কুয়াশার দেয়াল

শীত (জানুয়ারী ২০২০)

মোঃ আব্দুল মুক্তাদির
  • ৬৩
শুভ বললো, 'মা আমি তবে এখন যাচ্ছি।'
মা বললেন, 'যা, সাবধানে যাবি আর পৌঁছে কল দিবি।'
শুভ বললো, 'অবশ্যই মা...'

শুভ অনেকদিন পরে তার ছোট মামার বাড়িতে বেড়াতে যাচ্ছে। সেই ক্লাস এইটে থাকতে শেষবার গিয়েছিল। এখন সে অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছে। মাঝের সময়টাতে আর যাওয়া হয়নি। সেবার মামার বাড়িতে খুব মজা করেছিল শুভ আর তার মামাতো ভাইবোনরা। বাসে বসে এসব কথা ভাবতে লাগলো শুভ। দীর্ঘ নয় ঘণ্টা জার্নি করার পর শুভ তার মামার বাড়ি ঠাকুরগাঁও পৌঁছে গেল। মামা মামী শুভকে দেখে খুশী হলেন। মামা বললেন---
-'তোর মা কেমন আছে রে শুভ?'
-'মা ভালো আছে মামা।'
-'খুব ভালো। তোর পড়াশোনার খবর কি?'
-'ভালোই চলছে মামা।'
-'রেজাল্ট হলেই বুঝবোনি...'
-'ঠিক বলেছেন।'

বিকেল হয়ে গেছে। সারাদিনের চঞ্চলতা কমতে শুরু করেছে। শীতের বিকেল কেমন যেন বিষণ্ণ লাগে শুভর কাছে। রোদটা হলদেটে লাগছে, লোকজনের আচরণে নির্জীব নির্জীব ভাব। গাছের পাতাগুলো অপরিষ্কার হয়ে আছে।
শুভ মামীর দেয়া জলখাবার শেষ করে উঠানে এসে বসলো। সাদা মাটির ধবধবে উঠান। মৌসুমের কাটা ধান রাখার জন্য সেটাকে লেপে আরও মসৃণ করা হয়েছে। মামা বাজারে গেছেন। শুভর মামাতো ভাই ইরফান, আর মামাতো বোন ইফতি এখনো স্কুল থেকে ফেরেনি। অগত্যা মামীর সাথেই গল্প শুরু করলো শুভ। মামীকে বললো-----
-'মামী, ইরফানরা এখনো ফিরলো না কেন?, সন্ধ্যে হয়ে যাচ্ছে...'
-'ওদের পরীক্ষা চলছে। এখন প্রাইভেট এ আছে। প্রাইভেট পড়ে বাড়ি ফিরবে।'
-'তাইতো বলি, এতক্ষণ আবার কিসের স্কুল চলছে?...ওদের পরীক্ষা আর কয়টা আছে?'
-'কালকে শেষ।'
-'আমি কিন্তু এবার ওদের আমাদের বাড়িতে নিয়ে যাব। তুমি, মামা তো আর যাবেনা...'
-'হাহাহা...আমরা সময় পাইনা রে...'
-'ঠিক আছে ইরফান, ইফতি এবার যাবে...'
-'ঠিক আছে। তোমার মামাকে বলি...'

মামী রাতের রান্নার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। শীতের দিন বিকেল আর সন্ধ্যের মধ্যে তফাৎ করা যায়না। আলো থাকতে থাকতে ঝুপ করে অন্ধকার হয়ে গেল। গায়ের সাথে মশা ধাক্কা খেতে লাগলো। শুভ ঘরের ভিতর চলে এলো। ঘরটা খুব নিস্তব্দ। শুভ লাইট জ্বালিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো। তাকে যেই ঘরে থাকতে দেয়া হয়েছে সেটা বাড়ির শেষের ঘর। রাস্তা দিয়ে আগত লোকদের মৃদু কথা শোনা যাচ্ছে। শুভ মোবাইল টিপতে লাগলো।
একটু পরে ইফতির গলা শুনতে পেল শুভ। ইফতি শুভর ঘরে ঢুকে বললো---
-'কেমন আছেন শুভ ভাইয়া? আপনাকে অনেক দিন পরে দেখলাম।'
-'আমি ভালো আছি ইফতি, আমাকে অনেক দিন পরে তো দেখবেই। আমাদের বাড়িতে একবারও তো যাওনা তুমি...'
-'বাবা না নিয়ে গেলে কিভাবে যাব? আপনাদের বাড়ি তো অনেক দূর...'
-'তোমার পরীক্ষা কেমন চলছে?'
-'ভালো'
-'আর কয়টা পরীক্ষা আছে?'
-'কালকে হলেই শেষ।'
-'ইরফান এখনো আসেনি নাকি?'
-'এইতো ভাইয়া এখনই চলে আসবে।'
-'ঠিক আছে তুমি যাও, গতকালের পরীক্ষার প্রস্তুতি নাও...'

রাতের বেলা খাবার সময় একসাথে সবাইকে পেল শুভ। খাবার সময় তেমন কথা হলনা। শুভ শুনেছে তার স্কুলশিক্ষক মামা খাবার সময় কথা বলা পছন্দ করেননা। খাবার শেষ হলে ইরফান আর ইফতি চলে গেল। মামা-মামী শুভর ঘরে এসে বসলেন। কিছুক্ষণ পারিবারিক খোশগল্প চললো। মামা-মামী শুতে গেলেন। শুভ একটা বই নিয়ে শুয়ে পড়লো। কিছুক্ষণ পড়ার পরে আর ভালো লাগলো না। সে ডায়েরী লিখতে বসলো। প্রায় আধ ঘণ্টা লেখার পরে তার হাই উঠতে লাগলো। সে লাইট অফ করে লেপমুড়ি দিয়ে চোখ বন্ধ করলো।
রাতে একবার ঘুম ভেঙে গেলো। ঘড়িতে সময় দেখলো ১-৩০ বাজে। অনেক শীত পড়েছে বাহিরে শুভ বুঝতে পারলো। মাটিতে,গাছের পাতায় দুই এক ফোটা পানি পড়ার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। লেপের বাহিরের পিঠ ঠাণ্ডায় ভেজা ভেজা লাগছে।
শুভর ঘুম আসছেনা। ইদানীং এই একটা বদভ্যাস হয়েছে। এত শীত বাহিরে, অথচ মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে আর ঘুম আসতে চায়না। সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে জেগে জেগে দুই ঘণ্টা কেটে গেল। অবশেষে ঘুম এসে গেল শুভর।


সকাল ৬-৩০ বাজে। শুভ ঘুম থেকে উঠেছে। বাহিরে সাদা সাদা কুয়াশাভাব ধরে আছে। হাত পা জমে আসছে শুভর। সে কোনমতে হাতমুখ ধুয়ে এল। কান আর নাক ভীষণ ঠাণ্ডা হয়ে আছে। তাদের বাড়িতে এই গ্রামের মত এত শীত নয়। একেই বলে বুঝি "উত্তরের শীত"। শুভ আবার লেপের ভিতরে ঢুকল। বিছানার পাশের জানালাটা খুলে দিল শখ করে কুয়াশা দেখার জন্য। কালকে রোদ উঠেছিল আর আজকে ঘন কুয়াশা। খুব ঘন সাদা কুয়াশা পড়েছে। জানালা দিয়ে রাস্তার ওই পাশে কালকে একটা আমগাছ দেখেছিল সে। আজকে সেটা দেখা যাচ্ছেনা। কিছুক্ষণ শুয়ে থাকলো। তারপর উঠে পড়লো বিছানা থেকে। শীতের সব ভারি কাপড়চোপড় পড়ে নিল। বাহিরে যাবার জন্য উঠান পেরিয়ে সদর দরজার দিকে তাকে যেতে দেখে মামী বললো----
-'শুভ এত সকালে বাহিরে কোথায় যাচ্ছো?'
-'মামী, একটু ঘুরে আসি...'
-'এই ঠাণ্ডার মধ্যে!?'
-'মামী এখানকার শীতের সকাল একটু অন্য রকমের লাগছে...একটু বাহিরে থেকে দেখে আসি।'

শুভ বাড়ির বাহিরে এলো। সাদা মাটিতে শিশির পড়ে কিছুটা ভিজে আছে। চারিদিকে শুধু সাদা আর সাদা আর সব চুপচাপ। মনে হচ্ছে কোন যাদুকর কুয়াশার নামে কোন জাদুকরী ধোঁয়া ছড়িয়ে সবাইকে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছে। শুভ হাঁটতে হাঁটতে একটা ফাঁকা জায়গায় চলে এলো। গ্রামের শেষে এখান থেকে আবাদি জমি শুরু হয়েছে। এখানে এত ঘন কুয়াশা পড়েছে যে তিন গজ দূরের কিছু দেখা যাচ্ছে না। শুভ আগে কখনো এত ঘন কুয়াশা দেখেনি। তার দার্জিলিং, গ্যাংটক এর কথা মনে হচ্ছে! সে নিজের মামার বাড়িতে এসে দার্জিলিং, গ্যাংটক ভ্রমণের স্বাদ উপভোগ করতে পারছে! সে জমির আইল দিয়ে হাঁটতে শুরু করলো। শুভর মনে হচ্ছে সে সাদা মেঘের মধ্যে দিয়ে হাঁটছে। মাঝে মাঝে তার ভয়ও লাগছে। হলিউড ছবির মত সাদা ধোঁয়ার ভিতর দিয়ে কেউ বের হবেনা তো!? আবাদি জমিগুলো পেরিয়ে গ্রামের বাহিরে একটা জঙ্গলের মত জায়গা দেখতে পেল। শুভর রেইনফরেস্ট এর কথা মনে হল। এরকম ঘন কুয়াশার সকালে নির্জন জঙ্গলের স্থান দেখে সে একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো। জঙ্গলটা কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে এদিক ওদিক ঘোরাফেরা করে বাড়িতে ফিরে এলো।

সেদিন রাতের বেলা খাবার পরে শুভ, ইরফান, ইফতি ইরফানের ঘরে আড্ডা দিচ্ছিল।
শুভঃ 'পরীক্ষা শেষ তাহলে তোদের?'
ইফতিঃ 'হ্যাঁ ভাইয়া।'
শুভঃ 'যাক তাহলে তোদের সাথে আড্ডা দেয়া যাবে এখন।'
ইরফানঃ 'ভাইয়া, তুমি নাকি আজকে খুব ভোরে উঠে বাহিরে গিয়েছিলে?'
শুভঃ 'হ্যাঁ গিয়ে একটা দারুণ জিনিস উপভোগ করলাম।'
ইফতিঃ 'কি!?'
শুভঃ 'উফফফ... সকালবেলা এত ঘন কুয়াশা পড়ছিল যে আমার মনে হচ্ছিল আমি দার্জিলিং এ আছি।'
ইরফানঃ 'হাহাহা...'
শুভঃ 'হাসছিস কেন?'
ইরফানঃ 'এসব কুয়াশা দেখার কি আছে? আমার তো কুয়াশা দেখলেই বিরক্ত লাগে। ভাইয়া আর কি দেখলে?'
শুভঃ 'আরে গ্রামের আবাদি জমিগুলো পেরিয়ে একটা জঙ্গলের মত জায়গা দেখে আমার রেইনফরেস্টের কথা মনে হল। আবার সেখানে যাব ভাবছি।'
ইরফানঃ 'দেখো আবার জঙ্গল থেকে যেন কোন মেয়ে মানে আমাদের জংলী ভাবী যেন বের হয়ে না আসে!...'
ইফতিঃ 'হাহাহা...'


ভোর ৫-১৫ বাজে। অ্যালার্ম এর শব্দে শুভ ঘুম থেকে উঠে পড়লো। শীতের ভারি কাপড়চোপড়, জুতো আর টুপি পড়ে শুভ নিঃশব্দে বাড়ির গেট খুলে বাহিরে বের হয়ে এলো। শীতের ভোর। গোটা গ্রাম গভীর ঘুমে। পাতার উপর শিশিরের পানি পড়ার শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ নাই। মাঝে মাঝে দুই একটা বাড়ির লাইটের আলো দেখা গেল। কিন্তু সেগুলো প্রয়োজনের তুলনায় খুব নগণ্য। ফলে গ্রামের রাস্তার অন্ধকার কাটেনি। শুভ হাঁটতে হাঁটতে সকালে যেখানে এসেছিল সেখানে এলো। জঙ্গলের পাশ দিয়ে একবার পরিভ্রমন করে দেখল এটা তেমন একটা জঙ্গল নয়, একটা বড় বাগান জাতীয় জমি হবে। অনেকদিন আগাছা পরিস্কার না করবার ফলে জঙ্গলে পরিপূর্ণ হয়ে গেছে। হাঁটতে হাঁটতে জঙ্গলের পাশে একটা উঁচু মাটির ঢিবি দেখতে পেয়ে তার উপর কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলো। এক ঘণ্টা পরে এদিক ওদিক ঘোরাফেরা করে শুভ নিজের ঘরে ফিরে এলো।

সকাল ৯-০০ বাজে। ইরফানরা মনে হয় এখনো ঘুম থেকে উঠেনি। শুভ নিজের ডায়েরী লিখতে বসেছে-----
"আজকে আমার জীবনে একটা একইসাথে মজার এবং রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা হয়েছে। আমি মামার বাড়িতে বেড়াতে এসে কুয়াশা দেখার পরিকল্পনা করেছি। সোয়া পাঁচটার দিকে কাপড়চোপড় পড়ে বাহিরে বের হয়ে গিয়েছিলাম। সে এক বিস্ময়কর অভিজ্ঞতা। প্রথম প্রথম ভয় লাগছিল। এত সকালে নির্জন গ্রামের মাঝে কোন বিপদ হবেনা তো? কিন্তু একটু পরে শীতের ভোরের মায়াময় দৃশ্য আমার মন থেকে সব শঙ্কা দূর করে দিলো। আমি যেন বাংলাদেশে নাই, মনে হয় অন্য কোথাও চলে গেছি। আমি প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে বাহিরে কাটিয়ে এসেছি। মাঝখানে একবার সেই বড় বাগানটার পাশে একটা উঁচু মাটির ঢিবির উপর বসেছিলাম। আকাশ থেকে একটু একটু করে কুয়াশা আমার মাথার টুপিকে ভিজে দিচ্ছে আর আমার মনে হচ্ছে সাইবেরিয়া চলে গেছি!। নিজেকে তখন 'লিটল হাউস ইন দি বিগ উডস' এর বাবার মত মনে হচ্ছিল। উফফফ... এই দৃশ্যটা পরিপূর্ণ পেত, যদি আমার সাথে তখন আমার প্রিয়া থাকত...হাহাহা..."

বিকেলবেলা ইরফান, ইফতি, শুভ আড্ডা দিচ্ছিল শুভর ঘরে। এসময় একটা মেয়ে আসলো। মেয়েটাকে দেখে ইফতি বলল, 'আরে নিতু আপা!, আসো আসো...'
নিতু নামের মেয়েটা ঘরে ঢুকে বলল, 'তোদের পরীক্ষা কেমন হল?'- বলেই মেয়েটা শুভর দিকে চেয়ে অবাক হয়ে গেল।
শুভঃ 'আরে নিতু, তুমি এখানে!?'
নিতুঃ 'এটা তো আমাদের গ্রাম। কিন্তু তুমি এখানে কেন?'
ইফতিঃ 'শুভ ভাইয়া আমাদের বড় ফুফুর ছেলে, নিতু আপা'
নিতুঃ 'ও'
শুভঃ 'আমি জানি তোমার বাড়ি দূরে, কিন্তু মামার গ্রামে সেটা ভাবিনি। যাক ভালোয় হল। এবার আমাদের সবার ছুটিটা ভালো কাটবে।'
নিতুঃ 'শুভ তুমি কবে আসলে?'
শুভঃ 'এইতো দুইদিন মনে হয় হবে...'
তাদের আড্ডা চলতে লাগলো। ইফতি খেয়াল করলো নিতু আপা তাদের চেয়ে শুভ ভাইয়ার সাথেই আলাপ করছে বেশী। ব্যাপার কি? শুভ ভাইয়া, নিতু আপা কি প্ল্যান করে এই গ্রামে আসলো!? এসময় শুভ একবার উঠে মামার কাছে গেল। মামা তাকে ডাকছেন। ফিরে এসে দেখল নিতু চলে গেছে।

সেদিন রাতে শুভ গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়লো। সেদিন আর শুভর প্রভাত-ভ্রমনে যাওয়া হলনা।


পরেরদিন ভোররাতে শুভর ঘুম ভেঙে গেল। সে আবার বেরিয়ে পড়লো।
হাঁটতে হাঁটতে সেই মাটির ঢিবিটার কাছে এসে দাঁড়ালো। টর্চ জ্বালিয়ে দেখে নিল আশেপাশে সাপ বা সাপের গর্ত আছে কি না। পকেট থেকে একটা মোটা পলিথিন বের করে উঁচু ঢিবিটার সমান অংশে বিছিয়ে তার উপর বসে পড়লো। বিস্ময়ে চারিদিক দেখতে লাগলো। 'শুধু সাদা আর সাদা! এ যেন এক মায়াময়, রহস্যময় জগত। মাটিতে বসে আছি নাকি মেঘের ভিতর ঢুকে গেছি!। কাছের কোন জিনিসই দেখা যাচ্ছেনা। আমি কি কোন মায়াপুরীতে ঢুকে গেলাম!'
ছুপ...ছুপ...ছুপ...ছুপ--শুভর দিবাস্বপ্ন ভেঙে গেল। তার পাশে কে একজন এসে দাঁড়িয়েছে!। তার হার্টবিট বেড়ে গেল। ব্যাপার কি! সে কি সত্য সত্য কোন মায়াপুরীতে এসে গেল! এই লোকটা কি এখানকার প্রহরী? তাকে কি এখন ধরে নিয়ে যাবে!? নাকি অন্য কিছু?, এখনও আলো ফোটেনি। এই ভোররাতে তাকে ডাকাত ধরবে নাকি? কি করবে সে? চিৎকার করবে নাকি দৌড় দিবে? এসব ভাবতে ভাবতে দেখল সেই লোকটা তার সামনে এসেছে। শীতের কাপড়ে গোটা শরীর ঢাকা। মুখটাও ঢেকে রেখেছে। কেবল চোখ বের করা কিন্তু তাতেও আবার হালকা রঙের চশমা লাগানো। সে মানুষটা ধীরে ধীরে বলল---
-'তুমি কে?'
কণ্ঠস্বর শুনে মেয়েদের কণ্ঠস্বরের মত মনে হল। শুভ বলল----
-'আমি শুভ। আমি আপনার কোন ক্ষতি করিনি। আপনি আমার পেছনে লেগেছেন কেন, আপনি কে?'
-'আমি এই শীতের প্রকৃতি উপভোগ করি রাতে। এখানে হেঁটে বেড়াই। আমার নাম... নুহিয়া।'
-'আপনি কি মানুষ?'
-'মানুষ, আবার মানুষ না...'
-'মানে কি?'
-'মানে মানুষ মনে করলে মানুষ, না মনে করলে আমি মানুষ না।'
-'এত রাতে হেঁটে বেড়ান কেন?'
-'তুমি এই ভোররাতে বের হয়েছো কেন আর এই ঢিবিতে বসেই বা কি করছো?'
-'আমি তো এখানে দার্জিলিং এর সৌন্দর্য উপভোগ করছি।'
-'আমিও তো এখানে শীতের প্রকৃতি উপভোগ করি।'
শুভর এবার কিছুটা সাহস হল। মনে হল নুহিয়া মানুষ হোক আর যাই হোক, তার ক্ষতি করবে না। সে বলল---
-'চলেন তবে দুজন একসাথে ঘোরা যাক।'
দুজন একসাথে চলতে লাগলো। নুহিয়া বলল---
-'একা একা ঘুরছো কেন?'
-'কাকে নিয়ে ঘুরবো?'
-'স্ত্রী... অথবা... বান্ধবী নিয়ে ঘুরলে প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করতে বেশী ভালো লাগে।'
-'কেন একা ঘুরলে বুঝি প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়না?'
-'যায়, কিন্তু ভালো লাগে না। সমস্ত জীবজগতের ধর্ম হচ্ছে জোড়ায় জোড়ায় থাকা। যখনই কোন মানুষ নিজের আবাস ছেড়ে খোলা জায়গায় অবস্থান করে বা প্রকৃতির সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয় তখন সে একটা সঙ্গীর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। এটা জানো না?'
-'জানতাম না তো, আপনি তো অনেক জানেন? কিন্তু আমার যে কিছুই নাই...'
-'তোমার কাউকে কোনদিন ভালো লাগেনি?'
-'একজনকে তো লাগে, কিন্তু সে তো আমাকে পাত্তা দেয়না।'
-'খুঁজে দেখ,... তোমাকে হয়তো কারো ভালো লাগে, কিন্তু তুমি তাকে পাত্তা দিচ্ছো না...'
-'আমি যাকে-তাকে পাত্তা দিব কেন? তাকে যদি আমার ভালো না লাগে? ভালবাসা তো একপক্ষে হয়না...'
-'হাহাহা...তোমার সমস্যা কি জানো?'
-'কি?'
-'তোমার যাকে ভালো লাগে, সে তোমাকে পাত্তা দিচ্ছে না। আর তোমাকে যার ভালো লাগে, তাকে তুমি অবহেলা করছো!'


সকালবেলা বাড়িতে এসে শুভ নুহিয়ার কথা ভাবতে লাগলো।-- "নুহিয়া কি মেয়েমানুষ নাকি অন্য কিছু? না মানুষ নয়, একটা মেয়ে হয়ে ভোররাতে বেড়ানোর সাহস হবে না...তবে ওকি জঙ্গলের কন্যা?... ধ্যাত...আমি এসব কি ভাবছি... আচ্ছা নুহিয়ার কণ্ঠস্বর কিছুটা চেনা চেনা লাগছিল কেন? নাকি সুরেলা কণ্ঠের মেয়েদের কণ্ঠের মধ্যে মিল থাকে? কি জানি বাবা...আরে ধুররর...এত ভেবে কি হবে?... ও যেই হয় হোক আমার ক্ষতি তো করছে না..."
বিকেলবেলা নুহিয়ার ঘটনা ডায়েরীতে লেখার জন্য শুভ টেবিলে বসে পড়লো। কিন্তু ডায়েরী কোথায় গেল? ওটা তো এই টেবিলের উপরেই ছিল। শুভ গোটা ঘর খুঁজেও কোথাও ডায়েরী পেলনা। ইফতিকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলো শুভ----
-'ইফতি তুমি কি আমার ডায়েরীটা নিয়েছো?'
-'ছি ছি ভাইয়া, আমি আপনার ছোট, আমি আপনার ডায়েরী নিয়ে কি করবো?'
-'ও স্যরি, আমি ডায়েরীটা খুঁজে পাচ্ছিনা...'
-'কোথায় রেখেছিলেন?'
-'এই টেবিলের উপর...'
শুভ, ইফতি খোঁজাখুঁজি করে কোথাও ডায়েরী পেলনা। শুভ অনেক ভেবেও বের করতে পারলো না, তার ডায়েরী নিয়ে কার কি লাভ?

সেদিন রাতে খাবার পরে শুভরা আড্ডা বসিয়েছে----
ইফতিঃ 'ভাইয়ার ডায়েরীটা কোথায় যে গেল?'
শুভঃ 'থাক ইফতি, এটা তোরা আর কাউকে বলিস না, মামা-মামী শুনলে বিব্রতবোধ করবে।'
ইরফানঃ 'সেটা না হয় হল, কিন্তু তোমার ডায়েরী নিয়ে অন্য লোকে কি করবে?'
ইফতিঃ 'আমার মনে হচ্ছে ভাইয়া কিছু গোপন করছে...'
শুভঃ 'ইফতি......, তার মানে কি?'
ইফতিঃ 'কিছুনা এমনি বললাম...'
ইরফানঃ 'ভাইয়া আমি আজকে পাড়ার দোকানে একটা খবর শুনলাম। আমাদের গ্রামের শেষে যে জঙ্গল আছে সেখানে নাকি দুজন লোক রাতের বেলা বসে থাকে। আরেকজন বলল রাতের বেলা কালো রঙের দুটো জীন নাকি ঘুরে বেড়াচ্ছে। অন্য একজনও বলল সেই কালো জীনের কথা।'
শুভঃ 'তাই নাকি!'
ইরফানঃ 'হ্যাঁ। তোমার ডায়েরী হারাল, গ্রামে রহস্যময় লোকের আগমন এসব কি যে হচ্ছে...'
সেদিন গ্রামের লোকের কথা ভেবে ভোররাতে শুভ ভ্রমনে গেলনা। প্রতিদিন তাকে দেখতে পেলে লোকজন আরও ভয় পাবে।


এরপরের দিন ভোররাতে আবার ভ্রমণে বের হল শুভ। সেদিনও মাটির ঢিবির কাছে নুহিয়ার দেখা পেল শুভ। শুভ তাকে বলল---
-'নুহিয়া, আপনি কি এখানে সারা বছর ঘুরে বেড়ান?'
-'না, কেবল মাত্র শীতের সময়?'
-'তাহলে আপনি ভাগ্যবান'
-'কেন?'
-'আপনি গোটা শীত এখানে থাকতে পারবেন...'
-'তুমি থাকবেনা?'
-'আমি পরশুদিন চলে যাচ্ছি। কাল ভোররাতে হয়তো আর আসবোনা। আজকে আমাদের শেষ দেখা। আপনার কথা আমার মনে থাকবে...'
-'আবার কবে আসবে এখানে?'
-'জানিনা। দেখি আবার সামনের বছর শীতে আসার চেষ্টা করবো। আপনি যদি মানুষ হতেন তবে আপনাকে আমার বাড়িতে আসার আমন্ত্রণ জানাতাম...'


পরদিন শুভ মামাকে বলে ইরফান আর ইফতিকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যাবার অনুমতি আদায় করলো। ঠিক হল ইরফান আর ইফতি কাল সকালে শুভর সাথে রওনা দিবে।
দুপুরে ভাত খেয়ে শুভ বিছানায় শুয়ে পড়লো। কয়েকদিন দিনে রাতে সে ভালমত ঘুমাতে পারেনি। আজকে একেবারে গভীর ঘুম। ঘুম ভাঙলো একেবারে সন্ধ্যার পরে। ঘুম থেকে উঠে বাহিরে যাবে, এমন সময় টেবিলের উপর চোখ পড়লো তার। তার ডায়েরী! এটা কি ম্যাজিক নাকি? একবার উধাও হয়ে যাচ্ছে, একবার ফিরে আসছে! এত খোঁজাখুঁজি করে যেই ডায়েরীটা পাওয়া গেলোনা, সেটা নিজে নিজে টেবিলে হাজির!। ডায়েরীটা হাতে নিতেই তার নিচে রাখা চিঠিটা পেয়ে গেলো শুভ। তাতে লেখা রয়েছে----

"প্রিয় শুভ,
আমার ভালবাসা নিও। আমি তোমাকে আমাদের গ্রামে দেখে একই সাথে পুলকিত এবং ব্যাথিত হয়েছিলাম। আমার পুলকিত হবার কারণ হচ্ছে তুমি আমাদের গ্রামে এসেছো। আমি তোমাকে এবার আমার মনের কথাটা সরাসরি বলতে চেয়েছিলাম। আর দুঃখের কথা হচ্ছে কলেজের মত তোমার মামার বাড়িতেও আমাকে দেখে তুমি বিশেষ খুশী হওনি। সেদিন ইফতিদের বাড়িতে গিয়ে আমি টেবিলের উপর রাখা একটা ডায়েরী দেখতে পাই। ইফতির কাছ থেকে জানলাম ওটা তোমার ডায়েরী। তুমি যখন তোমার মামার ডাকে অন্য ঘরে গেলে তারপর ইরফানও চলে গেল। আমি একটা সুযোগ পেয়ে গেলাম। আমি ইফতিকে এক গ্লাস পানি আনতে পাঠালাম। এই সুযোগে আমি তোমার ডায়েরী লুকিয়ে ফেললাম। বিশ্বাস করো আমার কোন খারাপ উদ্দেশ্য ছিল না। আমি শুধু জানতে চেয়েছিলাম তুমি ডায়েরীতে আমার কথা বলেছো কিনা?। অথবা তোমার কোন প্রেমিকার কথা বলেছো কিনা, যার কারণে তুমি আমাকে অবজ্ঞা করছো।! আমি জানতে পারলাম তুমি সুমির কথা বলছো। তোমার সুমিকে ভালো লাগে। যাক কিছুটা বুঝতে পারলাম আমাকে অবজ্ঞা করার কারণ। ডায়েরী পড়ে আরও জানতে পারলাম তুমি ভোররাতে গ্রাম ঘুরে বেড়াচ্ছো। তাই আমিও তোমার সান্নিধ্য পাবার আশায় একটা প্ল্যান করলাম। তুমি যখন তোমার মামার বাড়ি থেকে বের হয়ে উঁচু ঢিবিটার কাছে যেতে, তখন আমাদের বাড়ির সামনে দিয়েই যেতে হতো। আমি তোমার আসার অপেক্ষায় ভোররাতে উঠে আমার জানালার কাছে বসে থাকতাম। যখন দেখলাম তুমি বের হয়েছো, আমিও নুহিয়া সেজে বের হয়ে গেলাম। তোমার কাছাকাছি থাকার জন্য এক সামান্য চেষ্টা। তোমাকে আমি ভালোবাসি। তোমাকে আমি সত্যিকার ভাবে পাবো না, তাই নুহিয়া সেজে ক্ষণিকের জন্য সেই স্বাদ পূরণ করার একটা চেষ্টা করলাম আর কি...। যখন শুনলাম একটা মেয়ে তোমাকে পাত্তা দিচ্ছেনা, বুঝলাম এটা সুমি। তুমি সুমির প্রেমে মজে আছো। বুঝলাম তোমার মনে আমার কোন স্থান নাই। শুভ তোমার সাথে কুয়াশার সকালে ঘুরে আমি একটা বিষয় বুঝে গেছি। আমাদের সম্পর্কের মাঝে শুরু থেকে শীতের কুয়াশার মত একটা অদৃশ্য দেয়াল রয়েছে। আমি হয়তো সেই দেয়াল টপকাতে অক্ষম। আমার ভালবাসা হচ্ছে শ্রাবণ মাসের রোদের মতন, শত চেষ্টা করেও মেঘকে সরাতে পারেনা। সুমি হয়তো চৈত্র্যের রোদের মতন, সামান্য একটু রশ্মি সবার নজর কাঁড়ে। সুমিরই ক্ষমতা আছে তার রশ্মি দিয়ে কুয়াশার দেয়াল টপকানো।
শুভ তোমার ডায়েরী ফেরত দিলাম। তুমি ভাল থাকো।
ইতি,
তোমার অবহেলার নিতু।"
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
আব্দুর কাদির এককথায় অসাধার। ভোট রইল প্রিয়।
ভালো লাগেনি ১৩ জানুয়ারী, ২০২০
সাইদ খোকন নাজিরী অনেক সুন্দর করে লেখা । ভাল লাগল ।শুভকামনা রইল।
ভালো লাগেনি ১৩ জানুয়ারী, ২০২০
ফয়জুল মহী খুব ভাল লাগলো। শুভ কামনা l
Ms Ahmad দারুন হয়েছে ভাই। পড়ে খুব ভাল লাগলো। শুভ কামনা রইল।

লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য

শীতের কুয়াশা দেখে নিতু বুঝতে পারলো তার আর শুভর মাঝখানেও শীতের কুয়াশার মত একটা দেয়াল তৈরি হয়ে আছে।

১১ জুন - ২০১৯ গল্প/কবিতা: ২০ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪