মৃত্যুর আগের দিন

পার্থিব (আগষ্ট ২০১৮)

পুলক আরাফাত
  • ৪৯
ঘুম থেকে সকাল সকাল উঠতে পারেনা নুয়াফা। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। নেট ঘেঁটে রাতজাগা, মোবাইল এ আড্ডাবাজি সব মিলিয়ে উঠতে উঠতে নুয়াফার সকাল নয়টা। তাও অ্যালার্ম ছাড়া উঠতে পারেনা। মা দু’বার ডেকে গেলেও কানে যায়না। যাকে বলে মহাব্যস্ত ঘুম। এই নামটাও তারই দেয়া। মা, সকালে আমার মহাব্যস্ত ঘুমে ডেকো না। তুমি ডাকলেও শুনিনা তো। বলেই একটা বিড়ালমার্কা হাসি দেবে। এই হাসির মানে হচ্ছে আদুরে হাসি। আচ্ছা বুঝলাম, যা তাড়াতাড়ি কর না। সাড়ে দশটায় ক্লাস। বাসা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে হওয়াতে নুয়াফার তাড়া নেই। চটজলদি দুটা পরোটা ডিম বা ভাজির সাথে গিলে হুটহাট ব্যাগটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। ক্লাস না থাকলে ঘুম এগারোটা পর্যন্ত গড়ায়।

মাঝারি গড়নের নুয়াফা চলে দুলে দুলে, যেন মঙ্গল গ্রহে হাঁটছে। ইনফর্মেশন এন্ড কমিউনিকেশন সায়েন্স নিয়ে স্নাতক পড়ছে ইস্ট ওয়েস্ট এ। খুব কৌতূহলী স্বভাবের দেখলেই বুঝা যায়। প্রচণ্ড আমুদে আর অনেক মেধাবী। তবে ভেতরে যে একটা চাপা দুঃখ আছে কাউকেই বুঝতে দেয় না। ছোটভাই নহর পড়ে ক্লাস নাইনে মাইলস্টোন স্কুলে। দু’ভাইবোন আর মা এই নিয়েই সংসার।

নুয়াফার বাসায় আসতে আসতে সেই দুপুর গড়িয়ে বিকেল। ওদের দুটো ইন্ডাস্ট্রি আছে। মা সায়রা হোসেনকেই সব সামলাতে হয়। মাঝে মাঝে নুয়াফাও অফিসে যায়। ইমেইলের ধরণ বুঝে কতগুলোর উত্তর দিয়ে আসে। সন্ধ্যের পর নিজের পড়া নিয়ে খানিক ব্যস্ত হয়ে পড়ে। নহর টিউশান থেকে বাসায় আসে রাত আটটায়। এসে কিছুক্ষণ স্টারস্পোর্টস চ্যানেল দেখে। তারপর নিজের রুমে চলে যায় পড়তে। দশটার পর আর পড়েনা। এর মাঝেই হয়ে যায়। খাওয়া-দাওয়া শেষ করেই বিছানায় ঝাঁপ। মহাব্যস্ত ঘুমের আগে নেটের জ্যামে বন্দী থাকা। এই হল জীবনযাপন।

নুয়াফা, বেশিক্ষণ রাত জাগলে কি হয় জানতো। শরীরের দরকারি ফ্যাট কমে যায়। শরীরও মলিন হয়ে পড়ে। সেদিন পত্রিকায় পড়লাম, বুঝলে? নুয়াফার মা বিশেষ কিছু বুঝালে তাঁর সন্তানদের তুমি করে বলেন। মা, আচ্ছা তুমি আপনি করে ডেকে অন্য আর কিছু বল। শুনি, তোমার মুখে আপনি ডাকলে কেমন শোনায়। পাকনামো বাদ দিয়ে যাও গিয়ে শাওয়ার নাও। মাথা ঘুরিয়ে ঘাড়েও শাওয়ার নিও। ব্লাড প্রেসার ঠিক থাকবে। বলতে হবেনা মা, মনে আছে।

ছেলেকে এত কিছুই বলতে হয়না সায়রা হোসেনের। কারণ, আপুকে যা বলা হয় সেও এগুলো মনে রেখে চলে। স্কুল থেকে এসে বিকেলে এক ঘণ্টার মতো ক্রিকেট খেলে। বাড়ির দারোয়ানকে বল করতে বলে আর নহর ব্যাটিং করে। তবে দারোয়ান এক ওভারের বেশি ব্যাটিং করতে পারেনা। উল্টাপাল্টা মেরে আউট হয়ে যায়। ফাঁকা ইনিংস ধরে বোলিং করতে হয় বেচারার।

নুয়াফার রুমে দেয়ালে টানানো কোন ছবি নেই। রুমটা আকাশী রঙের ইলিউশান করা। জাফর ইকবালের সায়েন্স ফিকশান পড়তে খুব ভালো লাগে ওর। পড়তে গেলে কোথায় যেন হারিয়ে যায় সে। নেটে সর্বশেষ প্রযুক্তি খুঁজে প্রায় প্রতিদিন।

নুয়াফাদের অফিসে একটা রুম আছে তালাবন্ধ করা। ও মাঝে বেশ কয়েকবার লক্ষ্য করেছে। মাকে জিজ্ঞেস করবে করবে করে আর করা হয়নি। তবে ভুলেনি। আজ এই রুমটায় সে ঢুকবে বলে মনস্থির করলো। বিকেলে বেশ কিছু মেইলের উত্তর দিতে হবে। তাই ভার্সিটি থেকে সোজা চলে গেলো অফিসে। অফিস রুমটা বেশ চওড়া, খোলামেলা। নুয়াফা অফিসে গেলে জানালা খুলে রাখে। এসি বন্ধ রাখে। মা’র কাছে ব্যবসার টুকিটাকি শিখেছে। তবে একটা ব্যাপার হল অফিস রুমে ওর বাবার কোন ছবি নেই। বছর কয়েক আগে ওর বাবা মারা যায়। আগে এটা নিয়ে কখনো ভাবেনি। আজ ভাবছে। কেন ভাবছে বুঝতে পারছেনা।

রুমটার তালা খোলা হল। ভেতরে ভ্যাঁপসা গন্ধ। মনে হল অনেক দিন হয় কেউ ভেতরে ঢুকেনি। কিছু পুরনো আসবাব আর দরকার নেই এমন কিছু জিনিস ছাড়া তেমন কিছুই নেই। রুমটা তেমন বড় নয়। ডান দিকে এগিয়ে দেখে একটা কাপড় দিয়ে কি যেন ঢাকা। বয়স্ক পিয়ন লতিফ আলীকে কাপড়টা সরাতে বলল নুয়াফা। ধুলোয় ভরা। একী, এটাতো তার বাবার ছবি। ছবিটা এখানে এভাবে কেন রাখা এটাই বুঝতে পারলনা। এ ছবিটা থাকার কথা মা’র ডেস্কের সামনে। যিনি সব গড়ে গেলেন তাঁর স্মৃতির এই দশা? বাসায় গিয়ে একই ছবি ল্যাপটপে আছে কিনা খুঁজতে লাগলো।

ছবি পাওয়া গেলো। ল্যাব থেকে বড় করে বাঁধাই করে আনতে পাঠালো নুয়াফা। সায়রা হোসেনকে কিছুই জানতে দিলোনা। সায়রা হোসেন পরের দিন অফিসে গিয়ে হঠাৎ দেখেন মৃত স্বামীর ছবি। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলেন।

ছবিটি সরিয়ে রাখার বিশেষ কারণ আছে। সায়রা হোসেন একটু ব্যাতিক্রম ধরনের মানুষ। যেদিন নহরের বাবা চট্রগ্রাম যেতে গিয়ে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান, দাফন শেষে তিনি ছবিটা আর চোখের সামনে রাখেননি। ধারণা করা হয় ব্যবসায়িক প্রতিপক্ষরা ইচ্ছেবশত দুর্ঘটনা ঘটিয়েছিল গাড়ি লক্ষ্য করে। পুলিশি তদন্তে পরে আর অগ্রগতি হয়নি। স্ত্রী হিসেবেও আর আগাননি সায়রা হোসেন। ঝামেলা বাড়তে পারে ভেবে ব্যবসা ধরে রাখায় মন দেন।

আজ চোখের সামনে প্রিয় মানুষের ছবিটি দেখে চোখে কখন যে পানি চলে এসেছে টেরই পাননি। কে করতে পারে কাজটা? ভাবছেন তিনি। পিয়ন লতিফ আলীকে ডাকলেন সায়রা হোসেন। লতিফ চাচা ছবিটা এখানে আবার টাঙিয়েছে কে? জী, ছোট ম্যাডাম। আচ্ছা আপনি যান।

বাসায় ফিরে বিছানায় কিছুক্ষণ শুয়ে বিশ্রাম নিলেন। তারপর পারিবারিক অ্যালবাম বের করে পুরনো ছবিগুলো দেখতে লাগলেন। মেয়েকে ডাকলেন। ছেলেটা ছোট। অনেক দায়িত্ব এখনো তাঁর কাঁধে।

তোমার বাবা শেষ কবে তোমার সাথে কথা বলেছিল মনে আছে নুয়াফা? মনে আছে মা। মৃত্যুর আগের দিন। চোখ দিয়ে টলটল করে পানি ঝরছে নুয়াফার। আমি এটাই চেয়েছিলাম। সন্তান হিসেবে তুমি সঠিক কাজটি করেছো। আমি ইচ্ছে করেই ছবিটা পুরনো ঘরে রেখে দিয়েছিলাম। যেটা করলে সন্তান হিসেবে সত্যিই তুমি তোমার বাবাকে ভালোবাসো কিনা এর পরীক্ষায় বিজয়ী তুমি। যে ব্যাথাটা সারাজীবন বুকে বয়ে চলতে হবে, তা চোখের সামনে সবসময় না থাকুক। যখনি তোমার বাবাকে মনে পড়ে পুরনো অ্যালবাম বের করে দেখি। তোমাকে ধন্যবাদ নুয়াফা।

নুয়াফা চোখ মুছে রুম থেকে বের হয়ে যাচ্ছিলো। মা’র ডাক শুনে পেছন ফিরল। ছবিটা ডেস্কের সামনে নয়, মাথার পেছনে রাখতে বল নুয়াফা। যে চেয়ারটায় আমি বসি, বসার আগে যেন দেখতে পাই।


নুয়াফা নিজের রুমে চলে গেলো। বাতি নিভিয়ে হালকা নীল আলোর ডিমলাইট জ্বালিয়ে দিলো। রাতে না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়লো মেয়েটা। সায়রা হোসেন ডাক দিয়ে বিরক্ত করলেন না। ঘুমের মাঝে নুয়াফা ঠিক সব মনে করতে পারছে। স্বপ্নে নুয়াফা শুনতে পাচ্ছে শেষবার তার বাবা তাকে যা বলেছিল। মা, তোমার জন্য চট্টগ্রাম থেকে কি আনবো বল? বড় বড় মোমবাতি আনবে বাবা। লাল, সবুজ, গাঢ় নীল, আর বেগুনী রঙের মোমবাতি। মানিক সাহেব অবাক হয়ে হাসলেন।

পরের দিন সন্ধ্যাবেলা বিদ্যুৎ চলে যায়। বাইরে তুমুল ঝড়। ইমেইলের উত্তর দিতে দিতে কখন সন্ধ্যে হয়ে গেছে টের পায়নি নুয়াফা। গতকাল রাতের স্বপ্নের কথা মনে হল। জেনারেটর না চালিয়ে সেই মোমবাতিগুলো জ্বালালো সে। মোমবাতির আলোয় ছবিটা ঝিলমিল করছে। নুয়াফা তার বাবার ছবিটার দিকে মোমবাতির আলোর উপর দিয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।

আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মাইনুল ইসলাম আলিফ গল্প লেখার হাত ভাল।সুন্দর গল্প।শুভ কামনা আর ভোট রইলাসবেন আমার ছোট গল্প আর কবিতা পড়তে।আমন্ত্রণ রইল।
মোঃ মোখলেছুর রহমান আধুনিক সরঞ্জামের সমারোহে একটি ভাল গল্প।

লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য

গল্পটিতে মনের গভীর আবেগকে তুলে ধরা হয়েছে ভিন্নভাবে। এই পৃথিবীতে আবেগের রঙ অনেক। জীবনে অদ্ভুত কিছু অনুভূতি আছে যা মানুষ সবসময় টের পায়না। বিশেষ মুহূর্তে এই অনুভূতিগুলো বিশেষভাবে জেগে উঠে। ভালোবাসা বহুমাত্রিক। ভালোবাসা বিপ্রতীপ কোণের মতো। বুকের গভীরে কিছু ভালোবাসা লুকিয়ে ছিন্ন হয়ে কাঁদে। এই কান্না কারো চোখে পড়ার কথা না। পার্থিব দুঃখ আর যন্ত্রণা এক হয়ে যায় যদি মনের তিক্ততায় কেউ ভারী নিঃশ্বাস ফেলে। আর তা দূর হয়ে যায় যদি কেঁদেকেটে একদিন চোখ দুটি শ্রান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।

২৪ জুলাই - ২০১৮ গল্প/কবিতা: ২২ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪