সুখের বসন্ত অনেক দূর

স্বপ্ন (জানুয়ারী ২০১৮)

Sardar Razzak
  • ৪৬
  • ১২
০১.
সখিবানু আর পদ্মকলি। প্রথমজন মা, দ্বিতীয়জন কন্যা। শুরুতেই মা আর মেয়ের মধ্যে খুবই একান্ত কিছু কথোপকথন শুনে নেয়া যাক- এ কারণে যে, এই কথোপকথনের মধ্যে দিয়ে তাদের চারিত্রিক দিকের বিশেষত্বের সামান্যতম হলেও কিছুটা ইঙ্গিত পাওয়া যাবে। ‘অই, অত মরণ মরণ করস ক্যা ? দড়ি তো ঘরের ভিত্রেই রইছে, গলায় দিলেই তো ল্যাঠা চুইক্যা যায়। রোজ রোজ চিক্কুর পাইড়া পাড়া জ্বালাইয়্যা মরবি ? একদিনও তো মরলি না। -সাজ গোজ করতে করতে কথাগুলি বলে পদ্মকলি।
সখিবানুও কম না- ঝক্ ঝক্ করে ওঠে- ‘মাগী কয় কি?’ আরে আমি মরলে তর এই ঠোঁটের নকশা, চৌখের নকশায় আকাল পড়ব না ? কোমরডি তো অহনও সরুই রইছে, মরলে কি আর থাকব? না নতুন নতুন আনকোরা নাগর কপালে জুটব ? স্বামীডিরেও তো গিইল্যা খাইলি, বাঁচাইবার পারলি না। পোলাডিরেও তো মানুষ করবার পারবি না। বেইশ্যার
দালাল অইয়াই তো মরণ লাগবো।’ ‘চোপ মাগী। এ্যাক্করে একডা কতাও কইবি না কইয়া দিলাম। মায়ে অইছস মাইয়ারে বেইশ্যা বানাইন্যার লাইগ্যা ? খালি
নাগরের লগে বিছানায় শোয়াইয়া দিয়া ট্যাকা কামাইন্যার লাইগ্যা? দুইডি নাগরের ট্যাকা তো একলাই গিইল্যা ফ্যালাস আর কি সুন্দর কইরা কস- গলায় দড়ি দিবি। তা দিলেই তো অয়, বারণ করছে ক্যাডায় ? আবার আমারে কস পোলায় বেইশ্যার দালাল অইবো। আরে বেইশ্যার পোলায় বেইশ্যার দালাল অইবো- এইডিই তো হিসাবের কতা। আল্লার ওলি
তো অইবো না! আমার স্বামীরে আমি গিইল্যা খাই নাই- তুই খুব ভাল কইরাই জানস। হ্যারে বাঁচানের লাইগ্যা, হ্যার চিকিৎসা করণের লাইগ্যা, হ্যার মুখে দুইডি সাদা ভাতের দানা তুইল্যা দেওনের লাইগ্যা, তর নিজের প্যাট ভরনের লাইগ্যা তুই-ই পরথম আমারে পর পুরুষের বিছনায় শোয়াইয়া দিছিলি। আমি বাধা দেই নাই, তর কতাই মাইন্যা লইছি- জিব্রিল
মরলে আমার যে আর কিছুই থাকবো না- এইডি ভাইব্যাই শুধু আমি তর কতা মাইন্যা লইছি। কিন্তু এইডিই আমি বুঝবার পারি নাই যে, তর কতা মাইন্যা লইলে জিব্রিলরেই আমি জন্মের মতো পর কইরা দিমু। রাইতের পর রাইত আমার দুই চক্ষের পানি দিয়া বালিশ ভিইজ্যা গেছে- কাউরেই কিছু কই নাই। কইবার পরবিত্তি অয় নাই। কিন্তু কই এত কিছু কইরাও
তো হ্যারে আমি বাঁচাইবার পারলাম না। হেই-ই তো আছিল আমার আন্ধার ঘরের টিম টিম কইরা জ্বইল্যা থাকা কপালের লাল টিপের লাহান সামাইন্য এক রত্তি সুখের বাত্তি। আমার জীবন, আমার সব- নিইভ্যা গেল, থাকলো না। তুই তো অহনও বাইচ্যা রইছস, প্যাট ভরতাছস। উল্টা অহন তুই আমারে নছিহত করস! শরম করে না তর? হ, বেইশ্যাগো আবার
শরম থাকতে আছে নাকি !’
শাড়ীর আঁচল দিয়ে চোখের পানি মোছে পদ্মকলি। কিছুতেই সামলাতে পারে না নিজেকে। হৃৎপিন্ডের ভেতরে হা-হাকার করে ওঠে। এক সাথে এতগুলি কথা কোন দিনই বলেনি পদ্মকলি। দু’চোখ বেয়ে ঝরতে থাকে অশ্রুর প্লাবন। কিন্তু এ সবে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই সখিবানুর। বিরামহীনভাবে সে চিৎকার করতেই থাকে‘হারে আমার কপাল!
এই আছিল আমার কপালে। মাইয়া অইয়া তুই আমারে আইজ খাওনের উক্তি দিলি? খামুনা আইজক্যর থাইক্যা তর নাগরের ট্যাকার ভাত।
না খাইয়া মইরা যামু হ্যাতেও খামুনা। শ্যাষ কতা কইয়া দিলাম। তর ভাতের থালায় আমি মুইত্যা দেই।’ কিছুটা শান্ত হয়ে চোখের পানি মুছে স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করে পদ্মকলি। বলে‘মুইত্যা দিয়া পরকালডারে বানের পানির লাহান ভাসাইয়া দিবি? নাকি ইটভাটির চুলা বানাবি? এই কালেই তো হেই চুলায় জ্বলতাছি দুইজনেই। কাম নাই, আইজক্যার মত এই পিলানডারে বাদ দে। ভাত না খাইস, হ্যাতেই চলব। আর ফ্যাচ্ ফ্যাচ্ করিস না। তুই কয়বার যে মরবি হেইডি গেরামের ব্যাবাক মাইনষের ঠোটের ডগায় লটকাইন্যা আছে- আমারে কইতে অইব না। শোন, ঘরে চাইল ডাইল ত্যাল নুন সবই আছে, ইচ্ছা অইলে রাইন্দ্যা বাইড়্যা খাইয়া লইস। আইজ রাইতে আর আমি ফিরুম না।’
সখিবানু আঁৎকে ওঠে, কপালে কয়েকটি ভাঁজ ফুটে ওঠে- ‘ও আল্লাহ, কস্ কী! আইজক্যা যে দুইজন বড়ই উঁচা দরের মান্ষি আইব। তরে তো কাইল রাইতেই আমি কইয়া রাখছি।’ ‘ফালাইয়া রাখ তর উঁচা দর। হ্যাগো থাইক্যাও উঁচা দরের নাগরের ঘরে আইজ আমার ‘ইনভাইড’, অ, তুই তো আবার ইংরেজী বুঝস না দাওয়াত, বুঝলি আমার দাওয়াত।
যাইক্গ্যা, সাজনডি কেমন অইল দ্যাখবি না ?’ - খিল খিল করে হাসতে থাকে পদ্মকলি। হাসতে হাসতেই মায়ের মুখোমুখিএসে দাঁড়ায়। মা ওর মুখের দিকে তাঁকায়, কিন্তু আর কিছু বলে না।

কিছুকক্ষণ আগেই একান্ত মনে সাজগোজ করছিল পদ্মকলি। এখন চোখের পানিতে সব ধুয়ে মুছে গেছে। আবার নতুন করে তড়িৎ গতিতে মুখে স্নো মেখে নিয়ে পাউডারের পাফ বুলিয়ে যায় বারবার করে। হঠাৎ এসব বন্ধ করে খিল খিল করে হাসিতে ভেঙ্গে পড়ে পদ্মকলি। হাসি ফুরোলে বাম হাতে আবার ঘষা মাঁজা ছোট্ট পুরোনো আয়নাটি মুখের সামনে তুলে ধরে
ডান হাত দিয়ে সস্তা লিপষ্টিকের টিউবটি দু ঠোঁটের ওপর ঘষতে শুরু করে। এর পর মাথার চুলের বিনুনিটা খুলে লম্বা চুলগুলি খুবই যত্নের সাথে চিরুনি করা শুরু করে। চিরুনি করা শেষ হলে আয়নাটা আবার মুখের সামনে তুলে ধরে দেখে নেয় সস্তা ¯স্নো’র ওপরে সস্তা পাউডারের প্রলেপটায় মুখটাকে ইচ্ছেমত ফর্সা দেখাচ্ছে কি না।ভাগ্যকুল নদী থেকে বেশ কিছু দূরের একটি গ্রাম- ‘ভাগ্যকুল’। নদীর নামেই গ্রামটির নামকরণ করা হয়েছিল কোনো এক কালে- সে নামটিই অক্ষত রয়ে গেছে আজও। সেই গ্রামের ভেতরেই মাটির মাত্র দুটি কাঁচা ঘরে মা মেয়ের বসবাস। একটি ঘর পদ্মকলির-দু’চালা। ওই ঘরটিতে ছেলেকে নিয়ে রাতে পদ্মকলি ঘুমায়। অন্যটি এক চালা- সে ঘরটিতেই মা সখিবানু কোনোরকমে প্রায়ই রাত্রি যাপন করে। কোন কোন দিন পদ্মকলির সাথে পদ্মকলির ঘরেও। যে রাতে পদ্মকলি বাড়ীতে থাকে না সে রাতে নাতিটিকে নিয়ে পদ্মকলির ঘরেই রাত্রি যাপন করে সখিবানু। মা মেয়ের বড় অদ্ভূত বিষন্ন জীবন- সুখ তো নেই-ই, সামান্য শান্তিও দুর্লভ্য। কিন্তু এমন ছিল না কখনই ওদের জীবন। এই মুক্তিযুদ্ধই ওদের জীবনকে এমন করে দিয়েছে। তবুও সান্তনা আর নিঃসীম গর্ব পদ্মকলির- ওর স্বামী একজন আকণ্ঠ মুক্তিযোদ্ধা এবং এ দেশটি এখন সর্বাঙ্গ স্বাধীন। পদ্মকলির ঘরের ভেতর মোটে ভাঙ্গা একটি টেবিল, টেবিলে সাজ গোজ করবার সামান্য কিছু কমদামী টুকিটাকি, একটি ব্রেসিয়ার দলা পাকানো, কাঁচের একটি পানির জাগ, তাতে অর্দ্ধ-জাগ পরিমাণ পানি, ওটির পাশে একটি কাঁচের শুণ্য গ্লাস। একটি চেয়ার- যে চেয়ারটিতে বসে সাজগোজ করছে পদ্মকলি। টেবিল থেকে কিছু দূরে একটি চৌকির ওপর পরিপাটি করা একটি বিছানা। বোঝাই যায় কোন খদ্দের এলে ঐ বিছানাতেই তার স্থান হয়। বিদেয় হলে নিজের শোবার ব্যবস্থা। এতক্ষণ চেয়ারে বসেই নিজেকে তৈরী করছিল পদ্মকলি। উঠে দাঁড়িয়েই সোজা সখিবানুর গলা জড়িয়ে ধরে বলতে শুরু করলো অবলীলায়-‘আইচ্ছা কতো মা- তুই মরলে আমার কি অইব? আর আমি মরলে তর কি অইব? আমাগের তিন কুলে তো কেউ নাই। খালি মরণ মরণ করস- আমার বুঝি খুব ভাল্লাগে? একদিনও আর ঐ কতা কবি না তুই। যদি কস তাইলে জানবি তর দড়ি আমার গলাতেই ঝুলব। তুইও আর ঠ্যাকাইবার পারবি না।’ মা মেয়ের মধ্যে এ ধরনের ঝগড়াঝাটি, চুলোচুলি, গালিগালাজ, কান্নাকাটি নৈমিত্তিক ঘটনার একটি স্বাভাবিক চিত্র মাত্র। কেউ কিছু মনে করে না।
মেনেই নিয়েছে গ্রামের প্রায় সব সাধারণ মানুষ ওদের চরম দারিদ্র্যের ভেতর থেকে সঞ্জাত ওদের প্রতি এক ধরনের দয়া মিশ্রিত করূনার কারণে। সবাই কেমন জানি বিষয়টিকে নিতান্তই চিরাচরিত-‘দারিদ্র্যের অভিশাপ’- হিসেবেই গ্রহণ করেছে। কিন্তু তারপরেও যে কিছু উটকো ঝামেলার সৃষ্টি হয় না তা নয়- হয়, তবে তার মাত্রার বিষয়টি খুব একটা উল্লেখ
করবার মত নয়। গ্রামের কম বয়সী কিছু ছেলে ছোঁকড়া এ ওর হাত টিপে নীরব হাসাহাসি করে, কোন কোন সময় আবার চায়ের দোকানেও বিষয়টি নিয়ে চটুল গল্প গুজব, হাসা হাসি হয়। কিন্তু ঐ পর্যন্তই। এর বাইরে আর গড়ায় না বিষয়টি।

০২.
ভাগ্যকুল।
ভাগ্যকুল নদীর তীর থেকে বহুদূরে অতি অপরিচিত কোন শুণ্য বিরান কদর্মাক্ত ভূমিতে যেন নীরব, নিষ্পন্দ, প্রাণহীন এক নিথর দেহের মতো কাত হয়ে পড়ে রয়েছে অজানা, অচেনা অদ্ভুত এক পদ্মকলি। একটি হাত বুকের ওপর জড়ানো অন্য হাতটি মাথার দিকে প্রলম্বিত। ভিজে যাওয়া ছিন্ন, ভিন্ন শাড়ী ব্লাউজ, তার ওপর পিচ্ছিল কাদার ভারী প্রলেপ-এ এক কিম্ভুতকিমাকার পদ্মকলি। মনে হয় কোনো ভাস্করের অর্দ্ধ খোদাই করা অসমাপ্ত ভাস্কর্য যেন। দূর থেকে কোনোভাবেই বুঝে ওঠার উপায় নেই ওর শরীরে শ্বাস প্রশ্বাস বইছে কিনা। আকাশে সূর্য নেই। তবে হালকা মেঘের আস্তরণ রয়েছে দিগন্ত জুড়ে। মাথার ওপরে কাক, চিল, শকুনের প্রবল মাতামাতি। বিচিত্র সব শব্দের চিৎকার, চ্যাচামেচি, ওড়া উড়ি দিগন্ত ছাড়িয়ে যাওয়া সীমাহীন মেঘের শরীরে ভেসে ওঠা দিকচক্রবালের ওপাড় পর্যন্ত বোধকরি।
জিব্রিলের মৃত্যুর পর কোনো এক মধ্য রাত্রিতে অতি আকষ্মিকভাবে ধেয়ে আসা প্রচন্ড ঝড় আর প্রবল জলোচ্ছাসের কবলে পড়ে ‘ভাগ্যকুল’ গ্রামটি প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিলো। গ্রামটির নব্বই শতাংশ কাঁচা ঘর বাড়ীর সবটাই ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছিলো। কত মানুষ, কত নারী, পূরুষের যে প্রাণহানি ঘটেছিলো কেউ জানে না তা, কোনো হিসেবও কেউ রাখে নি সে দিন। যেদিকে দু’চোখ পড়েছে সেদিকেই শুধু লাশ আর লাশ, সেই সাথে বিদ্ধস্ত বাড়ী ঘরের ধ্বংশস্তুপ। আর সেই ধ্বংশযজ্ঞের মর্মান্তিক স্মৃতি বহন করছে লাশের চাদর দিয়ে মুড়িয়ে দেয়া এ মূহুর্তের এ বিরান প্রান্তরটি। ভাগ্যকুল নদীর প্রবল জলোচ্ছাস এভাবেই সেদিন ভাগ্যকুল গ্রামের শত শত দরিদ্র আর বঞ্চিত মানুষজনের ভাগ্য বদলে দিয়েছিলো এক অভাবনীয় দুর্ভাগ্যের অভিশাপ দিয়ে। অলৌকিকভাবে অর্ধমৃত হয়ে কোনো মতে দু’একজন যারা বেঁচে গিয়েছিলো তাদেরই একজন ছিলো পদ্মকলি। কি মর্মান্তিক পদ্মকলির নিয়তি!! সব হারিয়ে তবু বেঁচে আছে এখনও


এ বেঁচে থাকা কি পদ্মকলির আর একটি মৃত্যুকে অনিবার্য করে তুললো না ? বেঁচে আছে পদ্মকলি। এখনও ছোট্ট প্রাণটি ধরে রেখেছে কোনোমতে। বুকের সাথে লেগে থাকা হাতটি মৃদু মৃদু নড়ে উঠছিল পদ্মকলির। থেমে থেমে বার কয়েক। এরপর মাথার ওপরে প্রলম্বিত হাতটিও নড়ছিল ধীরে ধীরে। চোখ দুটো মেলবার চেষ্টা করেও পারছিল না পদ্মকলি। ব্যর্থ হচ্ছিল বারবার। দুটো চোখের ওপরই প্রচুর কাদার বিস্তার পুরু ঠোঁট দুটোকে পর্যন্ত ঢেকে দিয়েছিল দারুণভাবে। কিছুতেই খুলতে পারছিল না পদ্মকলি ওর ক্ষুদ্র প্রাণের নিভু নিভু
দীপশিখাটির অতি সামান্য আলোর উষ্ণ উত্তাপ দিয়ে।
প্রচ- এক অভাবিত যুদ্ধ যেন শুরু করেছিল পদ্মকলি নিজের মৃত্যুর সাথে। যুদ্ধ শেষে মৃত্যুকে হার মানিয়েছিল ও ওর অসাধারণ জীবনী শক্তি দিয়ে হয়তো। নিজের শরীরের ওপর কয়েকটি উন্মত্ত কাকের কর্কস চিৎকার আর ওদের শক্ত ঠোঁটের ঠোকরের আঘাতে ফিরে পেয়েছিল পদ্মকলি ওর হারিয়ে যাওয়া জ্ঞানের কিছুটা বুঝিবা। হাত দুটি সচল হয়েছিল, পা
দুটিতে শক্তি সঞ্চারিত হচ্ছিল ধীরে ধীরে। দু’হাত দিয়ে চোখের ওপরের কাদার স্তুপ কোনোমতে সরিয়ে চারদিকে তাকাবার চেষ্টা করছিল পদ্মকলি কিন্তু পারছিল না। চোখ দু’টির ভেতরে যেন বালির পাহাড়। বার বার চোখ মুছতে মুছতে একসময় খুবই অস্বচ্ছ এবং কিছুটা ঘোলাটে দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেয়েছিল পদ্মকলি। তাই দিয়ে ভীষণ শঙ্কা আর আতঙ্ক নিয়ে
চারদিকে তাঁকাচ্ছিল পদ্মকলি। কাঁপা কাঁপা ঠোঁটে প্রথম উচ্চারণ করেছিল-‘আমার পোলা? আমার পোলায় কই?’ চারদিকে তাকিয়ে দেখবার চেষ্টা করছিল। দু’চাখ মুছে নিয়ে আবার তাঁকাচ্ছিল চারদিকে। পা’দুটোকে প্রাণপণ শক্তি দিয়ে কাদার ভেতর থেকে টেনে তুলতে গিয়ে ব্যর্থ হলো। পারলো না। অসম্ভব ভারী মনে হচ্ছিলো পা’দুটোকে। আবারও তাকালো
চারদিকে- শুধু লাশ আর লাশ, মানুষ আর পালিত পশুর লাশের মেলা, শকুনের মহোৎসব। একটি করে লাশের ওপর কয়েকটি করে শকুন খুবলে খুবলে খেয়ে চলছিলো মৃত মানুষ আর পশুর একাকার হয়ে যাওয়া নাড়ি ভুরি মাংস মজ্জা সব। কিছুতেই আর সহ্য করতে পারে না পদ্মকলি- আপনা আপনি দৃষ্ঠিশক্তি ক্ষীণ হয়ে আসে, পুরোপুরি নিভে যেতে চায়।
চিৎকার করে ওঠে-‘অ মা তুই কই ? অ মা, মা’রে, আমার পোলারে তুই নিছস্? কতা কস্ না ক্যা, অ মা? আমার পোলারে আইন্যা দে!’ কণ্ঠের সব শক্তি দিয়ে চিৎকার করতে চাইলেও চিৎকার করা হয়ে ওঠে না পদ্মকলির। কন্ঠস্বর মিইয়ে আসে,নিস্পৃহ হয়ে যায়। আবারও জ্ঞান হারাতে শুরু করে। প্রচ- বাতাসের ঝাপটা এসে লাগে ভেজা শরীরে। তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে
পড়ে পদ্মকলি। তন্দ্রাচ্ছন্নতার ভেতর দিয়েই স্বপ্ন দেখতে শুরু করে অনিঃশেষ। বড় সুখের স্বপ্ন! এ স্বপ্নের যেন শেষ নেই।মানুষের গোটা জীবনের স্বপ্ন যে- ‘সুখ’- সে সুখ বুঝিবা আর অধরা নয়, এবার হয়তো একেবারে নিশ্চিত হাতের মুঠোয়।দেখতে পায়- সুদূর আকাশের সীমানা যেখানে সিক্ত ¯স্নিগ্ধ মাটিকে ছুঁয়ে একান্ত আপনার করে নিয়েছে দু’জন দু’জনকেসেখান
থেকে রুদ্ধশ্বাস ঊর্দ্ধগতিতে পদ্মকলির দিকেই ছুটে আসছে একটি বিশাল শৃগাল- যার চোয়াল দু’টি কুৎসিত মাত্রায় প্রসারিত, চোখ দু’টিতে সমুদ্রগামী জাহাজের সার্চ লাইটের অন্তর্ভেদী তীক্ষèতা, প্রকা- জিভের পুরোটাই যেন বেরিয়ে এসেছে বাইরে- অবিরাম লালা ঝরছে- এক্ষুণি বোধ হয় গিলে ফেলবে কুঁকরে যাওয়া পদ্মকলির পুরো শরীরটিকে।
শৃগাল। শৃগাল নামের এই জন্তুটিকে ভীষণ রকমের ভয় পদ্মকলির। এই শৃগালই একদিন দিনে দুপুরে ওর কাঁচা মাটির ঘরের দাওয়ায় ছেঁড়া কাঁথার ওপর শোয়ানো ওর মাত্র চার মাস বয়সের বুকের মানিক, ওর একমাত্র সন্তানটিকে তীব্র আক্রমণ করে একটি পায়ের গোড়ায় তীক্ষè দাঁতের কামড় বসিয়ে দিয়ে তুলে নিয়ে গিয়েছিল ওর বাড়ী থেকে বেশ কিছু
দূরের ঘন-গভীর ঝোপের অন্ধকারে। সন্তানের কান্নার চিৎকার, পদ্মকলির হা-হা কার আর প্রতিবেশীদের কোলাহলে শৃগালটি আর শেষ পর্যন্ত ভক্ষণ করতে পারেনি পদ্মকলির দুধের বাচ্চাটিকে। ঝোঁপের ভেতর ফেলে রেখে কোথায় অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল। প্রতিবেশীরা উদ্ধার করে নিয়ে এসেছিল শিশুটিকে। এর পর থেকে কেমন যেন অস্বাভাবিক হয়ে গিয়েছিল
পদ্মকলি। প্রতি মুহুর্তে একটা ভয়ঙ্কর ভীতি, একটা প্রবল আতঙ্ক যেন তাড়া করে ফিরছিল ওকে। মুহুর্তের জন্যেও আর বুকের কাছ থেকে আলাদা করতে চায়নি ওর বুকের মানিককে। বুকের অনন্ত-গভীরে আঁকরে ধরে বুকেরই নরম উষ্ণতা দিয়ে তিল তিল করে বড় করে তুলছিল ওকে অস্ফুট প্রগাঢ় এক-‘সুখ’-এর প্রতীক হিসেবে। ঠিক তখন থেকেই শৃগাল
নামের ঐ জীবটির প্রতি দারুণ এক ধরনের অবিমিশ্র ঘৃণা, ক্ষোভ, আক্রোশ আর ভীতি পদ্মকলির প্রতি ফোঁটা রক্তের অণুতে, পরমাণুতে এবং কণিকার সাথে মিশে গিয়ে অবিচ্ছেদ্য হয়ে গিয়েছিল।
কুঞ্চিত, আড়ষ্ট, ভীত পদ্মকলির হৃৎপিন্ডে তবুও একটি অবিলোল সুখের শিহরণ- শৃগালটির শরীরের রংটি একেবারেই দুগ্ধফেননিভ শয্যার মত ধবধবে সাদা। শৃগালের গায়ের রংটি তো মোটেই সাদা হবার কথা নয়। অথচ তারপরেও সাদা।সাদারও যে একটি অসাধারণ সৌন্দর্যে আবৃত রূপ আছে- শিক্ষা না থাকলেও- জানে পদ্মকলি। তবে শুধুমাত্র এই জানা,
এই উপলব্ধিই কি সুখের অন্য নাম? বিশ্বাস করতে পারে না পদ্মকলি। সুখের নিঃশব্দ আগমনে আতঙ্ক থাকবে কেন?ভীতির মাত্রাহীন কম্পন সৃষ্টি হবে কেন হৃদয় জুড়ে? এ সুখ তো চায়নি সে, চেয়েছিল অফুরন্ত রঙ্গিন জীবন, সারা জীবন ধরে কিশোরীর পেলবতা মিশ্রিত অনিন্দ্য চপলতা, তরুণীর দুরন্ত প্রগলভতা। অস্থির হয়ে যায় ভেতরে ভেতরে, চাঞ্চল্য
ফুটে উঠতে চায় ওর ছোট্ট মুখম-লটি জুড়ে। কিন্তু এ কি ? এ তো সে সুখ নয়- এ যে শ্বেত শুভ্র রংয়ের অন্তর ছিঁড়ে


বেড়িয়ে আসা এক হিম-শিতল মৃত্যুর শব্দহীন আহ্বান, উৎকট নির্মমতার নির্মোহ হাতছানি, কৃষ্ণ-কষ্টের নিদারুণ যন্ত্রণা।
চৈত্রের নির্মেঘ প্রশান্ত আকাশে পূর্ণ চন্দ্রালোকের উজ্জ্বল বিভার প্রতিঃসরণ তো এ শুভ্রতায় এতটুকুও নেই। সফেদ
শুভ্রতাও তো সুখের এক ধরনের নিগুঢ় উপলব্ধি। কিন্তু কই- এ তো তা নয়। এ সুখ তো কোনোভাবেই কামনা করে নি
পদ্মকলি। খুব দ্রুত এগিয়ে আসছে শৃগালটি। এখুনি হয়তো আক্রমণ করে বসবে পদ্মকলিকে। হলোও তাই- উল্লসিত
উন্মাতাল ঝড়ের মতো কাছে এসেই একটি শক্তিমত্ত কামড় বসিয়ে দিল পদ্মকলির একটি পায়ের গোড়ায়। টানতে লাগলো
বিপুল শক্তিমত্ত গতিতে পেছনের দিকে- যেখানে আকাশ আর মাটির নিবিড় বন্ধুত্ব অপরূপ রূপের শোভা নিয়ে ঘনিষ্টতর
হয়েছে- তারও নেপথ্যে। অর্থাৎ দৃশ্যলোকের অন্তরালে। টেনে হিঁচ’ড়ে অবিরাম নিয়ে যেতে থাকলো শৃগালটি পদ্মকলির
মৃতপ্রায় শরীরটিকে। দূরে, বহুদূরে- আরও বহুদূরে টেনে নিয়ে গিয়ে এক সময় হঠাৎ করে কেন জানি ছেড়ে দিয়ে যেখান
থেকে এসেছিল সেখানেই আবার অদৃশ্য হয়ে গেল জন্তুটি। কেন এমনটি হলো ! এটি কিসের ইঙ্গিত? এটি কি শুভ নয়?
একটু কেঁপে উঠলো যেন পদ্মকলি। তবে কি এটি শুধুমাত্র পদ্মকলির আজীবন-‘স্বপ্ন-চিলের’-সোনালী ডানায় ¯িœগ্ধ উদার
মুক্ত আকাশে বিঘœহীন উড়ে চলা কাক্সিক্ষত-‘পুস্প-সুখ’-এর অকাল মৃত্যুর বিভৎস পূর্ব-সঙ্কেত !
জেগে উঠলো বোধকরি পদ্মকলি। পা’দুটো যেন একটু নড়ে উঠলো, ঠোঁট দুটোও কিছুটা কেঁপে উঠলো যেন। কিন্তু না
আবার তন্দ্রার নদীতেই ডুবে গেল। সারা মুখে ঘামের চিহ্ন- তৃণলতায় আশ্রয় নেয়া ঝরে পড়বার পূর্ব মুহুর্তের বিন্দু বিন্দু
শিশির ফোটা যেন স্ফটিক-স্বচ্ছ মুক্তোদানার মতো। বড় অপূর্ব লাগছিল পদ্মকলিকে! এত গাঢ় কাদায় আকণ্ঠ নিমজ্জিত
থেকেও এত অপরূপ কল্পিত স্বর্গের শোভা কি আগে কখনও ছিল পদ্মকলির? জানে না পদ্মকলি। জানতে চাইবার আগ্রহই
জন্মায় নি কোনদিন, সময়ও জোটে নি। কেন আগ্রহ জন্মায়নি এবং সময় জোটাতে পারেনি পদ্মকলিÑ সে এক ভিন্ন
ইাতহাস।
০৩.
জিব্রিল গায়েন।
পদ্মকলির স্বামী। একতারায় গান বেঁধে ভালোবেসেছিল পদ্মকলিকে। বিয়ে করেছিল। পদ্মকলির নামটি পদ্মকলি ছিল না
কোনদিন- ছিল শুধু ‘পদ্ম’। বিয়ের পর ‘কলি’-শব্দটি ওর নামের সাথে যোগ করে দিয়েছিল জিব্রিল। বড়ই মমতা জড়ানো
নাম। যতদিন জীবিত ছিল এ নামেই ওকে ডাকতো জিব্রিল।
বড় ক্লান্ত। ডান পা-টি খোঁড়া। খোঁড়া পা-টি নিয়েই ভাগ্যকুলের তীর ধরে অতীব শ্লথ গতিতে ক্রাচে ভর দিয়ে সামনের
দিকে হেঁটে আসছে জিব্রিল। কখনও গোটা শরীরটি ন্যুয়ে আসছে নীচের দিকে আবার কখনওবা ঋজু হয়ে দাঁড়াবার চেষ্ট
করছে প্রবল ইচ্ছাশক্তি দিয়ে। কিন্তু চলার গতিতে এতটুকু যতি পড়ছে না। ওর দূরলোকে তাকানোর ভঙ্গিমাই বলে দেয়
কোথায় যেন পৌঁছুতে চায় সে। ওর দু’চোখের সুদূর প্রসারিত দৃষ্টির তীক্ষèতা দেখে মনে হয় কিসের যেন এক অতলান্ত
আঁকুতি নিয়ে কি যেন অবিরাম খুঁজে চলেছে সে। কি যেন পেতে চাইছে সে তার নিজের মতো একান্তই আপন করে।

ভাগ্যকুলের পানিতে জোয়ার নেই। নি¯প্রভ, নিস্তেজ। হঠাৎ ঐ প্রশান্ত পানিতে নিজের ছায়া লক্ষ্য করে জিব্রিল।
অনেকক্ষণ সে ছায়ার দিকে অনিমেষ তাঁকিয়ে থাকে জিব্রিল গায়েন। ছায়ার মধ্যেই যেন নিজেকে নতুন করে উপলব্ধি
করতে চায় বার বার। কিন্তু পারে না। ব্যর্থ হয়। আবারও তাঁকায়, আবারও ব্যর্থ হয়। নিজেকে কেমন যেন অসহায় মনে
হয় নিজের কাছে। আর তাঁকাতে চায় না ঐ ছায়ার দিকে। আরও হয়তো অনেক দূর যেতে হবে ওকে। সন্ধ্যেও তো হয়ে
আসছে। ঘুরে দাঁড়ায় জিব্রিল‘খাড়াও।
কই যাও ?’- হঠাৎ পেছন থেকে নারী কন্ঠস্বর। চমকে ওঠে জিব্রিল গায়েন। থতমত খেয়ে যায় যেন। হাতে
একতারাটা নেই। একতারার বদলে জিব্রিলের দু’হাতের বগলে চেপে ধরা দু’টি ক্রাচ। কোনমতে নিজেকে সামলে নিয়ে
অপলক তাঁকিয়ে থাকে পদ্মকলির মুখের দিকে। ঝোঁপের আড়াল থেকে কখন যে পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে পদ্মকলি বুঝতে
পারেনি জিব্রিল। এখন চোখের সামনেই দন্ডায়মান সেই পদ্মকলি দু’চোখের বিস্ফারিত দৃষ্টি নিয়ে। দু’জনই বাকহীন। চরম
বিস্ময় আর জিজ্ঞাসা নিয়ে দু’জন শুধু তাঁকিয়ে থাকে দু’জনের দিকে। জিব্রিলের দু’চোখের তারায় অশ্রুর ইঙ্গিত। একটু
পরেই হয়তো ঝ’রে পড়তে শুরু করবে।
এ রকম একটি বিষণ্œ আবেগঘন অবস্থায় ফিস্ ফিস্ করে বলে ওঠে জিব্রিল‘তুই
মরস নাই ?’
‘ক্যামনে মরুম, তোমার লগে আমার দেখা হওন লাগবো যে। তুমি ফিইরা আইলা ক্যান? লোকে কয় একবার যুদ্ধে গেলে
নাকি আর ফিরন যায় না, জানডারে দিয়া দিতে অয়। তয় তুমি ফিইরা আইলা ক্যান, জানডারে দিয়া দিবার পার নাই !
দ্যাশ তো স্বাধীন অইয়্যা গেছে। দ্যাশ স্বাধীনের লইগ্যা জীবন দিলে মাইনসে তোমারে শহীদ কইতো। আর যুদ্ধে যাইবার

আগে তুমি তো কইয়্যাই গেছিলাÑ দ্যাশ স্বাধীনের লাইগ্যা তুমি জীবন দিবার যাইতাছ।’Ñ অনেক ক্ষোভ, দুঃখ আর
যন্ত্রণার উচ্চারণ যেন পদ্মকলির এ কথাগুলি।
‘তুই মরস নাই বইল্যাই বুঝি ফিইরা আইবার পারছি। নাইলে আমিই বা ফিইরা আসুম ক্যান ? আর ডাইন পাওডারেই বা
শক্তিহীন কইর‌্যা ফালামু ক্যান ? আর হেই শক্তিহীন পাও লইয়্যা এই ক্রাচের উপরে ভর কইর‌্যা তর সামনেই বা খাড়ামু
ক্যান ?
‘কি ? কী কও? কী কইবার চাও তুমি ?’Ñ এতকক্ষণ যেন কোনো এক মোহাচ্ছন্ন মানুষের মতো পদ্মকলি শুধু জিব্রিলের
মুখের দিকেই তাঁকিয়েছে, হাত পায়ের দিকে লক্ষ্য করে নি। আর সে কারণেই আচমকা পদ্মকলির দু’চোখের দৃষ্টি স্থির
হয়ে যায় জিব্রিলের দু’পায়ের ওপর, দু’হাতের বগলে চেপে ধরা ক্রাচ দু’টির ওপর। চোখ দু’টিতে অস্বাভাবিক রকমের
তীক্ষèতা ফুটে ওঠে। ভাবতে পারে না আসলে এটি সত্যি কিনা ?
‘হ। এইডিই সত্য। মাসের পর মাস ধইরা যুদ্ধ করছি- ইট্টুও ডরাই নাই, দ্যাশডিও প্রায় স্বাধীন হওনের খুব কাছে আইস্যা
পড়ছে- এরই মইধ্যে একদিন অনেক রাইতে খুব ছোট্ট একডি যুদ্ধে পর পর অনেকগুলি গুলি আইস্যা লাগলো আমার দুই
পাওতেই। বাঁচনের কতাই আছিল না। ক্যামন কইর‌্যা যে বাইচ্যা আইলাম নিজেই কইবার পারি না।’-কথাগুলি বলে
জিব্রিল স্থির তাঁকিয়ে থাকে পদ্মকলির মুখের দিকে। নিস্পৃহ, নিঃসার জড় পদার্থ যেন।

০৪.
‘যুদ্ধ অনেক আগেই শ্যাষ অইয়া গেছে, আমাগো দ্যাশডাও স্বাধীন অইয়া গেছে। শ্যাষবার যুদ্ধের ফরন্টে গিয়া সুস্থ পাও
দুইডিরে লইয়্যা আর ফিরবার পারি নাই। মেশিনগানের গুলিতে পাও দুইডি ঝাঁঝরা অইয়্যা গেছিলো। জ্ঞান হারাইয়্যা
ফালাইছিলাম। জ্ঞান যহন ফিইর‌্যা আইছে তহন আমি হাসপাতালের বিছনায়। পাও দুইডি অবশ অইয়্যা গ্যাছে, কোনো
অনুভূতি নাই। পরে জানছি এইডি ভারতের একডি হাসপাতাল। দুইডি পাও’ই কাইট্যা ফালানের কতা আছিলো, তয়
ডাক্তররাই খুব চেষ্টা কইর‌্যা পাও দুইডি না কাইট্যা কোনোমতে একডি পাওরে ঠিক করবার পারছে, আর একডিরে পারে
নাই, হেই পাওডিতে আমার আর কোনো শক্তি নাইÑপাওডি অবশ অইয়্যা গ্যাছে। দ্যাশ স্বাধীন হওনের কতা ডাক্তররাই
আমারে কইছে। হাসপাতালের বিছনায় শুইয়া শুইয়া কত কি যে ভাবছি, কত যে সুখের স্বপন দেখছি তরে আর পোলাডিরে
লইয়া- ঠিকানা নাইÑ স্বাধীন দ্যাশে ফিইর‌্যা যামু, বুক ভইর‌্যা শ্বাস নিমু, তরে লইয়্যা নতুন কইর‌্যা গান বান্ধুম, হেই গান
গাইয়্যা তরে আর পোলারে হুনামুÑ কত্ত কী যে ভাবছি, কত্ত স্বপন দেখছি কিন্তু দ্যাশে আইবার পারি নাই। দ্যাশে আইবার
লাইগ্যা ডাক্তরগো হাতে পায়ে ধইরা কত যে কাকুতি মিনুতি করছি ডাক্তররা আমারে ছাইড়া দেয় নাই, দ্যাশেও আর
আইবার দেয় নাই। হ্যার বাদে আরও কত দিন জানি অইব কইবার পারি না- হ্যাষে ডাক্তররা যহন বুঝবার পারছে
এই ডাইন পাওডির আর ভাল হওনের কুন লক্ষণই নাই, ক্যাবল তহনই ওই পাওডির আর চিকিৎসা না কইর‌্যা আমার
হাতে এই ক্রাচ দুইডি দিয়া হ্যারাই আমারে কইছে- ‘যাও, অহন দ্যাশে ফিইরা যাও। তোমাগো দ্যাশ স্বাধীন অইয়্যা
গ্যাছে। স্বাধীন দ্যাশে ফিইর‌্যা গিয়া বুক ফুলাইয়া বউ বাচ্চাগো লইয়া শান্তিতে বসবাস কর। আর কুনদিন কেউ
তোমাগের দ্যাশডারে পরাধীন বানাইবার পারব না, তোমাগো সুখ ছিনাইয়া লইবার পারবো না। আর একডি কতা, দ্যাশে
ফিইর‌্যা গিয়া ডাইন পাওডির চিকিৎসা কইরো। দীর্ঘদিন ধইর‌্যা চিকিৎসা করলে পাওডি ভালও অইয়্যা যাইবার পারে।
আমাগো কাছে তো অত বেশী সোময় নাই। থাকলে আমরাই চিকিৎসা করতাম।’ [কথাগুলি ডাক্তাররা শুদ্ধ বাংলা ভাষাতেই
বলেছিলো। কিন্তু সেই শুদ্ধ বাংলা ভাষাকে জিব্রিল এভাবে ওর নিজের ভাষাতে আপন করে নিয়েছে ]। কথাগুলি জিব্রিলের
চিন্তা প্রবাহে কেন জানি বার বার করে উথ্লে উঠছিলো পদ্মকলিকে বলবার জন্যে কিন্তু প্রকাশ করতে পারছিলো নানিজের
মধ্যে কেমন যেন এক ধরনের মিইয়ে আসা আড়ষ্টতা বোধ করছিলো জিব্রিল পদ্মকলির সম্মুখে ; কি যেন শুনতে
চাইছিলো শুধুই পদ্মকলির মুখ থেকে চোখের তীব্র চাঞ্চল্য আর অশেষ আগ্রহ নিয়ে। কিন্তু পদ্মকলি কিছুই বলে নি। শুধুই
ওর মুখের দিকে তাঁকিয়ে থেকেছে টিম টিম করে। এভাবে কত সময় কেটে গেছে বুঝতে পারে নি জিব্রিল। হঠাৎ শুধু
দেখতে পেয়েছে ফিরে যাবার জন্যে ঘুরে দাঁড়িয়েছে পদ্মকলি। স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে থেকে অপলক শুধু তাঁকিয়েই থেকেছে
জিব্রিল পদ্মকলির দিকে।
আর দাঁড়ায় নি পদ্মকলি। মুহুর্তেই যেন অদৃশ্য হয়ে যেতে চেয়েছে জিব্রিলের সামনে থেকে। এ দৃশ্য সে দেখতে চায়নি
কোনদিন, এ মূহুর্তে এ দৃশ্য আর সহ্য করতে পারে নি কিছুতেই। অতি দ্রুত পা বাড়িয়েছে সামনের দিকে। নিঃশ্ব^াস বন্ধ
হয়ে আসতে চাইছে ওর। কিন্তু এগুতে পারছে না পদ্মকলি। পায়ের গতি স্থবির হয়ে গেছে, বড় ভারী মনে হয়েছে
পা’দুটোকে। ধীরে ধীরে আবার ফিরে এসেছে জিব্রিলের কাছে। এসেই তাঁকিয়েছে ওর মুখের দিকেÑ ঝর ঝর করে
দু’চোখের পাতা ভিজিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে জিব্রিলের দু’গাল বেয়ে। কোনো শব্দ নেই জিব্রিলের কন্ঠে। নির্বাক হয়ে গেছে

একেবারেই। শাড়ীর আঁচল দিয়ে অশ্রু ভেজা গাল দু’টি মুছে দিয়ে বড় যতেœর সাথে অসহায় জিব্রিলের একটা হাত তুলে
নিয়েছে আপন কাঁধের ওপর। খুবই ছোট্ট করে শুধু বলেছেÑ

‘চলো, সুখের ঘর বাঁধবা না ?’Ñ পদ্মকলিও আর কিছুতেই রোধ করতে পারে নি নিজের চোখের অশ্রুধারাকে। ঝরেই
চলেছে সে অশ্রুধারা অবিরাম। পদ্মকলিও বুঝি আর চায় নি সে ধারাকে আটকে রাখতে। অন্ততঃ কেঁদেও যদি কিছুটা
সান্ত¦না পাওয়া যায় !
দু’জনই এগুতে থাকে সামনের দিকে।
নিয়ে যায় ওকে ওদের নিজেদের জীর্ণ কুটিরে।
০৫.
শুরু হয় পদ্মকলির আর এক নতুন জীবনযুদ্ধ। স্বামীকে বাঁচাতে হবে, চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে, ডাক্তারের ফিস
যোগাড় করতে হবে, নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে- নিজেকে বাঁচাতে না পারলে সব কিছুই বিপন্ন হয়ে যাবে- সব মিলিয়ে
প্রচুর অর্থের সংস্থান করতে হবে। সম্বল তো মাত্র একটিই- নিজের বিদ্ধস্ত শরীর। ঐ শরীর দিয়ে আর কত উপার্জন করা
যায়। আগে খুব একটা গ্রামের বাইরে যেত না পদ্মকলি। পাশের গাঁয়ের পালদের পাড়ায় যে দিন, যে দিন মাটির কাজ
হতো সে দিন, সে দিন মা মেয়েতে মিলে সে মাটির কাজ করে যা পেত তাতে করে সংসার নামের সোহাগী চুলোটিতে
দু’এক দিনের জন্যে সামান্য কিছু তেল পড়তো, জ্বলতো কোন মতে টিম টিম করে। কিন্তু যে দিন কাজ থাকতো না সে
দিন চুলোটি আপনিই নিভে যেত। নিভে তো যেত কিন্তু সাথে সাথে আর একটি চুলো জ্বালিয়ে রেখে যেত দাউ দাউ করেসে
টি জঠরের- ঐ চুলোর আগুনের তাপ সহ্য করা যেত না কোনোমতেই। তারপরেও সহ্য করতে হতো- অদৃষ্ট ভেবে
নিয়ে- এই-ই ছিল মা মেয়ের সংসারের নৈমিত্তিক স্থিরচিত্র।
কিন্তু এখন তা হবার উপায় নেই। এখন দিনের প্রায় পুরোটা আর রাতের মাঝামাঝি পর্যন্ত গ্রামের বাইরেই কাটাতে হয়
পদ্মকলিকে। কখনও গ্রাম থেকে দূরের কোন শহরে, কখনও বা কাছাকাছি কোন আধা শহরে। এখনই হয়তো এক বিছানায়
তো কিছুকক্ষণ পরেই আবার হয়তো ভিন্ন কোন বিছানায়। বড় ক্লান্ত হয়ে পড়তো পদ্মকলি। তারপরেও যা উপার্জন হতো
তাতে প্রয়োজন মিটতো না মোটেও। যখন বাড়ীতে ফিরে আসতো তখন ওকে যেন মনে হতো পানিতে ভিজিয়ে রাখা বাসি
ফুলের ন্যাতানো পাপড়ির মতো। এসেই শুধু শাড়ীটা বদলে বসে পড়তো স্বামীর শিয়রের কাছে। মাথাটা নিজের কোলে
তুলে নিয়ে স্বামীর কপালে হাত রাখতো পদ্মকলি। কখনো কখনো ওষুধ খাইয়ে দিতো স্বামীকে, পরিচর্যা করতো পরম
মমতা দিয়ে। কিছুই বলতো না জিব্রিল। শুধুই পলকহীন তাঁকিয়ে থাকতো পদ্মকলির মুখের দিকে। কখনও বা অতিযন্ত্রণাক্লিষ্ট
স্বরে কিছু একটা উচ্চারণ করতে চাইতো কিন্তু পারতো না- আপনা আপনিই থিতিয়ে আসতো কথা। পদ্মকলিও
বুঝতে পারতো না কি বলতে চাইতো জিব্রিল- শুধু এটুকু বুঝতো- প্রচ- যন্ত্রণায় কষ্ট পাচ্ছে ওর স্বামী। কিন্তু পদ্মকলির
কিই-ই বা করণীয় থাকতো তখন শুধু মাত্র চোখের পানিতে ডুবে যাওয়া ছাড়া!
অনেকগুলি জটিল রোগে আক্রান্ত জিব্রিল। জানে সে আর বাঁচবে না। বোঝে- পদ্মকলিরও কোন সামর্থ্য নেই উন্নত
চিকিৎসার জন্যে ওকে বাইরে কোথাও নিয়ে যাওয়ার। তাতেও ওর কোন দুঃখ নেই, নিয়তি হিসেবেই মেনে নিয়েছে ও।
দুঃখ শুধু দুটি জায়গায়, একটি- সে একজন নিরঙ্কুশ মুক্তিযোদ্ধা- ব্যক্তিগত কিছু প্রাপ্তির লক্ষ্য নিয়ে সে মুক্তিযুদ্ধ করে নি- যা
কিছু করেছে তা শুধু শত্রুর কবল থেকে নিজের দেশের মাটিটুকু আর সে মাটিতে বসবাসকারী জ্বরাজীর্ণ অন্ন বস্ত্রহীন দুখী
মানুষগুলিকে মুক্ত করবার জন্যে। দেশটিকে আপাদমস্তক স্বাধীন করবার বুকভরা নির্মোহ উত্তুঙ্গ আকাক্সক্ষা নিয়ে। অথচ
আজ সেই পবিত্র মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে নোংরা দলীয় রাজনীতি করা হচ্ছে, মহান স্বাধীনতাকে রাজনীতির কবরে দাফন করা
হচ্ছে ! আর দ্বিতীয়টি- জিব্রিলকে বাঁচাবার জন্যেই পদ্মকলিকে বেশ্যা হয়ে যেতে হল- জীবিত স্বামী নীরবে এসব প্রত্যক্ষ
করা ছাড়া আর কিছুই করতে পারলো না- এর চাইতে অপরিমেয় মর্মান্তিক দুঃখ আর কি হতে পারে ! এ সব ভাবতে
ভাবতে জিব্রিল যেন আরও দুর্বল হয়ে পড়ে।
কয়েকটি লাশ নিয়ে যাওয়া হচ্ছে কবরের দিকে-দাফন করা হবে। সবকটি মানুষই অনাহার আর চিকিৎসাহীনতার শিকার,
সব কজনই স্বাধীনতা যোদ্ধা। অনেক দূর থেকে সম্ভবতঃ কোন রাজনৈতিক দলের ব্যানারে পর্যাপ্ত সংখ্যক দলীয়
লোকজনের একটি মিছিল সামনের দিকে এগিয়ে আসবার শব্দ ভেসে আসছে- মিছিল থেকে বুলবুলির কণ্ঠে শিখিয়ে দেয়া
ষ্টেনগানের ঝর্ণার শব্দ তরঙ্গায়িত হচ্ছে- ‘স্বাধীনতা এনেছি, স্বাধীনতা রাখব।’- কি নিলাজ ঔদ্ধত্য মানুষের পবিত্র
মনুষ্যত্বের বিরুদ্ধে! কি অলৌকিক তামাশা অগণন দুঃখী মানুষের জীবন নিয়ে !! সর্বোপরি কি জঘন্য তিরস্কার আর
অপমান মুক্তিযুদ্ধ আর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্ভ্রম আর মর্যাদার
প্রতি !!! এক দিকে উপোষী আর রোগদগ্ধ মুক্তিযোদ্ধাদের লাশের মিছিল অন্য দিকে মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে দলীয় রাজনৈতিক
প্রহসন।গোটা স্বাধীনতাকে দলীয় রাজনীতি দিয়ে ‘দলীয়-করণ’। স্বাধীনতা এসেছে সত্যিই, কিন্তু যারা শ্লোগান দিচ্ছে

তারা হয়তো আসলে গোটা স্বাধীনতাকে দলীয় রাজনীতি দিয়ে ‘দলীয়-করণ’। স্বাধীনতা এসেছে সত্যিই, কিন্তু যারা
শ্লোগান দিচ্ছে তারা হয়তো আসলে জানেই না কী করে স্বাধীনতাকে আনতে হয়েছে, শুধু শিখিয়ে দেয়া বুলি আউড়ে
যাচ্ছে। যন্ত্রণা-জর্জর জিব্রিলের হাসতে ইচ্ছে করে- করুণার হাসি। খুবই করুণা হয় ওদের জন্যে।
‘স্বাধীনতা।’ ‘সুখ।’
-বড় মর্মভেদী দু’টি শব্দ।
শুধুই উপলব্ধি করা যায়, স্পর্শ করা যায় না।
‘এই স্বাধীনতা কত জনের কপাল ভাংছে, কত জনের চওড়া কইরা দিছে। আর কারও বা কপালে আগুন জ্বালাইয়া দিছে।
আমার কপালের আগুনে আমি জ্বলতাছি। আমার সুখ অন্যের ঘরে বসতি বান্দছে- আমার সুখের গান গাওনের একতারার
তার ছিইর‌্যা গেছে। আমার একতারার তার দিয়াই তো আমি আমার স্বাধীনতারে আমার জীবনের লগে বাইন্ধ্যা লইছিলাম।
কিন্তু আমার স্বাধীনতা আইজ বেইশ্যা অইয়া গেছে। আর কারে লইয়া আমি সুখের স্বাধীন গান বান্দুম ? স্বাধীনতা আমারে
অনেক দিছে- দুঃখ, কষ্ট, জ্বালা, যন্ত্রণা, অভাব আর উপাস- হ্যার পরেও দিছে পদ্মকলিরে। পদ্মকলি মরে নাই- বাইচ্যা
রইছে। আমি ভাবি নাই হ্যায় বাইচ্যা থাকব-এই স্বাধীনতা যুদ্ধই বুঝি আমার লাইগ্যা অরে বাঁচাইয়া রাখছে- আমার কাছে
ফিরাইয়া দিছে। পদ্মকলিরে পাইয়া আমি সব ভুইল্যা গেছিলাম। কিন্তু কই হ্যারেও তো আমি বাঁচাইবার পারলাম না। উল্টা
নিজেরে অন্যের কাছে বেইচ্যা দিয়া হ্যায়-ই আমারে বাঁচাইবার লাইগ্যা অর ছোট্ট জীবনডিরে বাজি রাইখ্যা ‘মরণ-যুদ্ধ’ শুরু
করছে। এই নিদারুণ ভারী জীবনের বোঝা ক্যামনে টাইন্যা বেড়ামু আমি ? আমার হেই শক্তি যে আর নাই।’ - যেন পাগল
হয়ে যায় জিব্রিল। পাগলের মতো অস্থির হয়ে ওঠে। এক সময় নিস্তেজ হয়ে পড়ে। শুরু হওয়া বিকেলের অস্তাচলগামী
সূর্যের স্থিতি যে বড় কম- বুঝতে পারে জিব্রিল।
আজকে শেষ রাত্রির দিকে ফিরেছে পদ্মকলি। উপার্জনও হয়েছে অন্যান্য দিনের চাইতে মোটামুটি বেশী। মনটা বেশ
প্রফুল্ল আজকে ওর। জিব্রিলের জন্যে সব ওষুধগুলি কেনা যাবে। দুটো ভাল খাবারও জুটবে ওদের অনেকদিন পর।
জিব্রিলের জন্যে দুটো গেঞ্জি কিনবার মত টাকাও থাকবে। লুঙ্গি কিনবার টাকা থাকবে না। অপেক্ষা করতে হবে। খুবই খুশি
খুশি আজ পদ্মকলি- সাজতে ইচ্ছে করছে দারুণভাবে- যেন জিব্রিলের চোখ দুটো ওর ওপরেই আটকে থাকে সারাক্ষণ।
চোখের পলক যেন ফেলতে না পারে ও।
সখিবানু অনেক রাত অবধি পরিচর্যা করেছে জিব্রিলের। ওষুধ খাইয়ে দিয়েছে, নিজের হাতে ভাত তুলে দিয়েছে ওর মুখে।
নিজের হাতে ভাত তুলে খেতে পারে না জিব্রিল- ওকে খাইয়ে দিতে হয়। শীতের রাতেও ঘামছে জিব্রিল। নিজের শাড়ীর
আঁচল দিয়ে কপালের ঘাম মুছে দিয়েছে, অনেক রাত পর্যন্ত পাখা করেছে সখিবানু জিব্রিলকে। পদ্মকলি যখন থাকে না
তখন সখিবানুকেই এ সব করতে হয়। সখিবানুও বড় ভালোবাসে জিব্রিলকে। বড় মায়া হয় জিব্রিলের মুখের দিকে
তাঁকালে। এ সব করে এক সময় ক্লান্ত শরীর নিয়ে নিজের চালার নীচের বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ে। কিন্তু দু’চোখে ঘুম
আসে না। কেমন যেন একটা আতঙ্ক ভর করে সখিবানুর ওপর। এত ঠান্ডাতে তো জিব্রিলের ঘামবার কথা নয়। তাহলে
কি........................................! আর ভাবতে পারে না সখিবানু। চরম ক্লান্তির ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে যায় কখন যেন
নিজের অজান্তেই।
০৬.
প্রতিদিনের মতো আজও বাড়ীতে ফিরে ঘরের দরোজার শিকল খুলে ভেতরে প্রবেশ করেই কোন রকমে শাড়ীটি বদলে ঘুরে
দাঁড়াতেই জিব্রিলের পায়ের দিকে দৃষ্টি পড়ে পদ্মকলির। চাদর সরে গিয়ে ওর পা’দুটি বাইরে বেরিয়ে পড়েছে। দ্রুত কাছে
গিয়ে চাদরটা টেনে চাদরের বাইরে বেরিয়ে আসা পা’দুটিকে ঢেকে দিতে গিয়ে হাত পড়ে জিব্রিলের ওই পা’দুটির ওপরচমকিত
বিদ্যুতের মতো চমকে উঠে দু’পা পিছিয়ে আসে পদ্মকলি- ‘এত ঠান্ডা- পা !’ কি এক ঘোর আতঙ্কে বুকটা কাঁপতে
থাকে দুরু দুরু। দৌড়ে গিয়ে মাথার কাছে বসে। হাত দেয় কপালে- ঠান্ডা, শুধুই জমাট বরফ-ঠান্ডা। চোখ দুটো খোলা
কিন্তু নিষ্পলক। অনেকক্ষণ ধরে বুকের ওপর কান পেতে রেখে শ্বাস প্রশ্বাসের স্পন্দন শুনতে চায় পদ্মকলি। কিন্তু না,
নেই। আর ফিরে আসবে না কোনো দিন ওর স্বপ্নের স্বাধীনতাÑজিব্রিল গায়েন। চিরদিনের মতো হারিয়ে ফেললো ওকে
পদ্মকলি।
অনেক জ্বালা যন্ত্রণা আর বুক ভরা অভিমান নিয়ে নীরবে নিভৃতে পদ্মকলিকে প্রচ- ঘৃণা করে চলে গেছে জিব্রিল- আর ফিরে
আসবে না কোন দিন। চিৎকার করে মাকে ডাকবার চেষ্টা করে পদ্মকলি কিন্তু পারে না, কণ্ঠস্বর উচ্চারিত হয় না গলা
দিয়ে। ঘরের পাশের চালার নীচেই ঘুমিয়ে থেকেও জানতে পারলো না সখিবানু এ মুহুর্তে কী ঘটে গেল পদ্মকলির জীবনে
!
পদ্মকলির অফুরন্ত নিষ্পাপ স্বাধীনতার অকাল মৃত্যু।
পদ্মকলির সারা জীবনের স্বপ্ন-দেখা সুখের করুণ মরণ।

০৭.
ওর অতীত ফুরিয়ে গেলো। বাস্তবতার প্রখর সূর্য ওর সম্মুখে। এবার সত্যি সত্যিই জেগে উঠলো পদ্মকলি। দাঁড়ালো সেই
রংহীন, বিবর্ণ বাস্তবতার মুখোমুখি। সেই বিরান প্রান্তরের লাশের স্তুপ থেকে ক্লিষ্ট শরীর নিয়ে অতি কষ্টে ধীরে ধীরে
উঠে বসলো কাদার ওপরেই। চারদিকে দৃষ্টি ফেরালো- পাশেই পড়ে রয়েছে সখিবানু। ওর মা- মৃত। বুকের মানিককে
খুঁজলো চারদিকে- যত দূর দৃষ্টি যায়- নেই। ওকেও হয়তো নিয়ে গেছে এই ভাগ্যকুলের দুর্ভাগ্যের পানির প্রমত্ত জোয়ার।
ঐটুকুন তো বাচ্চা, কতটুকুই বা ওর প্রাণ! এত প্রবল জলোচ্ছ্বাসের তোড়ে ও কি আর বাঁচতে পারে? পদ্মকলি বেঁচে আছেএটাই
তো অলৌকিক। টলতে টলতে কোনোমতে উঠে দাঁড়ালো পদ্মকলি। পা’দুটো কাঁপছে। চারদিকে আবারও তাঁকালো
একবার, বুক ভরে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিলো। তারপর যেখানে আকাশ আর মাটিতে একাকার হয়ে গেছে সেখানেই দৃষ্টি
নিবদ্ধ করে এগুতে থাকলো সামনের দিকে- কোন

প্রতিক্রিয়া নেই, কোন ভীতি নেই, নেই কোন চাঞ্চল্য- যেন এক জড় পদার্থ- এগুলোও কয়েক পা। কিন্তু এ কি ? আবার
সেই সাদা শৃগাল। তুষার-শুভ্র ‘শ্বেত শৃগাল’। সেই দিগন্তের শেষ প্রান্তের অদৃশ্যলোক থেকে শৃগালটি দ্রুততম বেগে
এগিয়ে আসছে পদ্মকলির দিকেই। কিন্তু আজ আর এতটুকুও ভয় পেলো না পদ্মকলি। ওর তো আজ আর হারাবার কিছু
নেই। এগুতেই থাকলো পদ্মকলি শৃগালটির মুখোমুখি। আজ আকাশে মেঘ নেই তবে বাতাসের গতি প্রচ-। ভারী কাদায়
আচ্ছাদিত পদ্মকলির ভেজা শাড়ীর আঁচলও বাতাসে উড়ছে।
হঠাৎ শৃগালটির চলমানতার গতি থেমে গেলো। আর এগুলো না পদ্মকলির দিকে। যে দিক থেকে এসেছিল সেদিকেই
ধাবিত হতে থাকলো রূদ্ধশ্বাসে। কিসের ইঙ্গিত দিয়ে গেল শৃগালটি ? এ কি কোন অতিলৌকিক সুখের পূর্বাভাষ! যে সুখ
শুধু মৃত্যুর গভীর সরোবরেই খুঁজে পাওয়া যায়। যেখানে দিগন্তের শেষ প্রান্ত গিয়ে মাটির সাথে মিশে এক হয়ে গেছে
তার ওপাড়ে গেলেই কি সে সুখের আলিঙ্গন পেতে পারবে ? সেখানে গেলেই কি সেই ‘অমৃত-সুখের’ দেখা পাবে পদ্মকলি
? সেই সুখের বসতি বাঁধতে পারবে? শুভ্র শৃগালটি তো সে দিকেই অদৃশ্য হয়ে গেল। বুঝতে পারে না কিছুই। শুধু লালনের
একটি গানের দুটি চরণ কেন জানি এই মুহুর্তে বার বার করে মনে পড়ছে ওর। হৃৎপিন্ডের তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে গেঁথে আছে
গানটির সবগুলি কথা। গানটিকে খুব ভালোবাসতো জিব্রিল, প্রায়ই গাইতো- খুবই দরদ মেশানো কণ্ঠে পদ্মকলিকে গানটি
গেয়ে শোনাতো জিব্রিল
‘অবোধ মন তোরে আর কি বলিপেয়ে
ধন,
সে ধন............................................সব হারালি !’
অতি ধীরে এবার সামনের দিকে এগুতে থাকে পদ্মকলি শৃগালটির দেখিয়ে দেয়া নির্দিষ্ট পথটি অনুসরন করে সেই
দিগন্তের ওপাড়ে মিশে যাওয়া সুখ-সরোবরে ডুবে থাকা ওর অপার স্বাধীনতা জিব্রিলের সাথে মিলিত হবার আকাক্সক্ষার
স্বপ্নে মগ্ন যেন নীলিমার নীলে ঢাকা কোনো এক দুর্লভ চতুর্দোলায় চড়ে। স্বপ্নটি খুব বেশীক্ষণ স্থায়ী হয় না। ভেঙ্গে যায়।
হাঁটতে শুরু করে পদ্মকলি। হাঁটতে হাঁটতে মাঝে মাঝে থেমে যায়, থেমে গিয়ে বসে পড়ে, প্রাণপন শক্তি দিয়ে উঠে
দাঁড়িয়ে হাঁটতে গিয়ে আবার টলতে টলতে পড়ে যায়, আবারও উঠে দাঁড়িয়ে হাঁটবার চেষ্টা করে, কিন্তু পারে না। সব শক্তি
যেন ফুরিয়ে আসে ওর। কিছুতেই পারে না আর, তবুও কোনোমতে শরীরের সব শক্তি একত্রিত করে উঠে দাঁড়ায় শেষ
বারের মতো বুঝি। উঠে দাঁড়িয়েই এক সময় স্থির হয়ে যায় পদ্মকলি। দাঁড়িয়ে পড়ে অসংখ্য লাশের চাদরে ঢাকা অসীম ধু
ধু প্রান্তরের মাঝখানে। শ্বাস প্রশ্বাসের গতিও স্তিমিত হতে শুরু করে ধীরে ধীরে। নিস্তেজ হতে থাকে পদ্মকলি সময়
ফুরোনোর ক্ষণে ক্ষণে। বিড়বিড় করে শুধু উচ্চারণ করে
‘আর পারি না।’
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
ম নি র মো হা ম্ম দ কিছু জায়গায় প্রিন্টিং সমস্যা আছে...এছাড়া আমার ভালো লেগেছে।। শুভ কামনা ,পছন্দ আর ভোট রইল।আমার কবিতায় আমন্ত্রণ জানিয়ে গেলাম।ভাল থাকুন।
ভালো লাগেনি ১৮ জানুয়ারী, ২০১৮
মাইনুল ইসলাম আলিফ গল্পটি দারুণ হয়েছে।অনেক মেয়ের স্বপ্ন এভাবেই অকালে ধূলিসাৎ হয়ে যায়।এর কি কোন প্রতিকার নেই? প্রশ্ন আমার কোটি বিবেকের কাছে।শুভ কামনা পছন্দ আর ভোট রইল।আমার কবিতায় আমন্ত্রণ জানিয়ে গেলাম।ভাল থাকুন।
ভালো লাগেনি ১৪ জানুয়ারী, ২০১৮
আমার গল্পের ওপর এ ধরনের একটি মূল্যায়নসহ মন্তব্য দেখে বিমুগ্ধ হয়েছি। গল্পটি এত নিবিড় অনুসন্ধানী দৃষ্টি দিয়ে পাঠ করেছেন ভাবাই যায় না। পদ্মকলির পরিনতি নিয়ে যে প্রশ্নটি করেছেন সে প্রশ্নটি আমর নিজেরও। এ প্রশ্নের উত্তর কবে আমরা পাবো জানিনা। আপনার কবিতাটি পাঠ করে অবশ্যই আমি মন্তব্য করব এবং ভোট দেব । শুভ কামনা রইলো।
ভালো লাগেনি ১৪ জানুয়ারী, ২০১৮
milon shorkar এই আছিল আমার কপালে। মাইয়া অইয়া তুই আমারে আইজ খাওনের উক্তি দিলি? খামুনা আইজক্যর থাইক্যা তর নাগরের ট্যাকার ভাত।
ভালো লাগেনি ১২ জানুয়ারী, ২০১৮
Sardar Razzak আপনার মন্তব্যে গল্পটির একটি চরিত্রের একটি সংলাপকে উদ্ধৃত করেছেন। সংলাপটি নিবাচন করে মন্তব্য করবার জন্য আপনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন।
ভালো লাগেনি ১২ জানুয়ারী, ২০১৮
Sardar Razzak গল্পটি আপনাকে আলোড়িত করেছে এটিই লেখকের জন্য অনেক বড় প্রাপ্তি। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। ভালো থাকবেন।
ভালো লাগেনি ১২ জানুয়ারী, ২০১৮
Sardar Razzak গল্পটির ওপর যে মন্তব্যটি আপনি করেছেন তাতে বোঝাই যায় গল্পটি আপনি নিবিড়ভাবে পাঠ করেছেন। খুবই খুশি হয়েছি। অসঙ্খ ধন্যবাদ আপনাকে। ভালো থাকবেন।
ভালো লাগেনি ১১ জানুয়ারী, ২০১৮
mi 6596139 পদ্মকলির সারা জীবনের স্বপ্ন-দেখা সুখের করুণ মরণ। লেখককে ধন্যবাদ ।
ভালো লাগেনি ১১ জানুয়ারী, ২০১৮
abulkalam azad আচ্ছাদিত পদ্মকলির ভেজা শাড়ীর আঁচলও বাতাসে উড়ছে।গল্পটি অপূব অদ্ভুত।
ভালো লাগেনি ১১ জানুয়ারী, ২০১৮
Sardar Razzak In your Comment You Expressed the Fundamental Essence of the story Which is Very much Impressive for me and Your Comment must Reflect the Underlying Implication of the Story Over the Mindset of the mass People.Wish Your Long Life with Good Luck. May Almighty ALLAH Bless you along with your Family Members.
মনজুরুল ইসলাম the core utility of this rare story has been drawn at the very last moment quiet beautifully. padmakoli, the leading character is ofcourse a picture of real reality in our society. side by side, the quality appeal in a story is absolutely arranged here.wish a very very good luck for the writer.
badru ddoza একটি গানের দুটি চরণ কেন জানি এই মুহুর্তে বার বার করে মনে পড়ছে ওর। হৃৎপিন্ডের তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে গেঁথে আছে

২৫ নভেম্বর - ২০১৭ গল্প/কবিতা: ১ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪