নটা খুব খারাপ। খারাপ বলতে বেশা বেশ রকম খারাপ। এই কয়েকদিন কোন কবিতা ধরা দেয়নি। গেল রাতে সারাক্ষণ ছাদে শুয়ে শুয়ে চাঁদ দেখেছি।পাশে রেখেছি খাতা কলম। মুখপোড়া চাঁদ সারারাত আলো দিল ঠিকই কিন্তু কোন শব্দ ধরা দিল না। লাভের মধ্যে লাভ হল সর্দি। এখন হ্যাচ্ছো, হাচ্চু, খ্যাক খ্যাক, নানান বিচিত্র শব্দ করে কফ ফেলা। কপালটাই খারাপ।
সন্ধ্যার পরপরই হাটতে হাটতে পাড়ার শহীদমিনারের পাশের চায়ের দোকানটায় গেলাম। দেখি হামিদ আগে থেকেই বসে আছে। সাথে আছে চাচা। হামিদ গোট্টাগাট্টা শরীর। সবকারীদলের রাজনীতি করে। সব সময় হাসিখুসি। আর চাচা, যার চরিত্র সব সময় রহস্যময় এবং দুনিয়ার তামাম জিনিস যে সন্দেহের চোখে দেখেন। তার আবার একটা পা খোড়া। কেউ বলে যুদ্ধে গিয়ে পায়ে গুলি খেয়েছেন। কেউ বলে তিনি ছিলেন জাদরেল টাইপের ডাকাত। তিনি নিজে এ ব্যপারে তেমন একটা মুখ খুলেন না। আমরাও তাকে এ ব্যপারে ঘাটাই না।
গিয়ে হামিদের পাশে বসলাম। পকেট থেকে সিগার বের করলাম। একরাশ ধোয়া ছাড়লাম। কয়েকহাত লম্বা দীর্ঘনিশ্বাস ফেললাম। তারপর হামিদ কে বললাম, “তো খবর কি?”। “খবর আর কি। মাথার ওপর ব্রীজ ভেঙ্গে পড়ছে। কোন শালার কোন মাথা ব্যাথা নাই। সব শালা খাটাশ” হামিদ চিবিয়ে চিবিয়ে উত্তর দিল। আমি একটু আবাক হলাম। “কোন ব্রিজ”। ক্যান বদ্দারহাটে ফ্লাইওভার ভাঙ্গছে খবর পাস নাই। এবারও আবাক হই। কি বদ্দারহাট ফ্লাইওভার। আহা লোকগুলো হয়তো বাজার করে বাসায় ফিরছিলো। কেউ হ্য়তো আড্ডাদিচ্ছিল। এরই মধ্যে মাথার বড় বড় পাথরখন্ড। আহা। কেউ হয়তো পাথরের নিচে বেচেছিল অনেকক্ষন। হাত পা সব থেতলে গেছে। এরই মধ্যে কোন প্রিয় মুখ ভাসছে। বুকটা হাহাকারে ভরে উঠল। আবার কবিতার শব্দগুলো আসব আসব বলে আবার উড়াল দিল।
এর মধ্যে রহিম এসে মিউ মিউ করে বলল, বদ্দারহাট ট্রেজেডি শুনেছিস। আমি হুংকার করে বললাম, “খবরদার ভেতো বাংগালী, (রহিমের থলথলে শরীর আর মিউ মিউ শব্দ করে কথার কারনে তার টাইটেল ভেতো বাংগালী। কোন কিছুতেই তার ধারণা নেই। কোন কিছুতেই তার যেন সমস্যা নেই) আজ নো মিউমিউ, আজ প্রতিবাদের দিন। আজ আমরা প্রতিবাদ করব। মিছিল করব। দোষ কাদের ছিল খুজে বের করব। আজ আমরা থামব না———— “তো , তুমি কি করবা”? চাচার হঠ্যাৎ টর্পেটো নিক্ষেপ। আমি আবেগ সামলা লাম। কাপা কাপা স্বরে, গলাটাকে যতটুকু আবেগময় করা যায়, ততটুকু করে বললাম আমরা কবিতা লেখে প্রতিবাদ জানাব। আমরা এভাবে এটা মেনে নিতে পারি না। “তাহলে সরকার বিরোধী আন্দোলনে নামতাছস” (এই প্রতিবাদী গলাটা বলে দেয় এটা আবুর গলা, যে বর্তমানে বিরোধীদলের দলে পড়েছে। বেচারাকে আজকাল দেখা যায় না (পাড়ার মধ্যে কিছু হলেই, বিরোধীদলের দোষ ষড়যন্ত্র হিসাবে চিহ্নিত করে মিছিল মিটিং করা হয়। তাই বিরোধীদলের সবাই আত্বগোপন থাকতে পছন্দ করে)। এগুলা সরকারী দলের কাজ, ব্রাজিলের মত খেলতাছে, দূর্নীতি মিশনে নামনে ফাইনাল না খেইলা মনে হয় নামব না। (এখানে আরও একটু যোগ করা দরকার আবু ব্রাজিলেরও সাপোর্টার।)। আমাগো দরকার একটা জোড় আন্দোলন, কি কস হামিদ? হামিদ একটু উদাস উদাস ভাবে তাকায়। মনে হয় এ বিষয়ে সে কোন মন্তব্য না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। চাচা খ্যাক করে হেসে বিড়ির ধোয়া ছাড়ল। তো আবু তোর দল কি এই বিষয়ে বক্তব্য দিসে না এগুলা তোগর কাছে মামুলি ব্যাপার। আবু বুক ভরে শ্বাস নিয়ে বলে “কাল আমরা প্রতিকী অনশন করুম। চাচা আর হামিদ দুজনই ঠ্যা ঠ্যা করে হেসে উঠল। কোকাকোলা খাইয়া প্রতিকী অনশন, খ্যাক খ্যাক।
আমি মূলত এসব কথায় কান দিচ্ছি না। আবেগে আমার মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। কবিতা প্রা্য়ই এসেই যাচ্ছে কিন্তু আবার আসছে না।কবিতার কাছাকাছি প্রসব আশংকায় আমি পুলকিত, শিহরীত এবং নিপীরিত। এ নিয়ে একটা কবিতার আসর করলে কেমন হয়। গন্যমান্য কবিরা আসবেন, কবিতা পড়বেন। বিষয় হবে একটা ব্রিজ।
চাচা হাই তুলে বললেন ও হামিদ তুমি কি কউ। হামিদও হাই তুলে বলল- অপরাধীর কোন পরিচয় নেই তারা কোন দলের না। আমাদের এটার ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। আর আমি আপনি মিলেই তো দেশের জনগন। এখানে দল টানাটানির কোন দরকার কি। আমরা আমরাই এটার প্রতিবাদ জানাব, কি বলিস রহিম? রহিম আবার মিউমিউ করে বলল, “ঠিক আছে কাল আমরা পাচ জন বদ্দারহাট গিয়ে অনশন করব। আমি হামিদ, আবু সবাই আতকে উঠলাম। আবু বলতে লাগল, দূর আজকাল অনশন টনশন দিয়ে কিছু হয় না। হামিদও দেথলাম তেমন একটা উৎসাহ নেই। চাচা ফিচেল হাসি দিয়ে বলল, কি ভয় পাও?যাও বাসায় গিয়া দুধ খাও”।
আসলে বর্তমানে সমাজে ভদ্রতা জিনিসটার খুবই অভাব। কবিদের জন্য কেউ কি একটু শালীন শব্দ ব্যবহার করতে পারে না। আমি এ ধরণের অপমান সহ্য করতে পারি না। আমি গর্জে উঠলাম “সবাই কাল রেডি থাকবা, রাত আটটায় আমরা অনশণ করতে যাচ্ছি। বলা শেষ হওয়া মাত্রই চাচার খ্যাক খ্যাক হাসিটা শুরু হল। আবু উদাস হয়ে আকাশের তারা দেখতে লাগল। হামিদ হাই তোলা শুরু করল। রহিমটা কেমন ফ্যাল ফ্যাল চোখে এপাশ ওপাশ তাকাচ্ছে। ঠিক এই সময় একটা শব্দ ধরা দিবে দিবে শুরু করছে। আমি হনহন করে বাসার দিকে হাটা দিলাম।
খুব সকালে ঘুম থেকে উঠলাম। আজ বিশেষ দিন। আজ প্রতিবাদের দিন। ওয়েল বিগেনিং ইস হাফ ডান। হামিদকে কল দিলাম। সে এখনো ঘুমাচ্ছে। আবুকে কল দিলাম। সেও ঘুমাচ্ছে। আরে গাধা অনশনে গেলেতো ঘুমানো ছাড়া আর কোন কাজ নেই। এখন ঘুমিয়ে কোন লাভ আছে। আজ একটু ব্যায়াম টেয়াম করলাম। আচ্ছা কবিদের কি ব্যায়াম করার অনুমোদন আছে। শরীরের প্রতি কোন যত্ন নেওয়া তো নিয়ম বিরুদ্ধ। যাওক। অনশনে যাওয়ার প্রথম কাজ হচ্ছে খাওয়া-পেট ভরা থাকলে অনশন সফল হওয়ার একটা সুযোগ আছে। বুয়াকে তাড়াতাড়ি নাস্তা বানাতে বললাম।
এখন সকাল দশটা বাজে। আবুকে কল দিলাম। দেখলাম বহুত গরম। কেউ যাক আর না যাক আবু যাবেই যাবে। মারহাবা এরকম ছেলেই তো দেশের দরকার। কথায় না বড় হয়ে কাজে বড়। সে বার বার বলতে লাগল এরকম ইস্যুতে অনশনে যাওয়া দায়িত্ব (সত্যি কথা বলতে কি আমি ভাবতাম বিরোধীদলরা শুধু তাদের স্বার্থে টান পড়লে পাচ দশ মিনিট প্রতিকী অনশন করে।) আবুর চিন্তাধারা অন্যরকম দেখে গর্ব হতে লাগল। হামিদ দেখি তার চেয়ে আধা সেলসিয়াস বেশি গরম। সে এর মধ্যে ব্যপারটা নিয়ে একটা তদন্ত করে ফেলেছে। এবং এর সাথে কে কে জড়িত সে বের করে ফেলেছে (তবে দোষীরা সবাই বিরোধীদল হওয়ায় আমার মনে কিঞ্চিত সন্দেহ) চাচার কোন খবর নেই। রহিমের মোবাইল নাই তাই আর কল দেওয়া হল না। শেষ পযর্ন্ত দেখব রহিম ভয়ে হিসু বেশি করার কারণে পানিশূণ্যতায় ভুগছে। যেতে পারবে না।
দুপুর বেলা একটু দেরি করে খেতে গেলাম। যত দেরীতে খাব তত বেশিক্ষণ পেট ভর্তি থাকবে। গরু, মুরগী, ডিম, দুধ সব আজকের মেনুতে রেখেছি। মেনু দেখে তো মা জিজ্ঞেস করেছিল, যুদ্ধ যাব কিনা? ব্যপারটা চেপে গেছি। তারপর গলা অবধি ভর্তি করে খেলাম। ঠেসে যা ঢুকানো যায়। পরে যখন আর খেতে পারছিলাম না তখন বাদ দিলাম। যুদ্ধে রসদ সরবরাহ খুবই গুরুত্বপূর্ন তা কে না জানে।
সন্ধ্যা থেকেই ব্যপারটা খুব একটা সুবিধার বলে মনে হল না। আসলে সারাদিন মনের উপর প্রচন্ড চাপ আসায় শরীরটা খুব একটা ভালও লাগছে না। আর মনের মধ্যে কিছুটা বাস্তবতা ধরা দিতে লাগল। ব্যপারটাতো এত সহজ না। আমরা যাব আর আমাদের আপ্যায়ন করবে তাতো না। পুলিস যদি আশে পাশে থাকে, লাঠির আঘাত তো ফ্রি। আর যদি তার উপর অন্য কোন বাহিনী কিছু থাকে তো কোর্টমার্শল। সোজা ফাসি। পুরো শরীরটা কেমন যেন গুলিয়ে উঠল। চিন্তা করতেই তো ভয় ভয় লাগছে। ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা পানি বের করলাম। ঢক ঢক করে খেয়ে ফেললাম। কপালে হাত দিয়ে দেখলাম ঘামছি। আবার পানি খেলাম। আচ্ছা এমন যদি হয়, কেউ পাত্তাই দিচ্ছে না। সবাই হাসা হাসি করছে। আমার চার জন (ভেতো বাঙালী রহিম আসে নাই তা আমি আগেই কল্পনা করে রাখছি) চুপচাপ বসে আছি। ক্ষুদা তৃষ্ণায় প্রাণ যায় যায় অবস্থা। আর অনেকজন আমাদের গোল বৃত্তাকার করে দেখছে। কয়েকজন হয়ত বাজিও ধরবে কোনটা আগে মারা যাবে। বিরাট মজার অনুষ্ঠান। কেউ বলবেও না, থাক আর দরকার নেই। এখন এতগুলো লোকের সামনে থেকে যে, চুপচাপ সরে আসব তাও তো হবে না। আর যদি পালাতে পারিও বাসায় কিভাবে মুখ দেখাব। বুকটা ধক ধক করে উঠল। ব্যাটা রহিমের যে এটা সুক্ষ ষড়যন্ত্র তা একটু একটু পরিষ্কার হতে লাগল। সে নিজে তো যাবে না– আমাদের জান নিয়ে ছিনিমিনি খেলার চেষ্টা। আমার আই কিউ বেশি হওয়ার কারণেই না আমি ব্যপারটা ধরতে পারছি। “হে স্বার্থপর, তোমার নিষ্ঠুর খেলায় আজ আমার জীবন মর মর,” (কবিতার লাইনও দেখি আসছে)। ঢক ঢক করে আরও এক গ্লাস পানি খেলাম। হঠ্যাৎ করে পৃথিবীটা কেমন যেন দুলে উঠল। তারপর সব অন্ধকার।
কানটা ঝিমঝিম করছে। মাথাটা কেমন ভার ভার। গলাটাও শুকনো কাঠ। আস্তে আস্তে চোখ খুললাম। দেখলাম মা পাশে শোয়া। অনেকগুলো ভোতা আওয়াজের শব্দ কানে আসছে। কি হয়েছে কেন হল এধরণের শব্দ। সকাল হয়ে গিয়েছে। আবার চোখ বন্ধ করলাম। সবাই কেমন যেন হাফ ছাড়ল মনে হচ্ছে। হঠ্যাৎ অনশনের কথা মনে উঠতেই অস্পষ্ট শব্দে বোধহয় অনশন শব্দটা মুখ থেকে বের হয়ে গেল।। বাবা বলে উঠল- কি? অনশন? কার? রহিমের? আমি পিট পিট করে চোখ খুললাম। আহা কাল রাতে রহিম আর বুড়া মত কে একটা যেন বদ্দারহাটে গিয়ে অনশন করতে গিয়েছে (বাবা সকালের বুলেটিন প্রায় মুখস্ত করেন) আর পুলিস এসে তাদের ধরে নিয়েছে। এই দেখ পত্রিকায় ছবি। আমি চোখ বড় বড় করে তাকালাম, দেখলাম চাচা তার ফোকলা দাতে হাসি দিচ্ছে, পুলিস টেনে গাড়িতে তুলছে, আর পাশে রহিমের উজ্জল মুখ, হাতে “ভি” চিহ্ন, তাকে ধাক্কা দিচ্ছে পুলিস। আবু হামিদ এরা কেউ নেই। মনে মনে সাবাস বাঙ্গালী বলে আবার চোখ বন্ধ করলাম।
১৭ ফেব্রুয়ারী - ২০১১
গল্প/কবিতা:
৬ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪