খাটের উপর মেয়েটির অজ্ঞান দেহের পাশে পড়ে থাকা ভাঙা চুড়ির লাল নীল কাঁচের টুকরায় বিদ্যুতের আলো লেগে ঝিকমিকিয়ে ওঠে।নিষ্পেষিত বিছানার চাদরের এলোমেলো ভাঁজে পুরনো শামিয়ানার স্থির ছায়া।একটানা ঝিঝি পোকার ডাক আর নিকষ কালো অমাবশ্যার রাত নির্জন বাড়িটাকে যেন পরম মমতায় আগলে রেখেছে।হাট করে খোলা দরজা দিয়ে আসা পৌষের হিম হিম বাতাস এসে ঝাপটা মারে মেয়েটির যন্ত্রনাকাতর মুখে।ধীরেধীরে জ্ঞান ফিরে পাওয়া মেয়েটির মুখ থেকে অস্ফুট কাতর ধ্বনি বেরিয়ে আসে, “বাবা!”
ঘন্টা দুই তিন আগের কথা।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে।শীতকালের বেলা ফুরিয়ে যায় দ্রুতই।মাগরিবের বেশ আগেভাগেই বাগানের ওপাশটা কেমন ঘোলাটে আর ছাইরঙা আলোতে ঝাপসা হয়ে ওঠে।গাঁ ঘেঁষাঘেঁষি করে ঠায় দাঁড়ানো আম কাঁঠালের বাগানটাকে কুয়াশায় মোড়া অশরীরী প্রেতাত্মা বলে মনে হয়।রান্নাঘরের ভাঙা পাটকাঠির বেড়ার ফাঁক দিয়ে ওদিকে চোখ পড়লেই গা ছম ছম করে ওঠে তিথির।কাল্পনিক বিপদের আশংকায় দোয়া দুরুদ পড়ে বুকে ফুঁ দেয়।বহুদিন পরে আজ শখ করে পরা লাল নীল কাঁচের চুড়ি ভরা ব্যস্তহাতে চুলার গনগনে আগুনের উপরে কড়াইয়ে ফুটন্ত ইলিশ মাছের তরকারিতে খুন্তি দিয়ে নাড়াচাড়া করে।ভাবখানা এমন যেন তরকারী নাড়াচাড়া করলেই ভয় দূর হয়ে যাবে।ন্যাপথেলিন এর গন্ধেভরা গায়ের মোটা চাদরটা আরো ভালভাবে জড়িয়ে নিয়ে নিম কাঠের পিড়িটা টেনে জ্বলন্ত উনুনের আরো কাছে এগিয়ে বসে।ছোটবেলা দাদির মুখে শুনেছে ভুতপ্রেত আগুন দেখলে এক লাফে দুচার গ্রাম পার হয়ে যায়,আর এমুখো হয়না কখনো।কথাটা কতটুকু সত্যি তা না জানলেও এমুহূর্তে মনে বেশ সাহস পায়।উনুনের মুখে লাকড়ি ঠেলে দিতে দিতে আগুনের গনগনে আঁচ এসে মুখে লাগে তবু ও পিড়ি পেতে ওখানেই ঠায় বসে থাকে।কেরোসিন তেলের বাতির মৃদু শিখা বেড়ার ফাঁক দিয়ে আসা উত্তরা হাওয়ায় কেঁপে কেঁপে ওঠে।
রাত নামার আগেই রাঁধাবাড়া শেষ করে হাড়ি পাতিল,দা বটি আর মশলার কৌটা রাখার ঝুড়িটা নিয়ে ঘরে উঠে দরজায় খিল দিতে হবে।আজকাল অবশ্য ছিঁচকে চোরের উৎপাত একেবারেই নেই তবু মায়ের কাছে শেখা অভ্যাস ছাড়তে পারেনা বলেই রান্না শেষে সবকিছু একে একে নিয়ে ঘরে তোলে। তিথির বাবা মজিদ ভুইঞা আজ তার দোকানের কাজে সদরে গিয়েছেন,ফিরতে রাত হবে।এই গ্রামের বাজারের সবচেয়ে বড় চালের দোকানটা মজিদ ভুইঞার।
বছর তিনেক আগে মা মারা যাওয়ার পর তিথি আর ওর বাবা এই দুটিমাত্র মানুষ নিয়ে ওদের নির্ঝঞ্ঝাট সংসার।একটি ভাই আছে তিথির,শহরে মোটামুটি গোছের চাকরী করে।বেশ কিছুদিন আগে ওখানকারই কোন এক মেয়েকে বিয়ে করেছে।এটা অবশ্য দ্বিতীয় বিয়ে।ঈদেরছুটি ছাড়া খুব একটা গ্রামে আসা হয়না তার।ফোনেই যা খবরাখবর পাওয়া যায় ভাইয়ের।এইচএসসি পাশ করে তিথি ও চেয়েছিলো ভাই এর কাছে শহরে গিয়ে কলেজে ভর্তি হতে কিন্তু মাঝবয়সী পিতার একাকিত্ব আর অসুবিধার কথা ভেবে আর যাওয়া হয়নি।বাড়ি থেকে কলেজের দুরত্ব খুব বেশি হওয়ায় পড়াশুনাটাও অসমাপ্ত থেকে গেছে।
একটা গ্যাসের চুলা আর গ্যাস সিলিন্ডার থাকলে বেশ হতো,তাহলে ঘরে বসেই রাতের রান্নাটা সেরে ফেলা যেত।আজকাল গ্রামের বেশিরভাগ স্বচ্ছল পরিবারেই মাটির চুলার পাশাপাশি থাকে এই প্রয়োজনীয় বাড়তি ব্যবস্থা।কিন্তু বাবা কানেই তোলেনা ওর কথা।এই রাত বিরাতে নির্জন বাড়িতে একলা বসে রান্নাবান্না করতে বড় ভয় লাগে তিথির।পাশের বাড়ি থেকে ক্লাস ফাইভে পড়া শিউলি প্রায়দিন ই সন্ধার পরে এসে তিথির কাছে বসে অংক কষে আর ইংরেজিটা পড়ে কিন্তু শিউলির দাদি হঠাৎ বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ায় আজ ওর আসার সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে।এতক্ষনেও যখন আসেনি তারমানে আজ আর আসবেইনা।আজকাল গ্রামের লোকজন ও বিনা কাজে কেউ কারো বাড়িতে প্রায় আসেই না।ঘরে ঘরে রঙিন টেলিভিশন হওয়াতে বিনোদনের অভাব একেবারেই নেই।অথচ সেই ছোটবেলায় দেখা যেত আশেপাশের দু চার ঘরের মেয়ে বৌয়েরা বিনা কাজেও মায়ের কাছে এসে কিছুক্ষণ বসতো,গৃহস্থালি টুকিটুকি কাজ ও করে দিত।প্রায়ই বিকেলের দিকে তিথির বাবা যখন দোকানে গিয়ে বসতো তখন দেখা যেত ওর মা এই রান্নাঘরের সামনে একটা পুরনো শীতলপাটি বিছিয়ে হাতের সেলাইয়ের হরেকরকম নকশা শিখিয়ে দিত তাদের।কিন্তু পদ্ম নকশা আর সূর্য নকশা মিলিয়ে করা মায়ের বিয়ের আগের নকশিকাঁথাটাই ছিলো তিথির সব থেকে পছন্দের।
বাড়িতে লোকজনের আসাটা তিথির বাবা একদমই পছন্দ করতো না।তবুও দেখা যেত গ্রাম সম্পর্কীয় বৃদ্ধা দাদীরাও লাঠিতে ভর দিয়ে ঠুকঠুক করে হেটে এসে বাড়িতে ঢোকার মুখেই হাঁক দিত, “অ বৌ”।তিথির মা তাদের জন্য গোপনে তার বাবার বাড়ি থেকে পান সুপুরি আনিয়ে রাখতেন কিন্তু তিথির বাবা জেনে ফেললে প্রলয়ংকারী কান্ড ঘটে যেত।পাড়া প্রতিবেশিদের সামনে কি বেইজ্জতিটাই না হতে হতো তখন।
প্রতিদিন দিনের আলো থাকতে থাকতেই রাতের রান্নাটা সেরে ফেলে ও কিন্তু আজ অবেলায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়াতে বাধ্য হয়েই এই অসময়ে রান্না বসাতে হয়।ঘুম ভেঙে তাড়াহুড়া করে উঠে দেখে বেলা যায় যায়।একে তো বাড়িতে আর কোন শরিকের বাস নেই তারউপর সবথেকে কাছের বাড়িটাও ঐ আম কাঁঠালের বাগানের ওপাশটায়।তাই বাড়িতে একা থাকলে সন্ধার পরে পারতপক্ষে বাইরে নামেনা।তারউপর এখন কৃষ্ণপক্ষের ঘোর অমাবস্যার রাত।সন্ধার পরেই চারদিক একেবারে ঘুটেঘুটে আঁধারে ছেঁয়ে যায়।
বাবাকে কতবার বলেছে দরজার বাইরে উঠানের উপর তার টেনে একটা বালব লাগাতে,পল্লি বিদ্যুৎের আলোয় কিছুটা হলেও তো রাতের আঁধার দূর হবে।একাকিত্ব আর ভয়ের মাত্রাটা কিছুটা হলেও তো কমবে।কিন্তু বাবা তো শোনেই নি উল্টো আরো ধমক দিয়ে বলেছে, “বসত বাড়িতে আবার ভয় কি?দোয়া কালাম পইড়া বুকে ফু দিয়া বাইরে নামলে দেখবি ভয়ডর কোথায় পলাইয়া যাইবো!”
আশেপাশের প্রায় সব বাড়িতেই বিদ্যুৎ এসেছে কিন্তু এই গ্রাম অঞ্চলে বিদ্যতের খুব দুরাবস্থা।এই আছে এই নেই এর লুকোচুরি খেলায় ক্লান্ত হয়ে তিথি বাবার কাছে সৌরবিদ্যুৎের জন্য আবেদন করেছিল।কিন্তু আবেদন বরাবরের মতই নামঞ্জুর।তাই সৌর বিদ্যুৎের আশা কে দুরাশা ভেবে ভাইয়ের কাছে আবদার করেছে একটা চার্জার লাইটের।ভাই ও কথা দিয়েছে সামনের ঈদেই বোনের চাওয়া পূরন করা হবে বলে। বিদ্যুৎ চলে গেলে এখন তাই সন্ধার পরে কেরোসিন ভরা দাদির আমলের এই টিমটিমে বাতিই তিথির একমাত্র ভরসা।দরকারি জিনিসের কথা বাবাকে বলতে বলতে একসময় ধৈর্যহারা হয়ে বলা ছেড়ে দিয়েছে আজকাল।একি কথা কত আর বলা যায়।আর তাছাড়া বাবার মুখে সেই ছোটবেলা থেকেই শুধু নাই নাই শুনে ইদানিং ও একেবারেই ত্যাক্ত বিরক্ত হয়ে গেছে।
বসত ভিটা,ধানিজমি আর বাজারের দোকান মিলিয়ে তিথির বাবার যে সম্পদ তাতে জীবনটা দিব্যি হেসেখেলে পার করে দেয়া যায়।পিতার একমাত্র সন্তান বলে সবকিছুই পেয়েছে উত্তারাধিকারসূত্রে,কিছুই তিথির বাবার কষ্ট করে উপার্জন করতে হয়নি।তিথির জানামতে যারা ছোটবেলা থেকে অভাবের মাঝে সংগ্রাম করে বেড়ে ওঠে তারা পরবর্তীতে খুব হিসেবি মানুষ বলে পরিচিতি পায় অথচ বাবা তো মেঘ না চাইতেই সমুদ্র পেয়েছে তবু কেন তার এ উৎকট স্বভাব? তাই তিথির মাঝেমাঝেই বিদ্রোহী হয়ে পিতার অবাধ্য হতে ইচ্ছে করে।কোন এক অজানা উপায়ে বাবার সমস্ত জমানো সম্পদ পুড়িয়ে ছারখার করে দিতে ইচ্ছে করে।কিন্তু না পেরে মনটা আরো তিক্ততায় ভরে যায়।
ব্যাংকে টাকার পাহাড় জমিয়েও লোক দেখানো অভাবের স্বভাব বাবার আজ পর্যন্ত গেলোনা।এত টাকা পয়সার মালিক হয়েও ছেলেমেয়েদের কলেজের বেতন কমাতে কি পরিমান নীচে নামতো বাবা ভাবলে আজও লজ্জায় মাথা নত হয়ে আসে ওর। অথচ মফস্বলের কলেজে আর ক'টাকাই বা বেতন।
ইদানিং তিথির মাঝেমাঝেই মনে হয় বাবা সুস্থ স্বাভাবিক তো? একটা মানুষ দিনের পর দিন সম্পদের পাহাড় গড়েও নিজের এমনকি সন্তানদেরও সুখ,আরাম আয়েশের কথা একটি বার ও না ভেবে কি করে পারে?তার কি ইচ্ছে করেনা একটু ভালো থাকতে,ভালো রাখতে?জাগতিক চাহিদা গুলোকে একটু সুন্দর ভাবে পূরন করতে?
নিজের মনকে বুঝ দেবার জন্য কখনো কখনো তিথি ভাবে এটা হয়তো বাবার খুব বাজে ধরনের কোন অসুখ।পৃথিবীতে কত রকম অদ্ভুত অসুখ ই তো থাকে মানুষের।এটাও ওই রকম কিছু একটা হবে হয়তো।
ইলিশ মাছের তরকারী হয়ে এসেছে।
মাছ কিনতে হয় বলেই কেনা।তাও আবার মাসে দু চার দিনের বেশিনা।আজকের মাছটা অবশ্য তিথির নানার পাঠানো।জামাইয়ের সংসারে মেয়ে বেঁচে না থাকলেও নাতনি আর জামাই এর জন্য প্রায়ই এটা সেটা পাঠান বৃদ্ধ নানা হোসেন আলি।
ঝকঝকে করে মাজা ছোট্ট পাতিল ভরা ভাত আর ভাতের মধ্যে দেয়া আলু সিদ্ধ আগেই ঘরে রেখে এসেছে।এখন মাছের তরকারীটা নিয়ে রান্নাঘরের দরজায় শেকল তুলে দিয়ে গেলেই হবে।হঠাৎ রান্নাঘরের পেছনের হাসনাহেনার ঝাড় থেকে আসা ফুলের তীব্র গন্ধের জোয়ার ছাপিয়েও সিগারেটের কেমন একটা কটু গন্ধ এসে নাকে লাগে ওর। বাবা কি তবে আগেভাগেই চলে এল?
শলার ঝাড়ুটা নিয়ে টিমটিমে বাতির স্বল্প আলোতে পেয়াজের খোসা ছড়ানো মাটির মেঝেটা ঝাড় দিতে দিতে কত কথা যে মনের আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়ায় ওর।মাঝেমাঝে রাগে দুঃখে ডাক ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করে।বিশেষ করে মায়ের মুখটা মনে পড়লে।দিনের পর দিন রোগে শোকে ভুগে বিনা চিকিৎসায় একপর্যায়ে জাগতিক সংসারের সাথে সমস্ত লেনাদেনাই চুকিয়ে ফেললো মা।তবু যদি বাবার একটু সুবুদ্ধি হত! অথচ তিথির জানামতে ওর বাবার মধ্যে অন্য কোন রকম বদঅভ্যাস নেই।গ্রামের কোন মানুষের সাথেও নেই পাছেও নেই তাই পরচর্চা,পরনিন্দাও নেই।এই একটিমাত্র দোষ ছাড়া নিপাট ভদ্রলোক ই বলা যায় তাকে।
এইতো গতবছর ওর ভাই তোফায়েলের সাথে পাশের গ্রামের পরী নামের এক মেয়ের বিয়ে হয়েছিলো। একটামাত্র ভাই তিথির।কত শখ আহ্লাদ করেছিলো ভাইয়ের বিয়ে নিয়ে কিন্তু শেষমেশ কিছুই হয়নি।না পেরেছে বৌয়ের জন্য মন ভরে কেনাকাটা করতে,না পেরেছে মানুষজন দাওয়াত দিতে।সে বার বাবার সাথে অভিমানে তিনদিন কথা বলাই বন্ধ রেখেছিলো।তবু ফলাফল বরাবরের মতই শূন্য।অবশ্য কাশেম আর পরীর বিয়েটা টেকেনি।বিয়ের মাত্র দুদিনের মাথায় শ্বশুরবাড়ি থেকে নতুন বৌ সবকিছু নিয়ে পালিয়েছিলো তার পুরাতন প্রেমিকের সংগে।বৌ পালাবার পরে তিথির বাবা তিথিকে ডেকে বলেছিলো, “দ্যাখ মা,তোর কথা শুইন্যা যদি বৌরে সোনার গয়নাগাটি দিতাম তাইলে তো এহন আম ও যাইতো ছালাও যাইতো।আল্লায় আমারে একদিক দিয়া হইলেও বাঁচাইয়া দিছে।এই জন্যই আমি বুইঝা শুইনা ট্যাহা পয়সা খরচ করি।” বাবার কথা শুনে তিথির গা জ্বলে গিয়েছিলো।ইচ্ছে হচ্চিলো মুখের উপরে বলে দেয়, “তুমি তো ট্যাহাই খরচ করোনা,তয় আবার বুইঝা শুইনা কি?” কিন্তু কিছুই বলা হয়না ওর।হাজার হোক জন্মদাতা পিতা তো।মনের কষ্ট মনের মধ্যে ফেলেই সাংসারিক টুকিটাকি হাজারটা কাজ মুখ বুঝে করে যায়।
তিথি আজপর্যন্ত ওর বাবাকে কখনো দেখেনি টাকা পয়সা দিয়ে কাউকে সাহায্য সহযোগীতা করতে।কারো বিপদে পাশে দাঁড়াতে। শত বিপদে পড়লেও যে মজিদ ভুইঞার কাছে আর্থিক সাহায্য পাওয়া যাবেনা তা গ্রামের কম বেশি সকলেরই জানা। তবু মাস দুই আগে ওপাড়া থেকে এক অল্পবয়সী হিন্দু বৌ এসে তিথির বাবার কাছে অনেক কাকুতিমিনতি করেছিলো।থানায় গিয়ে মাতব্বরের ছেলের নামে মামলা করার জন্য কিছু অর্থকড়ির প্রয়োজন তার।এমনকি থানায় যাবার মত প্রয়োজনীয় অর্থ ও তার কাছে ছিলনা।এই গ্রামের মাতব্বরের জোয়ান ছেলে মন্টু দিনে দুপুরে ঘরে ঢুকে বৌটার সর্বনাশ করে ধরা পড়ে ঐ বাড়িরই লোকজনের কাছে।পরে মাতব্বরের ডাকা সালিশে মন্টুকে নির্দোষ ঘোষণা করে দোষী সাব্যস্ত করা হয় নির্দোষীকেই।অতঃপর দুশ্চরিত্রা আখ্যা দিয়ে স্বামীও আর বাড়ি ফিরিয়ে নিতে অস্বিকৃতি জানায় তাকে। বৌটার কান্না দেখে তিথিও ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠেছিল কিন্তু ওর বাবা একটা পানের চার ভাগের এক ভাগ নিজের মুখে পুরে দিতে দিতে বরাবরের মতই অনড় হয়ে বসে বারবার একটা কথাই বলেছিল, “আমি নগদ ট্যাহা কই পামু?ট্যাহা পয়সা সব ব্যবসায় খাটাইয়া ফালাইছি আর তাছাড়া মামলা করলেই কি অর শাস্তি অইবো?মাঝখান দিয়া ট্যাহা গুলাও হারাইবা।থানার পুলিশ মামলা নিবো কিনা তারও তো কোন গেরান্টি নাই।”
হ্যা ঐ বৌটিও সেটা জানে।তবু মনকে বোঝাতে পারেনা।সব হারানো মানুষের তো আর হারাবার কিছু নেই।পুলিশের ঘরেও তো মা বোন আছে। একবার পায়ে ধরে পড়লে কি আর মন গলতো না তাদের! আর তাছাড়া টাকা নাকি রাত কে দিন করে দিতে পারে,এক্ষেত্রেও কি পারতো না!
তিথি ও বাবাকে বুঝিয়েছিলো যে টাকাটা তো চিরদিনের জন্য দিতে হবেনা,কিছু সময়ের জন্য ধার হিসেবে দেবে।বৌটা যেভাবেই পারুক পরে শোধ করেই তো দেবে কিন্তু ওর মিনতি পিতার পাষান হৃদয়ে এক বিন্দু চিড় ধরাতে পারেনি।পিতার কাছে অনুনয় করে বলেছিলো, “বাবা,একজন মানুষ হিসাবে তোমারই তো উচিত বৌদির লগে থানায় যাওয়া,আইজ যদি অর শাস্তি না অয় তাইলে কাইল যে আবার অন্যায় করবো না তার বা বিশ্বাস কি?” ওর বাবা রেগেমেগে বলেছিলো, “উচিত অনুচিতের তুই কি বুঝোস? তুই বুঝছসনি যে এক হাতে তালি বাজছে?”
বৌ টাকে শূণ্যহাতে বিদায় দিতে গিয়ে কষ্ট আর অপরাধবোধে বুক ভেংগে গিয়েছিলো ওর।কষ্টের পাশাপাশি প্রচন্ড রাগও হয়েছিলো সেদিন বাবার উপর।কিন্তু তীব্র ক্ষোভে শুধুমাত্র ট্রাংক থেকে বের করে দু তিনটা কাঁচের গ্লাস ভাঙা ছাড়া আর কিছুই করতে পারেনি। তাই মনে মনে শুধু সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশ্যে বিচার দিয়ে বলেছিলো, “খোদা! বাবারে তুমি এমন শাস্তি দ্যাও যেন তার কইলজা পুইড়া ছারখার হইয়া যায়!”
রান্নাঘরের সব কাজকর্ম শেষ করে আধখোলা দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকে দরজায় খিল দিতে দিতে কেমন গা শির শির করে ওঠে তিথির।মধ্য দুপুরে নির্জন পুকুরঘাটে একলা বসে হঠাৎ ঘুঘুর ডাক শুনে যেমন বুকের মধ্যে ধ্বক করে ওঠে অনেকটা সেরকম ভয় যেন অজগরের মত ওকে জাপ্টে ধরে।বদ্ধ ঘরের ভেতর এতটা ভয় লাগার কারন নিজেই বুঝতে পারেনা।একুশ বাইশ বছরের একটি মেয়ে ভুতের ভয়ে কাবু কথাটা ভেবে নিজের অজান্তেই একটু হেসে ফেলে আপনমনে মাথা নাড়িয়ে ভয়টাকে তাড়াতে চাইলো।গত তিনবছর ধরেই তো কত দিন রাত জেগে একা একা বাবার জন্য অপেক্ষা করেছে,কই আজকের মত এমন অদ্ভুত অনুভূতি তো কখনো হয়নি!আজকাল একা একা থাকতেই বরং তিথির বেশি ভালো লাগে।একা থাকলেই কত যে রঙিন সব কল্পনায় ভেসে বেড়ায় মন।পিতা নিশ্চিন্তমনে থাকলেও তিথি মাঝেমাঝেই নিজের বিয়ে নিয়ে কত কি ভাবে,সময়ে অসময়ে কাল্পনিক জীবনসংগীর সাথে ভালবাসার কাল্পনিক কথোপকথন নিশ্চিন্তমনে চালিয়ে যায়।
রান্না করা ইলিশের ঘ্রানে দুপুর থেকে অভুক্ত শরীরটা ক্ষুধায় চনমনিয়ে ওঠে ওর।আচ্ছা বাবাকে ছাড়াই আজ খেয়ে নিলে কেমন হয়! কত দিন পর আজ বাড়িতে ইলিশ এসেছে! কিন্তু পিতার জন্য রাত জেগে বসে থাকার পুরনো অভ্যাস ভেংগে ফেলতেও মন চাইছে না ওর।
বিদ্যুৎ আসার কোন ঠিক ঠিকানা নেই তাই হাতের কেরোসিন তেলের বাতিটা নেড়েচেড়ে দেখে নেয় তেল ভরা আছে কিনা।খাটের পাশের চাল ভরা টিনের বড় কৌটার উপর বাতিটা রাখতে রাখতে হঠাৎ পাশেই কাপড় ঝুলানো দড়ির ওপাশটাতে চোখ পড়াতে তীব্র আতংকে ওখানেই জমে যায় ও।মাতব্বরের ছেলে মন্টু আর তার সংগির লালসার হাসি ওর মাত্র তিন হাতের মধ্যে।
লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা
ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য
পৃথিবীতে কত বিচিত্র মানুষের বাস।কত বিচিত্র তাদের গতি পথ,চাওয়া পাওয়ার পথ।কেউ কেউ বহু ধনসম্পদের অধিকারী হয়েও দীনহীন জীবন যাপনে অভ্যস্ত।এটাই হয়তো তাদের ভাল থাকা,সুখে থাকার একমাত্র পথ।কিন্তু তারা হয়তো কোনদিন ও জানতেও পারেনা যে চেনা কিংবা অচেনা যাইহোক অন্যের প্রতি এগিয়ে দেয়া ছোট্ট একটা সাহায্যের হাত ও মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে উভয়ের জীবনের।
০৩ আগষ্ট - ২০১৮
গল্প/কবিতা:
১৫ টি
সমন্বিত স্কোর
৫.৪৩
বিচারক স্কোরঃ ৩.০৩ / ৭.০
পাঠক স্কোরঃ ২.৪ / ৩.০
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪