||শফিক||
গত দুদিন ধরে টানা বৃষ্টি।
সারাদিন সারারাত ধরে ঝরা বৃষ্টিতে গ্রামের আনাচ কানাচ,বাড়িঘর গাছপালা সব ভিজে জবজবে । কখোনো ঝপঝপ আর কখনোবা ঝমঝম করে ঝরছে। ঝরছে তো ঝরছেই। আর সেইসাথে বৃষ্টি কে সংগ দিতেই বোধহয় রাজ্যের যত ব্যাঙ এক সাথে গান ধরেছে। নেশার মত করুন একটা সুরে সবকিছু বিভোর হয়ে আছে।
চারদিকে কেমন একটা মন কেমন করা মন কেমন করা ব্যাপার।
কিছুক্ষণ পরপর দমকা হাওয়ার সাথে ভেসে আসা বৃষ্টি ভেজা মাটির গন্ধে মনের সব আগল খুলে দিতে ইচ্ছে করে। কিন্তু যার কাছে এমন বর্ষার দিনে মন প্রান উজাড় করে দেয়া যায় সেই রক্তমাংসের মানবীর সাথে আমার সরাসরি সাক্ষাতের সুযোগ হয়নি। সুযোগ না বলে বরং বলা যায় তার খোঁজ এখন পর্যন্ত পাইনি।
তবে আমাদের বাড়ির লোকজন এবার বোধহয় সত্যিকার অর্থেই তাকে খুঁজে পেয়েছে। আর খুঁজে পেয়ে বিয়েটাও একপ্রকার পাকা করে ফেলেছে।
আর সে কারনেই দিন দশেকের ছুটি নিয়ে এবার আমার গ্রামে আসা। সেই মানবীকে সাথে নিয়ে তবেই কর্মস্থলে ফিরবো। এমনটাই সবার ইচ্ছা।
আজ আমাদের মেয়ে দেখতে যাবার কথা ছিলো। কিন্তু এমন সৃষ্টিছাড়া বৃষ্টিতে ঘর থেকে বেরনো কার সাধ্য! তবে মনতো আর যুক্তি মেনে চলেনা। সেই অপরিচিতাকে এক নজর দেখার জন্য মনটা একেবারে ছটফট করছে। আর এমনই ভাগ্য আমার যে একথাটা যাদেরকে বলা যায় তেমন সম্পর্কের কোন আত্মীয় এবাড়িতে নেই।
কোন কিছুতে মন বসছেনা।
অফিসের এক গাদা কাজ মাথার মধ্যে সেঁদিয়ে রেখে বিনা কারনে এদিক-সেদিক ঘুরছি। কখনোবা এক বুক ব্যাকুলতা নিয়ে জানালার সামনে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখছি। ঝাপি খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে একটার পর একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ছে।
আচ্ছা সেই অপরিচিতাও কি এখন আমার কথা ভাবছে? আমার মত সেও কি তার গভীর কালো চোখ দুটোকে বৃষ্টির ধূসর চাদরে আবদ্ধ করে রেখেছে? আমাকে এক নজর দেখার জন্য তার মনটাও কি এমনই আকুলিবিকুলি করছে?
উঠানের দিক থেকে বেশ একটা কোলাহল উঠলো।
আমার অপরাচিতাকে একপাশে সরিয়ে রেখে নিচে নেমে এলাম কি ব্যাপার দেখতে।
মা বাবা বাদে বাড়ির সবাই নেমে গেছে উঠানে মাছ ধরতে। টানা বৃষ্টির ফলে পানি বাড়তে বাড়তে পুকুরের অবস্থা হয়েছে দশ মাসি পোয়াতির মত। উঠান আর পুকুরের এখন গলায় গলায় ভাব। কই,পুটি ছাড়াও আরো কয়েকরকমের মাছ উঠানের হাটু পানিতে খলবল খলবল করছে।
কই মাছের অবস্থা হয়েছে দেখার মত। কানে হেটে ধীর গতিতে পানি রেখে ডাংগার দিকে এগুচ্ছে। গন্তব্যের ঠিক নেই,পথের ঠিক নেই তবু এগোনো চাই ই চাই। আর সেই সুযোগে আমার ছোট বোন রুপা আর বড় চাচী মিলে মাছগুলোকে ধরে টপাটপ বালতির মধ্যে ভরছে।
আমাকে সিড়ির গোড়ায় দাড়ানো দেখে রুপা ছটফটিয়ে ডাকলো, 'দাদা, একটা বালতি নিয়ে নেমে এসো। অনেক মাছ উঠেছে।'
অন্যান্য দিন হলে ডাকতে হত না,নিজ আগ্রহেই এতক্ষনে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে মাছ ধরা উৎসবে লেগে পড়তাম। কিন্তু আজ আর ওদের সাথে যোগ দিতে ইচ্ছে করলো না।
কি একটা করুন সুর মনের মধ্যে নেচে বেড়াচ্ছে। কিছু ভালো লাগছেনা।
বিকেলের দিকেও বৃষ্টি কমার কোন লক্ষন দেখা গেলোনা। আমাদের দোতলা বাড়ির টিনের চালে বৃষ্টি বোধহয় নিজের সব আক্রোশ মেটাচ্ছে। প্রচন্ড ঝমঝম শব্দে কানে তালা লেগে যাওয়ার যোগাড়।
দোতলার ঘরে একা একা বসে বসে তাকে নিয়ে ভাবছি আর ক্যাসেট প্লেয়ারে গান শুনছি।
সপ্নরঙিন সেই শুভক্ষণে তাকে দেখে কি বলবো,কি নিয়ে আলাপ করবো আমরা এইসব নানান চিন্তা মাথায় গিজগিজ করছে। জীবনে কখনো কোন মেয়েকে জানার সুযোগ হয়নি,এ কারনেই কি আমি এত বেশি ভাবছি তাকে? নাকি এই গ্রাম্য পরিবেশ,এই মন কেমন করা বৃষ্টি এসব দায়ী?
এমন বৃষ্টির দিনে সকাল আর দুপুরের মাঝে খুব একটা ব্যবধান করা যায়না। বৃষ্টিতে মাখামাখি ঝাপসা ঝাপসা সকাল দুপুর গুলো অনেকটা একই রকম হয়।
বৃষ্টির ফাঁদে পড়ে দেরী হয়ে যাওয়ার ভয়ে খিচুড়ির জন্য অপেক্ষা না করে রাতের ভাত আর গতকালের মাছ দিয়ে কোনরকম দু চারটা খেয়েই বের হবার জন্য তৈরী হলাম।
বাড়ির আর কেউ না বুঝলেও রুপা ঠিকই ধরে ফেললো আমার উদ্দেশ্য। মুখে কিছু না বলে ও আড়ে আড়ে আমাকে দেখতে লাগলো। চোখ চোখ পড়ার ভয়ে আমি ওর দিকে না তাকিয়ে তৈরী হচ্ছিলাম আর সেই অপরিচিতার কথা ভাবছিলাম।
মেয়েটির নাম জুঁইফুল।
আমাদের বাড়িতে অন্তত তিনটা জুঁইফুলের গাছ আছে। বাড়ি থেকে বেরোবার আগে কয়েকটা ফুল পাঞ্জাবীর পকেটে করে নিয়ে যেতে হবে। নিজের নামের ফুল দেখে নিশ্চয়ই মেয়েটা চমকে উঠবে।
রুপার মত চঞ্চল মেয়ের পক্ষে আর কতক্ষনইবা চুপ থাকা সম্ভব!
ও কিছুক্ষন আমাকে ঘুরে ঘুরে দেখলো। তারপর গম্ভীর গলায় বললো, 'এ পাঞ্জাবী চলবেনা। আকাশী-নীল পড়তে হবে'
'কেন? এটাই তো ভালো।'
'বললাম তো চলবেনা। বৃষ্টির দিনে আকাশী রঙ পড়তে হয় জানোনা? আর প্যান্ট ওভাবে গুটিয়ে রেখেছো কেন? '
রুপার কথা শুনে আমি হাসি। ওর বিয়ে হয়েছে বছরখানেক হলো। অথচ এরইমধ্যে পাকা গিন্নিপনা চলে এসেছে ওর চাল চলনে। মেয়েরা পারেও বটে!
গ্রামের আধহাটু কাদার রাস্তায় নেমে এসে মনে হলো ফিরে যাই। কিন্তু মন বিদ্রোহ করলো।
প্যান্ট আরো কিছুটা গুটিয়ে যতটা সম্ভব কাদা এড়িয়ে হাটতে লাগলাম। একবার পকেট হাতড়িয়েও দেখলাম। ফুল গুলো জায়গামতই আছে।
রাস্তার যা অবস্থা তাতে মনে হচ্ছে একটা গরুর গাড়ি থাকলে বেশ মানিয়ে যেত। আজকাল অবশ্য গরুর গাড়ি খুব একটা পাওয়া যায়না। একটা সময় হয়তো একেবারেই উঠে যাবে।
এভাবে বুড়ো আংগুল চেপে চেপে হাটলে জুঁইফুলের স্কুলে পৌছাতে দুপুর হয়ে যাবে।
তারচেয়ে বরং মাটির রাস্তা ছেড়ে ধানিজমিতে নেমে যাওয়া ভালো। জমির আইল রাস্তার মত পিচ্ছিল হয়না। তবে বেশির ভাগই পানির নিচে। তবু রাস্তার চেয়ে ঢের ভালো।
কাকভেজা হয়ে যখন জুঁইফুলের স্কুলে পৌছালাম তখন স্কুলে সবেমাত্র ছুটির ঘন্টা পড়েছে। তুমুল বৃষ্টি উপেক্ষা করে স্কুলের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা পলিথিনে মোড়া বইখাতা নিয়ে দৌড়ে বেরিয়ে এলো স্কুল থেকে।
ভেজা ছাতা মাথায় ধরে রেখে বিহব্বল চোখে তাকিয়ে ভাবছি এখন উপায়? জুঁইফুল কি বেরিয়ে পড়েছে?
স্কুলের এক ছাত্রকে হাত ইশারায় ডেকে জুঁইফুলের কথা জিজ্ঞেস করলাম। ছেলেটি ঘাড় ঘুরিয়ে স্কুলের দিকে তাকিয়ে উজ্জ্বলমুখে হাত লম্বা করে দেখালো, 'আপা ঐ যে। ঐ যে নীল শাড়ি।'
আমি কানিবকের মত ঠাঁয় দাড়িয়ে জুঁইফুলকে দেখতে লাগলাম।
যতই দেখছি ততই বুঝতে পারছি সবাই মিলে আমাকে ঠকিয়েছে। সাথেসাথেই বাড়ির সবার প্রতি একটা বিশ্রী রকমের বিতৃষ্ণা জন্মালো।
তারপর নিজেকে দ্বিতীয় কোন ভাবনার সুযোগ না দিয়ে আমি নির্দয় হাতে ফুলগুলো রাস্তার প্যাক কাদার দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বাড়ির দিকে হাটতে লাগলাম।
|| জুঁইফুল ||
গত দুদিন ধরে বৃষ্টি পড়ছে তো পড়ছেই। মনে হচ্ছে আকাশে হাজারটা ফুটো হয়ে গলগল করে পানি বেরিয়ে এসে মনের আনন্দে আমাদের এই ছোট্ট গ্রামটাকে ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে।
বৃষ্টি বরাবরই আমার পছন্দ।
কিন্তু এবারের বৃষ্টিটা আমার জীবনে এক অন্য মাত্রা নিয়ে এসেছে। আর কয়েকদিনের মধ্যেই আমার জীবনের গন্ডিতে আরো একজনের অনুপ্রবেশ ঘটতে যাচ্ছে।
তাকে আমি চিনি না,কখনো সামনাসামনি দেখাও হয়নি তবু তার কথা ভেবে আমার কুমারী জীবনের নিঃসংগ দিন রাত্রি গুলো বেশ কেটে যাচ্ছে।
তার নাম শফিক।
তার একটা কালার ছবি আছে আমার কাছে। বইয়ের তাকের একেবারে উপরে রাখা রবি ঠাকুরের মালঞ্চের ভেতরের পৃষ্ঠার মধ্যে ছবিটা রেখেছি।
মাঝে মাঝে খুব গোপনে তাকে দেখি।
এত সুপুরুষ মানুষটা! আমার চোখ ঝলসে যায়।
শুনেছি মানুষটা খুব লাজুক কিন্তু ছবিতে সেটা বোঝা যায় না। চোখ মুখ সবই পুরুষালি গড়নে গড়া। অথচ তারমধ্যেও মানুষটার চোখে মুখে এক ধরনের অদ্ভুত ছেলেমানুষি আছে।
আজ মানুষটার আমাদের বাড়ি আসার কথা ছিলো। কিন্তু এই ছন্নছাড়া বৃষ্টির কারনে তারা আসতে পারবেনা জানিয়েছে। আজ তারা আসবে বলে স্কুল থেকে ছুটি নিয়ে রেখেছিলাম। এখন এতটা সময় কি করে যে পার করি!
জানালার শিক ধরে বৃষ্টি দেখতে দেখতে তাকে নিয়ে নানান কথা মনের মাঝে আড়মোড়া ভাঙে। আচ্ছা আমি কি মানুষটাকে ভালবেসে ফেলেছি? নিজের কাছে প্রশ্নটা করতে গিয়ে আচমকা আমার মাথায় কবিতার কয়েকটা লাইন ঘুরপাক খায়। সেইসাথে প্রশ্নের উত্তরও স্পষ্ট হয়ে যায়।
জানালার শিক গলিয়ে আমি গলে
যেতে থাকি,
তোমার গুটিয়ে রাখা ভেজা আস্তিনেই,
আমি ধরে রাখলে আজীবন, জেনে
গেছি
পাপ নেই, তাই শাস্তি নেই, শাস্তি
নেই।
উঠানের এক কোনায় লাগানো বেলিফুল গাছের গোড়ায় পানি থৈথৈ করছে। দোপাটি গুলো ডুবন্ত মানুষের মত মাথা উঁচিয়ে অসহায়ভাবে তাকিয়ে আছে।
প্রেমে পড়লে সত্যিই মানুষের মন কোমল হয়ে যায়। তাই হয়তো গাছগুলোর দিকে তাকিয়ে আমার মন আর্দ্র হয়ে ওঠে।
একটা কোদাল নিয়ে আমি নেমে যাই বৃষ্টি কাদার মধ্যে। ছোট্ট একটা নালা কেটে পানি নেমে যাওয়ার ব্যাবস্থা করতে হবে।
কচু পাতায় টপটপ করে বৃষ্টির পানি পড়ছে। কোন এক গাছের আড়াল থেকে একটা বেনেবৌ ডেকে উঠলো। মা রান্নাঘরে বসে আনাজপাতি কুটছে। উনুন থেকে আসা আধভেজা লাকড়ির ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়েছে উঠানময়। বড় চাচা তার ঘরের দাওয়ায় বসে একমনে জাল বুনে যাচ্ছেন। গোয়ালঘরের গরু দুটো জাবর কাটতে কাটতে নিষ্প্রাণ চোখ মেলে উঠানের দিকে চেয়ে আছে।
এসবই আমার আজন্ম চেনা ছবি।
তবু এ মুহূর্তে কাজ করতে করতে আমার হাত থেমে যায়। হঠাৎ করেই মনেহয় এই বাড়ি,এই উঠান কয়েকটা দিনের ব্যবধানেই আর আমার থাকবে না। একটা অজানা ব্যথায় বুক ধড়ফড় করে। চোখের কোনে প্রকৃতির প্রতি অভিমান জমে।
দুদিন পার হয়ে গেলো তবু বৃষ্টির লম্বা লম্বা সুতাগুলো একনাগাড়ে আকাশ থেকে নেমে আসছে। প্রকৃতির কাছে হয়তো অসীম ধৈর্যের পরীক্ষা দিয়ে যাচ্ছে। এতটুকুও অবসর নেই যেন!
বৃষ্টির কারনেই স্কুল একটু আগেভাগে ছুটি হয়ে গেলো।
স্কুলের ঘন্টা পরার সাথে সাথে আমি ছাতা হাতে মাঠে নেমে এলাম। ইশ শাড়ির পাড়টা একেবারে কাদায় মাখামাখি হয়ে গেছে। কেন যে বেছে বেছে আকাশী শাড়িটা পড়তে গেলাম! কাদার দাগ সহজে তোলা যায়না। বাড়ি ফিরেই ভালো করে ধুয়ে ফেলতে হবে।
শাড়ির কথা ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ চোখ গেলো রাস্তার পাশের শিরিষ গাছের দিকে।
গাছের নীচে পাঞ্জাবী পরা ছেলেটা কে দাঁড়িয়ে আছে ওখানে? এমন বাদলার দিনে মানুষ চলার উপরে থাকে,সেখানে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে ছেলেটি ওমন স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে কি দেখছে? আমাকে নয়তো?
সাথে সাথেই আমার সারা শরীর কাঁটা দিয়ে উঠলো।
ছবির মানুষটা এখানে কি করছে? আর ওভাবে ঘোর লাগা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে কেন?
আমার হাটার গতি নিজে থেকেই শ্লথ হয়ে আসলো। ছাতার আড়ালে নিজেকে লুকানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে আমিও আড় চোখে তাকে দেখি। ভারী লজ্জা লজ্জা লাগে আমার।
যখন মনে মনে ভাবছি কি কথা বলবো তারসাথে ঠিক তখনই দেখলাম পকেট হাতড়িয়ে সে কিছু সাদা ফুল বের করে রাস্তার প্যাক কাদায় ছুড়ে ফেলে দ্রুত হেঁটে গেল।
আচ্ছা আমার মাথাটা কি একটু ঘুরে উঠলো? নাকি এই বিশ্বসংসার আপনা থেকেই দুলে উঠলো?
একমুহূর্তেই সবকিছু এমন ঝাপসা হয়ে এলো কেন?
তারপর আর কিছু মনে নেই। আবছা মত শুধু মনে পড়ে আমার শরীরটা বৃষ্টিতে ভিজছে। বৃষ্টির ধারালো ফোটা গুলো আমার চোখ মুখ চিরে ফালি ফালি করে দিচ্ছে। বিষাক্ত যন্ত্রনায় আমি ছটফট করছি।
|| লেখক ||
প্রায় ত্রিশ বছর পরে দুধের ফেনার মত এক বৃষ্টি ঝরা বিকেলে শফিক সাহেব আর জুঁইফুল মুখোমুখি সোফায় বসে আছেন। প্রথম দেখায় শফিক সাহেব জুঁইফুলকে দেখে চমকে উঠলেও জুঁইফুলের মধ্যে পূর্বপরিচিতির কোন লক্ষন দেখা গেলোনা।
শফিক সাহেবের মেয়ে অবন্তীকে আজ ছেলে পক্ষ দেখতে এসেছে।
শফিক সাহেব গত এক সপ্তাহ ধরে খুব ছুটাছুটি করেছেন। কিভাবে আপ্যায়ন করবেন ছেলে পক্ষকে,মেয়ে কি শাড়ি পরবে,কতটুকু সাজবে এসব নিয়ে রাত দিন ভেবেছেন।
তার স্ত্রী অনন্যার রুচির উপর তিনি তেমন ভরসা করতে পারেননা।
প্রায় সময়ই তিনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবেন রুপ নামক পঁচা শামুকে পা দিয়ে তিনি ভুল করেছিলেন। মস্তবড় ভুল। ভুলই যদি না হবে তবে শুধু রুপের কারনে এমন স্থুল রুচিবোধের একটি মেয়েকে নিজের ঘাড়ে উঠাবেনই বা কেন?
আজ এত বছর পরে জুঁইফুলকে দেখে তিনি ভাবলেন একেই বলে সৌন্দর্য। শিক্ষা,বুদ্ধিমত্তা আর সুক্ষ্ণরুচিবোধের এক অদ্ভুত মিশেলে জ্বলজ্বল করছে জুঁইফুল। আজ থেকে ত্রিশ বছর আগে কি এমন রুপ তার চোখে পড়েছিলো?
কালো বলে জুঁইফুল কে তিনি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। শফিক সাহেবের তখন একবারের জন্যও মনে হয়নি এই আপাত সাদামাটা ব্যাপারটা একটা মেয়ের জন্য কতখানি মনকস্টের কারন হতে পারে।
কিন্তু এখন তিনি তার মেয়ে অবন্তীকে দেখে বুঝতে পারেন।
যতবার পাত্রপক্ষ জানিয়ে দেয়, 'মেয়ে আমাদের খুব পছন্দ হয়েছে,কিন্তু গায়ের রঙটা যদি ধরেন এই একটু শ্যামলার মধ্যেও পড়তো আরকি...বোঝেনই তো আজকালকার ছেলে.......' ততবার মেয়েটার ভেতরে বাদুড়ের ডানার মত নিরেট অন্ধকার নেমে এসে। মেয়েটা একটু একটু করে কুকড়ে যায়।
জুঁইফুল আর তার সুদর্শন ছেলের দিকে চায়ের কাপ এগিয়ে দিতে দিতে শফিক সাহেব ভাবলেন জুঁইফুল কি এখন তাকে দেখে মনে মনে বিজয়ীর হাসি হাসছে? জুঁইফুলের শান্ত দু'চোখ কি কৌতুকমাখা নয়?
শফিক সাহেবের নিজেকে খুব ছোট মনে হতে লাগলো। এমন একটা আঁটসাঁট পরিস্থিতিতে পরতে হবে জানলে তিনি এদেরকে না করে দিতেন।
কিন্তু তিনি কি আর জানতেন যে তার কলিগ জামিল সাহেবের স্ত্রী এই জুঁইফুল?
শফিক সাহেব চরম কিছু শোনার জন্য মনে মনে প্রস্তুত হলেন। সেই সংগে মনের গভীর থেকে তিনি এক ধরনের আগ্রহও বোধ করছেন।
আজ জুঁইফুলের পক্ষ থেকে আসা অপমানজনক কোন কথার মধ্য দিয়েই হয়তো ত্রিশ বছর আগে দেখা জুঁইফুল নামের মেয়েটির ফ্যাকাশে মুখ তার চোখের সামনে থেকে সরে যাবে। তিনি ভারমুক্ত হবেন।
খাওয়াদাওয়ার পর্ব শেষ হলে জুঁইফুল শফিক সাহেবের মেয়ে অবন্তীর অনামিকায় আংটি পরাতে পরাতে বললেন, 'আপনারা যদি অনুমতি দেন তাহলে আমি আজই বিয়ের দিনক্ষন পাকা করে যেতে চাই।'
একথাটার জন্য শফিক সাহেব একদমই প্রস্তুত ছিলেননা।
আকস্মিক বিস্ফোরণের মত তার সারা শরীরে এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা নেমে এল। তিনি কোন শব্দ উচ্চারণ করতে পারলেন না। শুধু তার অন্তরাত্মা ফিসফিস করে বললো, 'মুক্তি নেই,মুক্তি নেই।'
বিয়ের কথাবার্তা শেষ করে জুঁইফুল তার বড় ছেলে শফিক কে নিয়ে হাসিমুখে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলেন।
আজ তার বড় আনন্দের দিন। বড় সুখের দিন।
খুব বৃষ্টি হচ্ছে এই ইট কাঠ পাথরের শহরে। এই বয়সে বৃষ্টিতে ভেজা পোষায় না। তবু তিনি ছেলের হাত ধরে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে হাটতে লাগলেন।
তার চোখের কোণ থেকে একফোঁটা জল বেরিয়ে এসে বৃষ্টির সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেলো। হাটতে হাটতেই বহুকাল পরে জুঁইফুল আজ বৃষ্টি ভেজা বাতাসে ফুসফুস ভরে শ্বাস টেনে নিলেন। আহ!
লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা
ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য
প্রায় ত্রিশ বছর পরে তিনি হৃদয়ের সমস্ত দরজা জানালা খুলে দিয়ে বৃষ্টি ভেজা বাতাসে প্রাণভরে নিশ্বাস নিলেন.......
০৩ আগষ্ট - ২০১৮
গল্প/কবিতা:
১৫ টি
সমন্বিত স্কোর
৪.৯২
বিচারক স্কোরঃ ২.৫২ / ৭.০
পাঠক স্কোরঃ ২.৪ / ৩.০
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪