শূন্যতার গান

একটি বিয়ে (আগষ্ট ২০১৯)

রঙ পেন্সিল
  • ১১
  • ৪৬
কিন্তু নিয়তিকে মেনে নিলেও রেনু নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। কোমর ভাংগা সাপের মত মাঝেমাঝেই ও হিসিয়ে উঠছে। বিয়ে বাড়িটা ভেংগেচুরে তছনছ করে দিতে পারলে খানিকটা স্বস্তি পাওয়া যেত। নিজের বিয়ের কথা মনে হতেই ওর মুখে একদলা থুথু নোংরা পোকার মত কিলবিলিয়ে ওঠে। রেনুর ইচ্ছে করে জমানো থুথু ঐ লোকটার মুখে ছুড়ে দিতে। কিন্তু সেটা করা যাচ্ছে না বলে ওর মেজাজ আরো খারাপ হয়ে যায়।

এই বিয়ে ঠিক হওয়ার পর থেকেই রেনুর মন পালাই পালাই করছিলো। কিন্তু পালিয়ে যাবেই বা কোথায়? চাইলেই তো যেকোন সময় ঐ ন্যাড়া মাঠটা ধরে ঝাড়া দশ পনের মিনিটের মত দৌড়ালেই বাস স্টেশন। চোখ বন্ধ করে যেকোন একটা বাসে উঠে পড়লেই হলো। তারপর আর পায় কে!
কিন্তু বাসে নাহয় উঠলো। তারপর? এই টলমলে বয়সী একটা মেয়ে যার যাওয়ার কোন যায়গা নেই সে কার ভরসায় বাড়ি ছাড়বে?
সেজন্য আপাতত পালানোর চিন্তা বাদ দিয়ে ও বিয়ে থেকে রেহাই পাওয়ার হাজারটা ফন্দি আঁটতে লাগলো।
কিন্তু শেষপর্যন্ত কোনটা কাজে খাটাতে না পারায় আজ রেনুর গায়ে হলুদ।
সকাল আর দুপুরের সন্ধিক্ষণে একটা নতুন গামছা কামিজের উপর জড়িয়ে রেনু পিড়ি পেতে বসে আছে। রেনুর সামনে একটা বদনায় পানি,পানিতে আম পাতা ডোবানো। একটা এলুমিনিয়ামের থালার এক পাশে কাঁচা হলুদ আর অন্যপাশে মেহেদি বাটা।
রেনুর ছোট পাঁচ বোন একটু দূরে দাঁড়িয়ে ভয়ে ভয়ে রেনুকে দেখছে। একটু আগে মেহেদির লোভ সামলাতে না পেরে ওরা কিছুটা কাছে এসেছিলো কিন্তু রেনু একটা কঞ্চি নিয়ে ওদের তাড়া করেছে।
রেনুর মা রান্নাঘর থেকে মেয়েকে চাপা গলায় ধমক দিয়েছেন। 'বিয়ার কইন্যা কিন্তুক দ্যাখো লাজ শরমের এক্কেরে মাথা খাইছে। মাইনষে দ্যাখলে কি কইবো হুশ আছে?'
কিন্তু আশেপাশে যে কোন জনমানুষের বসতি নেই সে কথা রেনুর মা প্রায়ই ভুলে যান। এমন বিরান একটা জায়গায় কেই বা ঘর বাধতে আসবে!
তবে নদী ভাংগনে মাথার উপর থেকে যখন শেষ ছায়াটুকুও হেলে পড়েছিলো তখন এই বিরান জায়গাটাকেও রেনুদের একসময় স্বর্গভূমি মনে হয়েছিলো।
এই জমিটা রেনুদের এক আত্মীয়র। তিনি তার আত্মীয় এই পরিবারটির অসহায়ত্ব দেখে নিজের এই পতিত জমিটুকুকে ঘর বাধার উপযোগী করে দিয়েছিলেন। হয়তো তিনি রথ দেখা আর কলা বেঁচা দুটোই একসাথে সেরে নিতে চেয়েছেন।
রেনুরা থাকাতে জমিটার দখলও রইলো আবার পরবর্তীতে বসতভিটা হিসেবে চড়া দামে বিক্রি করার সুযোগতো থাকলোই।

মায়ের ধমক খেয়ে রেনুর গায়ের জ্বালা আরো বেড়ে যায়।
'আচ্ছা গায় গতরে কেরোসিন তেল দিয়া আগুন ধরাইলে কেমুন অয়? এক্কেরে জনমের বিয়ার সাধ বাপ মায়রে মিটাইয়া দেওন যায়।'
কিন্তু রেনু অতটা সাহসী হতে পারেনা। আর সাহসী হতে পারেনা বলেই ওর ভেতরে তীব্র গনগনে ক্রোধ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।
ও নিষ্ফল আক্রোশে পাতা ভর্তী বদনা পানা পুকুরে ছুড়ে মারে। হলুদের থালায় লাথি মেরে এক দৌড়ে গিয়ে পুকুরে ঝাপিয়ে পড়ে। ওর ভেতরের সুক্ষ্ম যন্ত্রনা পুকুরের পানিতে গলে গলে পড়ে। ও হিষ্টিরিয়া রোগীর মত একের পর এক ডুব দিতে থাকে।

না। শুধু পড়াশুনার জন্য নয়। যে মেয়ে একবার ফেল করে দ্বিতীয় বারের মত মাধ্যমিকের প্রস্তুতি নিচ্ছে সে কোন বুদ্ধিতে নিজের বিয়ে আটকাতে চাইবে?
এ বিয়েতে মত নেই রেনুর অন্য কারনে।
এই লোকটা,যাকে দেখলে এক দলা থুথু রেনুর মুখের ভেতর কিলবিলিয়ে ওঠে তার সাথে ও সারাটা জীবন কিভাবে কাটাবে? যে মধ্যদুপুরে একলা পেয়ে রেনুর অনাঘ্রাতা শরীরের আনাচ কানাচের খোঁজে হাত বাড়ায়,সেই কদর্য হাত রেনু কেমন করে নিজের করে নেবে?
না রেনু সেটা পারবেনা।
কিন্তু পরিবারের চাপে,অভাবের চাপে রেনুকে পারতে হবে। যে সংসারে পিতা অক্ষম,যে সংসারে ছেলেই একমাত্র উপার্জনক্ষম সে সংসারে ছেলের কথাই শেষ কথা। সে সংসারে পিতার মৃদু আপত্তি ছেলের সম্মতির কাছে কোথায় তলিয়ে যায় কেউ ঠাহর করতে পারেনা।
রেনুও পারেনা। তবে রেনু ভাবে অন্য কথা। 'নাহয় বাপ তার কুনো কামাই রোজগার করতে পারেনা,তাই বইল্যা কি পোলার কথায় ওডোন বওন লাগবো? বাপ হিসাবে পোলার কাছে কুনো অধিকার নাই? পোলায় কি বাপ মা ছাড়া এম্নে এম্নে পয়দা হইছে?'
কিন্তু কে দেবে রেনুর কথার জবাব! অভাবের সংসারে এসব কথা ভাবাও অন্যায়।
রেনুর ভাবনাগুলো যখন কথামালা হয়ে ফুলঝুরি ছোটায় তখন মা'ই রেনুর মুখ চেপে ধরে। ক্ষুধার কষ্ট জগৎে বড় কষ্ট। লাথি গুতা খেয়েও মুঠোমুঠো ভাত পেলে মন্দ কি?

সন্ধার পরপর লোকটির সাথে রেনুর বিয়ে হয়ে গেলো।
কথা ছিলো বিয়ের রাতটা লোকটি শ্বশুরবাড়ি কাটিয়ে পরেরদিনই বৌ নিয়ে ঢাকায় চলে যাবে। সেখানে তাদের বিরাট বাড়ি। ব্যবসায়ী বাবার একমাত্র পুত্র হওয়াতে টাকাপয়সার কোন কমতি নেই।
রেনুর ভাইয়ের কাছে যখন লোকটি এ বিয়ের প্রস্তাব তোলে তখন রেনুর বাবা আমতা আমতা করে বলেছিলেন, 'এ্যাত বড় ঘরের পোলা,এ্যারার মজ্জাদা কি আমরা দিতে পারুম?'
হবু শ্বশুরের কথা শুনে লোকটি বিনয়ের হাসি হেসেছিলো। না,সে শ্বশুরবাড়ি কোন আলাদা মর্যাদা চায়না,জামাই হিসেবে তার কোন চাহিদা নেই। সে শুধু সংসারীমনা একটা মেয়ে চায়। আজকাল ঢাকার মেয়ে গুলো কি আর মেয়ে আছে? তাদের শুধু সাজগোজ আর শহরময় ঘুরে বেড়ানো। তারা স্বামীর মাথায় পা রেখে সংসার করে। সেজন্যই লোকটি বাবার অমতে বন্ধুর বাড়ি পালিয়ে এসে গ্রামের মেয়ে বিয়ে করতে চাইছে।

রেনুর বাবা হবু জামাইয়ের কথা শুনে বিগলিত হয়ে পড়েন।
'এ্যাত বড় বাড়ির পোলা, কিন্তুক মনে কুনো ঘোরপেঁচ নাই। কি সুন্দর আচার ব্যাভার! আর আমার পোলাডারে দ্যাহো,তামাম দিন খালি কুত্তার লাহান ঘাউ ঘাউ।'

লোকটি তার কথা রেখেছে। বিয়ের পরদিনই বৌকে নিয়ে সে ঢাকা যাবার জন্য তোড়জোড় শুরু করে দিয়েছে। রেনুর বাবা মা মৃদু আপত্তি করেছিলেন।
কিন্তু লোকটি বিনয়ের সাথে প্রত্যাখান করেছে।
রেনুর মায়ের ইচ্ছে ছিলো রেনুর ছোট বোনেরা রেনুর সংগে যাক। কিন্তু লোকটি সব খোলাসা করে বলেছে। পিতার অমতে বিয়ে করাতে তার ব্যাবসায়ী বাবা তার উপর নাখোশ। তাই লোকটি বৌকে নিয়ে আগে গিয়ে পিতার মান ভাংগানোর পরে এরা যাক। নিজের বাড়ি গিয়ে সব ঠিকঠাক করে এদেরকে একটা খবর দিলেই তো এরা সবাই শহরে গিয়ে মেয়েকে দেখে আসতে পারবে।
মাত্র তো কদিনের ব্যাপার,তারপর তো মেয়ের সুখের সংসার সচক্ষে দেখে আসতে কোন বাধা থাকবেনা। আর ঠিকানা,ফোন নম্বর তো থাকলোই,তেমন বুঝলে দুই এক দিন পরে নাহয় সবাই আসুক।

রেনুর শ্বশুরবাড়ি যাত্রার সময় বাড়ির সবার চোখে জোয়ার এলেও রেনু শুষ্ক চোখে গোছগাছ করছে। একই কাপড় বার বার গোছাচ্ছে। যতটা দেরী করিয়ে দেয়া যায় ততই লাভ।
বাস ছাড়ার সময় প্রায় হয়ে এসেছে। এখনো যদি বাড়ি থেকে বেরোনো না যায় তবে ঢাকার বাস নির্ঘাত মিস হবে।
রেনুকে উঠে পড়তে হয়। রেনুর লাল শাড়ির আঁচলে এক অদ্ভুত ক্ষোভ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। সেখানে কান্নার কোন ছোঁয়া নেই। আছে শুধু একরাশ শূণ্যতা।
একবুক শূন্যতা নিয়েই রেনু লোকটির সাথে পথে নামে। যে পথের শেষ রেনুর জানা নেই। তবু রেনু ঠিকঠাক পা বাড়ায়। তিরতির করে কেবল ওর বুকের ভেতরটা কাঁপতে থাকে।


বাসের সিটে হেলান দিয়ে রেনু চোখ বন্ধ করে লোকটিকে নিয়ে ভাবতে শুরু করে। লোকটি দেখতে শুনতে মন্দ নয় তবু কি যেন একটা খটকা তার চেহারায় ঝুলে আছে।
রেনু অনেক ভেবেও এই খটকার জট খুলতে পারছেনা।
যতক্ষণ না এই জট খোলা না যায় ততক্ষন রেনু সাবধানে থাকবে। রেনুর বাবা মা নাহয় চোখ কান বন্ধ করে মেয়ে বিদায় করেছে,কিন্তু রেনুর চোখ কান দুটোই খোলা রাখতে হবে। স্বামী হলেই কি সবাই নিজের মানুষ হয়? হয় না।
সেজন্যই রেনু যাত্রাপথের সমস্ত খুটিনাটি মনে গেঁথে রাখবে। পথের হদিস কখন কোন কাজে লাগে কিছুইতো বলা যায়না।


সন্ধার পরপর যখন ঢাকার ভেতরে বাস ঢুকলো তখন রেনু সব ভুলে অবাক হয়ে ঢাকাবাসীদের দেখতে লাগলো।
চারদিকে এত আলো! এত রঙ! ফাগুনের আগুনরঙা পলাশের চেয়েও এত উজ্জ্বলতা এ শহরের! এ কোন অদ্ভুত পৃথিবীতে এসে পড়লো রেনু!
এই অদ্ভুত পৃথিবীতে এসে রেনু ভুলে গেলো ওর সতর্কতার কথা। ও বিভোর হয়ে সব দেখছিলো। এরমধ্যেই কখন বাস থেমেছে ও টেরই পায়নি।
লোকটি যখন রেনুর হাত ধরে ঝাকুনি দিয়েছে তখন রেনুর ঘোর কাটে। ওর চোখের উপর থেকে রঙের পর্দা সরে যাওয়াতে ও সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে।
'ক্কি, কি অইচে?'
না কিছু হয়নি। এখন রেনুদের নামতে হবে। রেনুরা ঢাকায় পৌছে গেছে।
পৌছানোর কথা শুনে রেনু লাল শাড়ির আঁচল মাথায় তুলে দেয়। ঢাকায় রেনুর শ্বশুরবাড়ি। শ্বশুরবাড়ির এলাকায় এসে নববধুর মাথায় ঘোমটা না দিলে চলে?


রেনুদের রিকশা একটা অন্ধকার স্যাতস্যাতে গলিতে ঢুকলে রেনু আবারো খটকার জট ছাড়ানোর চেষ্টা করে।
এ কোথায় এলো তারা? এই অন্ধকার,রংহীন শহরটাও কি ঢাকার অংশ?
ছোটবেলা থেকে শুনে এসেছে বড় রহস্যময়ী শহর ঢাকা। আজ নিজের চোখে দেখে রেনু কথাটার মানে বুঝতে পারলো।

বন্ধ ঘরের তালা খুলে যখন লোকটির সাথে রেনু ঘরে ঢুকলো তখন একটা ভয়ের হাওয়া ওর আপাদমস্তক কাঁপিয়ে দিলো।
ছড়ানো ছিটানো আধ খাওয়া সিগারেট আর ভাংগা কাঁচের টুকরো নববধুকে বরন করে নেয়ার জন্য যেন মুখিয়ে আছে। সারাদিন পথে থাকার ধকলটুকু শরীরে নিয়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে রেনু শূন্য চোখে ঘরটাকে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখছিলো।
একরুমের এই ছোট্ট স্যাতস্যাতে ঘরটা রেনুর শ্বশুরবাড়ি ?
এমন তো কথা ছিলো না। তবে কি রেনুর অবচেতন মনের ভাবনাটাই সত্যি?
না,রেনুকে ভেংগে পড়লে চলবেনা। দুঃসময়ের স্রোতে গা ভাসিয়ে না দিয়ে দরকার হলে রেনু স্রোতের বিপরীতে যাবে।

লোকটি চৌকির তলা থেকে গোটা চারেক আলু রেনুর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো আজ রাতটা ভাত আর আলু ভর্তা দিয়েই চলুক।
কোথায় চাল,কোথায় হাড়ি রেনুর কিছুই জানা নেই। ও অবাক হয়ে লোকটির দিকে তাকাতে লোকটা খেঁকিয়ে উঠলো,'ঐ মাগী,আলু চিনোস না? সারাজীবন ভাতের লগে আলু ছাড়া তো কিছু খাস নাই,আর এখন আলু চিনতাছোস না? ঢাকায় আইতে না আইতেই পাংখা গজাই গেছে,আ্যা?
না,লোকটার এমন কথায় রেনু অবাক হয়না। হঠাৎ করে লোকটার এই বিশ্রী রকমের পরিবর্তনে রেনুর শূণ্য বুকটা শুধু আরো শূণ্য হয়ে যায়।
রেনু চাইলে লোকটির এ কথার প্রতিবাদ করতে পারে। কিন্তু কথায় কথায় প্রতিবাদ করার মত বোকামি রেনু করবেনা। দু’চারটা দিন যাক। যা করার সব ঠান্ডা মাথায় ভেবেচিন্তে করতে হবে। অকারণে লোকটাকে খেপিয়ে দিয়ে লাভ নেই। এ শহরে রেনু অসহায়। লোকটা ওকে মেরে ফেললেও রেনুর বাড়ির মানুষ রেনুর লাশ অবধিও পৌছাতে পারবেনা। লোকটা তার পেছনে কোন ছাপ রেখে আসেনি। আজ কালকের ভেতর রেনুর পরিবারও ব্যাপারটা জেনে যাবে।


ঢাকায় আজ রেনুর তৃতীয় দিন।
সকাল বেলায়ই লোকটি বলে রেখেছে আজ রাতে তার দুইজন বন্ধু এখানে খাবে।
দুপুরের পরপর বাজার সদাই ও এসে গেলো।
রেনু ব্যস্ত হাতে রান্নাবান্না করছে। বাপের বাড়ি থাকতে টুকিটাকি রান্না করলেও মাছ বা মাংস মা ওকে কখনো রাধতে দেননি। অভাবের সংসারে ঘরে মাংস আসা মানেই তো উৎসব। সেখানে অল্পবয়সী মেয়েকে দিয়ে রাধাবাড়া করিয়ে কোন মা'ই বা উৎসবের আমেজটুকু নষ্ট করতে চান?

রেনু ভয়ে ভয়ে চুলায় মাংস বসিয়েছে। একটু এদিকওদিক হলেই লোকটার মুখে তুবড়ি ছুটবে। গায়ে হাত টাত তোলাও বিচিত্র নয়। রেনু সতর্ক চোখে রান্নার দিকে খেয়াল রাখছে।
দাওয়াত রাতে হলেও অন্ধকার পাতলা থাকতেই লোকটার বন্ধুরা এসে যাবে। আপ্যায়নের বন্দবস্ত সন্ধ্যার আগেই করে রাখতে হবে।
রেনুর রান্না শেষ। লোকটা এসে ওকে একবার তাড়া দিয়েছে। বিয়ের লাল শাড়িটা পড়ে মুখে ক্রিম পাউডার মেখে রেনুকে লোকটার বন্ধুদের সামনে যেতে হবে। লোকটার বন্ধুরা যেনতেন লোক নয়। একজন এই ঘরখানার মালিক।

রেনু আবারো সেই খটকার জট খোলার চেষ্টা করে। কিন্তু বরাবরের মতই সব তালগোল পাকিয়ে যায়।
হ্যা,রেনু যাবে। লোকটার কথামত তার বন্ধুদের সামনে সেজেগুজে গিয়ে তাদের আপ্যায়ন করবে। তবে রেনু দুঃসময়ের স্রোতে সাতার কাটবে না। তেমন বুঝলে ও আজই স্রোতের বিপরীতে নিজেকে ভাসিয়ে দেবে। এতটুকুও বুক কাঁপবে না রেনুর।

রেনু নিজের উপচে পড়া শরীরটাকে বিয়ের শাড়ির গলি-ঘুপচিতে আটকে রেখে লোক তিনজনের সামনে গেলো। যে এই ঘর খানার মালিক,সে মুখ দিয়ে একটা চূড়ান্ত রকমের অশ্লীল শব্দ তুলে লোকটিকে বললো, 'শালা,এই জিনিস ঘরের মধ্যে লুকাই রাখছোস?”
লোকটি খ্যাক খ্যাক করে হেসে বললো, 'আমি কইছিলাম না, আগের দুইটার চাইতে এইটা বহুত টসটসা। পার্টির লগে দরদাম চলতাছে। কথাবার্তা ফাইনাল হইলে মাল খালাস দিমু।'
তৃতীয় লোকটি যে এতক্ষন প্রকাশ্য চোখে রেনুকে দেখছিলো সে বললো, 'খালাস দেওনের আগে আমগো একটু চাইখা মাইখা দেখতে দিও। আর হুনো আমগো কমিশন নিয়া কিন্তু কোনো ঝামেলা চলবোনা। তুমি তো মিয়া মাল কেনা বেঁচা কইরাই খালাস। পুলিশের লগে দহরমমহরম কিন্তু আমগোই করা লাগে। '
তৃতীয় লোকটিকে হাত ইশারায় থামিয়ে দিয়ে দ্বিতীয় লোকটি বলে , 'তুমি মিয়া বহুত টাউট আছো। এইবারও যদি ঝামেলা করো তাইলে কিন্তু সোজা ঘাড় ধইরা বাইর কইরা দিমু। '
লোকটি জিভ কেটে বিনয়ের হাসি হাসে। 'কি যে কন। আপনাগো সাথে বেঈমানী করা মানে তো নিজের প্যাটে লাথি মারা।'

এইসব কথাবার্তার ফাঁকে একটু একটু করে রেনু খটকার জট খোলে।
না,রেনুর ভয় লাগেনা। নদী ভাংগনে যাদের সব হারিয়ে যায় তাদের এত সহজে ভয় পেলে চলে না। রেনু একটু একটু করে জট ছাড়াতে ছাড়াতে নিজের দুঃসময়টাকে উল্টেপাল্টে দেখে। চারিদিকেই শুধু আগ্রাসী স্রোত। রেনুকে এই স্রোতের বিপরীতে যেতে হবে।

শহর বাসের চতুর্থ দিনে রেনুর সমস্ত খটকা দূর হয়ে যাওয়ার সাথেসাথে কে যেন অদম্য শক্তিতে ওর বুকের ভেতরটা খামচে ধরে। ও কখনো রংহীন চোখে পলেস্তারা খসা দেয়ালের খাঁজে খাঁজে নিজেকে মুক্ত করে দেয়, আবার কখনো পাগলের মত ঘরময় ছোটাছুটি করে।

এই একরুমের স্যাতস্যাতে ঘরখানা থেকে বের হওয়ার সমস্ত পথ বন্ধ। রেনুকে চার দেয়ালের ভেতর থেকে আত্মরক্ষার অস্ত্র তুলে নিতে হবে। রেনুর ঘনিষ্ঠ অনুভূতিরা এক এক করে রেনুকে ছেড়ে গেলেও ও নিজের মত করে একটা পরিকল্পনা খাড়া করে।

অনেক ভেবেচিন্তে রেনু বটিতে ধার দেয়া শুরু করে।
বটির ধারালো ফলা একটু একটু করে ঝলসে ওঠে। রেনুর ভেতর থেকে কেউ যেন তাগাদা দেয়। 'দ্রুত রেনু,দ্রুত।'
রেনু পাথর মুখে অস্ত্রে ধার দিতে থাকে। অস্ত্রের ধারালো ফলা চোখের খুব কাছে নিয়ে দেখতে দেখতে রেনুর শূণ্য বুকটা শুধু আরো শূণ্য হয়ে যায়।


সপ্তম রাতে রেনুর সুযোগ আসে অস্ত্রের ধার পরীক্ষা করার।
লোকটির কথামত দ্বিতীয় ও তৃতীয় লোকটির জন্য আজ রেনুকে সেজেগুজে অপেক্ষা করতে হবে।
বন্ধ ঘরে রেনু একা। দরজা বরবরের মত বাইরে থেকে তালা বন্ধ। লোকটা বেরিয়ে যাওয়ার পরপরই রেনু ভেতর থেকে ছিটকিনি তুলে দিয়েছে।

গুমোট ঘরখানায় এখন অনেক রাত।
সর্বশেষ নেড়ি কুকুরটার ডাকও যখন থেমে গেলো তখন বন্ধ ঘরে তালা খোলার শব্দ হলো। শব্দ শুনে রেনু ছিটকিনি খুলে দিয়ে অপেক্ষা করে।
শানিত অস্ত্রের ধার পরীক্ষা করার অপেক্ষা।

গল্পের এ পর্যায়ে এসে জামিল সাহেব তার গল্প বলা বন্ধ করলেন।
'তারপর? তারপর কি হলো? মেয়েটি কি পালাতে পেরেছিলো?' শ্রোতাদের সম্মিলিত প্রশ্ন ভেসে আসে।
জামিল সাহেব মাথা নেড়ে কিছুটা আক্ষেপের সুরে বললেন, 'একটি ভুল বিয়ে রেনুদের গলায় ফাঁস হয়ে আটকে থাকে। রেনুরা সেখান থেকে পালাতে পারেনা। এ সমাজ রেনুদের পালাতে দেয়না।'
এই বলে তিনি মনযোগ দিয়ে চশমার কাঁচ মুছতে লাগলেন।

















আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
Jamal Uddin Ahmed রেনু কি বটির ধার পরীক্ষা করেছিল? শক্ত সংযত ভাষার গাঁথুনি। বরাবরের মত সুখপাঠ্য। অনেক শুভ কামনা।
কাজী প্রিয়াংকা সিলমী কাহিনীটি খুব চেনা। প্রথমেই অনুমান করতে পারছিলাম গল্প কোন দিকে এগুচ্ছে। কিন্তু চমৎকার লেখনী উপভোগ করতে তবুও পড়তেই হল। শেষটা পড়ে মন খারাপ হয়ে গেল। বাস্তব এমনই হয়। কিন্তু তাও মনে হল, 'ইশ! এই রেনু পালাতে পারলে বেশ হত!'
নাজমুল হুসাইন একটি ভুল বিয়ে রেনুদের গলায় ফাঁস হয়ে আটকে থাকে। রেনুরা সেখান থেকে পালাতে পারেনা। এ সমাজ রেনুদের পালাতে দেয়না।'চমৎকার কথামালা।
আদেল পারভেজ সকাল শুরু হলো গল্পে গল্পে । অভিনন্দন।
মোঃ নুরেআলম সিদ্দিকী এই প্রথম মনে হচ্ছে আপনার গল্প পড়লাম। লেখাটি অসাধারণ হয়েছে। লেখার ভাবমূর্তিও একটু অন্যরকম।। শেষের দিকে গল্পের রেষটা আরও বাড়িয়ে দিল। যা হোক, অনেক শুভ কামনা ও ভোট রইল।।
অনেক ধন্যবাদ ভাই।
Abdullahil Kafi খুবই চমকপ্রদ লেখনী। ভোট করলাম। আমার গল্পে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি
অনেক ধন্যবাদ। হ্যা যাব ইনশাআল্লাহ
রুহুল আমীন রাজু অনবদ্য প্রকাশ। শুভকামনা
বিশ্বরঞ্জন দত্তগুপ্ত সুন্দর উপস্থাপনার মধ্য দিয়ে একটা ভাল গল্প পড়লাম । শুভকামনা রইল ।
অনেক ধন্যবাদ! আপনার জন্যও শুভকামনা
মাইনুল ইসলাম আলিফ চমৎকার একটি গল্প পড়লাম।আপনার লেখার হাত দারুন।আর আমি কিন্তু গল্পের জগতে নতুন।তবে ইদানীং গল্প আমাকে পেয়ে বসেছে।খুব সহজেই ছাড়বে বলে মনে হচ্ছে না।জানি না সফল হতে পারবো কিনা? দোয়া চাই।
অনেক ধন্যবাদ। দোয়া রইলো।
Ahad Adnan চমৎকার গল্প। মনে হচ্ছে এর রেশ থেকে যাবে কয়েকদিন। কালকে পড়েছিলাম, এখনও মন খারাপ হয়ে আছে।

লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য

একটি বিয়েকে কেন্দ্র করে এ গল্পটি লেখা।

০৩ আগষ্ট - ২০১৮ গল্প/কবিতা: ১৫ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪