আমার শিশুরা

শিশু (সেপ্টেম্বর ২০১৯)

জুবায়ের আল মাহমুদ
  • ৫১
এক
বছর চারেক পূর্বে যখন আমার ছোট আপার একমাত্র কন্যাসন্তানটি জন্মগ্রহণ করিলো, তখন বাড়িময় সকলেরই কাঁন্নার রোল পড়িয়া গেল। আসলে আপনার কাঁন্নায় আমাদের একমাত্র হাসির খোরাক আর আপনাকে নিশ্চুপ থাকিতে দেখিলে আপনার আপনজনও কান্নায় ভাঙিয়া পড়িবে এই শিক্ষা আপনি জন্মানোর সময়ই পাইয়া থাকিবেন এবং তাহা জনমভর সত্য বলিয়া জানিবেন। অর্থ্যাৎ কন্যাটি জন্মিলো কিন্তু কাঁদিলো না। তবে প্রাণবায়ু তখনও রহিয়াছিল এবং ডাক্তারবাবুও তাহাকে বাঁচাইবার যথেষ্ট সম্ভাবনাও দেখিয়াছিলেন। ফলস্বরূপ রাজশাহী মেডিকেলে দীর্ঘ আঠারো দিন থাকিবার পর যখন বাড়িতে আসিলো তখন অবধি সে কন্যাটি নিজে না কাঁদিলেও অন্তত আমাদের আর কাঁন্না করিবার মতো ভয়ে রাখিল না। বলিয়া থাকি, সেই আঠারো দিনের প্রত্যেকটি দিন আমি বেলা গড়াইলে প্র্যাকটিসে যাইতাম আর সন্ধ্যা নামিলে দুরুদুরু বুক লইয়া সাইকেলে চাপিয়া বাড়ি ফিরিবার সময় কতই না ভয়ে থাকিতাম। ভাবিতাম আজকেই বোধহয় দুঃসংবাদটা শুনিবো।
যাহাই হোক, সেই যাত্রায় তাহার প্রাণটা বাঁচিলেও আর বাকি দশ জনের মতো সে যে স্বাভাবিক জীবন পাইবে না সে ধারনা সকলেই মানিয়া লইয়াছিল। পরবর্তীতে যদিও তাহা ভুল প্রমাণিত হইয়াছে এবং সারাক্ষণ রনি মামা-মনি মামা বলিয়া ক্ষ্যাপাইয়া কন্যাটি সবার চাইতে বেশি বুদ্ধির পরিচয় দিয়াছে তাহা বলাই বাহুল্য।
সবাই চাইতে বলিতে বুঝাইলাম আমাদের এই ম-ল বংশে শুধু সেই কন্যাটি ছাড়াও আরো সাত জন নাতি-নাতনি রহিয়াছে এবং সকলেই সেই নিশ্চুপ-বাঁচাল কন্যাশিশুটির চাইতে বয়সে বড়।
সেই তাহাদের গল্পই আজ আমি আপনাদের নিকট পাড়িব। তাহার পূর্বে নিজের পরিচয়টা একবার বলিয়া যাই।
আমার এই বাইশ বৎসরের জীবনকে ভাগ করিলে বৃহত্তম অংশে দুইটি ভাগে ভাগ করা যায়। যেহেতু আজকে আমি নিজের গল্প বলিব না তাই আর সেদিকে না যাই। নিজেকে বর্ণনা দিতে গিয়ে সহজ ভাষায় কেবল অপরাজিতা গল্পের অনুপমের কথাই বারংবার মনে পড়িয়া যায়। তাঁহার মতোই বলিতে ইচ্ছে করে- এ জীবনটা না দৈর্ঘ্যরে হিসাবে বড়, না গুণের হিসাবে। পার্থক্য এই যে অনুপমের পুরোপুরি না হইলেও আধখানা কল্যাণী জুটিয়াছিল; আর আমার রসের হাঁড়ি আজও উন্মুখ হইয়া রহিয়াছে। যদিও আমি সন্দিহান যে সেটা আদৌ রসের হাঁড়ি কিনা বা রস যদিও কিছু থাকে তবে তাহা যৎসামান্যই। ব্যাপারখানি এমন নয় যে আমি মেয়েলিপনা করিতেছি। প্রায় ছ‘ফিট লম্বা; প্রশস্ত বুক; চওড়া কাঁধ এমনকি তামিলদের মতো জাঁদরেলি গোফও রহিয়াছে। তাহার পরেও এখনও আমার অন্তরপুরীতে প্রেমরস বলিয়া কোন বস্তুরই সন্ধান পায় নাই। তাইতে আজও কোন সুন্দরীর এলোকেশ আর বাঁকা চক্ষু আমার হৃদয়ে শীতল সমীরণের সুবাস দিতে পারিলো না। কেন পারিলো না? তাহা আর কি করিয়া বলি!
তবে বক্তব্য শুনিয়া আপনারা যদি ভাবিয়া থাকেন যে, ইহাতে আমার বড্ড আফসোস হয় তবে জানিয়া রাখিবেন আমি আপনাদের বাকি দশজনের মতো নহে। আমার আফসোসের ক্ষেত্র-ভালোবাসার মাঠ আপনাদের মতো সরল নহে। অবশ্য সেটা সরল হইতেও সরলতম। তবে আফসোস আমার ঠিকই হয়। কেন হয়? সে কাহিনী বলিতে গেলে আজ আর কুল পাইবো না।
আসল কথায় ফিরিয়া আসি। আগেই বলিয়াছি আমার ভালোবাসার মাঠ আপনাদের মতো নহে। সেই যখন ক্লাস ফোরে পড়িতেছিলাম; তখনই আমার বড় আপার প্রথম কন্যাটি জন্মিলো আর আমিও যেন আমার ভালোবাসার মাঠে ভালোবাসার গাছটি লাগাইলাম। সেটা যে শিশুকালের অবচেতন মনেই হইয়া গেল তাহা আর আগ বাড়াইয়া না বলিলেও চলে। আর তাহার প্রভাব যে এত প্রকট হইয়াছে যে আজ অবধি তাহাই আমি সত্য বলিয়া জানিয়া আসিয়াছি এবং মানিয়াও লইয়াছি। আজ সেই গাছে আট আটটি ফুল ফুটিয়াছে আর তাহাদের পরিচর্যা করিতেই আমার ঘাম ছুটিয়া যাইতেছে।
বড় আপার মেয়েটি এবার সপ্তম শ্রেণিতে পড়িতেছে। তবে কি করিয়া যে তাহার নাম পুঁটি হইয়া গেল তাহা আমার আজও অজানা। মজার ব্যাপার হইলো, আজও আমি তাহাকে পুঁটি বলিয়া ক্ষ্যাপাইয়া যাই আর সেও বটি লইয়া আমার দিকে ছুটিয়া আসে। কপট রাগ দেখাইলেও সেও এতে যথেষ্ট বিনোদন পায়। সংসারী হইয়াছে বটে। ইদানিং কেমন যেন সর্ম্পকে টান পড়িতেছে। আসলে বড় হইয়া উঠিতেছে তো। তাই এই মজার বিষয়গুলো আর বয়সের সঙ্গে মানাইতেছে না।
মেজ আপার ছেলেটা একটু মোটাসোটা আর গোলগাল বলিয়া তাহাকে ক্ষ্যাপাইবার যোগাড়ের অভাব নাই। বিছানায় দুইটা বালিশ থাকিলে সবাইকে তাহার পেছনদিকে ইঙ্গিত করিয়া জিজ্ঞাসা করি, “বলতো এখানে বালিশ কয়টা?” ব্যাপারখানি বুঝিতে পারিয়া সবাই খিল খিল করিয়া হাসিতে হাসিতে সমস্বরে জোর গলায় বলিয়া ওঠে- “চারটে।” সঙ্গে সঙ্গে তাহার আধামণ ওজনের ঘুষি আমার পিঠের উপর পড়িতে থাকে আর আমি হাসিতে হাসিতে বলিয়া যায়- “এ মামা মরে গেলে আর পাবি নে। লোকে যে কিছুদিন পর তোকে গোলবালিশ বলবে তখন কি হবে শুনি?”
বড় ভাইয়ের মেয়েটি এবারই স্কুলে যাওয়া আরম্ভ করিয়াছে। এখনই সে আমার শরৎ রচনা হইতে এক দু‘লাইন নিজের হোমওয়ার্কের খাতায় লিখতে শুরু করিয়াছে। আমি হাসিয়া তাহার পিঠের উপরে আস্তে করিয়া চড় মারিতে লাগি। সেও হাসিয়া বলিয়া যায়, “আমারতো লাকচেই না।” আমিও মারিতেই থাকি সেও বলিতে থাকে- “আমারতো কিচ্চু লাকচে না, একদমই লাকচে না, ইটটুও লাকচে না।” শেষে হার মানিয়া নত স্বীকার করিয়া বলি, “তোকে মারতে মারতে আর হাত লাল হইয়া গেল।” শুনিয়া সে খিলখিল করিয়া হাসিয়া ওঠে। সে হাসির অর্থ বোধকরি আমিও জানি না।
বড় আপার বড় ছেলেটি হইয়াছে খেলা পাগল। ওর যখন চার বৎসর বয়স; তখন একবার তাহাকে ফিল্ডিং করিবার কথা বলায় সে বল্ডিং করিবার আবদার করিয়াছিল। সেই থেকে শুরু। আজ দশ বৎসরে পড়িয়াও সে আর কখনোই বোলিং করিতে চায় না। তাহার অবশ্য আবদারের শেষ নাই। মামা ব্যাট আনি দাও; মামা বলে টেপ লাগা দাও; মামা সুতা পেচা দাও; মামা খেলতে আসো ইত্যাদি ইত্যাদি। আমিও মজা করিয়া বলি- “তাহলে তুই বল্ডিং কর।’’ শুনিয়া সে রাগিয়া বল দিয়া আমার গায়ে আঘাত করিতে থাকে আর আমিও সকলের সহিত হাসিতে থাকি।
তো এমনি করিয়াই বাচ্চাদের সহিত আমার খুনসুটি চলিতে থাকে। গল্পের আসরে কেহ একটা কিছু না পারিলে বা না বুঝিলে বাকিগুলো ভেংচি দিয়া শ্লোক কাটিয়া বলে,
“বোঝে না কিছু; আপেলকে কয় লিচু”
শ্লোকটা যে আমার তৈরি সে আর বলতে! বাচ্চাগুলোও বড় হইতে থাকে। মজার গল্পগুলোও যেন আস্তে আস্তে মজা হারাইতে থাকে। তবে যে এত দ্রুত হারাইবে; তাহা বোধকরি কল্পনাতেও কখনো ভাবি নাই।

দুই
গত তিন দিন ধরিয়া হাসপাতালের বেডে অর্ধমৃত অবস্থায় পড়িয়া রহিয়াছি। অবস্থা পূর্বেই তুলনায় একটু বেশিই প্রকট হইয়া গিয়াছিল। প্রায় মাস পাঁচেক পূর্বেই আমার ক্যান্সার ধরা পড়িয়াছে আর ডাক্তারবাবুও প্রায় নিশ্চিতভাবেই বলিয়া দিয়াছেন যে আর খুব বেশি দিন হয়ত অক্সিজেনের অপচয় করিতে হইবে না। গত দু‘দিন অচেতন থাকিবার পর আজকে একটু মুখ তুলিতে পারিতেছি আরকি।
শ্রাবণী ফোন দিয়াছিল। তাহাকে হাসাইবার জন্য আস্তে করিয়া বলিলাম, “পুঁটি! এ পুঁটি।” ও পাশ হইতে কোন আওয়াজই পাইলাম না। যেন অদৃশ্য মনচক্ষু সজাগ হইয়া দেখিলাম যে, সে হাসিলো না বরঞ্চ তাহার চোখ দুটি ছলছল করিয়া উঠিল। হয়তো কোন দিন খাবার আসনে পুঁটি মাছ দেখিলে ভাবিবে, তাহার একটা পাগল মামা আছিল।
হয়তো খাবার সময় জালাতন করায় বড় ভাবী তনিমার পিঠের উপরে দুটো চড় থাপ্পড় মারিলে সেও প্রতি উত্তরে বলিয়া উঠিবে, “আমার ইটটুও লাকচে না।” হয়তো তখন তার ছোট চাচ্চুর কথা মনে পড়িতে পারে। আবার নাও পারে।
হয়তো আর একটু বয়স বাড়িলে তামিম নিজের স্বাস্থ্যের যত্ন লইতে শিখিবে। তখন হয়তো আয়নায় নিজেকে দেখিয়া অস্ফুটে বলিয়া উঠিবে, “গোলবালিশ।”
বাধন হয়তো আর কোন দিনই বোলিং করিতে শিখিবে না। তাহার মামার কারণে।
অতঃপর আমি যাইতেছি। এই দুনিয়ার বেহেশত ছাড়িয়া আমার আসল বেহেশতে- কিছু বুঝিবার আগেই যাইতেছি। মনে হইলো যেন কানের নিকট ফিস ফিস করিয়া কেহ বলিয়া যাইতেছে- “বোঝে না কিছু; আপেলকে কয় লিচু।”
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
নাজমুল হুসাইন অনেকটা রবিন্দ্রনাথের গল্পের মত মনে হল।বেশ ভালো লিখেছেন,তবে সাধু ভাষার চেয়ে চলিত ভাষাই আমার কাছে বেশি ভালো লাগে প্রিয় লেখক।
ভালো লাগেনি ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৯
অনুপ্রেরণা পেলাম। পছন্দ জিনিসটাই এমন। সাধু ভাষা আমাকে প্রচণ্ড রকম টানে।
ভালো লাগেনি ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০১৯
রঙ পেন্সিল ভাল লেগেছে,বিশেষ করে গুরুচাণ্ডালীর ভয় না করেই যে সাধু ভাষায় লিখেছেন সেজন্য। শুভকামনা।
Ahad Adnan অন্যরকম স্বাদ, খুব ভালো লেগেছে। ভালোলাগা এবং শুভকামনা রইল।
ভালো লাগেনি ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৯
ধন্যবাদ ভাইয়া
ভালো লাগেনি ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৯
কাজী প্রিয়াংকা সিলমী পড়তে পড়তে নিজের প্রিয় মামা-চাচাদের কথা মনে পড়ে গেল। শেষ কবে সমসাময়িক লেখা সাধু ভাষায় পড়েছি মনে পড়ে না। চলিত ভাষার বদলে সাধু ভাষায় লেখার সিদ্ধান্ত নেবার কারণ জানতে পারি কি?
ভালো লাগেনি ২ সেপ্টেম্বর, ২০১৯
ধন্যবাদ আপু। আসলে আমি নিজেও জানি না। তবে বাকি লেখকদের তুলনায় শরৎচন্দ্র আর রবীন্দ্রনাথই আমাকে বেশি টানে।
ভালো লাগেনি ৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৯

লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য

গল্পে একজন তরুণের সাথে তার ভাই-বোনের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে করা মজার কিছু স্মৃতি তুলে ধরা হয়েছে। বাচ্চাদের সাথে একজন তরুণের খুনসুটি আলোচনা করা হয়েছে। এবং একটু কিন্তু.......

০৪ আগষ্ট - ২০১৯ গল্প/কবিতা: ১ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "ছোটবেলা”
কবিতার বিষয় "ছোটবেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪