ইশারায় সে

বাবা (জুন ২০২২)

Ahad Adnan
মোট ভোট প্রাপ্ত পয়েন্ট ৫.৩৩
  • 0
  • ৮২
আবু মিয়ার একটাই ভালো পাঞ্জাবি। ভালো মানে, কোন ছিদ্র নেই, পরলে এখনও ভদ্রস্থ মনে হয়। চাঁদ ওঠার সাথে সাথে পাঞ্জাবিটা বের করে অ্যালুমিনিয়ামের বাসনে জ¦লন্ত কয়লা নিয়ে একটু ডলে নিয়েছে। গরিবের ইস্ত্রি। নাকের সামনে পাঞ্জাবিটা ধরতেই একটা কুসুম উষ্ণ ন্যাফথলিন মাখানো গন্ধ ভেসে আসে। মনের অজান্তেই সে বলে, ‘এইটা গায়ে দিয়া কাল নামাজে যামু’। যদিও সকালে ঈদগাহের সামনে তাকে দেখেই শুক্কুর বলে, ‘আবু ভাই, এই ভালা পাঞ্জাবি পইরা বইলে তো কেও তোমারে ভিক্ষা দিবনা’।

গ্রামের ঈদগাহ। তবে সেই গ্রাম কি আর আছে? ঈদগাহের সামনে কিছু ছোকরা ছেলে, থুঁতনির নিচে একটু একটু লোম গজিয়েছে অবস্থা, মুখ বাঁকা করে ছবি তুলছে। আবু মিয়া এতদিনে জেনে গেছে, এটাকে সেলফি বলে। সে আরও জানে, এই ছোকরাদের ফোনগুলোর দাম কুড়ি-পঁচিশ হাজার টাকা। তার মোটামুটি এক বছরের ভিক্ষার উপার্জনের সমান।

সব মিলিয়ে পনেরো জন বসে আছে ঈদগাহের তোরণের সামনে। পাঁচজন পুরুষ, দশজন মহিলা। দুইজন বৃদ্ধা বাদে বাকি মহিলাগুলোর কোলে একটা করে শিশু, বিভিন্ন বয়সের, বিভিন্ন আহারের। কারও আহার বুকের দুধ, কারও বৃদ্ধাঙ্গুল, কারও সস্তা ললিপপ, আর একটু বড়গুলোর জন্য চড়-থাপ্পর। আবু মিয়া গণনার সময় এদের বাদ দিয়েছে অবশ্য।

খুব সম্ভবত ‘ভালো’ পাঞ্জাবিটার জন্যই আবু মিয়া তেমন ভিক্ষা পাচ্ছে না। যে মহিলাগুলো স্তনে বাচ্চা লাগিয়ে রেখেছে, যে লোকটার পিঠে বড় একটা টিউমার, এমনকি যে শুক্কুর বাসের ধাক্কায় দুইটা পা হারিয়েছিল, খুব ভিক্ষা পাচ্ছে। পরম বাধ্য কুকুরের মত নিরীহ মুখ করে আবু তাকায় আগত মুসল্লিদের দিকে। খুব মিহি করে আবেদন জানায়, ‘এই গরীবরে দুইটা টাকা দেন বাবা’। কিন্তু সে এখনও খুব ‘আবেদনময়’ হয়ে উঠতে পারছে না।

আবু মিয়াকে দেখেই নাসির একটা বিরক্তিমাখা দৃষ্টি দিয়ে মুখ ফিরিয়ে নেয়। আবু মিয়ার দ্বিতীয় ছেলে এই নাসির। ওর জন্মের পর দুইটা ছাগল দিয়ে আকিকা দিয়েছিল সে। পাটমিলের তখন রমরমা অবস্থা। এরপরই মিলটা বন্ধ হয় আর খারাপ সময়ের শুরু। নাসির এখন গার্মেন্টসের ঝুটের ব্যাবসা করে খুব কামাচ্ছে। বাবার কোন খোঁজও নেয়না তাই।

একটু পরেই ঈদগাহে আসে জব্বর, তৃতীয় ছেলে। সে ফোনে কথা বলতে বলতে আসছিল। বাবা দেখলেও ছেলে দেখেনি তাই। রিকশাওয়ালাদের ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক জব্বর প্রায়ই বাবাকে দেখে হাটে ভিক্ষা করতে। কিন্তু কথা বলার সময় কোথায় তার?

দূর থেকে নেয়ামতকে দেখতেই আবু মিয়া মুখ কোথায় লুকাবে ভেবে পায়না। হাজার হোক, বড় মেয়ের জামাই। দুবাই থেকে কবে আসল লোকটা? মেয়েকে সে দেখেনি তিনবছর। আর ছোট মেয়েতো প্রেম করে অন্য জেলায় বিয়ে করে পালিয়েছে আরও বেশিদিন হয়ে গেল। বউটাও সেই মাসেই মারা গিয়েছিল তার। আল্লাহ সহায়, নেয়ামত চিনতে পারেনি আবু মিয়াকে।

ছোটছেলে মকবুল নামাজ পড়তে আসবে না এটা জানে আবু মিয়া। সারাদিন গাঁজা, মাঝে মাঝে ইয়াবা খেয়ে পড়ে থাকে এই ‘হারামজাদা’। গতমাসে ভিক্ষুক বাবার ঝোলা থেকে টাকা কেড়ে নিতেও বাঁধেনি তার।

আবু মিয়া হয়ত এখনও অপেক্ষা করছে কারও জন্য। বাংলা খুৎবা শেষ হয় হয় এমন সময় আসে আনু, বড় ছেলে। সাথে তার ছোট ছেলে, আট-নয় বছর হবে হয়ত। আবুকে দেখে সে ডাক দিয়ে বসে, ‘দাদাজান, বাজান ওই যে দাদাজান’। ‘চুপ, নামাজ খাড়ায়া যাইব। পা চালা’ বলে আনু মিয়া টেনে নিয়ে যায় ছেলেকে।

আবু মিয়ার চোখ ভিজে আসে। সে তাকিয়ে থাকে নাতির দিকে। নাতি তার দিকে আকুল তাকিয়ে আছে। বাবার মুঠিতে আটকানো হাতটা ছাড়িয়ে নিতে তার প্রচন্ড যুদ্ধ। একসময় সে যুদ্ধে জিতেও যায়। আনু মিয়া নামাজের কাতারে দাঁড়িয়ে গেছে। আর তখনই নাতি তার দাদার দিকে দুই হাতের ইশারায় ডাকতে থাকে।

আবু মিয়া ভিক্ষার থালা ফেলে রেখে দাঁড়িয়ে যায়। চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়ছে তার। শুক্কুর একবার তাড়া দেয়, ‘পাগল হইছ নাকি! একবার উঠলে আর বইতে পারবা না। ভিক্ষা পাইবা না। বইসা পড় তাড়াতাড়ি’।

‘তুই দ্যাখস নাই, শুক্কুর? আমার নাতি আমার জন্য দাঁড়াইয়া আছে। আমি যামু ওই কাতারে। সে আমারে ডাকে। ইশারায় ডাকে আমারে সে’।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
Jamal Uddin Ahmed অভিনন্দন।
ফয়জুল মহী বেশ সুন্দর অনুভূতির প্রকাশ ভালো লাগলো লেখাটা

লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য

সন্তান যখন বড় হয়ে মনুষ্যত্ব হারিয়ে ফেলে, বাবা হয়ে যায় অচেনা মানুষ। বাবা সন্তানের সম্পর্ক তখন শুধুই এক বিড়ম্বনা। কিন্তু নাড়ির টান কি এতই ঠুনকো। রক্তের টান ইশারায় ডাকতে থাকে বাবাকে।

২৩ সেপ্টেম্বর - ২০১৮ গল্প/কবিতা: ৪২ টি

সমন্বিত স্কোর

৫.৩৩

বিচারক স্কোরঃ ২.৩৩ / ৭.০ পাঠক স্কোরঃ ৩ / ৩.০

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪