অশনি মেঘ

ঝড় (এপ্রিল ২০১৯)

বহতা নদী
  • ৫৪
ঘটনা বেশ জটিল দিকে মোড় নিয়েছে। জটিলতার এই গিঁটগুলো যতটা সম্ভব কড়াপাকের হওয়া চাই। একই সাথে জটমুক্তির ব্যাপারটাও যেন ঝর্ণা জলের গড়িয়ে পড়বার মত স্বাচ্ছন্দ্যময় হয়। এসব প্যাচ খেলতে গিয়ে যুতসই শব্দ হাতড়াতে বেশ ধকল যায়। যতটা অনায়েস মনে হয়, সাহিত্যের ব্যাপারটা আসলে অতটা সহজ নয়। যে দুপুরের খাওয়া দাওয়ার পাট চুকিয়ে বাড়িটাকে খানিক ভাতঘুমের আমেজ মাখতে দিয়ে, নিজে বুকে বালিশচাপা দিয়ে লিখতে বসলেই শব্দেরা সব উড়ে উড়ে এসে জড়ো হবে খাতায়। এ মেলা কসরত সাধ্য। কিন্তু এটা ক'জন বোঝে! অন্তত রবিন তো বুঝে না। কিংবা হয়ত বোঝে, স্বীকারের সততা দেখায় না।

গতকালকের ঘটনার পর নিজের সাথে নিজে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছি, সাহিত্য বিষয়ক আর কোন আলোচনা স্বামী নামের ক্ষণে চেনা, পরক্ষণেই ভীষণ অচেনা মানুষটির সাথে আর নয়। নিজের এই একটাই তো শখ, যা যজ্ঞের ধনের আন্তরিকতায় আগলে রেখেছি। সংসারের শতেক ঝামেলাতেও ভেসে যেতে দেইনি। এমন তো না যে আমি সংসারের কাজে হেলা করি! সবই তো ঠিকঠাক চলছে। অতি বড় সংসারীরও তো ভুলচুক হতে পারে যে কোন সময়। তাতে কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যায়! কিন্তু প্রায় প্রতিদিনই রবিন আমার লেখালেখি নিয়ে অশান্তি তৈরির ছুতো খুঁজে বেড়ায়। সামান্য কোন বিষয় নিয়ে মনিমালিন্য ঘটলে ঘটনা শেষমেশ আমার লেখা বিষয়ে এসে স্হির হয়। মাঝে মাঝে ভাবি ছেড়েই দেব, এত অশান্তি আর ভালই লাগে না।

একটা সাহিত্য পত্রিকার বিশেষ সংখ্যায় গল্প জমা দেবার শেষদিন আগামি পরশু। তাদের কথা দিয়েছি লেখা দেব। অথচ গল্পটা এখনও দানা বাঁধেনি। দানা যে বাঁধবে, নিয়ে বসতে তো হবে! তার সুযোগ পেলাম কোথায়? ননদের ভাশুরের ছেলের বিয়ে, সেখানে না গেলেই না। শুধু গেলেই হবে না, সমস্ত আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে তবেই ফেরা। শাশুড়িরও তেমন ইচ্ছে। কাজেই নিরুপায় আমাকেও আটকে থাকতে হয় তাঁর সাথে। ছেলে কিন্তু ঠিকই তার গলফ্ পর্ব সেরে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতায় যোগ দিয়েছে। সে বেলায় কারও সমস্যা নেই। সমস্যা আমারও হয় না। যে যার পছন্দের বিষয় নিয়ে থাকতে চাইলে আমার কেন সমস্যা হবে! কিন্তু আমার পছন্দ নিয়ে সময়ে সময়ে অনেকেরই মাথা ব্যথা ওঠে যায়। এটা অসহ্য।

গল্পটা নিয়ে বসতে না পারার ব্যাপারটা বেশ জ্বালাচ্ছে। বিয়ে বাড়িতে এসেও চিন্তাটা থেকে নিস্তার পাচ্ছি না। ভেতরে ভেতরে ভীষণ এক অস্হিরতায় ছটফট করছি। এটাও ঠিক হচ্ছে না বুঝতে পারি। নাছোর এক অশান্তি আর অস্হিরতার চিহ্ন সম্ভবত চোখেমুখে ছায়া ফেলেছিল। স্বামীর সেটা চোখ এড়ায়নি। কাছে এসে খুব দরদ ঢেলে জিজ্ঞেস করেছিল ব্যাপার কী? ব্যাপার খুলে বলতেই স্হানকাল ভুলে দপ্ করে এমনভাবে জ্বলে ওঠল, যে সেটা দেখে লজ্জায়, অস্বস্তিতে আমার ছুটে কোথাও পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করছিল।

ওসব নাকি ট্র্যাশ! খামোখাই সময় নষ্টের নেশা। অশিক্ষিত মানুষ তো না যে দুটো কথা শুনিয়ে মনকে শান্ত করব। বিয়ে বাড়ি থেকে ফেরার পথে মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছিলাম, চিরদিনের মত লেখালেখি ছেড়ে দেব। আমি সংসারি মানুষ, আমার কাজ মন দিয়ে সংসার করা। স্বামী, সন্তান, শাশুড়ির মন যুগিয়ে চলা। বাড়তি সময় কুড়িয়ে পেলে টেলিভিশনে চোখ আটকে অলস সময় কাটানো, নয়ত এর ওর নামে কুটনামি করা।

এদিকে যখন পত্র পত্রিকায় লেখা ছাপা হয় তখন খুব আহ্লাদ করে বলা হয়, ‘ভালই তো লিখ তুমি! আমার বসের বউ তোমার লেখার ভক্ত। তিনি নিয়মিত পড়েন। বুঝলে!’ ‘বস পড়েন না?’ এমন একটা বজ্জাত প্রশ্ন পাক খেয়ে ওঠে আসতে চাইলেও আমি গিলে ফেলি। মেয়েদের লেখা মেয়েরাই তো পড়বে। বস তো পুরুষ মানুষ। যেমন পুরুষ মানুষ আমার স্বামী। সে কোনও দিন পড়ে নাকি মন দিয়ে? পত্রিকায় ছাপা হলে এক ঝলক দেখেই বলে বাহ্ ভালই তো। দেয়া হয়ে গেল আমার অক্লান্ত শ্রমের চরম স্বীকৃতি। এমন স্বীকৃতিতে লেখক জীবনের সার্থকতার আনন্দে নেচেকুঁদে অস্হির হব কিনা ভেবে না পেয়ে থম্ ধরে থাকি।

বাড়ি ফিরে ঘুমানোর আগে আবার মত পালটেছি। কেন নিজের এতদিনের একটা পছন্দকে ছেড়ে দেব? কক্ষনও না। দুনিয়া উল্টে গেলেও প্রতি শুক্রবারে রবিন তো কই গল্ফ খেলা বাদ দেয় না? দল বেঁধে ধানমণ্ডি লেকে মাছ ধরায় ক্লান্তি আসে না। প্রতি মাসে ঘুরে ঘুরে একেক বন্ধুর বাড়িতে গেটটুগেদারের নামে গাদাগুচ্ছের মদ গেলা বন্ধ হয় না।

বিয়ের আগে আমি গান গাইতাম। বিয়ের পর পর রবিন খুব আদেখলাপনা করত আমার গান নিয়ে। শ্বশুর তখনও বেঁচে ছিলেন। তাঁর এসব একদমই পছন্দ ছিল না। ভীষণ বদরাগী শ্বশুরকে ছেলেও ভীষণ ভয় করত। বাবার ভয়ে ভীত ছেলে তখন বলেছিল, লক্ষী বুঝই তো, হাজী মানুষ, বয়সও হয়েছে। আর কদিনই বা আছেন বাবা বলো! মন ভরে গাইবার সময় তো সামনে পড়েই আছে।

আমার বাবাও হাজী মানুষ। গান নিয়ে তাঁর কোনো আপত্তি ছিল না। বরং ভোরের রেওয়াজের সময় নামাজ আদায় করে, মৃদু পায়ে এসে পাশে বসত বাবা। যতক্ষণ রেওয়াজ করতাম ততক্ষণ বাবা ধ্যানমগ্ন মুনির মত বসে থাকত। প্রায় প্রায় বাবা পছন্দের গান শুনতে চাইত। বাবার আব্দার মত কত গান যে শুনিয়েছি! শ্বশুর যখন মারা যান ততদিনে আমার অফুরন্ত সময়ের টানাটানি শুরু হয়ে গেছে।
দেড় বছরের ব্যবধানে এসে গেছে আমার এক ছেলে আর মেয়ে। তাদের বড় করে তুলতে তুলতে গলা থেকে গান ততদিনে ফেরার। তারপর চিরদিনের মতই হারিয়ে গেছে সুর, তাল, লয়ের পুরনো অভ্যাস। ভুলেও কোন দিন আর গুনগুন করিনি আমি। মনেই পড়ে না কখনও গান জানতাম!

লেখালেখি আমার রক্তে ছিল কিনা জানিনা। কিন্তু সুর ছিল। সেটাকে চিরদিনের মত নির্বাসনে পাঠিয়ে মনে মনে কতটা ফাঁকা হয়ে গেছি সে শুধু আমিই জানি। সুর হারানোর দুঃখেই কিনা জানিনা এক সময় লেখালেখিতে ঝুঁকেছি। ভেবেছিলাম সঙ্গীতের মত লেখালেখি তো আর কারও বিরক্তির কারণ হবে না। নিঃশব্দে, কারও কোন ব্যাঘাত না ঘটিয়েই করা যাবে।

ছেলে মেয়েরা স্কুল ছেড়ে কলেজগামী হলো এক সময়। তখন অফুরন্ত সময় সামনে এসে দাঁড়াল। হঠাৎ পাওয়া প্রচুর অবসর আমার বুকে মেলায় প্রিয় মানুষের হাত ছুটে হারিয়ে যাওয়ার হাহাকার জাগালো। যেন বাড়ি ফেরার পথ ভুলে গেছি। আমার আর কোথাও ফেরা হবে না। কেমন যে ভয় ধরানো অনুভূতি সেটা কী বলবো! বলা যায় ওই অনুভূতিটা আমাকে বেশি করে লেখালেখিতে জুড়ে দিল। তাছাড়া এটাও তখন স্পষ্ট আমার নিজস্ব কোন অবলম্বন নেই, যেটা ধরে নিজের মত সময় কাটানো যায়। তখন থেকেই জোরেশোরে লেখালেখির শুরু। এখন মোটামুটি নিয়মিত ভাবে দৈনিক পত্রপত্রিকার সাহিত্য পাতায় কিংবা ওয়েবজিনে লেখালেখি করি। অনেকেই লেখা চেয়ে নেন। পাঁচটা গল্প সমগ্র বেরিয়েছে ইতিমধ্যে। নিজের জন্য একান্ত করে পাওয়া একটা খোলা জানলা সেটা হুট করে বন্ধ হতে দেয়া যাবে না। যতই অশান্তির ঝড় আসুক। আমার ভালোবাসার এই পৃথিবীটাকে কোনভাবেই হারিয়ে যেতে দেব না।
রবিনের আর কোন কটুক্তিতেই কান দিচ্ছি না আমি।

আজ গল্পটা নিয়ে বসেছি। বেশ জটিল একটা অবস্হায় এসে পৌঁছেছে গল্প। কাহিনীর পাত্রপাত্রী এক জটিল সমস্যার ঝড়ে পড়ে দিশেহারা। এই জটিল অবস্হা থেকে উদ্ধারের একটা পথ দেখাতে চাই গল্পে। ঝড় পরবর্তী শান্তিময় একটা পরিস্হিতি তৈরির জন্য আমি প্রাণপণ কলম চালাই।

লিখতে লিখতে যখন শেষ লাইনে দাঁড়িটা বসালাম তখন গল্পের দিকে তাকিয়ে একটা প্রশান্তি ভর করলো, তৃপ্তির সাথে আমার সকল বেদনাকে উগড়ে দিতে পেরেছি গল্পটিতে। যা লিখেছি মন থেকে লিখেছি। স্বতঃস্ফূর্ততার সাথে বেরিয়ে এসেছে শব্দ বাক্যসমূহ। কোথাও থামতে হয়নি। কিন্তু চরিত্রগুলোর মধ্যে চেনা চেহারা এত বেশী যে সেটার দিকে তাকিয়ে আবার একটা অস্বস্তি দানা বাঁধতে শুরু করে। এই গল্প প্রকাশ পেলে আমার সংসারে নতুন একটা ঝড় এসে হাজির হবে না তো? ……….
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
রঙ পেন্সিল অনেক অনেক শুভকামনা রেখে গেলাম।
আবিদ হাসান আপনার গল্পটি বিজয়ী না হলে অবাক হবো।কি সুন্দর ভাবে গল্পের মাধ্যমে বাস্তবতা তুলে ধরলেন!
ARJUN SARMA ভালো লাগলো, ভালো থাকুন
ARJUN SARMA ভালো লাগলো, ভালো থাকুন
ARJUN SARMA ভালো লাগলো, ভালো থাকুন
ARJUN SARMA ভালো লাগলো, ভালো থাকুন
ARJUN SARMA ভালো লাগলো, ভালো থাকুন
ARJUN SARMA ভালো লাগলো, ভালো থাকুন
মাইনুল ইসলাম আলিফ নিজের গল্প খুব যুতসই ঢঙে বলেছেন।সাহস করে সত্যি বলেছেন।ভোট রইল।আসবেন একবার আমার পাতায়,আমন্ত্রণ রইল।
রুহুল আমিন ইমন অনেক অনেক শুভকামনা এবং ভোট রইল।

লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য

মানুষের জীবনে কত রকমের ঝড় আসে। প্রতিনিয়ত সেইসব ঝড়ের মোকাবেলা করে টিকে থাকতে হয়। একজন নারী সাহিত্যিক সংসারের শতেক ঝামেলা সামলে তারপর লেখার কাজটি চালিয়ে যান। সেই পথটা সব ক্ষেত্রে নিরংকুশ হয় না। এখানে একজন নারী তার বিয়ের আগের সমস্ত কিছু বিসর্জন দিয়ে স্বামীর সংসারে এসেছে। সবকিছু বাদ দিলেও সাহিত্যচর্চা বাদ দিতে পারেনি। বারবার বাধাপ্রাপ্ত হয়েও এগিয়ে গেছে। বাধার মুখেও গল্প লিখে গেছে। কিন্তু এইমাত্র যে গল্পটি লিখেছে সেখানে এমন কিছু চিত্র ভেসে উঠছে যা তার বাস্তব জীবনেরই প্রতিফলন। তিনি আশংকায় আছেন এই গল্প প্রকাশিত হলে সংসারে আরেকটি ঝড় উঠবে।

২০ ফেব্রুয়ারী - ২০১৯ গল্প/কবিতা: ২ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "ছোটবেলা”
কবিতার বিষয় "ছোটবেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪