আমার সদ্যজাত উপসর্গটার কথা শুনলে অনেকেই হেসে উড়িয়ে দিবে সন্দেহ নেই। ডাক্তারের কাছে গেলে অযথা একগাদা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করিয়ে নিবে এবং শেষপর্যন্ত কিছু ঘুমের বড়ি লিখে দিবে। তাই ডাক্তারের কাছে না গিয়ে নিজেই কিছু সিডেটিভ ট্যাবলেট কিনে খাচ্ছি। তাছাড়া আমার এক সহকর্মি যে কি না আধ্যাত্মিকতায় চরম বিশ্বাসী, সে কোন এক হুজুরের কাছ থেকে তিসির তেল পড়িয়ে এনে দিয়েছে। রোজ ঘুমাবার আগে একটা দোয়া পড়ে কপালে মালিশ করতে হবে। তাও করছি। কিন্তু ফলতো আশানুরূপ পাচ্ছি না।
জটিল তত্ত্বকথায় আমার আগ্রহ কম, ধৈর্যেও কুলায় না। তারপরও কিছু কথা-উপকথা মানুষের অবৈজ্ঞানিক যুক্তিকেও বিশ্বাসযোগ্য করে তোলে। স্বপ্নেরও তেমন এন্তার বৈজ্ঞানিক, আধ্যাত্মিক, লৌকিক ব্যখ্যা আছে। প্রচলিত ধারনায় কিংবা বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যায় একথা প্রতিষ্ঠিত যে কোন বিষয় বা ব্যক্তি নিয়ে ভাবতে ভাবতে ঘুমোতে গেলে সেই বিষয় বা ব্যক্তিকেন্দ্রিক ছবি স্বপ্নের মধ্যে এলোমেলোভাবে ধরা দিতে পারে। সবার বেলায় তাই হয়; আমারও হয়েছে। কিন্তু আমারটা যে ভীষণ গোলমেলে।
আমার বিয়ের কথা চলছে। একটি বিদেশি ব্যাংকে দুবছর ধরে চাকরি করছি। ম্যাড়ম্যাড়ে টাইপের মানুষ; প্রেমটেম করতে পারিনি। বাবা পল্লীবিদ্যুত অফিসে চাকুরি করেন। এখন অবসরে আসার সময় হয়ে গেছে। বলতে গেলে বাড়িতে অনড় থেকেই কর্মজীবন শেষ করলেন; বাইরে যেতে হয়নি। বাবা-মা দুজনই এখন পাগলপারা হয়ে মেয়ে দেখছেন। কিন্তু আমি যে ধূম্রকুণ্ডুলিতে পড়ে ঘুরপাক খেয়ে চলেছি তা কাকে বলব? ছোটবেলায় মাকে যখন সোহার কাহিনী বলেছিলাম তখন তিনি তেঁতে উঠেছিলেন। এখনকার ঘটনা বললে নির্ঘাৎ তিনি আমাকে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে যাবেন।
কী অদ্ভূতুড়ে ব্যাপার! প্রতি সপ্তায় এটি ঘটছে। এবং যতই সময় যাচ্ছে তা জটিল হচ্ছে। ঘটনাটা আদপে স্বপ্নই; তবে স্বপ্নের সাথে বাস্তবের যোগসূত্রটাই গোলমেলে এবং ভীতিকর। প্রথমদিন ঘুম ভাঙার পর আমি যুগপৎ স্মৃতিকাতর এবং আমোদিত হয়েছি। অবেলার কেউ – যে স্মৃতিতেও নেই – এই বেলায় এসে যদি স্বপ্নের নীল সরোবরে বুদ্বুদের মত ভেসে ওঠে, সেতো ভাল লাগারই কথা। স্বপ্নের অমসৃণ সেলুলয়েডের যে মানবীটি ‘হাই’ বলে আমার চুল ধরে টান দিল তাকে আমি চিনতে পারিনি। কিন্তু যখন বলল, ‘কী, চিনতে পারিসনি? সোহা।’ ধন্দে পড়ার মত কথা! সোহা আবার কে? ঢেউখেলানো শাড়ি পড়া তন্বী তরুণী; আগে কখনও দেখিনি। হঠাৎ খেয়াল হল, এক ভয়ধরানো পিচ্চি সোহা ছিল অতীতের হাজীগঞ্জে। কিন্তু এই সোহাটা আবার কে? আমার ভাবনা স্থির হয় না। সে আবার বলে, ‘অনেক দিন হয়ে গেল; ভুলে গেছিস।’ ওমা, হঠাৎ তার পোশাক বদলে গেল; এখন পরনে তার স্কুলের ইউনিফর্ম। বলল, ‘রামবুটান খাবি?’ ওর কথা শুনে আমি সেই হাজীগঞ্জ মডেল পাইলট স্কুলের গবেট মুকুল হয়ে গেলাম। মুকুল আমার ডাকনাম। আমি উচ্ছ্বসিত হয়ে বলতে চেয়েছিলাম, তুই এত্ত বড় হয়ে গেছিস! কিন্তু তার আগেই ঘুম ভেঙ্গে গেল।
হাজীগঞ্জ মডেল পাইলট হাইস্কুলের ছাত্র ছিলাম আমি গোড়া থেকেই; কিন্তু সোহা নামের মেয়েটি এসে ভর্তি হয়েছিল ক্লাস সেভেনে, মাত্র এক বছর আগে। কড়া আইন-কানুন স্কুলের – মেয়েরা মেয়েদের মতন, ছেলেরা ছেলেদের মতন। রক্ষণশীল, ডিসিপ্লিন্ড। তবু কেমন করে তার সাথে একটু বেশি ঘনিষ্টতা হয়ে গেল আমার। দুটি সম্ভাব্য কারণের মধ্যে একটি ছিল, আমাদের প্রায়ই দেখা হয়ে যেত স্কুলে আসার পথে। আমি পৌরসভা অফিসের কাছে এসে যখন কুমিল্লা-চাঁদপুর মহাসড়কে উঠতাম তখন কোনো কোনোদিন সোহাকে দেখতাম ড্যামকেয়ার ভাব নিয়ে উত্তরদিক থেকে হেঁটে আসছে – কখনও একা, কখনও আরও দুয়েকজন ছাত্রীসহ। একা হলেতো হয়েই গেল। বড়দের মত জিজ্ঞেস করত, ‘কিরে কেমন আছিস, লেখাপড়া কেমন চলছে?’ ইত্যাদি। আমি বাঁধোবাঁধো কন্ঠে মাপা শব্দে উত্তর দিতাম। আরেকটা কারন, আমার এখনকার বিবেচনায়, আমরা দুজনই লেখাপড়ায় ভাল ছিলাম বলে মত বিনিময়ের সুযোগ হত। তবে আশ্চর্যের কথা, আমি কখনও জানতেই চাইলাম না সে কোথায় থাকত; তারও আমার ব্যাপারে এধরনের কোনো আগ্রহ দেখিনি। এখন বুঝি, তখন এধরনের কোনো আগ্রহ জন্মানোর বয়স আমাদের ছিল না। সে দিনগুলোতো কবেই ডাকাতিয়া নদীর খরস্রোতে ভেসে গেছে।
জটিলতার সূত্রপাত সেদিন বসুন্ধরার লিফট থেকে নেমে আসার পরই। ছুটির দিনে মোতালেব প্লাজায় নতুন মডেলের একটা মোবাইল ফোনের খোঁজে গিয়ে ফেরার পথে বসুন্ধরা সিটিতে একটা ঢুঁ মেরে আসছিলাম। অন্য লোকদের সাথে লিফটে উঠতে উঠতে মেয়েটি বলল, ‘হাই!’ মাথা ঘুরিয়ে দেখি, আরে! সেই মেয়ে, যাকে আগের রাতে স্বপ্নে দেখেছি। স্বপ্নের সোহা! আমি কিছু বলবার আগেই ক্যাপ্সুল লিফটটি উপরে উঠতে শুরু করল। আমি সাতপাঁচ না ভেবেই এস্কেলেটার ধরে দ্বিতল ত্রিতল দৌঁড়াতে লাগলাম। ভেবেছিলাম কোথাও না কোথাও ওকে আমি ধরতে পারব। কিন্তু সে আশায় গুড়ে বালি। অনেক ছোটাছুটি করেও তার টিকিটির খোঁজ পেলাম না।
স্বপ্ন-বাস্তবতার লুকোচুরি ওই একবার হলে আমি বেঁচে যেতাম; কিন্তু এরকমটি ঘটেছে অন্তত পাঁচবার। একবার অফিস-ফিরতি বিকেলে কেমাল আতাতুর্ক রোড ধরে হাঁটছি, দেখি ধীরগতি ঢাকাচাকা বাসের ভিতর থেকে হাত নাড়ছে সে-ই, সোহা। আমি শুধু হা করেই তাকিয়ে থাকলাম; বাস গুলশানের দিকে চলে গেল। আরেক সন্ধ্যায় রবীন্দ্র সরোবরের লোকসঙ্গীতের অনুষ্ঠানে সামনের সারিতে দেখলাম ও বসে আছে; কোনো ভুল নেই, ও সোহাই। আমি দূরে দাঁড়িয়ে আছি আর ভাবছি, আজ ধরা পড়ে গেছ বাছাধন! অনুষ্ঠান শেষ হতেই হুড়মুড় করে সামনে এগিয়ে গিয়ে দেখি সে নেই।
আমি যে ইদানীং কিছুটা অসুস্থ হয়ে পড়েছি তা নিজেও টের পাচ্ছি। সারাক্ষণ এই মেয়েটা আমার মাথা দখল করে আছে। ঘুমের বিঘ্নতো ঘটছেই, অফিসের কাজকর্মেও তার প্রভাব পড়েছে – সাধারণ অফিসতো নয়, ব্যাংক বলে কথা। এই সোহা কি সেই সোহা! তার দুর্বোধ্য আচরণ আমাকে বার বার ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে হাজীগঞ্জ পাইলট স্কুলে। মাকে বলেছিলাম, কিন্তু মা আমার কথা বিশ্বাস করেননি। মা কেন, অন্য কেউই হয়ত আমার এসব কথা বিশ্বাস করত না। হঠাৎ করে – আশেপাশে কেউ না থাকলেই বলত, ‘চোখ বন্ধ!’ আমি চোখ বন্ধ করতাম। ও আবার বলত, ‘চোখ খোল!’ আমি চোখ খুলেই দেখতাম আমার মুখের সামনে একটি পাকা রস-টসটসে ডুমুর ধরে আছে। শুধু ডুমুরই নয়, অ্যাপ্রিকট, স্ট্রবেরি, কাঁচা খেজুর এমন আরও অনেক বিজাতীয় ফল যার কোনটাই আমি চিনতাম না, সে চোখের পলকে হাজির করত আর আমি সত্যিসত্যি ভয় পেয়ে যেতাম। সে বলত, ‘খবরদার, কাউকে বলবি না; তাহলে আর পাবিনা।’ আমি ফ্যালফ্যাল করে তার দিকে তাকিয়ে থাকলে বলত, ‘দেখছিস কী? খা, খা। আর শোন শোন, এই ফলের নাম হল পীচ......।’ প্রতিটা ফলই সে আমাকে এভাবে চিনিয়ে দিত। এবং প্রতিবারই সাবধান করে দিত, খবরদার......। আমি মাকে ছাড়া আর কাউকে এসব কথা বলিনি, তা-ও তার অন্তর্ধান হওয়ার পরই কেবল। মা রেগে বলেছিলেন, ‘চাপা মারার আর জায়গা পেলি না?’ ক্লাস এইটের ফাইন্যাল পরীক্ষা শেষে আমরা কেউ আর সেই সোহাকে দেখিনি। সহপাঠীদের দুয়েকজন আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘কিরে, ওই স্মার্ট মেয়েটা গেল কই?’ আমিতো জানতাম না; বলব কী করে? কিন্তু তার শুন্যতায় মনের মধ্যে প্রচণ্ড ধাক্কা অনুভব করছিলাম বেশ কিছুদিন।
সেই স্কুলবেলার আরেকটি ঘটনা আমি কাউকেই বলার সাহস পাইনি। একদিন যখন আমরা মহাসড়ক ধরে হেঁটে আসছিলাম তখন কুমিল্লাগামী একটি বাস আমার উপরে প্রায় উঠেই পড়েছিল; কিন্তু হঠাৎ দেখি বিদ্যুৎগতিতে আমি রাস্তার কিনারে ছিটকে পড়েছি। তখনও আমি সোহার দিকে হা করে তাকিয়েছিলাম। সে বলল, ‘হা করে কী দেখছিস? ওঠ। খবরদার, কাউকে কিছু বলবিনা।’ না, আমি বলিনি; বললে কেউ বিশ্বাস করবে না। কিন্তু এখন? এখনও কি সে আমার সাথে খেলছে? এতদিন পর? কেন? আর আসলে কে সে? কেনই বা সে এমন লুকোচুরি খেলছে?
বাবা সেদিন অফিসের কাজে ঢাকা এসেছিলেন। ইব্রাহিমপুরের যে বাসায় আমরা চার সহকর্মি মেস করে থাকি বাবা সেখানে একরাত থেকে গেছেন। আমার শারীরিক অবস্থার অধোগতি দেখে চরম বকাঝকা করেছেন। কেন ঠিকমত খাওয়াদাওয়া করিনা, কেন ঘুমাইনা এরকম হাজার প্রশ্নবাণ। আমি যে নির্দোষ, অষুদপথ্য চলছে, এমন কি হুজুরের পড়া তেলও ব্যবহার করছি বাবা এসব কথা আমার সহকর্মিদের কাছ থেকে শুনে গেছেন। কিন্তু তার দুশ্চিন্তা অন্যত্র। মেয়ে দেখা হয়ে গেছে। বিয়ের তারিখ যে কোন সময় ঠিক হয়ে যাবে; এ অবস্থায় যদি আমার এমন দশা হয়! শুনেছি, আমার ছুটিছাটার বিষয় নিয়ে কথা বলতে তিনি এসেছিলেন। কিন্তু এ বিষয়ে কিছু না বলেই পরদিন বাড়ি চলে গেছেন।
দুদিন পরই মায়ের ফোন, ‘মুকুল, তুই আজই বাড়িতে আয়।’
আমি বুঝে গেছি, আমাকে যেতেই হবে। মাকে বললাম, ‘আজ পারব না। বিষ্যুদবার অফিস করে রওয়ানা দেব।’
‘শোন, কয়েকদিনের ছুটি নিয়ে আসবি কিন্তু; কাজ আছে অনেক। আমি সব শুনেছি তোর বাপের কাছ থেকে।’
সেতো আমি বুঝতেই পারছি; হুলুস্থুল বাঁধিয়েছেন বাবাই। বললাম, ‘ঠিক আছে।’
আমার নানার গ্রামের এক ডাকসাইটে কবিরাজের কথা মা-খালাদের বৈঠকি গল্পে অনেকবার শুনেছি। মায়ের কী সম্পর্কের যেন ভাই হয়। বশকরা জ্বিন দিয়ে নাকি তাবিজতুমারি করে। মা শেষপর্যন্ত তার শরণাপন্ন হয়েছেন। বাড়িতে গিয়ে দেখি সাত ঘাটের পানিভর্তি বোতল, তাবিজচুবানো সরিষার তেল, মাদুলিতে পোরা জাফরান দিয়ে ভুজপাতায় লেখা তাবিজ আরও কী কী যেন আমার জন্য অপেক্ষা করছে। পানি ক’বার খেতে হবে, তেল মাথার তালুতে কীভাবে দিতে হবে আর মাদুলি কোথায় পরতে হবে মা আমাকে তা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখিয়ে দিলেন। আমার নাকি খারাপ হাওয়া লেগেছে; কবিরাজ মামার নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে হবে। আমি মাকে বললাম, ‘দেখ মা, বাকি সবকিছু করা যাবে, কিন্তু আমি গলায় মাদুলি পরব না, কিছুতেই না।’ মা নাছোড়বান্দা, আমাকে পরতেই হবে। অবশেষে একটা সমাধান বেরোল; মা নিজের একটা স্বর্ণের চেইনে মাদুলিটা বেঁধে আমার গলায় ঝুলিয়ে দিলেন। রক্ষা, ওটা আমি শার্টের নিচে লুকিয়ে রাখতে পারি।
চিকিৎসা ব্যবস্থাপনাপর্ব শেষ করেই আসল কথা পেড়ে বসলেন মা, পরদিন বউ দেখতে যাবেন আমাকে নিয়ে। আমি বললাম, ‘তোমরা দেখাদেখি শেষ করেছ, আর আমিতো ছবি দেখেছি, নতুন করে আবার কী? তাছাড়া মিলিতো ওকে চিনেই।’ আমার ছোটবোন মিলির স্বামী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক; তার ডিপার্টমেন্টের ছাত্রী আমার হবু স্ত্রী। মা কি আর ওসব কানে তোলেন; অনার্স পরীক্ষা শেষ করে মেয়ে বাড়িতেই আছে – চাঁদপুরে, অতএব আমাকে যেতেই হবে। শুধু তাই না। এ যাত্রায় বিয়ের তারিখ ফাইন্যাল করে আসতে হবে।
রাতের বাসে করে আসাতে ক্লান্তি পেয়ে বসেছে। মা খাবার বাড়তে বাড়তেই আমি পুকুরে গিয়ে দুটো ডুব মেরে এলাম। আশা করছি একটা ভাল ঘুম হবে। কী আশ্চর্য! হলোও, কোন উপসর্গ ছাড়া। মেজাজটা বেশ ফুরফুরে লাগছে ঘুম থেকে উঠার পর। চিকিৎসা শুরু করার আগেই শুভ লক্ষণ!
বরাবরের মতই পুরনো বন্ধুদের খোঁজে বেরিয়ে পড়ি বিকেলে। মহাসড়ক ধরে হাঁটছি আর ঢাকায় ফেলে আসা ধকলের কথা ভাবছি। এখন মনে হচ্ছে স্বপ্ন-বাস্তবের বিদঘুটে চক্রটি আসলে অনিদ্রাজনিত কারণে ঘটা একধরনের মানসিক বৈকল্য ছিল। হয়ত প্রথম দিনের স্বপ্ন এবং তার পরদিনই লিফটে তথাকথিত সোহাকে দেখার পরই আমি অতীতচারী হয়ে পড়ি; তারই রেশ বাকি দিনগুলোতে পড়েছিল। তাই ঠিকমত ঘুম হয়নি। শুনেছি, ঘুম না হলে মানুষ পাগল হয়ে যায়। কিন্তু এটাতো সত্য, সোহা নামে একটা মেয়ে একসময় ছিল। আমি যে পথ ধরে এই মুহুর্তে হাঁটছি, সেই একই পথে সোহাও হেঁটে গেছে। একসাথে কথা বলতে বলতে আমরা স্কুলে গিয়েছি। ওইতো ওখানে স্কুল; সোহার দুর্বোধ্য সম্মোহক উপস্থিতি...।
স্কুল-সহপাঠী পুরনোদের মধ্যে শুধু সোলেমানকেই পেলাম; সে রড-সিমেন্টের দোকান খুলেছে সম্প্রতি। পড়ালেখার তেমন অগ্রগতি না হওয়াতে ইন্টার পাশ করে দুবাই গিয়ে চার বছরে কিছু টাকা কামাই করে এসে গতবছর বিয়ে করেছে। বউ ফেলে আর বিদেশ যাবার ইচ্ছে নেই বলে বেশ প্রস্তুতি নিয়েই ব্যবসায় মন দিয়েছে। সোলেমান আমাকে পেয়ে খুবই খুশি হয়েছে এবং আন্তরিকভাবেই পুরনো বন্ধুকে আপ্যায়ন করেছে। শুধু তাই না, তার বউকে দেখতে যেতে হবে সেই ওয়াদাও আমাকে করিয়ে ছেড়েছে। কানে কানে এ সুখবরটাও দিয়ে দিয়েছ, ‘আর কয়দিন পর তুমি চাচা অইবা!’ আমারও যে সময় ঘনিয়ে এসেছে সে খবরও আমি তাকে দিয়ে এসেছি।
সন্ধ্যা ঘন হবার আগেই সোলেমানের দোকান থেকে উঠে বাড়ির পথ ধরেছি। মাথায় একটু চাপ আছে; কালকে যেতেই হবে কনে সন্দর্শনে। এখনও শরতকাল শেষ হয়নি বোধ হয়; দূরের মাঠে কাশের শীর্ণ অবয়ব দেখা যাচ্ছে। হাওয়ার দমকের মধ্যে আরামদায়ক শৈতল্য আছে। তবে যানবাহনের দখলে থাকা মহাসড়কে দাঁড়িয়ে প্রকৃতির রূপরহস্য পুরো উপভোগ করা দুষ্কর।
পৌরসভা অফিসে পৌঁছার আগেই চাঁদপুরগামী একটি বাস বিপরীতমুখী আরেকটি বাস অতিক্রম করতে গিয়ে গতি মন্থর করল। ঠিক তখনই নারীকন্ঠে ‘অ্যাই’ শব্দ শুনে উপর দিকে তাকাতেই দেখি সেই মুখ – এখানেও! সে জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে একটা ছোট প্যাকেট ছুঁড়ে মারল আমার দিকে। গাড়ি তখন গতি বাড়িয়ে দিয়েছে। আমি বরাবরের মত হা করে তাকিয়ে আছি। কিছুক্ষণ পর সুদৃশ্য র্যাপারে মোড়ানো প্যাকেটটি হাতে নিয়ে খুলে দেখি ছোট্ট একটি সুগন্ধীর শিশি। এমন ধাতব শিশি আমি কখনও দেখিনি; এরকম প্রত্নপদার্থ শুধু জাদুঘরেই দেখা যায়। সাথে ফুলের পাঁপড়ির মত একটি টুকরো কাগজ; তাতে লেখা, ‘তোর বউয়ের জন্য।’
আমার মাথাটা এখন আবার ভারী হয়ে এসেছে। রবোটের মত হেঁটে হেঁটে বাড়ির পথে নামতে নামতে আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি কাল চাঁদপুর যাব না। মা-বাবা যা-ই বলুন, আমাকে কবিরাজ মামার কাছে যেতেই হবে। কবিরাজ মামাকে এই রহস্যের জট খুলতেই হবে; নইলে কালই হবে তার বুজরুকির শেষ দিন।