গ্রীষ্মে দখিনা হাওয়া

লাজ (জুন ২০১৮)

আসাদুজ্জামান খান
  • ১৭
(১)

রোদটা আজ একেবারে তাঁতিয়ে দিয়েছে চারদিক। সেরকমই অবশ্য হবার কথা। জৈষ্ঠের মাঝামাঝি সময়। ভরদুপুর। খোলা নৌকায় বসে শাহানা বিরক্ত। খেয়া কখন ছাড়বে বুঝতে পারছেনা। একে প্রচন্ড গরম, তার উপর আবার খুব ক্ষুধা লেগেছে। সেই সাত সকালে সে বেড়িয়েছে একটা বিস্কুট আর এক গ্লাস পানি খেয়ে। উপজেলা শহরের নতুন এক কিন্ডারগার্টেনে সে চাকুরী করে মাস দুয়েক ধরে। এরা বেতন দেয় নাম-কা-ওয়াস্তে। চাকুরীটা নেয়া শুধু অভিজ্ঞতার জন্য। এইচ এস সি পরীক্ষার পরে একেবারে বসে না থেকে এখানে ঢুকেছিল। মা প্রথমে রাজি হয়নি তার কষ্টের কথা ভেবে। শাহানা বুঝিয়েছিল এতে অভিজ্ঞতাও হবে, আর সামান্য কিছু টাকা হলেও তো আসবে! অভাবের সংসারে তাই বা কম কি! তার অবশ্য দু'টা টিউশনি আছে আর কয়েকজন ছোটছোট ছেলেমেয়েকে সে ব্যাচে পড়ায়। আপাতত এই দিয়ে তাদের সংসার চলে। কিছু জমিজমা তাদের আছে। তবে বর্গাচাষে সেখান থেকে যা আসে তা দিয়ে বছরের খোরাকির অর্ধেকও হয়না।

শাহানাদের এ অবস্থায় পরার কথা ছিলনা। বাবা হাইস্কুলের শিক্ষক ছিলেন। মা'কে নিয়ে আর ছোট ভাইটিকে নিয়ে তাদের সংসার ভালোই চলছিল। শাহানার এসএসসি পরীক্ষার ঠিক পরপরেই কি যে হয়ে গেল! বাবা স্ট্রোক করলেন। বেঁচে গেলেন অবশ্য, তবে একেবারে প্যারালাইজড হয়ে। তার চিকিৎসার জন্য জমানো টাকা সব ফুরিয়ে এলো। বেসরকারী স্কুল। সেখান থেকে পেনশন ধরনের কিছু পাওয়া যাবে কিনা শাহানা জানেনা। হেডমাষ্টার স্যার বলেছিলেন, কিছু টাকা পাওয়া যাবে তবে সময় লাগবে। এই চরম দুঃসময়ের মধ্যে তাদের এসএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট বের হল। শাহানা সবগুলো বিষয়ে এ-প্লাস। যেটাকে গোল্ডেন এ-প্লাস বলে। তাদের এই গ্রামের স্কুলে এর আগে কেউ এমন রেজাল্ট করতে পারেনি। সেবার এমনকি উপজেলা সদর স্কুল থেকেই মাত্র তিন জন গোল্ডেন এ-প্লাস পেয়েছিল। রেজাল্টের খুশি অবশ্য উবে গিয়েছিল শীঘ্রই। বিজ্ঞানের ছাত্রী শাহানা জানে, এইচএসসি'র বিজ্ঞান পড়তে তার টিউশন বা কোচিং নেয়া লাগবে। এগুলোর টাকা কোথা থেকে আসবে! তাছাড়া বাবার এই অবস্থায় সংসারের হাল ধরা তারই কর্তব্য। অনেক ভেবে উপজেলা শহরের কলেজে সে সমাজবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হল। সেই সাথে গ্রামে কয়েকটা টিউশনি শুরু করল। স্কুলের স্যারেরা আর তার মা চাইছিলেন সে বিজ্ঞান নিয়েই পড়ুক। বাবাও তাই হয়ত চাইছিলেন, কিন্তু কিছু বলতে পারেন না। শুধু গোঁ গোঁ শব্দ করেন আর চোখের পানি ফেলেন। এদিক সেদিক থেকে কিছু সাহায্য পাওয়া হয়ত যাবে। কিন্তু শাহানা অনড় ছিল অন্যের থেকে সাহায্য না নিতে। বলেছিল, এতে বাবা খুব কষ্ট পাবে। গত দেড়-দু বছর কি অমানুষিক পরিশ্রমই না সে করেছে! বরাবরই সে ভালো ছাত্রী। এত কষ্টের মধ্যেও তাই সে পড়াশুনাটা ভালো ভাবে চালিয়ে গেছে। পরীক্ষা ভালোই হয়েছে। পরশুই তো রেজাল্ট হওয়ার কথা!

"অল রাবিশ" "ডিসগাস্টিং" শব্দ দুটো তার কানে আঘাত করে ভাবনায় ছেদ ঘটালো। ঘুরে দেখল স্যুট পড়া দুজন ভদ্রলোক নৌকায় উঠতে গিয়ে কাদার মধ্যে পা দিয়ে ফেলেছে। শাহানা মুখ টিপে হাসল একটু। ভদ্রলোক দুজন তার বিপরীত দিকেই বসল। শাহানা নিজের ভাবনায় মন দিল আবার। কিন্তু দিতে আর পারল কই! শহুরে ভদ্রলোকদের কথা গুলো তার কানে বিঁধছিল।
"এজন্যই আমি আসতে চাইনি। জোর করলি। ধুর। গ্রাম মানেই নোংরা, কাদা, গোবর। অল দ্যা শিটস এন্ড রাবিশ এভ্রিহোয়্যার।"
"কি করব বল। আম্মু জোর করলেন। প্রতিবছর গ্রামে এসে একমাস থাকেন। এবার গো ধরলেন, আমি এসে না নিয়ে গেলে নাকি যাবেননা। একা একা আসতে ইচ্ছে হচ্ছিলনা, তাই তোকে নিয়ে এলাম সাথে। আমারই কি এসব গ্রাম-ট্রাম ভালো লাগে!"

আরো কিসব বলছিল। বেশিরভাগই ইংরেজি শব্দের ব্যাবহারে গালাগাল চলছিল। এক পর্যায়ে কোন একজন গ্রামের মানুষদের অশিক্ষিত বর্বর শ্রেনীর বলেও অভিহিত করে ফেলল। একে গরম, ক্ষুধা, নৌকা ছাড়তে বিলম্ব, তার উপর আবার এই শহুরে বর্বর আক্রমণ! যা হয়না সাধারনত, শাহানার ধৈর্যচ্যুতি ঘটল।

"হাউ সেলফিশ ইউ পিপল আর! ভিলেজেস আর ইউর রুটস। ইউর সিভিলাইজেশন ইজ ডিপেন্ডেন্ট অন ভিলেজেস। ইউর ফুড সাপ্পলাইস আর ডিপেন্ডেন্ট অন ভিলেজেস। অ্যান্ড ইউ আর ইন্সাল্টিং ভিলেজেস অ্যান্ড ভিলেজ পিপল? দে মাইট বি নট সো কল্ড এডুকেটেড লাইক ইউ, বাট দে মাস্ট বি সিম্পল, পোলাইট অ্যান্ড ওয়েল-ম্যান্নারড, নট অ্যারোগেন্ট লাইক ইউ।" একটানে কথা গুলো বলে শাহানা হাঁপাচ্ছিল।

আর 'শহুরে ভদ্রলোক" হাসান আর শফিকের সামনে যেন পৃথিবীর অষ্টমাশ্চার্য কিছু একটা ঘটল। তারা দুজন একদম ভ্যাবদা মেরে গেছে। গ্রামের ছেলেমেয়েরা লেখাপড়ায় এগিয়ে আসছে, তারা তা জানে। কিন্তু এই অজ পাড়াগাঁয়ে, অতি সাধারন বোরকা আর মাথায় কমদামী হিজাব পরা অতি সাধারন চেহারার এক মেয়ের মুখে নির্ভেজাল ইংরেজীতে এমন ধমক তারা ঠিক আশা করতে পারেনি। কিছু বলতে যাওয়ার আগেই ফটফট শব্দ তুলে ইঞ্জিনচালিত নৌকা (যেটাকে ট্রলারও বলে) ছেড়ে দিল। ওপারে পৌঁছে "প্লিজ এক্সকিউজ মি। প্রোবাবলি আই ওয়াজ ঠু হার্শ। সরি।" বলে নৌকা থেকে নেমে শাহানা হনহন করে চলে গেল। হাসান আর শফিক যতক্ষনে সম্বিৎ ফিরে "এই যে শুনুন" বলে তাকে ডাক দিল, ততক্ষনে শাহানা শোনার সীমানার বাইরে।
(২)

দু’দিন ধরে প্রচন্ড জ্বর ছিল শাহানার। আজ একটু কমের দিকে। আধো ঘুম আধো জাগরণে সে টের পেলো মা মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। কি যেন বলছেন। কাঁদছেনও কি! পাশে বাবার শব্দও শোনা গেল। শাহানা উঠতে গেল। মা জিজ্ঞাসা করলেন
“উঠতে পারবি?”
“হ্যা মা। আজ জ্বর একটু কম লাগছে।
মা থার্মোমিটার দিয়ে দেখলেন। হ্যা ১০০ ডিগ্রী ফারেনহাইটের নিচে নেমে এসেছে।
“মা, গোসল করি?
“আজই করবি? আজ থাক। মাথায় পানি দিয়ে দেবো। কাল করিস।
“না মা, আজই করি। জ্বর মনে হয় ছেড়ে যাবে।দুতিন দিনের জ্বরে শাহানা সাধারনত ওষুধ খায়না। সে জানে, শরীরে যদি ইনফেকশন হয়, শরীর নিজ থেকেই তার সাথে যুদ্ধ করার জন্য শরীরের তাপমাত্রা বাড়িয়ে দেয়। ওষুধ খেয়ে তাপমাত্রা কমানোর মানে হয়না। তবে হ্যা, যদি বেশ দুদিনের মধ্যেও তাপমাত্রা না কমে, তবে ডাক্তারের পরামর্শে ওষুধ খাওয়া দরকার হয়। সাধারন জ্বরে শাহানারও ওষুধ দুটো। জ্বর যখন একটু কম কম লাগবে, হাল্কা গরম পানিতে গোসল দিয়ে ফেলতে হবে। আর আনারস। স্কুলের রুহুল স্যার বলতেন জ্বর হলে একা একটা আনারস খেয়ে ফেলতে হবে, কাউকে ভাগ দেয়া যাবেনা, তাহলেই জ্বর চলে যাবে। মনে পড়তেই মজা লাগল।
গোসলে আজ একটু সময় নিল সে। জ্বরের কেমন যেন একটা গন্ধ থাকে, সেটা দূর করার জন্য। আরেব্বাহ। মা দেখি আনারসও যোগার করে ফেলেছেন।
বাইরের ঘরে কার যেন কথা শোনা যাচ্ছে। শাহানা উঁকি দিয়ে দেখল স্কুলের হেডমাষ্টার স্যার, জামাল স্যার আর রুহুল স্যার এসেছেন। বাবার সাথে কথা বলার চেষ্টা করছেন। সে ঢুকে সালাম দিল। হেডমাষ্টার স্যার কাছে ডেকে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন
আমরা অনেক খুশি হয়েছি মা। তুই এত কষ্ট করে লেখাপড়া করছিস, তাও এত ভাল রেজাল্ট করলি। আমাদের এই গ্রাম আমাদের এই স্কুল তোর কাছে কৃতজ্ঞ”।
শাহানা কেঁদে ফেলল। মাও আঁচল চাপা দিলেন চোখে।
গতকালই তাদের এইচএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট হয়েছে। সমাজবিজ্ঞান বিভাগ থেকে তাদের উপজেলায় সেই একমাত্র গোল্ডেন এ-প্লাস পেয়ে পাশ করেছে। কলেজের প্রিন্সিপাল স্যার আর বাংলার জহির স্যার ফোন করেছিলেন অভিনন্দন জানাতে। জ্বরের মধ্যে কি কথা হয়েছে তাদের সাথে সে ভুলেই গেছে। আজ স্যারদের সাথে ফোনে একবার কথা বলতে হবে। বন্ধুরাও নিশ্চয়ই অনেকে ফোন বা মেসেজ করেছে। মোবাইল ফোন নিয়ে বসতে হবে।

হেডমাষ্টার স্যার বললেন
শোন মা। আমাদের স্কুল থেকে কাল তোকে একটা সংবর্ধনা দেবো। তুই এই স্কুল থেকে কত ভালো রেজাল্ট নিয়ে পাশ করলি! তখন কিছু করা হলনা। তোর বাবার তখন যে অবস্থা ছিল! এর পরে কলেজে গেলি। সেখানেও এত ভালো রেজাল্ট করলি। তোর মত সোনার টুকরা মেয়ে তো আমাদের গর্বরে মা!

(৩)
স্কুলে আজ তাদের সাবেক ছাত্রী শাহানার সংবর্ধনা। এলাকার সব গণ্যমান্য ব্যাক্তিবর্গ এসেছেন। এই মেয়েটা তাদের ছোট এই গ্রামের মুখ উজ্জ্বল করেছে। সবাই তাকে প্রাণ ভরে দোয়া দিতেই এসেছে। প্রধান অতিথি করা হয়েছে আয়শা বেগম কে। উনি খাঁ সাবের ছোট কন্যা। খাঁ সাব আশেপাশের দশ-বিশ গ্রামের সবচেয়ে সম্মানিত মানুষ ছিলেন। প্রচুর ধন-সম্পদও ছিল। তিনি গত হয়েছেন অনেক বছর হল। ছেলে-মেয়েরা কেউ গ্রামে থাকেনা। শহরে বিদেশে থাকে। তার বিশাল জমিজমার কিছু ছেলেমেয়েরা বিক্রি করে চলে গেছে, আর কিছু নদী-ভাঙ্গনে বিলীন হয়েছে। গেল কবছর হল, আয়শা বেগম গ্রামে আসেন মাঝেমধ্যে। পুরনো ঘরের একটা মেরামত করে নিজেদের বাসযোগ্য করেছেন। আর বাকি ঘরগুলো মসজিদসহ আবাসিক মাদ্রাসা বানিয়েছেন। বাপের মত না হলেও ধীরেধীরে আয়শা বেগমও মানুষের মনে স্থান করে নিচ্ছেন তার বিনয় আর নিরহংকারী দান-খয়রাতের জন্য।

শাহানাকে আয়শা বেগম একটি মেডেল পড়িয়ে দিলেন আর কপালে চুম্বন করলেন। নিজের ছোট বক্তৃতায় তিনি বলে গেলেন এই গ্রামে কাটানো তার শৈশব কৈশোরের কথা, গ্রাম আর গ্রামের মানুষের প্রতি তার ভালোবাসার কথা। শাহানার ভূয়সী প্রশংসাও করলেন তিনি, গ্রামের মুখ উজ্জ্বল করার জন্য। হেডমাষ্টার স্যার এবার শাহানাকে কিছু বলতে বললেন। তার পড়াশুনা নিয়ে আর আগামীর স্বপ্ন নিয়ে।

কি বলবে শাহানা? স্বপ্ন কি অদৌ আছে? গত দুবছর সে কি অমানুষিক পরিশ্রম করেছে, তা জানে সে, তার মা-বাবা, আর সবার উপরে আরশে যিনি বসে আছেন, তিনি। কি বলবে সে? বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা নেয়া কি তার দ্বারা সম্ভব? কোথা হতে আসবে সেই অর্থ? কে দেখবে তার মা-বাবাকে। ভাইটা যে এখনো ছোট! না, বক্তৃতায় সে কাউকে স্বপ্নের কথা শোনাতে পারেনি। বরং সে সবাইকে কাঁদিয়েই গেলো!
সংবর্ধনা অনুষ্ঠান শেষে শিক্ষকদের রুমে অতিথিদের সাথে শাহানাকে বসানো হল। আয়শা বেগমের সাথে তার ছেলে হাসান আর হাসানের বন্ধু শফিকও আছে। তাদের দেখে শাহানা একটু গুটিশুটি মেরে গেছে। ছি! সেদিন কি করল সে! এনাদেরই তো সে দুকথা শুনিয়ে দিয়েছিল। একথা সেকথায় আয়শা বেগম তাকে বললেন
শোন মা, তুমি একেবারেই ভেঙ্গে পরোনা। তোমার বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া হবেনা, উচ্চশিক্ষা হবেনা, এটা ভুলেও মনে স্থান দিওনা। তোমার লেখাপড়ার দায়িত্ব আমি নিলাম।
কিন্তু বাড়িতে আমার মা-বাবা...তাদের ব্যাবস্থাও হয়ে যাবে। আমি মাসে মাসে তোমার বাবা-মার নামে কিছু আর্থিক সাহায্য পাঠাবো।
শাহানার চোখ আবার অশ্রুসজল হয়ে উঠল। স্বপ্ন দেখা কি আবার শুরু হল? সে আরো পড়াশুনা করবে! অনার্স, মাস্টার্স, পিএইচডি, গবেষনা! এই দেশ, এই সমাজ, এই গ্রামের সমস্যাগুলো নিয়ে সে কাজ করবে। কিন্তু......

(৪)
দুদিন পরে সে স্কুলে গেল। হেডমাষ্টার স্যারের সাথে দেখা করতে হবে। এই দুইদিন সে ব্যস্ত ছিল। কলেজে গিয়েছে। স্যারদের সাথে বন্ধুদের সাথে দেখা হয়েছে। কিন্ডারগার্টেনে, যেখানে সে চাকরী করে সেখানে গিয়ে অনুপস্থিতির জন্য দরখাস্ত দিয়ে আরো দুদিনের ছুটি নিয়ে এসেছে। আরো কিছু পরিকল্পনা সে করে ফেলেছে ভবিষ্যতের জন্য। অনেক বোঝাপড়া হয়েছে। নিজের সাথে। মায়ের সাথেও পরামর্শ হয়েছে। বাবার সাথেও। বাবা অবশ্য কথা বলতে পারেন না, শুধু নীরবে অশ্রু ঝরান।
হেডমাষ্টার স্যারকে শাহানা জানাল সে সাহায্য নিয়ে পড়তে চায়না।
স্যার, আয়শা ম্যাডামের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। কিন্তু আমি তার সাহায্যে পড়বনা। আমার পড়াশুনা চালিয়ে চাওয়া জরুরী, কিন্তু তার চেয়েও জরুরী আমার মা-বাবাকে দেখাশুনা করা। আমার বাবা সারাজীবন সামান্যতম অনুগ্রহও কারো কাছ থেকে নেননি। আজকে তার এই অসুস্থ অবস্থায় তাকে অন্যের পাঠানো সাহায্য নিয়ে বেঁচে থাকতে হবে, এটা মেনে নেয়া তার সন্তান হিসেবে আমার জন্য অসম্ভব। আমাকে ক্ষমা করবেন স্যার। আয়শা ম্যাডামের সামনে গিয়ে তাকে না বলাটা আমার জন্য ধৃষ্টতাস্বরুপ। আপনি যদি আমার হয়ে তাকে জানান, খুব ভালো হয়, স্যার।
কি করবি তাহলে? পড়াশুনা একেবারে বাদ?
না স্যার, বিএ পাশ-কোর্সে ভর্তি হব। কিন্ডারগার্টেনের চাকরীটা স্থায়ী করে নেবে বলেছে ওরা। আর কিছু টিউশনী তো থাকবেই। ও দিয়ে চলে যাবে।
হেডমাষ্টার স্যার আর অন্য স্যারেরা বিভিন্নভাবে তাকে বোঝানোর চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দেয়।

বেশ নির্ভার লাগে শাহানার। নিয়তি আমাদের হাতে নয়। আমরা শুধু চেষ্টাই করতে পারি মাত্র। জীবনের পথ তো আর মসৃণ নয়। কারো কারো জন্য খুবই কঠিন। আত্মমর্যাদা, সততা, নৈতিকতা ইতাদি ধরে রেখে কঠিন পথ পাড়ি দিতেও একধরনের বিজয়ী আনন্দ পাওয়া যায়।

(৫)
ফযরের নামাযের পরে সূর্য ওঠার সময়ে শাহানা বাইরে একটু হাটে। পাশের তালুকদার বাড়ির পুকুরের পাড় তারপর বিস্তৃত ক্ষেত, দূরের নদী, তার উপর দিয়ে ধীরেধীরে উঠে আসা সূর্য দেখতে তার বেশ লাগে।
আনমনা হয়ে সে হাঁটছিল। হঠাৎ ঠিক সামনেই একজন মানুষের উপস্থিতি তাকে চমকে দেয়। হাসান সাহেব। আয়শা ম্যডামের ছেলে। সেদিন ট্রলারে দেখা হওয়া দুজনের একজন।
তাহলে, ঠিক করলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বেননা! বড়লোকেরা খারাপ মানুষ; তাদের সাহায্য নিবেননা?
সে কি! ছি ছি! আমি তা কখন বললাম! আপনারা কত ভালো মানুষ। গ্রামের জন্য আপনার মা কত কিছু করছেন! আমরাও তা থেকে বঞ্চিত নই। সম্মিলিতভাবে আমরাতো নিয়মিতই আপনাদের সাহায্য নিয়ে থাকি। তবে ব্যাক্তিগত আর্থিক সাহায্য নিতে সংকোচ বোধ হয়।
হুম। বুঝলাম। আমি আপনাকে কিছু কথা বলতে এসেছি। শুনবেন তো?
অবশ্যই শুনব। কি যে বলেন!
নাহ। ঠিক সাহস করে উঠতে পারছিনা। সেদিন প্রথম দেখায় যে ঝাড়িটা দিলেন!
আমাকে ক্ষমা করবেন। সেদিন আসলে কি যে হয়ে গেল আমার! সাধারনত আমি এভাবে হঠাৎ রেগে যাইনা।
আসলে আপনি খুবই ভালো করেছেন। ক্ষমা চেয়ে আর লজ্জা দেবেন না। ঠিকই তো! গ্রামকে আমরা কত অবজ্ঞা করি, অথচ গ্রামেই আমাদের শেকড়।
শাহানা মাথা নিচু করল। হাসান বলতে লাগল
আমি নিজের সম্পর্কে কিছু বলি। আমার বাবা নেই। বোনের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। সে কানাডাতে থাকে। আম্মু আর আমিই আছি এখন। বাবার রেখে যাওয়া ব্যাবসা আম্মুই দেখেন। আমিও মাঝে মাঝে একটু দেখাশোনা করি। তাই বলে ভাববেন না যেন আমি বাবার পয়সা বসে বসে খাই। লেখাপড়া না করে মাস্তান ধরনের হয়েছি। আপনার মত এত ভালো ছাত্র ছিলাম না, কিন্তু একেবারে মন্দও ছিলাম না। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়নে অনার্স-মাস্টার্স করে নিউজিল্যান্ড যাচ্ছি পিএইচডি করতে শিঘ্রীই।
আম্মু চাচ্ছেন, আমি যাতে বিয়ে করি। বিদেশে গিয়ে যদি আবার কোন শ্বেতাঙ্গিনীর পাল্লায় পরি, সে ভয় তার। আমি হেসেই উড়িয়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু কাল রাতে আমার মত পরিবর্তন করেছি। আম্মুকে জানিয়েও দিয়েছি সে কথা। হঠাৎ এমন একজনের দেখা পেয়েছি, মনে হল, জীবনসঙ্গিনী হিসেবে এর চেয়ে ভালো কেউ হতে পারেনা।
হবেন আমার জীবনসঙ্গিনী?

এমন অদ্ভুত কথা শোনার জন্য শাহানা প্রস্তুত ছিলনা। এরকম কিছু ঘটতে পারে সে কখনো ভাবতেই পারেনি। কি বলবে কি করবে সে কিছুই বুঝতে না পেরে ফিক করে হেসে ফেলল ধুর, কিসব ঠাট্টা করছেন!
এবার হাসান ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। সে ভেবেছিল মেয়েটা হয়ত লজ্জা পাবে, খুশি হবে বা রেগে যাবে। কিন্তু সে যে একেবারে তার কথা হেসে উড়িয়ে দিল যেন সে ঠাট্টা করছে।
আপনার কাছে ঠাট্টা মনে হল! আমারই দোষ, আমি হয়ত ঠিকভাবে বলতে পারিনি। আমি ঠাট্টা করছিনা। আমি আর আম্মু কাল সারারাত এই নিয়ে অনেক আলোচনা, চিন্তাভাবনা করে এই ফাইন্যাল করেছি।
শাহানা এবার কথার গুরুত্ব বুঝতে পারল। ঘটনার অভাবনীয়তায় সে হতবিহবল হয়ে গেল। তার মধ্যে তীব্র একটা অজানা অনুভূতি হল। আনন্দ, লজ্জা, ভয়, শংকা সবকিছুর সংমিশ্রণ আছে এই অনুভূতিতে। সে গ্রামের দরিদ্র ঘরের মেয়ে। সে দেখতে সুন্দরী নয়। সে তেমন আকর্ষনীয়া নয়। তিন চারটে মেয়ের সাথে একসাথে হেটে গেলে সে বিশেষ ভাবে কারো চোখে পড়বেনা। অথচ তাকে বিয়ের প্রস্তাব দিচ্ছে এত শিক্ষিত, নামযশ-ওয়ালা ধন-সম্পদের অধিকারী সুদর্শন একজন। এটা বিশ্বাস করাই কঠিন। এ কিভাবে সম্ভব? সম্ভব হতেই পারে। এ জগতে খারাপের সংখ্যা অনেক হলেও ভালো মানুষের অভাব নেই। কিন্তু সে কি করবে? তার বাবা-মা?
হাসান বোধ হয় তার মনের কথা বুঝতে পারল।
আপনার বাবা-মায়ের কথা ভেবে বিচলিত হবেন না। আল্লাহপাকের ইচ্ছায় আমাদের অনেক আছে। আপনি আমার স্ত্রী হলে, আমার যা, আপনারও তা। নিজের সম্পদ থেকেই আপনি আপনার বাবা-মায়ের জন্য করতে পারবেন। কারো সাহায্য নিতে হবেনা।
শাহানার চোখ দিয়ে পানি ঝরা শুরু হল। এমনও হয়? এমন করেও হয়!
কিন্তু আপনি আমার মধ্যে কি দেখলেন? আমি গ্রামের এক সাধারন পরিবারের অতি সাধারন মেয়ে। রূপ-সৌন্দর্য বলতেও কিছুই আমার নেই। আপনি কেন আমাকে বিয়ে করতে চাচ্ছেন? এটা কি করুনা নয়?
করুনা? আপনাকে? সে কথা ভাবাও আমার জন্য অন্যায়। আপনি অসম্ভব মেধাবী। যতদুর জেনেছি, অন্যসব রমনীয় গুণের অভাবও আপনার নেই। সবচেয়ে বড় কথা আমি আপনার মধ্যে যে চারত্রিক দৃঢ়তা, সততা, নৈতিকতা দেখেছি, তা এই বর্তমান সমাজে সহজলভ্য নয়। আম্মুও আপনার এই রূপ চিনতে পেরেছে। শুধুমাত্র দারিদ্রতার অযুহাতে আপনি হারিয়ে যাবেন, সেটা কোনভাবেই হতে পারেনা। আপনি নিজের স্বপ্নগুলো পূরণ করবেন। একটা সুন্দর সমাজের স্বপ্ন। আপনাকে জানার পরে আমিও ভিন্নভাবে স্বপ্ন দেখা শুরু করেছি। লোভ-লালসাহীন, অহংকার-স্বার্থপরতাহীন ভালোবাসাময় সুন্দর এক সমাজের স্বপ্ন। আমরা একসাথে সেই সুন্দর স্বপ্নের বাস্তবায়ন করব।
চলুন, বাড়িতে। আম্মু এসেছে সব ঠিকঠাক করতে। আপনার বাবা-মায়ের সাথে কথা বলছে। এতক্ষনে হয়ত সব পাকাপাকি হয়ে গেছে”। হাসান হাসল।

সূর্য অনেকটাই উঠে গেছে। আরেকটা রোদ- তাঁতানো দিনের শুরু হয়ত। কিন্তু এই মুহুর্তটা অসম্ভব সুন্দর। দক্ষিন দিকের বিস্তীর্ন মাঠ পেরিয়ে আসা ভোরের হাওয়াটা বেশ প্রাণজুড়ানো। ভোরের সূর্যালোকের নিচে এই মাঠ, নদী, গাছপালা, ভোরের হাওয়া, পাশের মানুষটি সব কিছু মিলে শাহানাকে জানান দেয় সুন্দর আগামীর। স্বপ্নলোকের মত সুন্দর আগামীর। শাহানার মনের সেই বিশেষ অনুভূতি থেকে শংকা আর ভয় দূর হয়ে গেল। এখন সেখানে আছে শুধু তীব্র লাজমাখা আনন্দ।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মাইনুল ইসলাম আলিফ ন্দর গল্প।ভোট ও শুভ কামনা রইল। আসবেন আমার গল্প আর কবিতার পাতায়।
ধন্যবাদ। এবং আপনার জন্যও শুভকামনা। আপনার লেখনীগুলো বেশ। ভালো থাকবেন এবং লিখতে থাকবেন।
মোঃ নুরেআলম সিদ্দিকী গল্পটি কেমন যেন আন মনা ভাব ছিল, তবে শেষ পর্যায় এসে তা ফুটে উঠেছে। অনেক শুভকামনা রইল....
ধন্যবাদ। এবং আপনার জন্যও শুভকামনা।
Fahmida Bari Bipu ভালোই লেগেছে গল্পটা পড়তে। অনুভূতির প্রকাশটুকু যথাযথ ছিল। হয়ত কিছুটা অপূর্ণতা আছে গল্পে, তবে তা অনুভব করলেও সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারছি না। শুভকামনা। লিখতে থাকুন।
অনেক ধন্যবাদ মন্তব্যের জন্য। ভালো থাকবেন।
এলিজা রহমান গল্পটা ভাল লেগেছে , তবে গল্পে লাজ বা লজ্জার বিষয়টা কি দেখিনি ।
অনেক ধন্যবাদ মন্তব্যের জন্য। ভালো থাকবেন। লাজের কথা সম্ভবত বলেছি শেষের দিকে "শাহানার মনের সেই বিশেষ অনুভূতি থেকে শংকা আর ভয় দূর হয়ে গেল। এখন সেখানে আছে শুধু তীব্র লাজমাখা আনন্দ।"
Shamima Sultana সমাজে শাহানার মত মেয়ের বড় দ্রকার।কিন্তু এই বিয়ে আমার অপছন্দ। আজ যাকে ব্যক্তিত্ব ভেবে বিয়ের প্রস্তাব দুই এক বছর পর উল্টো রুপ দেখা যাবে হাসানের। সেই দিনের কথা ভেবে কষ্ট পাচ্ছি। ভোট দিয়ে গেলাম আমার পাতায় স্বাগত
অনেক ধন্যবাদ মন্তব্যের জন্য। ভালো থাকবেন। আসলে সমাজ বা জীবন যাই বলেন না কেন, আমরা তার হয়ত একটা দিকই দেখি। ওপাশের রূপটা দেখা হয়না সবসময়। আমি ঠিক গল্পকার নই আপা। নিজের দেখা জগতকে শুধুমাত্র গল্পাকারে সাজানোর চেষ্টা করেছি। এই গল্পের চরিত্রগুলোকে আমি ব্যাক্তিগত ভাবে কিছুটা জানি। এদের জীবনে "আজ যাকে ব্যক্তিত্ব ভেবে বিয়ের প্রস্তাব দুই এক বছর পর উল্টো রুপ দেখা যাবে হাসানের" কোনভাবেই সত্য নয়। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, এদের মত মানুষ আমাদের সমাজে একেবারে কম নয়।
ওয়াহিদ মামুন লাভলু শাহানা খুব সহনশীল। পড়াশোনা করা আবার শিক্ষকতাও করা। অন্যের সাহায্য না নিতে চাওয়া। এরকম দৃঢ় চরিত্র যার আছে তার পক্ষে অনেক কিছুই সম্ভব। পরিশেষে তার কষ্টের জীবনের শেষ হওয়ার ইঙ্গিত পাওয়া গেল। অনেক ভাল লাগল। শ্রদ্ধা গ্রহণ করবেন। আপনার জন্য অনেক অনেক শুভকামনা রইলো। ভাল থাকবেন।
অনেক ধন্যবাদ ভাই। এরকম মানুষগুলো সমাজে আছে কিন্তু দিন দিন কমে যাচ্ছে। আপনার জন্যও শুভকামনা

লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য

গল্পটা একটা মেয়ের। সে অসম্ভব মেধাবী। খুব ভালো রেজাল্ট নিয়ে সে এইচএসসি পাশ করে। কিন্তু দারিদ্রের কশাঘাতে ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখতে সে ভুলে যেতে থাকে। ঠিক এই সময়ে তার জীবনে অভাবনীয় এক ঘটনা ঘটে। গ্রীষ্মের দুঃসহ রাত শেষে আলোকজ্জল সকালে ভোরের প্রাণজুড়ানো ঠান্ডা হাওয়ার মত কিছু একটা তাকে আবার স্বপ্ন দেখতে শুরু করায়। সুন্দর আগামীর স্বপ্ন। সুন্দর জীবনের স্বপ্ন। হঠাৎ পাওয়া এই অভাবনীয় প্রাপ্তি তাকে তীব্র লাজমাখা আনন্দ দান করে। 'লাজ' সংখ্যার গল্প হিসেবে আমার এই সামান্য নিবেদন।

০১ জানুয়ারী - ২০১৮ গল্প/কবিতা: ৯ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

বিজ্ঞপ্তি

“মে ২০২৪” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ মে, ২০২৪ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।

প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী