গ্রাম ছেড়েছি বহু বছর। কিন্তু শেকড়ের মায়া ছাড়তে পারিনি। বছরে একবার হলেও যাওয়া হয়। গ্রামের বাড়িতে অবশ্য তেমন কেউ নেই। তাছাড়া চাকুরীর সুবাদে আমাদেরও অবকাশ কম। তারপরও বছরান্তে একবার না গেলে ভালো লাগেনা। ছেলেমেয়েরাও যেতে চায়। শহরের কঠিন জীবনের থেকে কিছুক্ষনের জন্য হাফ ছেড়ে বাঁচা।
বরিশালের গ্রাম্য নদী, খাল, বিল, মেঠো পথ আমাকে যেমন, ওদেরো তেমন টানে। তবে দুএকদিনের বেশি থাকা হয়না। আত্মীয়স্বজন, পুরনো বন্ধুবান্ধব যারা আছেন, দেখা করতে আসেন। কিছুক্ষন আড্ডা দেয়া, একসাথে একবেলা খাওয়া, আর ছেলেমেয়েদের আর তাদের মাকে নিয়ে পাড়া-প্রতিবেশী মহিলাদের এক বিকেল গ্রাম ঘুরে দেখা- এই'ই পরের একবছরের খোড়াক।
*******
মজিদ চাচার দোকানের সামনে আড্ডা দিচ্ছিলাম। পুরনো বন্ধুবান্ধব আর মুরুব্বীদের কেউ কেউ ছিলেন। শীতের পড়ন্ত দুপুরের মিষ্টি রোদে খাটি গরুর দুধের চা আর নতুন-পুরাতন দিনের গল্প বেশ লাগছিল। কয়েকজনের মাথা ছাড়িয়ে একটু দূরে একজনের সাথে চোখাচোখি হল হঠাৎ। কঠিন, কাঠখোট্টা অবয়ব মুখ আর শরীরের, কিন্তু অদ্ভুত মায়াভরা চোখ। খুব চেনা মনে হল। কিন্তু স্মৃতি প্রতারনা করল। কোথায় দেখেছি এই চোখ! কিছুক্ষন আনমনা হয়ে গেলাম। কে কি বলছে আশেপাশে, কানে যাচ্ছিলনা। হঠাত বিদ্যুৎচমকের মত মনে পড়ল। হাসু, আমাদের হাসেম! তাকিয়ে দেখি সে অনেক দূরে চলে গেছে। আমার সাথে চোখাচোখি হতেই সে দ্রুত প্রস্থান করেছে। ডাক দিলাম। পেছন ফিরে না তাকিয়ে আরো দ্রুত সরে গেল। আমার মন একটু খারাপ হল। কত বছর পরে দেখা! অথচ ও আমার সাথে একটু কথাও না বলে পালিয়ে গেল!
******
বাল্যবন্ধু শামছুলকে জিজ্ঞাসা করলাম ওর কথা। ও বলল, হাসুরা এখানে অনেকদিন ছিলনা। মাদারীপুরের কাছাকাছি ছিল। গতবছর ফিরে এসেছে। নদীর পাড়ে ছোট একটা চায়ের দোকান দিয়েছে, দিনে সেখানে বসে। আর রাতে মাঝেমাঝে নৌকা আর জাল নিয়ে বের হয় মাছটাছ ধরে। সময়ে সময়ে দিনমজুরের কাজও করে। কথাবার্তা খুব কম বলে। রাত বিরেতে একা একা নৌকা বাইতে বাইতে করুন সুরে গান গায়। নামাজ কালামও করে। ছেলে আছে একটা বছর দশেকের। বাপের সাথেই বেশি থাকে। মেয়ের বয়স সাত। চরের দিকে ছোট একটা টিনের ঘর করেছে, সেখানেই থাকে। শামছুল বলল, দেখা করতে চাইলে সন্ধ্যাবেলা নদীর ধারে ট্রলার ঘাট গেলেই হবে। দুটা চায়ের দোকান আছে। একটা হাসুর।
******
যখন প্রাইমারী স্কুলে পড়তাম,আমাদের ক্লাসের অন্যতম ভালো ছাত্র ছিল হাসু। বিশেষ করে অংকের মাথা ছিল খুব ভালো। যেখানে ৭০-৮০ নাম্বার তুলতেই আমাদের দফারফা হয়ে যেত, ওকে কখনো ৯৫ এর নিচে পেতে দেখিনি। খুব দরিদ্রঘরের ছেলে হাসু। আমরাও দরিদ্র ছিলাম, তবে তিনবেলা খাবার জুটে যেত। হাসুদের তাও জুটত না ঠিকমত। ওর বাবা ছিল দিনমজুর কৃষক। সেই আমলে গ্রাম্য দিনমজুরদের আয় একেবারেই কম ছিল। সংসারে মানুষজন একেবারে কম নয়। কোনমতে দুতিনবেলা খাবার জোটাতে তার অনেক কষ্ট হত।
প্রাইমারী স্কুলে হাসুর পড়াশুনায় সমস্যা হয়নি, কারন ওটা অবৈতনিক ছিল। কিন্তু হাইস্কুলে গিয়ে হাসু মহা সমস্যায় পড়ল। বই কিনতে হয়, স্কুলে বেতন দিতে হয়। এসব কুলিয়ে ওঠা হাসুর পক্ষে সম্ভব ছিলনা। লেখাপড়ায় ঘাটতি হতে লাগল, সে আস্তে আস্তে পিছিয়ে যেতে লাগল। ক্লাস সেভেনে থাকতে হাসুর বাবা মারা গেলো হঠাত। ওরা পড়ল অথৈ সাগরে। জীবিকার জন্য ১৩ বছর বয়সের হাসুকে নামতে হল মাঠে। ক্ষেতমজুর, জেলে, কুলি, অনেক কাজই ঐ বয়সে করতে হয়েছে। তবুও ও চেয়েছিল পড়াশুনা করতে। যতদুর মনে পড়ে স্কুল থেকে ওর বেতন মাফ করে দিয়েছিল। কিন্তু বই খাতা কলমের জন্যও তো টাকা লাগে! তাছাড়া কাজকর্মের জন্য স্কুলেও সে ঠিকমত আসতে পারতনা। কি আশ্চর্য বিষয়; ওর এই দৈন্য দশায়ও অনেকে ওদের দারিদ্র্যতা নিয়ে ঠাট্টা করত। আমাকে আজো অবাক করে, আমাদের গ্রামে অনেক টাকাপয়সাওয়ালা মানুষ থাকতেও অসম্ভব মেধাবী এই ছেলেটাকে কেউ তেমন সাহায্য করতে এগিয়ে আসেনি। হাসু আমার সাথে গল্প করত, স্বপ্ন আর হতাশার মিশ্রনে। ওর চোখদুটো বড্ড মায়াভরা ছিল। আমি দেখছিলাম ওই মায়াভরা চোখ থেকে স্বপ্নগুলো ধীরেধীরে হারিয়ে যেতে আর সেখানে হতাশার জায়গা করে নিতে! তারপর কোথায় হারিয়ে গেল হাসুরা একদিন!
******
আমরা কৈশোর পেড়িয়ে তরুন হলাম, স্কুল পেড়িয়ে কলেজে গেলাম। তারপর বিশ্ববিদ্যালয়। তারপর চাকুরী। বিয়ে, সংসার, ছেলেমেয়ে, টাকাপয়সা। আমাদের স্বার্থপর মন হাসুকে একেবারেই ভুলে গেল! তারপর দুইযুগ পরে এই দেখা! সেই কোমল কিশোর শরীর রুক্ষ কঠোর হয়েছে, সেই মিষ্টি চেহারা কাঠখোট্টা রুপ নিয়েছে। শুধু সেই মায়াভরা চোখ আগের মতই আছে।
******
মাগরিবের নামাজের পড়ে গেলাম। দোকানের সামনে বসলাম। হাসু মাথা নিচু করে বসে। আমার দিকে না তাকিয়েই জিজ্ঞসা করল
"স্যার, চা দিমু?"
"হাসু, তুই আমারে চিনতে পারোস নাই?"
"স্যার, আম্নেরা বড় মানুষ। মোরা চেনলেই কি আর না চেনলেই কি?"
"কিরে তুই আমার লগে এমনে কথা কস ক্যা?"
উঠে গিয়ে ওর পাশে বসে হাতে হাত রাখলাম। হাসুর চোখ ছলছল করে উঠল। আমি সামলাতে পারলাম না। কেঁদে ফেললাম।
একটু স্বাভাবিক হয়ে হাসু আমার সাথে স্বাভাবিক ভাবে কথা বলা শুরু করল। সেই শৈশবের দিনের মত গ্রাম্যভাষায়, তুই-তোকারি করে।
******
আমি কোথাও একান্তে বসতে চাইলাম। নিরিবিলি কথা বলা দরকার ওর সাথে। কতবছরের কত জমানো কথা আছে। ওর বাড়ি যেতে চাইলে রাজি হলনা। বলল "তার চাইতে ভালো, ল নাও লইয়া গাঙ্গের মইধ্যে যাই।"
বউকে একটা ফোন করে দিলাম। ফিরতে দেরী হবে। শীতের শান্ত নদী। দ্বাদশীর চাঁদ হালকা কুয়াশা ভেদ করে আড়িয়াল খাঁ'র বুকে রূপালী চাদর বিছিয়েছে। নৌকার ছোট ছইয়ের মাঝে আমি আর হাসু বসলাম। আমাদের মাঝখানে টিমটিমে জ্বলা একটা হারিকেন। আমি জ্যাকেট গায়ে, হাসু একটা পাতলা পুরনো চাদর গায়ে জড়িয়ে নিয়েছে।
বুকের ভেতরটা হুহু করে উঠল। এই ছেলের এ অবস্থা হওয়ার কথা ছিলনা। যার অংকের মাথা এত ভালো, তার হয়ত নামকরা ইঞ্জিনিয়ার কিংবা ম্যাথমেটিক্সের প্রোফেসর হওয়ার কথা। হায়! কেউ এগিয়ে আসেনি এরকম রত্নের যত্ন নিতে। এত মেধাবী একটা ছেলে আজ চায়ের দোকান কিংবা মাছ ধরে জীবিকানির্বাহ করে!
******
সেসব দিন নিয়ে তার কোন অভিযোগ নেই। সে বিষয়ে কথা বলতেও সে খুব আগ্রহী নয়। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া নিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম। অবাক হয়ে জানলাম সে তার ছেলেমেয়েকে স্কুলে পাঠায়নি!
বলে "কি হইব এইসব ল্যাখাপড়া কইরা। কতই তো ল্যাখাপড়া জানা মানুষ দ্যাখলাম। কয়জন ভালোমানুষ এর মইধ্যে! স্কুলে পাঠানোর কথা কস (!), স্কুলে যাইব, পরীক্ষা দিবো, হেই পরীক্ষায় প্রশ্ন আউট হইব। এইরকম কইরা পাশ করতে করতে বড় হইলে বড় চোর হইব! তার থিকা ভালো, এইসব ল্যাখাপড়া না করুক।"
আমার খুব মন খারাপ হল।
তবে কথায় কথায় অবাক হয়ে জানলাম, স্কুলের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না পেলেও তার ছেলেমেয়েরা স্বশিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে। নৌকায় তাকের উপর তার কিছু আলামত দেখলাম। স্কুলের বিভিন্ন ক্লাসের বই, সাহিত্য, ইতিহাস, ভুগোল, বিজ্ঞান কিছুই বাদ নেই। সে জানালো, তার ছোট্ট বাড়ির একটা ছোট কোণ বিভিন্ন প্রকার বইয়ে পূর্ণ।
আমি বললাম, "তোর ছেলেমেয়ে দুইটা আমারে দিবি? শহরে নিয়া যাই? আমার নিজেরগুলানের মতই থাকব।
হাসু বলল "দোস্ত, তুই মোগো লাইগ্যা মন খারাপ করিস না। মোরা ভালোই আছি। ভালোই আছিলাম। স্কুল বাদ দিছি। ল্যাখাপড়া বাদ দেইনাই। খুব খাটনি করতাম। টাকাপয়সা ভালোই আইত। তয় ভাই-বোইনগুলা কেউ ল্যাখাপড়া করতে চাইলনা। জোড় করিনাই। কামে ঢুকাইয়া দিছি সবাইরে। মায়েরে নিয়া থাকতাম। আর পড়তাম। বছর হিসাব কইরা তোরা যেই ক্লাসে উঠতি, ঐ ক্লাসের বই কিন্যা পড়তাম। বিজ্ঞান বেশি পড়তে পারি নাই, তয় অংক ছাড়িনাই। তারপর বিয়াশাদী। পোলা মাইয়া দুইডাই মোর ল্যাহান পড়া-পাগল। পড়াই অগো কাছে খেলা। তয় এগোরে এইসব স্কুল টিস্কুলে দিয়া পাশ করামুনা। এরা আনন্দ লইয়া নিজের মত শিক্ষিত হইব। গ্রামে কিছু জমিজমা কিনছি। কিছু ব্যাবসা বানিজ্যও আছে, মাছের। পোলা মাইয়ারা এইগুলাই কইরা খাইবো। পাশ, সার্টিফিকেট, ডিগ্রী এইগুলার দরকার নাই। এইগুলা ছাড়াই এরা মানুষ হইব। জীবন মোগো লইয়া অনেক খেলছে, এইবার মোরাও একটু খেলি।" হাসুর গলায় ক্ষোভ, ঘৃণা, অভিযোগ, সংকল্প আর অভিমানের মিশ্রন।
******
হারিকেনের চিমনি ভেদ করা মৃদু আলোয় আমি দেখলাম ওর সেই মায়াভরা চোখদুটো কেমন কঠিন আর জ্বলজ্বলে হয়ে উঠল। সময় যেন ঘোরের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। আমাদের কারো মুখে কোন কথা নেই। শান্ত নদীর উপরে অতি মৃদু দুলতে থাকা নৌকায় হালকা শীষের মত পানি কেটে যাওয়া ছাড়া আর শব্দ নেই। হাসু করুন সুরে গান ধরল। বহু আগের।
"সানসার হায় এক নদীয়া
দুখ সুখ দো কিনারে হায়।
না জানে কাহা গায়ে হাম
বেহতে ধারে হায়।"
এর অর্থ আমি ভালো বুঝিনা। যেটুকু বুঝলাম, তাতে মনে হল "সংসার হল এক নদীর মত, যেখানে দুঃখ আর সুখ নদীর দুই ধার। এই সুখ দুঃখের নদীর স্রোতে ভেসে আমি কোথায় যাচ্ছি তা অজানা"।
লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা
ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য
এ সংখ্যার বিষয় 'কাঠখোট্টা'।
আমার গল্পের নায়ক হাসু জীবনের রুক্ষপথ পাড়ি দিয়েছে। শৈশবে সে ছিল কোমল প্রান, মেধাবী ছাত্র। জীবন চলার পথের বাধা বিপত্তি তার সে কোমলতা ছাপিয়ে তাকে আপাত দৃষ্টিতে কাঠখোট্টা বানিয়ে দিয়েছে। সমাজ এবং সমাজের প্রচলিত নিয়মকে তাই সে এখন বিদ্রুপ করে এবং নিজেকেই সুখী ভাবে।
০১ জানুয়ারী - ২০১৮
গল্প/কবিতা:
৯ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪