পায়েস ইউএনও

নবান্ন (অক্টোবর ২০১৯)

Jamal Uddin Ahmed
মোট ভোট ১১ প্রাপ্ত পয়েন্ট ৩.৭৬
  • ১৪
  • ৪৫
১.
সরকারি কর্মচারির অনেক বিধি-নিষেধ আছে। তবে শেষ পর্যন্ত পৌরসভার চেয়ারম্যান রফিক চৌধুরির অনুরোধের ঢেঁকি গিলতেই হলো নতুন ইউএনও’কে। অবশ্য মফস্বলে কাজ করতে গেলে জনপ্রতিনিধি এবং গণ্যমান্য লোকদের সাথে সমন্বয় করেই কাজ চালাতে হয় প্রশাসনের লোকদের। তাছাড়া অনেক সময় এতে বিভিন্ন হিসেব-নিকশের বিষয়ও জড়িত থাকে। এজন্য ঘনিষ্টতার মাত্রাজ্ঞান রাখতে হয়। কিন্তু উৎসব-আমেজের মাসের দোহাই দিয়ে ইউএনও’কে রাজি করিয়ে ফেললেন রফিক চৌধুরি। শুক্রবার বিকেলে কলেজ-মাঠে মেলা উদ্বোধন শেষে তার বাড়িতে পদধূলি দেবেন মাত্র কিছুদিন আগে যোগ দেয়া নতুন ইউএনও ।

রক্ষণশীলতা নাকি নগরমুখী প্রবণতার জন্য এ অঞ্চলে বরাবরই ঐতিহ্যবাহী উৎসবের আমেজ কম। প্রাক-বিদ্যুতায়নের যুগে যা-ও জারী-সারি-পালা গানের কদর একটু ছিল, এখন তা-ও নেই। কদাচিৎ রথ-মেলা, ঘোড়দৌড়, নৌকা বাইচের কথা শোনা গেলেও নবান্ন নামের উৎসবের সাথে অধিকাংশ লোকের পরিচয় কেবল বইয়ের পাতায়ই। তবে হিন্দুঘন গ্রামে ঘটা করে উৎসব না করলেও লোকজন ধর্মাচার হিসেবে নবান্নের পর্বটা পালন করে। ইদানীংকালে নগরপ্রিয় হয়ে ওঠা কিছু গ্রামীন সংস্কৃতি নতুন করে গ্রামে-গঞ্জে বেশ প্রভাব ফেলেছে। রফিক চৌধুরি আয়োজিত নবান্ন মেলাও সেরকম কিছু।

স্বামীর কাছে মেলার কথা শুনে নীতা আক্ষেপ করে বললেন, ‘ইস্, আমি যদি যেতে পারতাম!’

ইউএনও বললেন, ‘হুম, পারবে। তবে আজ না। কাল অথবা পরশু কাজের বুয়াকে নিয়ে একবার ঘুরে আসতে পার।

‘ধুর, সিলেটের নাম শুনে উড়াল দিয়ে চলে এলাম। একটু স্বাধীনভাবে চলতে পারব না?’

‘ব্যস্ত হচ্ছ কেন? সবেতো এসেছ। সিলেটে অনেক কিছু দেখার আছে। একটু অপেক্ষা কর, বাচ্চাটাও একটু ছোটাছুটি করা শিখে নিক।’ ইউএনও স্ত্রীকে প্রবোধ দিলেন।

প্রায় সমবয়সী বলে উপজেলা চেয়ারম্যান এবং ইউএনও’র সম্পর্ক জমে গেছে খুব তাড়াতাড়ি। তাই আলাপচারিতায় বসলে আমলাতন্ত্র বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় না। থানা শহরের বড় মসজিদে জুমার নামাজ পড়ে ইউএনও’কে বাসা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে রফিক চৌধুরি মেলা প্রাঙ্গনে ছুটে যান। প্রস্তুতি মোটামুটি সন্তোষজনক। বড় সামিয়ানার নিচে চেয়ার-টেবিল পেতে বিশেষ অতিথিদের বসার ব্যবস্থা। নামাজের সময় মাইক বন্ধ ছিল। তবে এখন আবার শুরু হয়েছে গান, মেলায় যাইরে…। শিশু কিশোরদেরই উৎসাহ বেশি। সারিবদ্ধভাবে দোকান বসেছে কলেজ-মাঠে। মাটির আসবাব থেকে শুরু করে আধুনিক কালের প্লাস্টিক এবং ইলেক্ট্রনিক সামগ্রী কী নেই মেলায়। আর নাড়ু, বাতাসা, খই, হাওয়াই মিঠাই এসবতো আছেই।

অনুষ্ঠানে সংক্ষিপ্তভাবে অন্য দু’জন অতিথি বক্তব্য দেয়ার পর ইউএনও বাংলার কৃষ্টি-সংস্কৃতি নিয়ে মুল্যবান কথা বললেন। সিলেটের নৈসর্গিক সৌন্দর্যের গুণগান করতেও তিনি ভুললেন না। আনুষ্ঠানিকতা শেষে মেলার মাঠ ঘুরে আসতেই সন্ধ্যা হয়ে যায়। তাই সেখান থেকে তিনি সোজা রফিক চৌধুরির বাড়ি রওয়ানা হলেন।

রফিক চৌধুরির বৈঠকখানায় শুধু ইউএনও’ই আসেননি। সাবেক ও বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যান, সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ, পুলিশের এসিও আছেন আমন্ত্রিতদের মধ্যে। আরও দু’চারজন অনাহুত হয়ে এসে গেছেন, কারণ এরকম মজমায় উপস্থিত থাকাটাও একটা মর্যাদার ব্যাপার।

ইতিমধ্যে সদ্যভাজা পিঠে-পুলি, পায়েস, লেবুর শরবত ইত্যাদি এসে গেছে। ইউএনও প্রথমেই মদির গন্ধমাখা ধোঁয়াওঠা পায়েসের বাটিটা তুলে নিলেন। অন্যরা নিজেদের পছন্দের পদ দিয়ে শুরু করলেন।

গরম পিঠা মুখে তুলতে তুলতে অতিথিরা ইউএনও’র প্রাণবন্ত ভাষণের প্রশংসা করলেন। কিন্তু ইউএনও এসব স্তুতি কানে না তুলে মজা করে পায়েস খেতে খেতে বললেন, ‘দেখছি সিলেটে এখন অনেক পদের পিঠেপুলি তৈরি হয়। আগেতো চার-পাঁচটার বেশি দেখা যেত না। ’

উপজেলা চেয়ারম্যান নিসার মিয়া তখনই বলে উঠলেন, ‘ও হ্যাঁ, শুনলাম ইউএনও সাহেব নাকি ছোটবেলায় সিলেটে ছিলেন।’

‘হ্যাঁ, কিছুদিন ছিলাম, গোলাপগঞ্জে’, ইউএনও বলেন।

রফিক চৌধুরি চমকে উঠে বললেন, ‘তাই নাকি? গোলাপগঞ্জতো আমার শশুরবাড়ি, হা হা হা।’

ইউএনও ওসব কথায় না গিয়ে হাসতে হাসতে বললেন, ‘জানেন, পায়েস আমার খুব প্রিয়। এক বাটিতে হয় না, দুই বাটি লাগে।’

ইউএনও’র কথায় সবাই হো হো করে হেসে উঠলেও রফিক চৌধুরি এক দৌড়ে বাড়ির ভিতরে ছুটে গেলেন। অন্দরমহলে মহিলারা খুবই ব্যস্ত। তিনি তার স্ত্রী রাবেয়াকে একপাশে ডেকে এনে বললেন, ‘বাজিমাৎ! তোমার পায়েস ইউএনও সাহেবের খুব পছন্দ হয়েছে। দাও দাও, আরও দাও।’

স্বামীর কথায় রাবেয়া হঠাৎ থমকে দাঁড়ালেন, কিন্তু কিছু বললেন না।

রফিক চৌধুরি ইউএনও’কে পায়েসের দ্বিতীয় বাটি এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘ইন্টারনেটের কল্যাণে পুরো দুনিয়াই মানুষের হাতের মুঠোয়। মেয়েছেলেরা সব শিখে নিয়েছে। ’

‘তাইতো দেখছি’, ইউএনও গরম পায়েসভর্তি চামচে ফুঁ দিতে দিতে বললেন।

২.
আক্কাস চৌধুরির আড্ডা ছিল অগ্রণী ব্যাংকের ম্যানেজার মাহমুদ ভূঁইয়ার সাথে। বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতায় দুই পরিবারের সদস্যরাও পরিচিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছে একে অপরের সাথে। আক্কাস চৌধুরিই বলেছিলেন, ‘আমার মেয়েটি অংকে কাঁচা, আপনার ছেলেটা স্কুল থেকে আসার পথে আমার মেয়েকে যদি একটু দেখিয়ে দিয়ে আসত তবে খুবই উপকার হতো।’

ছেলের সামনে এসএসসি পরীক্ষা। অন্যকে সময় দেয়ার মত সময় তার নেই। তবু গুরুত্বপূর্ণ ক্লায়েন্ট এবং ব্যক্তিগত বন্ধুকে না বলতে পারলেন না মাহমুদ ভূঁইয়া। ভাবলেন, মেধাবী ছাত্রের কাছে ক্লাস এইটের অংক তেমন কিছু না; সপ্তাহে দু’তিন দিন স্কুল থেকে ফেরার পথে একটু নাহয় বুঝিয়ে দিয়ে আসা যায়।

উপরের ক্লাসের ছাত্র, ক্লাসের সেকেণ্ডবয় কামাল ভাইয়ের কাছে অংক শেখার সুযোগ পেয়ে রাবেয়ার মাথা খারাপ অবস্থা। কামাল মনযোগ দিয়ে অংক শেখাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু চঞ্চলা ছাত্রীর মাথায় সূত্রগুলো বারবার প্যাঁচ লেগে যাচ্ছে। ক্লাস এইটের ছাত্রী; প্যাঁচতো লাগবেই। মুশকিল হল, এই প্যাঁচ খুলতে গিয়ে ধমক দিলেই রাবেয়া ফ্যাচফ্যাচ করে কান্না জুড়ে দেয়। কামাল তখন বলে, ‘এসব করলে কিন্তু আমি আর আসব না। ’ তখন আবার চোখ-মুখ মুছে হাসিহাসি মুখ করে রাবেয়া বলে, ‘ঠিক আছে, আর করব না।’

সাকুল্যে ভাঙ্গাচোরা বছরখানেক পড়িয়েছে কামাল। তাতে রাবেয়ার অংকভীতিতো কেটেছেই, অন্যান্য বিষয়গুলোতেও ভাল ফল করে নবম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হয়েছে। রাবেয়ার মা-বাবা এতে খুবই খুশি। কামালের জন্য মজার মজার খাবার তৈরি করেন রাবেয়ার মা। তবে যেদিনই পায়েস থাকে সেদিনই সে হাসতে হাসতে রাবেয়াকে বলে, ‘আরেক বাটি।’ এসএসসি পরীক্ষার পর ঢাকায় চাচার কাছে চলে যাওয়ার আগে পর্যন্ত কামাল এসেছে রাবেয়াদের বাড়িতে। ততদিনে চঞ্চলা ছাত্রীও অনেক সুবোধ হয়েছে। আগের মত ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদেনা, তবে ফ্যালফ্যাল করে তাকায়। কথাবার্তায় অনেক সহজও হয়েছে। তাই টিউটর কামালভাইকে মাঝেমাঝে ‘আরেক বাটি স্যার’ ডাকে। কামাল কিছু বলে না, শুধু একটু মুচকি হাসে।

৩.
সেদিন সন্ধ্যায় ইউএনও চলে যাবার পরও অনেক আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী এসেছিল রফিক চৌধুরির বাড়িতে। সবাই প্রশংসা করেছে এমন সুন্দর একটা আয়োজনের জন্য। দাওয়াতের ধকল শেষ হলে বাড়ির সবাই হাঁফ ছেড়ে বাঁচে।

তবু রাবেয়ার মনটা একটু উচাটন। তিনি বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করে পুরনো দিনের বিচ্ছিন্ন অ্যালবামের ছবি দেখছেন। চলে যাবার আগে একদিন খপ করে কামালভাইয়ের হাত চেপে ধরে তিনি বলেছিলেন, ‘প্লীজ, যাবেন না, প্লীজ।’ কামালের মনের গহ্বরে তখন কোনো জলাশয় ছিল কি না কিংবা থাকলেও তাতে তখন কোনো তরঙ্গ খেলেছিল কি না রাবেয়া জানতে পারেননি। কারণ এরপর কামালের সাথে তার আর কোনোদিন দেখা হয়নি। তবে ইউএনও’র পায়েসপ্রীতির কথা শুনে হঠাৎ করেই আজ সেই স্বপ্নবেলার ‘আরেক বাটি’ স্যারের স্মৃতি তার মস্তিস্কের তন্ত্রীতে ছোটাছুটি করছে।

রফিক চৌধুরি ব্যস্ত মানুষ। তিনি বিভিন্ন কাজকর্ম সেরে একটু দেরিতে ঘরে ফিরে দেখেন রাবেয়া তখনও ঘুমাননি। তিনি জিজ্ঞেস করেন, ‘কী ব্যাপার, এখনও ঘুমাও নি?’

‘ঘুম আসেনি।’

‘এত ধকলের পরও ঘুম আসেনি?’ রফিক চৌধুরি বলেন, ‘তবে যা-ই বল আয়োজনটা খুব ভাল হয়েছে। অতিথিরা খুব মজা করে খেয়েছে।’

রাবেয়া বলেন, ‘যাক, কোনো বদনাম হয়নি, রক্ষে!’ তারপর একটু থেমে জিজ্ঞেস করেন, আচ্ছা তোমার পায়েস ইউএনও’র নাম কী?’

রফিক চৌধুরি হো হো করে হেসে উঠেন, ‘ভাল নাম দিয়েছতো – পায়েস ইউএনও। পায়েস ইউএনও’র ভাল নাম হচ্ছে মোস্তফা কামাল ভূঁইয়া।’
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
Tahmina Alom Mollah কামালের মনের গহ্বরে তখন কোন জলাশয় ছিল কি না কিম্বা থাকলেও তাতে তখন কোন তরঙ্গ খেলেছিল কি না রাবেয়া জানতে পারেনি -- ভীষণ সুন্দর। রাবেয়াদের তা জানার সুযোগই বা কোথায়...!!!
ভালো লাগেনি ২ জানুয়ারী, ২০২০
ধন্যবাদ।
ভালো লাগেনি ৩ জানুয়ারী, ২০২০
কাজী জাহাঙ্গীর জামাল ভাই এটা একটা অনন্য রেকর্ড উভয় ফরমেটে সেরা হওয়া, অনেক অনেক অভিনন্দন...
আপনারা পড়েছেন এটিই আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। অনেক ধন্যবাদ।
সেলিনা ইসলাম অনেক অনেক অভিনন্দন!
অনেক অনেক ধন্যবাদ।
মোঃ মোখলেছুর রহমান অভিনন্দন! প্রিয় কবি।
মোখলেছ ভাই, এইখানে আপনাকে না দেখে মনটা খারাপ ছিল। এখন দেখি কোন ফাঁকে চুপ করে বসে আছেন। অনেক অনেক ধন্যবাদ।
জুলফিকার নোমান অনেক অনেক অভিনন্দন, সেই সাথে শুভ কামনা রইল।
অনেক ধন্যবাদ।
মোঃ আব্দুল মুক্তাদির অভিনন্দন
অনেক ধন্যবাদ।
কেতকী অনেক অভিনন্দন রইলো।
অনেক অনেক ধন্যবাদ।
Fahmida Bari Bipu প্রাণঢালা অভিনন্দন আপনাকে। অনেকদিন পরে কাউকে দুই বিভাগেই প্রথম রূপে দেখলাম। এগিয়ে যান। শুভেচ্ছা সবসময়।
অনেক অনেক ধন্যবাদ। আপনাদের শুভ কামনাই আমার পাথেয়।

লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য

মানব জীবন নানাবিধ নানামুখি সুতার বুনন। নবান্ন উৎসবকে কেন্দ্র করে স্মৃতিভেজা সেই সুতোগুলোয় আবার কেমন প্যাঁচ লেগে যায়। সেই প্যাঁচেরই এক হালকা উপস্থাপন এই গল্প।

১৯ নভেম্বর - ২০১৭ গল্প/কবিতা: ১৬১ টি

সমন্বিত স্কোর

৩.৭৬

বিচারক স্কোরঃ ২.১১ / ৭.০ পাঠক স্কোরঃ ১.৬৫ / ৩.০

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "ছোটবেলা”
কবিতার বিষয় "ছোটবেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪