানায়। টিনটিনের মতো সেও বহুবার ট্রেজার হান্টে বেরিয়েছে। তবে একা না, কাকার সাথে।
তবে সবচেয়ে রঙিন ছিল আমার ছোটবেলার স্মৃতিগুলো।
আমাদের একটা জাহাজ আছে। প্রায়ই বাবার সাথে সমুদ্রবিহারে বেরোতাম, সাগরে মাছ ধরতাম। আমাদের ছিল বিশাল বিশাল ফল বাগান আর ফসলী ক্ষেত। আমরা সেখানে লুকোচুরি খেলতাম। এলাকায় খুব সম্মানিত একটি পরিবার আমরা। বাবা এলাকার মানুষের নানা উপকার করত, আমিও ছোটবেলা থেকে তার সাথে সাথে থাকতাম। আমি বড় হয়েছি আমাদের বিশাল জমিদারবাড়ির নানা গল্পকাহিনী শুনে শুনে। একদল বন্ধু ছিল আমার, আমিই হতাম তাদের লিডার।
আমি খুব সুন্দর গুছিয়ে কথা বলতে পারি। ক্লাসে যখন কথাগুলো বলছিলাম তখন প্রফেসর শেরিল আমাকে মুগ্ধ নয়নে দেখছিলেন। সহপাঠীদের চকচকে চোখও আমার নজর এড়ায় নি। ক্লাসের সেই প্রথম দিনের পর আমার অনেকগুলো বন্ধু হলো। একেকজন একেক দেশের; বলা চলে ‘বহুজাতিক’ বন্ধুগোষ্ঠী!
সবার চোখে আমার ছোটবেলাটাই সবচেয়ে মধুর। কিন্তু না! ক্লাসরুমে সগৌরবে বলা আমার প্রতিটা কথাই ছিল মিথ্যা!
হতদরিদ্র পরিবারে আমার জন্ম। অপুষ্টিতে আমার বড় দুই ভাইই মারা যায়। কীভাবে কীভাবে যেন আমি টিকে যাই।
আমার বাবা অন্যের জমিতে কাজ করত। আমাদের জাহাজ তো দূর, নৌকাই ছিল না। ভরা মৌসুমে বাবা অন্যের নৌকায় জেলেগিরি করত। টানের সময় খালবিল থেকে মাছ ধরত খেয়া জাল দিয়ে। সেই জালটাও ধার করা।
এলাকায় আমাদের সম্মান বলতে কিছু ছিল না। গ্রামবাসী সামান্য ক’টা টাকার বিনিময়ে আমাদের দিয়ে ঘরের কাজ, ক্ষেতি জমির কাজ, ল্যাট্রিন পরিষ্কার করার কাজ করাতো।
আমার শৈশব স্মৃতি ভয়াবহ! সেখানে হাতড়ে পাতরে ভালো কিছু খুঁজে পাই না। পেটভরা ক্ষুধা নিয়ে ক্লাস করতাম। শীতের সময় হাড় বরফ করা কাদাপানিতে বাবার সাথে মাছ ধরতাম।
মাস্টার বাবুরা ক্লাসের ২, ৩ রোল নম্বধারীদের বাড়ি এসে পড়িয়ে যেত। ১ রোল নম্বরওয়ালা আমি নিজে নিজে পড়তাম। বন্ধুরা যখন হালফ্যাশনের পোশাকে ফুলবাবু হয়ে ঘুরে বেড়াত তখন আমার পরনে থাকত ঘুনসি দোলাই। আমার গায়ের গন্ধে নাকি ওদের বমি আসত! আমি ক্লাস করতাম একদম লাস্ট বেঞ্চে বসে।
দাদার সূত্রে এক টুকরো জমি পেয়েছিলাম আমরা। ওটার ওপর তোলা ছন-মাটির ঘরে কেটেছে আমার ভয়ার্ত শৈশব। ঝড়ে ঘরের চালা উড়ে গেছিল একবার। প্রচণ্ড ভয় পেয়েছিলাম। সারারাত সবাই কাটিয়েছিলাম বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে। প্রতি শীতেই ভীষণ কষ্ট হতো আমাদের। তবে এই সব কষ্ট ছাপিয়ে গেছিল আত্মপরিচয়ের কষ্ট।
সমাজে আমাদের কী নজরে দেখা হতো তার একটা নমুনা দেই।
একদিন এক বড়লোক বাবু আমাকে বলেছিল ওনার বাড়ির পাশের নালাটা সাফ করে দিতে। পরদিন আমার বার্ষিক পরীক্ষা। আমি ‘না’ করে দিয়েছিলাম। সবার সামনে না করায় তিনি ভীষণ অপমানিত বোধ করেছিলেন।
‘ফকিন্নীর বাচ্চা ফকিন্নী, আমি কি মাগনা করাব?’ তিনি খেঁকিয়ে উঠলেন
‘গালি দ্যান ক্যা? আমি কি আপনের গোলাম?’
জবাব শুনে বড় বাবু আমাকে কষে থাপ্পর দিলেন। আমি কাঁদতে কাঁদতে ঘরে ফিরলাম। আর কারো ছেলের গায়ে হাত তুললে বিচার বসত। কিন্তু আমি তো মেথরের ছেলে! বাবা উল্টো আমাকেই বকতে লাগলেন কেন মুরুব্বিদের সাথে তর্ক করলাম।
সেদিনই ঘেন্না ধরে গেল দারিদ্র আর আমার অক্ষম বাবার ওপর। গরিব বলেই তো এত অপমান! আমার বাবা শুধু না, তার বাবা, তারও বাবা হতদরিদ্র ছিল। পৈত্রিক বলেই কি আমিও এই দরিদ্র জীবনই পাবো? অবশ্যই না!
সবাই বলে শৈশব নাকি তার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়; শৈশবে ফিরে যাওয়ার অদ্ভুত আকুতি আমি সবার মধ্যে দেখি। আমার মধ্যে এই আকুতি নেই। ছোটবেলা আমার জীবনের সবচেয়ে খারাপ সময়। ছোটবেলায় ফিরে যাওয়া তো দূর, যদি সম্ভব হতো তাহলে আমার ব্রেইনের যে যে নিউরনে ছোটবেলার স্মৃতি জমা আছে সার্জারি করে সেগুলো ফেলে দিতাম।
ছোটবেলার সবকিছু আমি ভুলে যেতে চাই। সব!
না, সব না। আমার মায়ের স্মৃতিটুকু আমি ভুলতে চাই না। আর চাইলেও ভুলতে পারব না সেই গোধূলিবেলার স্মৃতিটা।
বাবার নৌকায় আমি, পাশে তমা। পাশের বাড়ির রবি কাকার মেয়ে, আমার খেলার সঙ্গী। আর কেউ তো আমার সাথে মিশত না, তমা ছাড়া।
আমি আর তমা নদীর পানিতে পা ডুবিয়ে বসে আছি। নদীতে অনেক স্রোত। বাবা বারবার বলছিলেন উঠে আসতে, দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। আমি আসতে চাচ্ছি, কিন্তু তমা উঠছে না। ও উঠছে না বলেও আমিও উঠছি না।
হঠাৎ নৌকার ঝাঁকুনিতে তমা পানিতে পড়ে গেল। ও সাঁতার জানত না, অত স্রোতে সাঁতার জেনেও অবশ্য লাভ নেই।
তমা পড়েই ডুবে গেল। আমরা বাপ-ছেলে নৌকা নিয়ে খুঁজলাম। তমার মৃতদেহ ভেসে উঠেছিল অনেক দূরে।
সেই বিকেলবেলাটা আজও আমার স্বপ্নে ফিরে ফিরে আসে। আমি ঘুমাতে পারি না।

২.
মাধ্যমিকে বিশাল ‘অঘটন’ ঘটিয়ে ফেললাম। বোর্ড স্ট্যান্ড করে বসলাম। আমি আজীবন গ্রাম ছাড়তে চেয়েছি, আমার রাস্তা খুলে গেল। মেধাবৃত্তি আর গ্রামের গণ্যমান্যদের দেয়া টাকা পুঁজি করে শহরে গেলাম পড়তে। কলেজ থেকে নামী বিশ্ববিদ্যালয়। গ্রামের সাথে কেটে ফেললাম সম্পর্কের সুতোটুকু। কিন্তু ছোটবেলার স্মৃতি সবটা মুছতে পারলাম না। সেই পড়ন্ত বিকেলবেলাটা ঘুরেফিরে মানসপটে ভেসে ওঠে। দুঃস্বপ্ন দেখে আমি জেগে উঠি।
শহরে যাওয়ার পর বাবার সাথে কতবার দেখা হয়েছে তা আঙুলের কড় গুণে বলে দিতে পারি। তার বেশিরভাগই বাবার আসা- আমার মেসে, না হয় হলে। আমি গ্রামে আর যাই নি দুয়েকবার ছাড়া। মা ছিল না, নাড়ির টানও ছিল না।
গ্রামে কেন যাই নি? হয়ত তমার সাথে আমার স্মৃতিমাখা পথটা আমি আর মাড়াতে চাই নি।

৩.
দেশে আমার শিক্ষাজীবনের একদম শেষটায় না চাইতেও গ্রামে যেতে হলো রবি কাকার ফোন পেয়ে। আমার তমার বাবা! বাবার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু। গভীর রাতে ফোনটা পেয়ে বিরক্তির চেয়ে অপ্রস্তুত হয়েছিলাম বেশি। তমা মারা যাওয়ার পর আমি একবারও ওনার সামনে যাই নি।
কাকা ফোনে জানাল বাবা মৃত্যুশয্যায়, আমি যেন তাড়াতাড়ি আসি। তিন কূলে বাবার কেউ নেই, আমি না গেলে মুখাগ্নি কে করাবে?
আমার সামনে ফাইনাল এক্সাম। যাব না যাব না করেও ঠিকই ব্যাগ গুছিয়ে বাড়ির পথ ধরলাম। হতদরিদ্র বাবার জন্যে প্রচণ্ড ঘৃণার সাথে সাথে হৃদয়ের চোঁরা কুঠুরিতে কিছু ভালবাসাও হয়ত বেঁচে ছিল।
এই কয়টা দিন বাবাকে ছায়ার মতো আগলে রেখেছিল রবি কাকা। আমাকে পেয়ে তিনি হাফ ছেড়ে বাঁচলেন।

৪.
বাবার শিয়রে বসে আছি। কিছু চাপা কষ্ট, কিছু অভিমান কণ্ঠরোধ করতে চায়। তবু আজ একটা ফয়সালা করতেই হবে।
‘বাবু! আর তো পারি নে! আইজ অন্তত কবার দ্যান’
বাবার কথা বলার শক্তি ছিল না। তবু অনেক কষ্টে বললেন, ‘না!’ আমার বুকটা ফেটে আসতে চাইল
‘রাতে ঘুমাতি তো পারি নে’
আমি ঝরঝর করে কেঁদে ফেললাম। বাবার চোখ দিয়েও নামল অশ্রুমালা। সেই অশ্রুতে ঠিকরে উঠল সেই গোধূলিবেলাটা-
আমি আর তমা পানিতে পা দোলাচ্ছি। ওর হাতে ছোট একটা পুতুল। আমি দুষ্টুমি করে পুতুলটা নদীতে ফেলে দিলাম। তমা ক্রুদ্ধভাবে বলল, ফকিন্নীর বাচ্চা ফকিন্নী! আমার পুতুল ফেললি ক্যান?
হতদরিদ্র বলে সারাজীবন মানুষের অবজ্ঞা পেয়েছি। কেউ ‘ফকিন্নী’ বলে গায়ে জ্বালা ধরে যেত। তমার মুখে গালিটা শুনে মাথায় রক্ত উঠে গেল। এক ধাক্কায় ওকে নৌকা থেকে পানিতে ফেলে দিলাম। দিয়েই বুঝলাম কত বড় ভুল করেছি।
আমার চেয়েও শঙ্কিত হলো আমার বাবা। বৈঠা ফেলে তিনি সাথে সাথেই পানিতে ঝাঁপ দিলেন। কিন্তু তমাকে জীবিত উদ্ধার করতে পারেন নি।
আমি সেদিনই চেয়েছিলাম রবি কাকার কাছে গিয়ে দোষ স্বীকার করতে। কিন্তু বাবা মাথার দিব্যি দিলেন। সেই দিব্যি আমাকে রবি কাকা পর্যন্ত আজও পৌঁছাতে দেয় নি…
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
Sunil Akash শুরুর একঘেঁয়ে (খানিকটা বিরক্তিকরও!) বর্ণনা শেষে এসে অর্থ খুঁজে পেয়েছে। সেদিক থেকে উতরে গেছে বলা যায়।
অনেকদিন পর গঠনমূলক সমালোচনা পেলাম। ধন্যবাদ! এভাবেই লেখার ভুল ধরিয়ে সংশোধনের সুযোগ করে দেবেন, প্রত্যাশা রইল।
সমালোচনা জিনিসটা সবাই হজম করতে পারে না। আপনি জিনিসটাকে পজিটিভলি নিয়েছেন দেখে ভালো লাগল।
ধন্যবাদ! আসলে সমালোচনা লেখকের জন্যেই ভালো যদি তা গঠনমূলক হয়। শুধু "ভালো লাগে নি" না বলে যদি বলা হয় "এই কারণে ভালো লাগে নি" তাহলে লেখক নিজের ভুলটুকু শুধরে নিতে পারে। আমি যেমন আপনার সমালোচনার আলোকে 'ভালবাসা' সংখ্যার গল্পটাকে আরো আকর্ষণীয় করার চেষ্টা করেছি।
ফয়জুল মহী অনবদ্য লিখনশৈলী! শুভ কামনা নিরন্তর।

লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য

ইয়র্কশায়ারে আমাদের প্রথম ক্লাসটা ছিল পরিচিতিমূলক। প্রফেসর মিজ শেরিলের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ক্লাসের অর্ধেক শিক্ষার্থীই তাদের ছোটবেলার স্মৃতিচারণ করল।

৩০ সেপ্টেম্বর - ২০২৩ গল্প/কবিতা: ২৫ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

বিজ্ঞপ্তি

“ফেব্রুয়ারী ২০২৫” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।

প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী