ভাঙা আয়নাটায় একবার নিজেকে দেখে নিই। ময়লা চিরুনিটা দিয়ে চুল আচরানোর ক্ষুদ্র চেষ্টা চালাই, সফলতা আত্মতুষ্টিসাপেক্ষ। গ্রাম থেকে উঠে আসা গরিব একটা ছেলের পরিপাটি হওয়া এর থেকে বেশি কিছু না। ক্যাসিও ঘড়িটার দিকে একবার তাকাই। সময় বিকাল চারটা বেজে সাত মিনিট। হাতে এখনো দেড় ঘন্টা। কেন যেন কপাল বেয়ে ঘাম বেরিয়ে আসে। অভিজ্ঞতাটা যে নতুন। মেস ছেড়ে বেরিয়ে এলাম ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে। আজ হলুদ ট্যাক্সিতে যেতে হবে, স্ট্যান্ডার্ড বজায় রাখা যাকে বলে আর কি। দেখেশুনে একটা হলুদ ট্যাক্সি ঠিক করে ফেললাম। ভাড়া দুশো টাকা। ঢাকা শহরে এই একটা সমস্যা। কেউ মিটারে যেতে চায় না। এমনভাবে মুখ ঘুরিয়ে মানা করে যেন রাস্তাটা তার বাপের একার। আমরা তার গোলাম শ্রেণীর কিছু একটা। চাইলেও এড়ানো যায় না। অগত্যা আশি টাকার ভাড়া দুশো টাকায় যেতে হয়। জানালাটা খুলে দিলাম আমি। প্রাকৃতিক বাতাসই বেশি ভাল লাগে। কেন যেন শীততাপ যন্ত্র জিনিসটা আমায় তেমন টানে না। বন্ধু-বান্ধবগুলো ঠিকই বলে- আমি আস্ত একটা ছোট লোক। একটা দীর্ঘশ্বাস আসে ভেতর থেকে। আমি চোখ বুজে ফেলি। ক্যাবটা স্টার্ট নেয়। ক্যাব এগিয়ে চলে। আমার চোখটা লেগে আসে ধীরে ধীরে। একটা সময় গভীর ঘুমে তলিয়ে যাই। ঠিক ঘুম না, খুব সম্ভবত ঘোর লাগে। আমি ঝিমুতে থাকি। গাড়ি এগিয়ে চলে।
"ভাই।" ঘুম ঘুম চোখে তাকালাম ড্রাইভারের দিকে। "কি?" "জায়গা মত এসে পড়সি।" চোখজোড়া দুহাত দিয়ে কচলে নিই। ক্যাবের দরজাটা খুলি সাবধানে। হোটেলটার সামনে নেমে দাঁড়াই। কাগজ দেখে মিলিয়ে নিই ঠিকানাটা। বড়সড় হোটেল। এত বড় হোটেলে আমার সাত জনমের আসার ভাগ্য হবে কিনা কে জানে। গলাটা শুকিয়ে আসছে। ঢোক গেলার চেষ্টা করি।
"কোথায় যাবেন?" রিসিপশনে বসা মেয়েটা জিজ্ঞেস করেন। "চারশ দু নাম্বার রুমে।" জবাব দিই আমি। টেলিফোনে কিছু নাম্বার ডায়াল করেন, খটখট করে কি যেন দেখেন কম্পিউটারে। আমি অপেক্ষা করি। মেয়েটা হাসিমুখে আমার দিকে ফিরে তাকান। "যেতে পারেন।" দরজায় খটখট করতেই এক সুন্দরী মেয়ে এসে খুলে দেয়। বয়স আমার কাছাকাছিই হবার কথা। এতটা সুন্দর যে কেউ হতে পারে তা আমার জানা ছিল না। মেয়েটা আমার দিকে তাকায়। চোখে কেমন যেন দৃঢ়তা। "কি চাই?" "আপনি মিসেস হোসেন?" "তুমি দীপক, রাইট?" মেয়েটি হেসে ওঠে। আমি মাথা নাড়ি। "এসো ভেতরে এসো।" হাসিমুখে মেয়েটা আমাকে ঢোকার জন্যে জায়গা করে দেয়।
রুমে শীততাপ যন্ত্র চলছে। একধরনের সূক্ষ যান্ত্রিক শব্দ হয়ে যাচ্ছে একনাগাড়ে। সেই যান্ত্রিক শব্দটা মাথায় একটা ভোঁতা যন্ত্রণার শুরু করে। অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম প্রচন্ড ঠান্ডায়ও আমি ঘেমে যাচ্ছি। সেই ঘাম মেয়েটার গায়ে লেগে একাকার হয়ে যাচ্ছে। খুব খারাপ একটা অনুভূতি, তেল চিটচিটে ভাব। মেয়েটা সমস্ত শক্তি দিয়ে আমাকে খামচে ধরে। মাথার যন্ত্রণা বেড়েই চলেছে।
শার্টের উপরের বোতামটা লাগাতে লাগাতেই টাকার অংকটা গুণে নিলাম। তারপর মেয়েটির দিকে তাকালাম, কেমন হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। কিছুক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া ব্যাপারটা কি তার মনে একটুকুও পাপবোধ আনছে না? অবশ্য সবার মানসিকতা বিচার করবার অধিকার আমার নেই। আমি একটু গলা খাঁকড়ি দিলাম। "একটা কথা বলবেন?" "বলুন।" মেয়েটা হাসি হাসি মুখে জবাব দেয়। "আপনার স্বামীর সাথে আপনার বয়সের পার্থক্য কত?" প্রশ্নটা করেই মনে হল এটা জিজ্ঞেস করার অনুমতি আমার নেই। মেয়েটি স্থির চোখে আমাকে দেখলো কিছুটা সময়। তারপর আগের মত হেসে বলে উঠলো, "এটা মনে হয় আপনার জানার বিষয় নয়?" আমি মাথা নিচু করে ফেললাম। সত্যিই আমার জানার বিষয় নয়।
নিয়ন আলোগুলোর নিচ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি এক পা দু পা করে। হাতে একটা ব্যাগ, সে ব্যাগ ভর্তি টাকা। এ নিয়ে আমার বিন্দুমাত্রও ভয় হচ্ছে না। কেন হচ্ছে না? অনুভূতিগুলো কি এতই ভোঁতা হয়ে গেলো? নাকি আমি মরে গেলাম। অথচ আমি চলছি, বাঁচার জন্যেই চলছি। নিজের ভেতরই এক ধরনের ঘৃণা জন্মেছে। মুখ দিয়ে থুথুর দলা ছুঁড়ে ফেললাম। তিন মাস আগেও জীবনটা অন্যরকম ছিল। বাঁচার নূন্যতম যোগ্যতাটুকু হারিয়ে যখন রাস্তায় এসে পড়লাম তখন রাহাত আমাকে এক অদ্ভুত চাকরি দিল। সে চাকরি প্রথমে মানা করে দিলেও পরে আর পারি নি। অবাক হয়ে রাহাতকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, "দেহ ব্যবসা ছেলেরা করতে পারে?" রাহাত হো হো করে হেসেছিল। "তোর কি মনে হয় মেয়েদের চাহিদা নেই?" "কিন্তু-" "প্রতিদিন কত অভিনয় হয় জানিস?" একটু থামে রাহাত। "পয়সাওয়ালা বুড়োগুলোকে যখন এই কৈশোর পেরোনো মেয়েগুলো বিয়ে করে তখন কি তারা এই বুড়োর কাছে বেশি কিছু আশা করতে পারে রে? দিনশেষে মানুষেরও পশুত্বকে প্রশ্রয় দিতে হয়। নয়তো বেঁচে থাকা যায় না।" কথাটা মিথ্যে নয়। পশুত্বের তাগিদটা শুধু ছেলেদেরই না মেয়েদেরও আছে। সবার অগোচরে এক নতুন পেশাও গড়ে উঠছে। সেই পেশাকে প্রশ্রয় দিচ্ছে আধুনিকতার নাম করে গড়ে ওঠা একদল উচ্ছৃখল। আমরা এতসব বুঝি না, পেট চলাতে, পরিবারের কষ্টের দিকে তাকিয়ে ব্যবসায় নেমে পড়ি। এত এত শিক্ষা যখন আমাদের এক মুঠো খাবার দিতে পারে না, তখন নৈতিকতা কৌতুক মনে হয়। মোবাইলটা ভাইব্রেট করছে। আমি রিসিভ করি, রাহাত। "পেমেন্ট পেয়েছিস?" ওপাশ থেকে বলে ওঠে। "হু।" "বিশ পারসেন্ট অফিসে জমা দিয়ে যাবি। মনে যেন থাকে।" "আচ্ছা।" ওপাশ থেকে কি যেন ভাবে। "পরশু আরেকটা মিট আছে। মহিলার স্বামী বিদেশ থাকে। তুই যাবি?" আমি হেসে উঠি। নিজের মধ্যে একধরনের ঘেন্নাবোধ জাগতে থাকে। পরক্ষণেই তার মাঝে একধরনের আনন্দ খুঁজে পাই। কারো কাছে তো হাত পাতি নি, পরিশ্রম করে রোজগার করে যাচ্ছি। সবাই ব্যবসা করে। কেউ বৈধ কেউ অবৈধ, মানুষ নিয়ে ব্যবসায় নামে কতজন। কই, কেউ তো খারাপ বলে না। আমিও ব্যবসায়ী, সৎ ব্যবসায়ী।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
রণতূর্য ২
গল্পটা শিক্ষণীয়। ভালো লেগেছে।আমার পাতায় আমন্ত্রন রইল।
ওয়াহিদ মামুন লাভলু
দুঃখজনক মিট যা কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না। অত্যন্ত মুল্যবান চিত্র যাতে শিক্ষা গ্রহণ করার মত বিষয় আছে। একটা অভিনব ও ন্যাক্কারজনক ব্যবসার কথা তুলে ধরেছেন। এই গল্পে মানুষের সতর্ক হওয়ার মত বিষয় আছে। অনেক মানসম্পন্ন গল্প। শ্রদ্ধা জানবেন। শুভেচ্ছা। ভাল থাকবেন।
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
বিজ্ঞপ্তি
“জানুয়ারী ২০২৫” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ জানুয়ারী, ২০২৫ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।