-এই শুনেছিস, গ্রাম থেকে অনু ফোন করেছিল। আব্বাকে নাকি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
- তো, আমি কী করব? এমন তো আগেও হয়েছে। ইউ আর নট আস্কিং মি টু এটেন্ড বাই এনি চান্স, আর ইউ? পরশু বোস্টনে ল’ সেমিনার। এসব ঝামেলায় আমি নেই।
-নেই মানে? আমার কাজ নেই? ঘোড়ার ঘাস কাটি আমি? আমাকে প্রতিদিন ভ্রাম্যমান আদালত চালাতে হচ্ছে ঢাকায়। দেখিস না মিডিয়ায়? আর এইবার মনে হয় অবস্থা খারাপ। বাঁচবে না।
-আজরাইল তো তোমার কথায় আসবে? মরে যাবে? এত সোজা?
-এতকিছু জানি না। কাল সকালে ঢাকা টু যশোর ফ্লাইট বুকিং করছি। তুই আর তোর বউ যাবি কিনা দশ মিনিটের মধ্যে জানা। আমি তারানা’কে জানাচ্ছি। ও তো আবার এখন বিশাল মানবাধিকার কর্মী সেজে আছে। দেখি, দেশে আছে কিনা।
ফোনটা ধুম করে কেটে দিলেন মানিক সাহেব। উনাকে আপনারা চেনেন। ইদানিং প্রায় প্রতিদিনই ভ্রাম্যমান আদালতের বিচারক হয়ে চষে বেড়ান এখানে সেখানে। মিডিয়ার কল্যাণে তিনি রীতিমত সেলেব্রিটি। গ্রাম, দেশের বাড়ি, আব্বা, এসব এখন দূর অতীত তার কাছে। বুড়ো বাবাটা গ্রামে একাই থাকে। ঠিক একা বলা যায় কি? পাশের বাড়ির নাতি সম্পর্কের অনু ছেলেটা দেখে তাকে। খাওয়া দাওয়া, অন্যান্য ব্যাপার দেখে। দেশের প্রতিষ্ঠিত তিন সন্তান অবশ্য মাসিক টাকা পাঠাতে ভুল করে না। রাত এগারোটায় একটা টকশো ছিল মানিক সাহেবের। ফোনটা বন্ধ করার কয়েক মিনিট আগে ফোন এল অনুর। হঠাৎ বুক ব্যথায় বমি করে নেতিয়ে পড়েছে আব্বা। ওরা নিয়ে যাচ্ছে সদর হাসপাতালে। হাত-পা ঠাণ্ডা। বাঁচবে কি? বলা মুশকিল। আটাত্তরে হার্ট অ্যাটাক হলে বাঁচে মানুষ? কাল কি জানাজা হতে পারে? মায়ের জানাজা পড়া হয়নি তার। রাষ্ট্রীয় খরচে গোল বেগুনের চাষ শিখতে তিনি ছিলেন ইস্তাম্বুলে। এবার মিস করা যাবে না। ছোট ভাইকে ফোন দিয়ে এবার তিনি রিং দিবেন ছোট বোনকে। টকশো’র প্রডিউসার হম্বি করছে। করুক। আব্বা বলে কথা।
-দেশে আছিস নাকি? শোন, কাল গ্রামে যেতে হবে। আব্বা মরতে বসেছে।
-এত হার্শ করে বলছ কেন? বলতে পারে, আব্বার শরীর খারাপ। কিংবা আব্বা কিন্তু ভালো নেই। অথবা আব্বা শয্যাশায়ী। ‘মৃত্যু’র মত এত অশালীন শব্দ ব্যবহারের দরকার কি? হিউম্যান রাইটসের সূত্রমতে এটা ঈল এটিকেট।
- রাখ তোর স্টুপিড রাইটসের কচকচানি। তুই দেখি মানবাধিকার আর টকশো’গিরি করতে করতে ফাজিল সুশীল হয়ে গেছিস। একবারও দেখতে যাস আব্বাকে? খোঁজ নিস? এবার অবস্থা খারাপ। টিকবে না। কাল ফ্লাইট বুকিং দিচ্ছি। এখনই জানা।
-তোমরা মনে হয় খুব খবর রাখো? মায়ের জানাজায় পর্যন্ত ছিলে না। সম্পত্তির সময় তো ঠিকই থাকো।
-বাজে কথা বলবি না। আমার তখন ট্রেইনিং ছিল। সরকারি প্রশিক্ষন। আর তুই মেয়ে হয়ে এত সম্পত্তি সম্পত্তি শিখেছিস কিভাবে? বড়ভাইরা এখনও বেঁচে আছেতো। নাকি নেই? আগে তো বুড়াটাকে মরতে দে। কাল যাবি কিনা বল?
এবার ফোন কেটে দিল মানিক সাহেবের বোন। ছোট বেলা থেকেই বেয়াদব। এর মধ্যেই ভাই বোনদের নিয়ে ফ্লাইট বুকিং হয়ে গেছে। ডিটেইলস তিনি হোয়াটস অ্যাপ করে দিয়েছেন অনুকে। রাতটা কাটুক। দীর্ঘ একটা রাত।
পরদিন সকাল দশটা। মানিক সাহেবের আব্বা চোখ মেলেছেন। একটু ভালো লাগছে তার। চোখের সামনে কাদের যেন খুঁজছেন তিনি। তারা নেই।
-কিছু খেয়েছিস অনু? রাতে তো মনে হয় দুই চোখের পাতা এক করতে পারিসনি। যা একটু ঘুমা? গাধার বাচ্চাগুলোর কী অবস্থা? আসবে, নাকি বলে দিয়েছিস ডাক্তার ছুটি দিয়ে দিয়েছে?
-কী বলেন দাদা? ফ্লাইট নম্বর, সময় সব হোয়াটস অ্যাপ করে দিয়েছে ম্যাজিস্ট্রেট চাচা। ফ্লাইট দেরি হচ্ছে মনে হয়। দেখছি আবার।
-আসলে আসুক, না আসলেও সমস্যা নেই। কাল রাতে আমি মৃত্যুকে অর্ধেক দেখে ফেলেছি। বুকটার মধ্যে যেভাবে মোচড় দিল, আর চোখের সামনে কেমন অন্ধকার, আর মনে হল তোর দাদী দূর থেকে অভয় দিচ্ছে, আর একটা লোক, কালো একটা জুব্বা পরা, যেন বুকটা ফেরে হৃৎপিণ্ডটা তালের রস করার মত করে একটা মোচড় দিল, আহ! এখন তুই বলছিস, ইসিজি ভালো, এসিডিটির ইনজেকশন দিয়ে সব ঠিক। যাকগে, মরতে একদিন হবেই। আসবে না, ওরা আসবে না। না আসুক, তুই থাকিস আমার জানাজাটায়। কই গেলি অনু?
অনু তখন বাইরে। মুঠোফোনে অন্তর্জাল টিপতে টিপতে একটা খবরে চোখ আটকে গেল তার। আজ সকালে ঢাকা থেকে যশোরগামী বুরাক বিমান দুর্ঘটনায় বিস্ফোরিত হয়েছে। বেঁচে নেই কোনো যাত্রী। অনু নির্বাক। চোখ থেকে পানি পড়ছে টপটপ করে। জানালা দিয়ে দেখছে সে দাদুকে। শূন্য দৃষ্টি। সেই দৃষ্টিতে অপেক্ষা, হতাশা আর অসহায়তা। এখন সায়াহ্ন। একদিন এই দৃষ্টি খাঁ খাঁ করবে। অপেক্ষা হবে দীর্ঘতর। সন্তান নয়, মৃত্যু নামের সেই অমোঘ নিয়তির আলিঙ্গনের জন্য হাঁসফাঁস করবে শিরা উপশিরা।
কার যাওয়ার কথা ছিল , আর গেল কারা। বিমান দুর্ঘটনা শুধুই একটা উপলক্ষ। মৃত্যু জিনিসটার অংক নিজের নিয়মে চলে। আমরা বোকার মতো পাটি গণিত , বীজ গণিত কষতে বসি। জিওম্যাট্রি, ক্যালকুলাসের কচলাকচলি করি। অথচ মহাবিশ্ব চলে একজনের জীবনমৃত্যুর সবচেয়ে খাঁটি-গণিতের সূত্রে । ধারাবাহিকতার কোনো বালাই নেই সেই মাস্টার মশায়ের পাঠশালায়।
লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা
ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য
এই গল্পের সবচেয়ে বড় চমক বা টুইস্ট আসবে বিমান দুর্ঘটনার মাধ্যমে । তাই বলা যায় প্লেন ক্র্যাশ বিষয়ের সাথে এ গল্প পুরোপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ।
২৩ সেপ্টেম্বর - ২০১৮
গল্প/কবিতা:
৪৪ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ সেপ্টেম্বর,২০২৫