‘অ্যাই, বয় মানে তো বালক, না’?
‘হুম’।
‘আর ফ্রেন্ড হচ্ছে বন্ধু। তাহলে “বয়ফ্রেন্ড” মানে দাঁড়াচ্ছে বালক বন্ধু। কিন্তু এটা দেখি বুড়ো ধামরা। গাল ভর্তি দাড়ি গোঁফ। ঘাড় পর্যন্ত চুল। নীলা এটাকেই বালক বন্ধু বানিয়েছে’?
‘কপাল! আরও কত কিছু দেখতে হবে? আমি হলাম আগের আমলের ম্যাট্রিক পাস। ঠাস বুনটের ইংরেজি আমার। আর তোমার ছেলে মেয়েরা আমাকে ইংরেজি শেখাচ্ছে। “বয়ফ্রেন্ড” মানে তোমাকে যে কি করে বোঝাই, আমি নিজেই ঠিকমত বুঝিনা আজকাল’।
শীতের রাত। কামাল স্যার আর তার স্ত্রী একটা লেপের তলায় বসে ঠকঠক করে কাঁপছেন। ছোট্ট একটা বাড়ি। এই দুই বুড়ো-বুড়ি ছাড়া নেই কেও।
‘ছেলেটা তাও নিজের চোখের সামনে বিয়ে দিলাম। মেয়েটার বিয়ে কি আর দিতে পারব’?
‘তুমি কালই, না এখনই একটা মেসেজ লিখে দাও তো, তুই চলে আয়। নাকি কলই করবে’?
‘তোমার মেয়ে কি বিয়ে করবে? “বয়ফ্রেন্ড” জুটিয়ে নিয়েছে। মানে বোঝ এটার’?
ভালোই একটা চাকরি করত ছেলেটা। হঠাৎ করে ডিভি লটারি পেয়ে পাল্টে গেল সব। বউ তখন গর্ভবতী, তিন মাস। দেশে থাকবে, একটা নাতি কিংবা নাতনির মুখ দেখবে, কোলে নিয়ে চুমু দেবে, অনেক আশাই ছিল কামাল স্যারের। নাতিটার এখন তিন বছর, জন্মসূত্রে আমেরিকার নাগরিক। এখনও মুখই দেখা হল না। না, মুখ অবশ্য দেখা হয়েছে। ফেসবুক আছে না! ছেলে একটা আইফোন পাঠিয়েছে। ফেসবুকে ঢুঁ মারতে শিখে গেছেন স্যার। কিন্তু এত আধুনিক ভাষা রপ্ত করতে সমস্যা হচ্ছে খুব।
‘লাইক’ মানে নাকি ‘পছন্দ করা’। ছেলে তাহলে ‘তোর রহিম চাচা মারা গিয়েছে’ কথাটা ‘পছন্দ’ করল? অন্তত ‘ইন্না লিল্লাহি...রাজিউন’ বলতে পারত না? ‘হট’, ‘কুল’, ‘পোক’, ‘ম্যান’ কথাগুলোর অর্থও মিলছে না আজকাল। ‘ব্রো’, ‘ডুড’ এসব শব্দ নেই কামাল স্যারের অভিধানে। মফস্বলের কলেজটাতে ইংরেজি পড়িয়ে কেটে গেল পঞ্চাশটা বছর। এখন ফেসবুক খুললে মনে হয় আদর্শলিপি পড়ছেন।
মেয়েটা বুয়েটে সুযোগ পেয়েছিল, এই গ্রামেই প্রথম। পাশ করে একটা বৃত্তি নিয়ে চলে গেল জার্মানি। আর কি আসবে? ভিনদেশে এরকম ‘বালক বন্ধু’ পেয়ে গেলে কেও কি ফিরে?
স্যারের স্ত্রী মুঠোফোনটা বন্ধ করে রেখে দেন। মাথা ধরে যায় এসব ফেসবুক, ভাইবারে। কিন্তু ঘুম আসে না। আজ ছিল একুশে ফেব্রুয়ারি। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। সকালের আলোচনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে এসেছিলেন এমপি সাহেব। আসতে দুপুর গড়িয়েছিল। আমন্ত্রিত হয়ে সকাল থেকেই ছিলেন কামাল স্যার। ছাত্ররা সারাটা সকালের রোদ গায়ে পুড়িয়ে যখন ক্লান্ত তখন এসছিলেন প্রধান অতিথি। এত সকালে ওঠার অভ্যাস নেই। মুখ থেকে বের হচ্ছিল মদের ভুরভুর গন্ধ। ‘বাংলা আমার চেতনা’ বিষয়ে বলতে গিয়ে শব্দের পর শব্দ বিদেশি অশুদ্ধ উচ্চারণ। কামাল স্যারের মাথা নিচু হয়ে গিয়েছিল। রাগে ফুঁসছিলেন তিনি।
রাত গভীর হতে থাকে। পাশের বিদ্যালয়ের মাঠে জোরে জোরে গান বাজছে। ‘নাগিন, নাগিন’। ‘নাগিন’ মানে তো সাপ। কামাল স্যারের মনে হচ্ছে, তাইতো, আসলেই তো সাপ। চারদিকে কালনাগিনী ফোঁস ফোঁস করছে। থুঁতনির নিচে কয়েকটা লোমওয়ালা ছেলেটা নিজেকে বলে ‘ডিজে’, এটার মানেও জানা নেই। ছেলেটার একেকটা বিট বুকের মধ্যে এসে ফোঁস ফোঁস করে আঘাত করছে।
কামাল স্যার স্ত্রীর হাত ধরে কাঁদতে থাকেন। প্রেশারটা অনেক বেড়ে গেছে। শীতের রাতে এসব বিটের শব্দ বুকটা খুব ধড়ফড়িয়ে দেয়। ইদানিং বয়সটা খুব বেশি ফুরিয়ে যাচ্ছে। ছেলে মেয়েদের আধুনিক যত ভাষা কিছুই মাথায় ঢুকে না।
অন্তত একুশে ফেব্রুয়ারির রাতে হিন্দি, ইংরেজি গান না বাজালেই নয়? কোন সমস্যা হলে কী একটা সরকারি নাম্বারে ফোন করলে নাকি পুলিশ আসে। করি করি করে আর করা হয় না ফোন।
কামাল স্যার ভাবেন, একটা অভিধান কিনে নেই। একবার আধুনিক হয়ে যাই। ঘুমিয়ে পড়া স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে আবার মনে হয়, থাক, কি হবে এসব শিখে। ওদের পৃথিবীতে না হয় বোবা, বধির, অন্ধ হয়েই থাকি।
বোবার নাকি কোন শত্রু নেই।
লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা
ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য
'বাংলা' আমাদের একটি চেতনার নাম। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম এই চেতনার কিছু পরিবর্তন হবে এটাই স্বাভাবিক। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই, এই নষ্ট সময়ে কারও কারও কাছে এই চেতনা আবেদন হারিয়ে ফেলছে। এই নির্মম বাস্তবতার কিছু উদাহরণ নিয়েই এই গল্প।
২৩ সেপ্টেম্বর - ২০১৮
গল্প/কবিতা:
৪২ টি
সমন্বিত স্কোর
৪.৬৩
বিচারক স্কোরঃ ১.৬৩ / ৭.০
পাঠক স্কোরঃ ৩ / ৩.০
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪