ডিসেম্বরের সকাল। শীত নেমেছে জাঁকিয়ে। ছোট একটা নদী, শুকিয়ে গেছে। নাম না জানা গ্রামটার নাম না জানা কাঁদা-মাটি নদীটার সামনে দাঁড়িয়ে আনোয়ার দাঁড়িয়ে থাকে।
খুব ক্লান্তি লাগছে। পা দুটোতে কে যেন পাথর বেঁধে দিয়েছে। বাড়ির কথা মনে পড়ছে। সেই মে মাস থেকে বাড়িছাড়া ছেলেটা। মাদারীপুরের ছোট গ্রামটায় মার্চ মাসেই আগুনের খবর পৌঁছে গিয়েছিল। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। স্বাধীনতার কীইবা বুঝে সদ্য যৌবনে পা দেওয়া গ্রামের ছেলেগুলো। সালেক কি বুঝত? সেই দিনটার কথা এখনো মনে পড়ে আনোয়ারের। সালেক কোথা থেকে ছুটে আসল। ‘জানিস ঢাকায় যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। পাকিস্তানিরা রাতের বেলা ঝাঁপিয়ে পড়েছে ঢাকার উপর, আমাদের উপর। চারদিকে লাশ আর লাশ, রক্ত, আগুন। ঢাকা পুড়ছে’। সালেকের চোখ দুটো জ্বলে উঠল। চোয়াল শক্ত হয়ে আসল। সেই কথা মনে করে আজ আনোয়ারের মুঠি আবার শক্ত হয়ে উঠে। উড়ে যায় সব ক্লান্তি, অবসাদ।
হাঁটু-জল নদীটা পার হয়ে মাঠ। মাঠ শেষ করে একটা বটগাছ। তারপর গ্রামের রাস্তা। এই গ্রামটার নামও জানা নেই। বটগাছটা দেখে নিজের গ্রামের কথা মনে পড়ে আবার। বৈশাখের একটা দুপুর। সালেকের ভেতর ততোদিনে নেতৃত্ব মাথাচাড়া দেওয়া শুরু করেছে। সেই দুপুরেই ঠিক হয় ওরা যুদ্ধে যাবে, মুক্তিযুদ্ধে। চারবন্ধু। সালেক, আবুল, মনসুর আর আনোয়ার। কখনো কোনো অস্ত্র ছুঁয়ে দেখেনি, তবু ওরা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে চায়। যুদ্ধের কিছুই জানা নেই। এমনকি ‘যুদ্ধ’ শব্দটাই নতুন ওদের কাছে, তবু যুদ্ধে যেতেই হবে। বিধবা মা, আর সালেক, দুই জনের সংসার। এই মা’কে ফেলে সালেক যুদ্ধে চলে যায়। আনোয়ারের সব আছে। মা, বাবা, ভাই, বোন। তাই বুঝি ওকে অনেক কষ্টে পালিয়ে আসতে হয়। বাকি দুইজন কেন জানি আসতে পারেনি সেই রাতে। সবাই কি আর সালেক হয়?
গ্রামের মাঝে খণ্ড খণ্ড মিছিল হচ্ছে। ছেলে ছোকরার দল নতুন দেশটার পতাকা নিয়ে উল্লাস করছে। চারদিকে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান। এমনই একটা জটলা দূর থেকে দেখছে আনোয়ার। এলোমেলো লম্বা চুল, খোঁচা খোঁচা দাড়ি, গায়ে একটা ময়লা শাল। প্রচণ্ড ক্ষুধায় পা আর চলছে না। পকেটও ফাঁকা। সেই জটলা থেকে একজন বুড়োমত লোক এগিয়ে আসে।
‘কে তুমি বাবা। তোমারেতো আগে দেখিনি। তুমি কি মুক্তি’?
আনোয়ার মাথা নাড়ে। কিছু বোঝার আগেই বুড়োটা বুকে জড়িয়ে ধরে ওকে। নতুন এই দেশটায় সবাই সবার আপন, আত্মার আত্মীয়। আনোয়ার কান্না আটকাতে পারে না।
লোকটার ছেলেও মুক্তিযোদ্ধা। যুদ্ধ শেষে ফেরতও এসেছে। শুধু একটা পা আর ফিরতে পারেনি। দুটো গুড় মুড়ি খেয়ে যখন হাঁটতে থাকে আনোয়ার, আর কিছুদূর গেলেই পদ্মা, তখন শেষ সাতটা মাসের কথা ভাবতে থাকে সে। মে’তে দুই বন্ধু মিলে সীমান্ত পার হয়ে যায় ভারত। ট্রেনিং নেওয়ার দিনগুলোতে আনোয়ার রাতে কান্না করত। সালেক সান্ত্বনা দিত। কান্না সালেকও করত। সেই কান্না কেও দেখত না। কেও তাই সান্ত্বনা দিতেও আসত না।
ছোটবেলা থেকেই বাবার মুখ দেখেনি হতভাগা ছেলেটা। অনেক কষ্টে ছেলেটাকে বড় করেছে চাচী। সালেকের মা’কে চাচী বলত আনোয়ার। পাশাপাশি বাড়ি। দূর সম্পর্কের আত্মীয়ও। তবু ওর দিন বেশিই কাটত সালেকের ওখানে। শাপলা দিয়ে গরম ভাত চাচী মুখে তুলে দিত আনোয়ারের মুখে, তারপর সালেকের মুখে। পরীক্ষা শেষে কত রাত কেটেছে উঠোনে চাচীর গল্প শুনে। সালেক স্কুল ছেড়ে দিয়েছিল ছোটবেলায়। কিন্তু আনোয়ার ওকে ছাড়েনি। সেই সালেক যখন বলল যুদ্ধে যাবে, আনোয়ার চমকে উঠে।
‘না গেলি তুই যুদ্ধে। চাচীকে একলা ফেলে যাসনে। আমরা তো যাচ্ছি। তুই থাক’।
‘দেশটাও আমার মা। মা কে স্বাধীন করবই। আমি যুদ্ধে যাবই’।
আর কী আশ্চর্য, বুকে পাথর বেঁধে চাচী ছেলেকে পাঠিয়ে দিলেন যুদ্ধে। আনোয়ারকে আসতে হয়েছিল পালিয়ে, চুপিচুপি। আর চাচী একমাত্র ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে কেমন করে বলতে পারলেন, ‘যা বাবা। দেশ স্বাধীন করে তারপর ফিরবি’।
পদ্মার তীরে আসতে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। কোনো নৌকা নেই। কুয়াশা চারদিক অন্ধকার করে রেখেছে। আনোয়ারকে সেই রাতে থাকতেই হয়। একটা থাকার ব্যবস্থা হয়েও যায়। নতুন দেশটায় সবাই খুব আপন।
কুমিল্লার একটা জায়গায় তুমুল যুদ্ধ হচ্ছে। সালেক সামনে থেকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ওদের। চারদিকে গুলি। গ্রেনেড। একটার পর একটা হানাদারের লাশ পড়ছে। ওরা এখন সেনা ক্যাম্পটার খুব কাছাকাছি। হঠাৎ একটা গুলি গিয়ে ঢুকে কপালে, কপালের ঠিক মাঝ বরাবর। লুটিয়ে পড়ে সালেক।
আনোয়ারের ঘুম ভেঙে যায়। উঠে পড়ে ধড়ফড় করতে করতে। ডিসেম্বরের এই শীতের রাতে ঘামতে থাকে দরদর করে। চোখ ভিজে যায়। দুই চোখ আর এক হয় না। শুধু আজকেই না। মধ্য অক্টোবরের সেই রাতটা চলে গেছে দুই মাস হয়ে এল। ও আর ঘুমাতে পারেনি।
পদ্মার বুকে নৌকা চলছে ধীরগতিতে। বড় একটা নৌকা। আরও জনা বিশেক লোক আছে। ফেরার পথে রাস্তায় রাস্তায় মানুষের উল্লাস, আনন্দ, বিজয় মিছিল, চাপা কান্না, হারানোর ব্যথা। আনোয়ারের মাথা জুড়ে একটাই চিন্তা, একটাই ভয়। চাচীকে কী বলবে? কেমন করে বলবে? একটা কিছু যদি হয়ে যায়?
‘চাচী আমি ফিরে এসেছি। সালেকরে ফিরায়ে আনতে পারিনি চাচী। ও আর ফিরবে না’।
আঁতকে উঠে আনোয়ার। না। এমন কথা বলতে পারবে না।
‘আমি তোমার সালেক, চাচী। আমিই তোমার সালেক। তোমাকে মা বলে ডাকব, জ্বালিয়ে মারব, তুমি বকবে, থালায় ভাত তুলে দিবে। আমিই তোমার ছেলে’।
কী করে সম্ভব এমন বলা? আনোয়ার ভেবে পায় না।
‘চাচী সালেকরে আমি হারায়ে ফেলেছি। ও হয়ত ভালোই আছে। এই ফিরে আসবে কোনো একদিন। সালেক ফিরে আসবেই। সালেক আসবেই, চাচী’।
একটা মা’কে মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব? অন্যায়? মিথ্যা বলাতো কোনোদিন শিখে নি সে। এই মাটিতে মিথ্যার কোনো জায়গা নেই।
সন্ধ্যাবেলা। চারদিক ঘুটঘুটে অন্ধকার। নিজেদের বাড়িটাই আগে পড়ে আনোয়ারের। ও ঢুকে না। সালেকদের বাড়ির উঠোনের বেড়াটা ধাক্কা দেয় ধীরে। একটা কুপিও নেই। অনুমানের উপর ভর করে ঘরের দরজার সামনে দাঁড়ায়। একটাই ঘর। চাচীকে ডাকবে? হয়ত ঘুমিয়ে আছেন? সকালে দেখা করবে? এসব ভাবতে ভাবতে দেখে দরজায় শিকল দেওয়া। মানে ভিতরে কেও নেই।
হঠাৎ একটা টর্চের আলো চোখে পড়ে।
‘কে ওখানে? আনোয়ার না? বাজান তুই ফিরা আইলি? আয় বাজান, বুকে আয়। সালেক কই’?
‘সালেক নাই। চাচী কই, বাজান’?
ছেলেকে বুকে জড়িয়ে বাবা কান্নায় ভেঙে পড়েন। ছেলে চলে যাওয়ার পর সালেকের মা খাওয়া দাওয়া প্রায় ছেড়েই দেন। সারাদিন শুধু কান্না করতেন। একটা সময় বিছানায় পড়ে যান। আনোয়ারের মা তখন তার পাশেই থাকতেন। সেবা করতেন। একদিন দুপুর থেকে জ্বর, প্রচণ্ড জ্বর। আবোল তাবোল বকছেন।
‘সালেক, ফিরে এসেছিস, বাজান’?
‘সালেক, ভাত রান্ধা শেষ, নদীতে ডুব দিয়া আয়, খাবি না’?
চারদিকে আগুন জ্বলছে। কোনো ডাক্তার নেই। মাঝরাত। মৃত্যুর সাথে লড়তে লড়তে একসময় ঢলে পড়লেন। আহা, কী সেই চেহারা। কোনো দুঃখ নেই, কোনো যন্ত্রণা নেই, একটা আলো আলো হাসি মুখ। এমন মরণও হয়। ‘আহা, দুইটা মাস হয়ে গেল। ওই চেহারা চোখে ভাসেরে, বাজান’।
‘দুই মাস! কবে? কবে বাজান?’
‘তারিখ কি আর মনে থাকে? অক্টোবরের মাঝামাঝি। হ, ওইদিন ছিল শুক্রবার। জানাজা হয় জুম্মার পর’।
আনোয়ারের মাথা ঘুরতে থাকে। এমনও হয় পৃথিবীতে! ওদের অপারেশন ছিল বৃহস্পতিবার, ১৪ তারিখ রাতে। সালেকের কপালে যখন বুলেটটা বিধে তখন মাঝরাত। নতুন একটা দিন তখন।
একাত্তরের মধ্য অক্টোবরের সেই রাতে, সেই একই সময়ে, ছেলের কান্না মা শুনতে পেয়েছিলেন।
কিংবা মায়ের কান্না ছেলে শুনতে পেয়েছিল।
যেমন করে মার্চে দেশটার কান্নায় ঝাঁপিয়ে পড়ে এই মাটির সন্তানেরা।
আর সন্তানের রক্তে গর্জে উঠে মা।
বিজ্ঞানে পড়া মাধ্যাকর্ষণের মতো, কিংবা এর চেয়ে শক্তিশালী কোনো আকর্ষণ, শক্তি কাজ করে জগতে। মানুষে মানুষে। সন্তান আর মায়ের মাঝে। দেশ আর সন্তানের মাঝে। এই শক্তির বলে জন্ম নেয় একেকটা একাত্তর।
লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা
ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য
এই গল্পে একজন মুক্তিযোদ্ধা সাথে দুই মায়ের সাথে আত্মিক সম্পর্ক ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এক মা হচ্ছে প্রাকৃতিক মা। আরেক মা দেশমাতৃকা। সন্তান যেমন এই জননীর জন্য জীবন বাজি রাখতে জানে, জননীও সন্তানের বিপদে, কষ্টে সাড়া দিয়ে ওঠে। বড় অদ্ভুত এই সম্পর্ক। 'জননী ' বিষয়ে এই গল্পটি তাই প্রাসঙ্গিক।
২৩ সেপ্টেম্বর - ২০১৮
গল্প/কবিতা:
৪২ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪