(১)
“আম্মু আম্মু...”
“কী হইছে?”
“আসো না”
“এখন আসতে পারব না। কাজে আছি”
তুলি কিচেনে ছুটে এলো। মেয়েটি রীতিমতো হাঁপাচ্ছে।
“আম্মু টিভিতে কী দেখাচ্ছে দেখো!”
“কী দেখাচ্ছে?”
“তুরিন প্লাজায় আগুন লাগছে। অনেক মানুষ ভেতরে আটকা পড়ছে, বেরোইতে পারতেছে না”
“তাই নাকি!”
আলেয়া বেগমের কণ্ঠে উদ্বেগের ছাপ। তবে সেটা যে মেকী তা বোঝা যায়। কে মাথা ঘামায় এসব অঘটন সংবাদ নিয়ে! এসব তো হরহামেশাই ঘটছে। তার মনযোগ নিবদ্ধ উনুনের কড়াইয়ের ওপর। মুরগীর মশলাটা জাতের না, তরকারির রং কেমন মরা মরা! লবণও একটু বেশি হয়ে গেছে...
“আম্মু তুমি বুঝো নাই? তুরিন প্লাজা, যেখানে কেএফসির দোকানটা... আব্বু তো ওইখানেই গেছে শুভর জন্যে বার্গার আনতে!”
আলেয়া বেগমের বুকের ভেতরটা ছ্যাৎ করে উঠল। তাই তো! মানুষটা গেছে অনেকক্ষণ হলো, এখনো যে আসে নাই...
চমকিত হাতের ধাক্কায় লবণের জারটা মেঝেতে পড়ে টুকরো টুকরো হয়ে গেল, লবণ ছড়িয়ে পড়ল মেঝেময়। আলেয়ার সেদিকে নজর নেই, মেয়ের পেছনে ছুটতে ছুটতে টিভিরুমে গেল।
তুরিন প্লাজায় লেলিহান আগুন... টিভি চ্যানেলে লাইভ দেখাচ্ছে। নিউজ ক্রলে অবিশ্রান্তভাবে অগ্নিকাণ্ডের নিউজ আপডেট ভেসে আসছে। গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ থেকে আগুনের সূত্রপাত ঘন্টাখানেক আগে। সময়ের সাথে সাথে আগুন বাড়ছে। ভবনের ভেতরে আটকে পড়াদের উদ্ধারকাজ আর অগ্নিনির্বাপন তৎপরতা চলছে একযোগে। আগুন নিয়ন্ত্রণের বাইরে...
“মা রে! তোর আব্বুর নম্বরে একটা কল দে...”
তুলি কাঁপা কাঁপা হাতে বাবার নম্বরে কল দিলো
“আম্মু! মোবাইল তো বন্ধ বলতেছে...”
আলেয়া মেয়ের হাত থেকে মোবাইলটা কেড়ে নিয়ে নিজেই কয়েকবার কল দিল। প্রতিবারই মেয়েলি কণ্ঠে রেসপন্স “এই মুহূর্তে আপনার কাঙ্ক্ষিত নম্বরে....”
আলেয়ার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। বোরকাটা গায়ে চাপাতে চাপাতে মেয়েকে নিয়ে ছুটে বেরিয়ে গেল। তুরিন প্লাজা ভালই দূর। ওরা কীভাবে অকুস্থলে পৌঁছল তা নিজেরাও জানেন না। ঘোর দুর্যোগে মাথা কাজ করে না।
অগ্নিকবলিত ভবনটির সামনে অগণিত মানুষ- টিভি চ্যানেলের সাংবাদিক-ক্রু-ক্যামেরাম্যান, আটকে পড়াদের স্বজন, উৎসাহী জনতা... ইউটিউব চ্যানেলের ভ্লগাররাও সংখ্যায় নেহায়েত কম নয়। ফেসবুক লাইভ করছে কেউ কেউ। কে কার আগে আগুনের খবর টেলিকাস্ট করতে পারে তার জোর প্রতিযোগিতা যেন। নিউজ যত আগে হবে ভিউ লাইক কমেন্ট তত বেশি; ঘোর দুর্যোগ কারো কারো জন্যে রমরমা ব্যবসা
ফায়ার ফাইটাররা পূর্ণোদ্যমে কাজ করে চলেছে। আগুন কোনভাবেই নিয়ন্ত্রণে আসছে না। গত দুই ঘন্টায় হাফিজের নম্বরে অন্তত দু’শবার কল করা হয়েছে, প্রতিবারই মোবাইল বন্ধ। আলেয়া একটু পর পর ডুকরে কেঁদে উঠছে। মেয়ের কান্না থামছেই না। আজ ওদের কারণেই...
(২)
(ঘন্টা তিনেক আগে আজকের সন্ধ্যায়)
হাফিজুর রহমান অন্যান্য দিন সন্ধ্যা ছ’টা নাগাদ বাসায় ফেরেন। আজ সাতটা পেরিয়ে যাচ্ছে, তার বাসায় ফেরার নাম নেই। আলেয়া বেগম অবশ্য স্বামীর দেরি দেখে খুশিই হলেন। যাক, আজ তাহলে স্বামীর মনে আছে...! প্রতিদিনই আনব আনব করে সপ্তা পার করে ফেলল, ওনার মনেই থাকে না! আজ বাদে কাল ছোট বোনটার বিয়ে। আজও যদি ভুলে যায় তো লোকটার কপালে শনি আছে!
তুলিও বাবার জন্যে অধীর আগ্রহে অপেক্ষায়। কালকের পরীক্ষার পর বার্ষিক ছুটি, কাল যদি জিনিসটা স্কুলে নিয়ে যেতে না পারে তাহলে বান্ধবীদের কাছে প্রেস্টিজ পাংকচার...
আর শুভর সাপ্তাহিক আবদার- কেএফসির বার্গার!
মোটকথা, বাসার তিনটা প্রাণীই হাফিজের গৃহপ্রত্যাবর্তনের অপেক্ষায়। কলিংবেলের আওয়াজ কানে সুধা বর্ষন করলো সবার। কিন্তু একী, হাফিজের সাথে লাঞ্চব্যাগ ছাড়া আর কিছুই নেই!
লোকটা আজও ভুলে গেছে! স্ত্রী আগেই বলে দিয়েছিল, আজ যদি না আনে তো কথা বলা বন্ধ! স্বামীকে কৈফিয়তের সুযোগ না দিয়েই সে মুখ ঝামটা দিয়ে কিচেনে চলে গেল। মেয়েও রিডিং রুমে চলে গেল বাবার সাথে একটা কথাও না বলে। কিন্তু ছেলের কোনো ছাড়াছাড়ি নেই! বাবাকে সমানে বকতে লাগল, কেন সে ভুলে গেছে...
হাফিজের মনটাই খারাপ হয়ে গেল। এই সংসারে কেউ তাকে বোঝে না! সে ভাল আছে না মন্দ, কেউ একবার জিজ্ঞেস করার প্রয়োজনও মনে করল না। খালি আনো আনো আনো... মানুষটা না, বস্তুই ওদের কাছে মূখ্য।
একবুক অভিমান নিয়ে পোষাক না ছেড়েই সে বেরিয়ে পড়ল।
(৩)
প্রচণ্ড অনুশোচনায় মনটা ভরে আছে আলেয়ার। সন্ধ্যাবেলায় মানুষটাকে হাসিমুখ দেখালে এখন হয়ত তার জন্যে অশ্রু ঝরাতে হতো না।
ফোন পেয়ে তুলির মামা এসেছে। ভবন থেকে কাউকে বেরোতে দেখলেই ওরা ছুটে যাচ্ছে। কয়েকটা লাশ বের করা হয়েছে। এর মধ্যে তুলির বাবা নেই।
মানুষটা কি তবে বেঁচে আছে? এমনও তো হতে পারে, সে এদিকটায় আসেই নি! হয়ত বৌ-ছেলেমেয়ের সাথে অভিমান করে কোনো বন্ধুর বাসায় গিয়ে বসে আছে...
এটা উইশফুল থিংকিং কিনা আলেয়া জানে না। সে এটাও জানে না আসলে সে কিসের জন্যে অপেক্ষা করছে- স্বামী, না তার লাশ? আশা আর আশঙ্কার দ্বৈরথে সময় যেন থমকে আছে অনন্তকালের জন্য।
(৪)
চার্চে রাত বারোটার ঘন্টা বেজেছে খানিক আগে। আগুন নিভেছে। বুকে পোড়া চিহ্ন নিয়ে ক্লিষ্টভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে তুরিন প্লাজা, ছাই-জলে মাখামাখি এর ওপর-নিচ। মাঝেমধ্যে বাতাসে ভেসে আসছে আধপোড়া কাগজের টুকরো। পোড়া গন্ধে সয়লাব চারপাশ।
উদ্ধারকাজ শেষ। আলেয়ার অপেক্ষার অবসান ঘটেছে। তার মানুষটাকে পাওয়া গেছে। তাকে উদ্ধার করা হয়েছে নয়তলা ভবনের সপ্তম তলা থেকে। বেঁচে থাকার সংগ্রাম করতে করতে অত উঁচুতে উঠে পড়েছিল সে। তবে শেষরক্ষা হয় নি। তপ্ত কালো ধোঁয়া জেঁকে বসেছিল তার শ্বাসনালীতে। জীবনের শেষ মুহূর্তটায় টবে টবে সাজানো গাছগুলোর মধ্যে নাক ডুবিয়ে একটুখানি অক্সিজেনের খোঁজ করেছিল হয়ত...
আলেয়াকে তার স্বামীর নিথর দেহটার সাথে একটা স্কুলব্যাগ বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে। তাতে ডোরেমনের ছবি। নতুন ক্লাসে এমন একটা ব্যাগের বায়নাই তো অবুঝ ছেলেটা করেছিল...
ব্যাগ থেকে একে একে বেরুলো একটা জুয়েলারি বক্স, লেডিস হাতঘড়ির কেস... এই তুচ্ছ জিনিসগুলো নিয়েই তো মা-মেয়ের অত অভিমান!
অভিমান তো হাফিজের বুকেও ছিল। সারাদিনের ধকল শেষে ক্লান্ত শরীরে তাকে বেরিয়ে পড়তে হয়েছিল শুধু বৌ-বাচ্চার মান ভাঙাতে। তাদের আবদারের জিনিসগুলো নিয়ে সে ফিরতে চেয়েছিল সেই পরিবারের কাছেই। বিষাক্ত ধোঁয়ায় বুকটা যখন সঙ্কুচিত হয়ে পড়ছিল তখন আরো প্রবলভাবে ব্যাগটা বুকে চেপে ধরেছিল সে। ঝাপসা হয়ে আসা দৃশ্যপটে কি তখন ভেসে উঠেছিল ডোরেমন ব্যাগ হাতে পেয়ে ছেলের উচ্ছ্বল আনন্দে উদ্ভাসিত চেহারাটা? নিমীলিত চোখে কি দেখেছিল হাতঘড়িটা হাতে পড়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরা মেয়ের হাসিমুখ? অসাড় হয়ে আসা হাতটা কি কল্পনায় স্ত্রীকে পড়িয়ে দিতে চেয়েছিল সোনার নেকলেসটা? রূহ তার পুরনো নিবাস ছেড়ে অনন্ত আলোকের পানে যেতে যেতে কি পেছন ফিরে শেষবারের মতো দেখতে চেয়েছিল তার ফ্যামিলি এলবাম?
স্কুলব্যাগটা শিশুর মতো বুকে জড়িয়ে আলেয়া বেগম হাউমাউ করে কাঁদছে। অভিমানের জমাট বরফ গলে গেছে বহু আগেই। সেই বরফ গলা জল এখন অশ্রুপ্লাবন। আফসোস! তার এই বুকভাঙা কান্না ফেরাতে পারবে না মানুষটাকে, একবুক অভিমান নিয়ে যে দুনিয়া ছেড়ে গেছে...
অথচ এমনটাও তো হতে পারত...
ঘড়িতে সন্ধ্যা সাতটা। তিনটি প্রাণ অধীর আগ্রহে একজনের অপেক্ষায়। ডোরবেল বাজল। আলেয়া তড়িঘড়ি দরজার দিকে গেল। পেছন পেছন শুভও।
“আব্বু, আমার বার্গার আনো নাই?”
“ওহ হো, আমি তো একদম ভুলে গেছি...”
“তুমি খালি ভুলে যাও! তুমি একটা পচা, তোমার সাথে কথা বলব না...”
পিচ্চিটা অভিমানে গাল ফুলিয়ে ভেতরঘরে চলে গেল। এখনই বার্গার এনে না দিলে তার মান ভাঙবে না। হাফিজ লাঞ্চব্যাগটা স্ত্রীর হাতে দিয়ে দরজার দিকে যেতে উদ্যত হলো। পেছন থেকে আলেয়া ওর হাতটা চেপে ধরল। শান্তভাবে মাথা নেড়ে নিষেধ করল যেতে। বার্গার না আনুক, বাবা যে দিনশেষে বাসায় ফিরেছে, এটাই কি যথেষ্ট নয়?
***সব অভিমানকে পাত্তা দিতে নেই। সম্পর্ক অমলিন থাকুক পারস্পারিক বোঝাপড়ায়। বস্তু নয়, ব্যক্তি যখন মূখ্য হবে পারিবারিক বন্ধন তখন হবে মধুময়***
লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা
ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য
“এখন আসতে পারব না। কাজে আছি”
৩০ সেপ্টেম্বর - ২০২৩
গল্প/কবিতা:
২১ টি
সমন্বিত স্কোর
৫.৩৯
বিচারক স্কোরঃ ২.৫৭ / ৭.০
পাঠক স্কোরঃ ২.৮২ / ৩.০
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪