মুখচোরা

লাজ (জুন ২০১৮)

ফারহানা বহ্নি শিখা
  • ১০
  • ১১২
রানু খুব কষ্ট পাচ্ছে হসপিটালে। আসার সময় আমার হাত খুব শক্ত করে ধরে রেখেছিলো। তার মুখচ্ছবি, চোখ বলছিলো,
প্লিজ যেওনা,আমার পাশে আজ থাকো।


কিন্তু তা সম্ভব নয়। মা বলে দিয়েছেন,
তুই পুরুষ মানুষ এখানে থেকে কি করবি? ডাক্তার, নার্সরা তো বারবার টহল দিয়ে যাচ্ছে৷ আর আসল ব্যথা উঠতে দেরি আছে। যা, সকালে তাড়াতাড়ি আসিস। বাচ্চা হতে কাল দুপুরও হতে পারে।

হুম, বাচ্চা। আমাদের প্রথম সন্তান! খুব খুশি লাগছে আমার, আবার কষ্টও লাগছে রানু'র জন্য। বেচারী কষ্ট পাচ্ছে।
সকাল থেকে রানু মুখ কালো করে ঘোরাঘুরি করছিলো। মাঝেমাঝেই তার এমন খারাপ লাগছে, তাই অতো মনোযোগ দিইনি, অফিস চলে গিয়েছিলাম। বাসায় আসতে আসতে সন্ধ্যা, খুব বেশি ট্রাফিক। এসেই দেখি ও বিছানায় ছটফট করছে। মাকে জানালাম, মা বলল,
হসপিটাল নিয়ে যেতে হবে, জলদি গাড়ি নিয়ে আয়।

আমি বাসায় চলে আসলাম, রানুকে মায়ের সাথে রেখে। কিন্তু ঘুম আসছেনা। এপাশ ওপাশ করছি, এতো বড় খালি বিছানায় কোনোভাবে ঘুম আসছেনা৷ রানু প্রতি রাতে খুবই সংকোচের সাথে তার এক পা আমার পায়ের উপর দিয়ে বলতো,
আপনার কি কষ্ট হচ্ছে? নামিয়ে ফেলবো? 
আমি বলতাম,
না, ঠিক আছে।
আসলে কোনোভাবে রেখে আরাম পাচ্ছিনা। রানু লজ্জিত স্বরে বলতো।
ঠিক আছে, রাখো, সমস্যা নেই।
আপনার ভারী লাগলে বলবেন।
হুম৷
ঘুমিয়ে পড়েছেন?
না, কিছু বলবে?
না।

রানু আরো কিছু হয়তো বলতো । আমার নির্লিপ্ততা হয়তো ওকে থামিয়ে দিতো। আমি খুব ভালো বক্তা নই, দুই এক কথার পর কি বলবো বুঝতে পারিনা। চুপচাপই থাকি বেশি। কিন্তু রানু কথা বলতে পছন্দ করে, বুঝতে পারি৷ মাঝেমধ্যে আমার থেকে লুকিয়ে কিসব লিখতো ও।

ওর লেখার কথা মনে পড়ায় উঠে বাতি জ্বালালাম। রাতে ভালো খাওয়া হয়নি, খিদেও লেগেছে প্রচুর। রানু'র জন্য রাখা বিস্কুট আছে, মাত্র ক'দিন আগেই এনেছি। খিদেয় কষ্ট পেতো। মুখ ফুটে বলেওনি কোনদিন, লজ্জা লাগতো মনে হয়। ভাবি, আমার স্বভাবের কারণেই, ও অতো বেশি সহজ হতে পারেনা আমার সাথে।

ক'দিন আগে বারবার উঠছে বসছে, লাইট জ্বালায়, পানিও খেয়ে আসলো নাকি জানালো।
এমন করছো কেন? ঘুম আসছেনা? খারাপ লাগছে? মাকে ডাকবো?
না, না৷
তাহলে?
খিদে লেগেছে।
কিছু খেয়ে আসো৷
লজ্জা করছে, পানি খেয়েছি।
লজ্জা কিসের?
প্রতিদিন খিদে লাগে এখন।


পরদিন আমি টিনসহ বিস্কুট পাওয়া যায়, তা এনে রাখলাম আলমারির উপর, কিছু বললাম না।

অর্ধরাতে উঠে দেখি, বসে বসে বিস্কুট খাচ্ছে৷ আহারে বেচারি, কতদিন ধরে যে খিদেয় কষ্ট পাচ্ছিলো!
আমাকে জাগতে দেখে সে হেসে বলে,
থ্যাংকইউ।
আমি একটু মুচকি হেসে পাশ ফিরে শুলাম।


এখন উঠে আমিও বিস্কুট খেতে নিলাম, রানু'র কথা মনে পড়লো আবার। ওরও কি খিদে লাগেনি!? মায়ের সামনে খেতে বেচারির নিশ্চয় লজ্জা লাগবে। ফোন করবো নাকি, জিজ্ঞেস করবো?

না, থাক, আমারও লজ্জা করছে।


ড্রয়ার খুলে দেখলাম, একটা ডাইরি। প্রথম পৃষ্ঠা উল্টাতেই লেখা,

প্রিয় বান্ধবী রানু'র শুভ বিবাহে আমার ক্ষুদ্র উপহার,

শুভেচ্ছাসহ ভালোবাসায়,
সাবিহা।

তারপর রানু'র হাতের লেখা। প্রায় সব লেখায় আমাকে ঘিরে। তার আগে তার প্রিয় সব জিনিসের তালিকা, একেবারে ধাপে ধাপে রচনাকারে লেখা।

প্রিয় ফুল: টকটকে লাল গোলাপ
প্রিয় পাখি: হলদে পাখি
প্রিয় ফল: আম
প্রিয় রঙ: লাল
প্রিয় লেখক: হুমায়ূন আহমেদ
প্রিয় কবি: জীবনানন্দ দাশ, পুর্নেন্দু পত্রী
একদম শেষে লেখা,
প্রিয় মানুষ:কবির৷ অর্থাৎ, আমি!?

কিভাবে!? আমার মতো রস কষহীণ মানুষ কিভাবে তার প্রিয় মানুষের জায়গা দখল করে নিতে পারে!? আমিতো ঠিকমতো নিজের আবেগ অনুভূতিও প্রকাশ করতে পারিনা। সবকিছুতেই আমার সংকোচ, কি এক লজ্জা বাধা হয়ে এসে দাঁড়ায়।

তারপর শুরু করলাম রানু'র ডাইরি পড়া। যদিও জানি না বলে ডাইরি পড়া উচিৎ হচ্ছেনা। কিন্তু লোভ সামলাতে পারছিনা কিছুতেই। ঘুমও আসছেনা। সে লিখেছে-


"মানুষটা এতো মুখচোরা কেনো? খুব ইচ্ছে করে সময়ে অসময়ে তাকে একটু জড়িয়ে ধরি। বিশেষ করে তার ছুটির দিনে, বৃষ্টির দুপুরে, কখনো ঠাণ্ডা বিকেলে ছাদে।


আর এখন রাতে। শরীর ভারি হওয়ায় কখনোই আরাম করে শুতে পারিনা, কখনো তার গায়ের উপর পা তুলে দিই। ভয়ও করে, সংকোচও, সে কিছু ভাব্বে নাতো!

জিজ্ঞেস করলে, ঠিক আছে বলে। কিন্তু বলে না যে,
ইচ্ছে হলে ভালোভাবে জড়িয়ে ধরো কিংবা দুই পা তুলে দাও। 
কখনো সেও তো জড়িয়ে ধরতে পারে, তা না!

সে যখন কাজে চলে যেতে বের হয়, ইচ্ছে করে বলি, আমার কপালে একটা চুমু দিয়ে যাও৷ নয়তো বলি, এদিকে এসো, তোমার কপালে একটা চুমু খাই, একটু নিচু হওতো..., বলা হয়না। তার গাম্ভীর্য, আমাকে বাধা দেয়।

কখনো ইচ্ছে করে তার হাতটি ধরে ছাদে হাঁটি, শ্বাশুড়ীমা তো সারাক্ষণ আমাদের পাহাড়া দিয়ে নেই, তিনি তো সন্ধ্যায় তার রুমেই বেশি শুয়ে বসে থাকেন।

আজকাল একটু বেশিই খুব করে কাছে পেতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছে করে, সারাক্ষণ সে ফোন করে জানতে চাইবে, আমার কেমন লাগছে, কিছু খেতে মন চাইছে কিনা।

রাতে ইচ্ছে করে, আমার বাবুসোনাটা পেটে কেমন সুন্দর নড়াচড়া করছে, সে তা হাত দিয়ে বারবার দেখুক। পেটে কান টেকিয়ে শুনোক, বাবু কি বলছে, লজ্জায় কিছু বলা হয়না তাকে।

কিন্তু, সেদিন লজ্জার মাথা খেয়ে তাকে খিদে লাগার কথা বলে ফেললাম। সকালে দেখি সে বিস্কুট এনে রেখে দিলো আমার জন্য, কি যে ভালো লেগেছে!

ওকে খুব তুমি করে বলতে ইচ্ছে করে। নিজে থেকে একবারো বলছেনা কেনো, "বছর পেরিয়ে গেলো, আর কতো আপনি আপনি করবে?"

আপনি সম্বোধন কেমন পর পর লাগে আমার!

এরপরও, অপেক্ষায় বসে থাকি, কখন তার ছুটি হবে, কখন বাসায় এসে কলিংবেল দেবে, আর আমি দৌঁড়ে দরজা খুলে দিবো।

দরজা খুলার সাথে সাথে ইদানীং, সে প্রতিদিনই আমার দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকায়, যেন জানতে চায়, সব ঠিক আছে তো? তুমি ভালো আছো?
আমার ঠোঁটের কোণে তখন বিশ্বজয়ী হাসি।


আমার খুব ভালো লাগে তার এই চাহনি৷ সারাদিনের ক্লান্তি, অসুস্থতা নিমিষেই শেষ হয়ে যায়, আমি প্রাণবন্ত হয়ে পড়ি। তখন ভাবি, সব কথা মুখে না বললেও চলে!

কিন্তু ক'দিন ধরে দু:স্বপ্ন দেখছি বারবার। মনে হচ্ছে মরে যাবো। কিন্তু মরতে ইচ্ছে করছেনা৷ আমার সোনা বাবুকে কি আমার দেখা হবেনা! কবিরের সাথে কল্পনা করা ইচ্ছেগুলো কি পুরণ করতে পারবোনা?"


আর কিছু লেখা নেই, এসব লেখাও একসাথে নয়, একেকদিন কিছু কিছু করে লেখা। হঠাৎ রানু'র জন্য বুকে খুব কষ্ট হতে লাগলো। ঘড়ি দেখলাম, একটা বাজে, এমন কিছু রাত নয়।


রাতে কিছু রিক্সা পাওয়া যায়, ডাবল ভাড়া দিয়ে হসপিটালের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। প্রতিমধ্যে একটা ফুলের দোকান থেকে তাজা টকটকে লাল গোলাপ ফুল নিলাম ক'টা। অনেক কষ্ট করে কৈফিয়ত দিয়ে ঢুকলাম হসপিটালে। দেখি রানু তখনো জেগে, তার ব্যথা নাকি বাড়ছে কমছে।


আমাকে দেখে তার চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে গেলো, কষ্টের পরিবর্তে সেখানে হাজারো সুখ খেলা করছে। এখন না আসলে তার এই সুন্দর স্বর্গীয় মুখ, আমার কখনোই দেখা হতো না।


মা ঘুমিয়ে পড়েছিলেন, জেগে উঠতেই বললেন,
কিরে বাবু তো এখনো আসেনি, ফুল কেনো!

আমি আবারো লজ্জা পেয়ে মুখ নিচু করে বসে রইলাম। আর ভাবছি, মনে মনে নিশ্চয় রানু ডাইরিতে লিখবে, "অবশেষে মুখচোরা মানুষটা মানুষ হলো!"
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
ওয়াহিদ মামুন লাভলু ডাইরিতে লেখা রানুর কামনাগুলো সত্যিই খুবই ভালো লাগার মতো। --- ডাইরিটা পড়ে খুব ভালো হয়েছে, রানুর ইচ্ছাগুলো জেনে নিয়ে সে অনুযায়ী সংশোধন করার সুযোগ পেল। খুব ভাল লাগল। আমার শ্রদ্ধা গ্রহণ করবেন।
বিশ্বরঞ্জন দত্তগুপ্ত সুন্দর লেখাটি পড়ে খুব ভাল লাগল । ভাল থাকবেন । ভোট আর অনেক শুভকামনা ।
সেলিনা ইসলাম চমৎকার থিম! গল্প মনে হল বেশ দ্রুত বলা হয়েছে। সব মিলিয়ে ভালো লাগল। ভালো লাগলো "মুখচোরা" শব্দটা যে লজ্জা শব্দের সমার্থক তা সুন্দরভাবে উঠে এসেছে। এই কথাটা বলে রীতিমত কঠিন মন্তব্য শুনতে হয়েছে আমার এবারের গল্পে! আরও লিখুন আপু সেই প্রত্যাশায় শুভকামনা।
অসংখ্য ধন্যবাদ। আপনার গল্প তো পড়তেই হবে, তবে।
মোঃ নুরেআলম সিদ্দিকী আপনার গল্পে সবসময় আলাদা এক ধরণের ভাব ও লেখার গভীরতা থাকে যা সহজে পাঠকের মন কেড়ে নেই। তবে এবারের গল্প একেবারে সাদাসিধে এবং সহজ সরল কাহিনী তুলে এনেছেন, অনেক ভালো লাগলো। অনেক শুভকামনা ও শুভেচ্ছা রইল। ভালো থাকুন....
মৌরি হক দোলা অনেক অনেক ভালোলাগা ও শুভকামনা রইল.....
মোঃ মোখলেছুর রহমান হঠাৎ বৃষ্টির মত গল্পের শুরু চমৎকার,ভাষার সাবলিল গতি সবকিছু মিলে ভাল একটি গল্প।ভোট রইল,সেই সাথে আমার কবিতা পড়ার আমন্ত্রন রইল।
Fahmida Bari Bipu বেশ ভালো লাগলো গল্পটা। ভোট রইলো।
আপনি ভালো লেগেছে বলেছেন, তাহলে মনে হচ্ছে, খারাপ হয়নি।অসংখ্য ধন্যবাদ আপু।
ফারহানা বহ্নি শিখা অসংখ্য ধন্যবাদ। জ্বি, অবশ্যই।
%3C%21-- %3C%21-- ভাল লাগল। ভোট রেখে গেলাম। শুভকামনা রইল। সময় পেলে আমার লেখাটি পড়ে দেখবেন। ধন্যবাদ।
মাইনুল ইসলাম আলিফ চমৎকার গল্প।শুভ কামনা আর ভোট রইল।আসবেন আপু আমার পাতায়।
ধন্যবাদ। অবশ্যই ঘুরে আসবো।

লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য

এই গল্পে একজোড়া দম্পতি'র কাহিনী বলেছি, যারা লজ্জা সংকোচের কারণে তাদের নিত্যদিনের ছোটখাটো চাওয়া পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। অথচ মনেমনে তা তীব্রভাবে চায় এবং শেষ পর্যন্ত তাদের চাওয়া পূর্ণতা পায়।

১৭ জানুয়ারী - ২০১৮ গল্প/কবিতা: ১০ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "সংসার”
কবিতার বিষয় "সংসার”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ এপ্রিল,২০২৫