নীলার অপলক দৃষ্টি বাইরের দিকে। বিকেলের সময়টা বারান্দায় বসে কাটানোর অভ্যাসটা তার পুরোনো দিনের। কিছুক্ষণ আগে থেকে যাওয়া বৃষ্টির আলিঙ্গনে প্রকৃতি ধারণ করেছে এক চোখ ধাঁধানো রূপ। অবশ্য এই মুহূর্তে এই অপরূপ সৌন্দর্যকে উপভোগ করার মতো মানসিক অবস্থা মোটেই নেই নীলার। তার মনের অর্ধেকটা জুড়ে তখন স্বপ্ন, আর বাকিটা জুড়ে তা ভঙ্গের আশঙ্কা।
এইচ.এস.সি পরীক্ষার ফলাফল আশানুরূপ হওয়ার পরেও কিছুতেই নিজের মনকে স্থির রাখতে পারছে না নীলা। শিক্ষকদের মতে সে মেধাবী। ভালো কোনো জায়গায় চান্স হবেই; হতে পারতো খুব সহজেই, যদি না এর মধ্যে বাধঁ সাধতেন রফিক সাহেব। রফিক সাহেব নীলার বাবা। নীলার সামনে খোলা এতগুলো দরজা বন্ধ করে দেয়ার পেছনে খুব জোড়ালো কারণ আছে তা বলা যায় না।
শহরবাসী হলেও নিজের চিন্তা চেতনায় খুব একটা আধুনিক হয়ে উঠতে পারেননি তিনি। মেয়ে মানুষ, হয় ডাক্তারি পড়বি নাইলে বিয়ে করে স্বামী-সংসার করবি। মেয়েদের আবার উকিল-ইঞ্জিনিয়ার হওয়া!- এ কথা বলে গত রাতেও মুখ বাঁকাতে ভুল করেননি রফিক সাহেব। অবশ্য এ ধরণের কথা নীলা প্রথমবার শুনেছে তা নয়। এর আগেও বহুবার এমন মন্তব্য করেছেন তিনি। এসব কথা শুনলে নীলার গায়ে জ্বালা ধরে। তবুও শুধুমাত্র বাবা বলে চুপ করে অনেক কিছু হজম করতে হয় তার। বড়দের, বিশেষ করে বাবার মুখের উপর কিছু বলার মতো মেয়ে নীলা নয়।
ছোটবেলায় নীলার স্বপ্ন ছিল পাইলট হওয়ার। কিন্ত এক প্রকার জোর করেই মাটি চাপা দিতে হয়েছে সেই ইচ্ছেকে। বুনে নিতে হয়েছে নতুন স্বপ্ন।
ডাক্তার আমি হবই! আজ থেকে ঠিক তিন বছর আগে এমনি এক শক্ত প্রতিজ্ঞা করেছিল নীলা। তেবে সেটা বাবার কথা শুনে নয়। কারণটা ভিন্ন।
৩ বছর আগে।
নীলু-ক্ষীণ গলায় তার মেয়েকে ডাকলেন মৃত্যু শয্যায় অবস্থানরত মিসেস নাসরিন। তার মাথায় হাত রাখলো নীলা।
আমার একটা কথা রাখবি?
বলো মা।
কোনোদিন তোর ইচ্ছের বিরুদ্ধে তোকে কিছু করাতে চাইনি। শুধুমাত্র একটা কথা-
কি কথা মা?
চিকিৎসার অভাবে তোর নানা মারা গিয়েছিলেন।
হুম, জানি।
মা.. তুই ডাক্তার হবি? অনেক বড় ডাক্তার। বিনা পয়সায় গরীবের চিকিৎসা করবি। বল মা, হবি না? এই স্বপ্ন আমার অনেক দিনের মা।
এ কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে যায় নীলা। মা কোনোদিন এমন কোনো কথা বলেনি, এমন কোনো অনুরোধ করেনি, আজ হঠাৎ কি হলো মায়ের? এই উত্তর অবশ্য জানা হয়নি নীলার। সেই রাতেই মিসেস নাসরিন পাড়ি জমান না ফেরার দেশে।
মূলত প্রয়াত মায়ের মেষ স্বপ্ন পূরণের উদ্দেশেই নিজেকে নতুন করে গুছিয়ে নেয় নীলা।
সন্ধ্যা নামার আগেই বারান্দা থেকে উঠে আসে সে।
ফোন বেজে উঠলে নীলার চোখ চলে যায় টেবিল এর দিকে। রিতুর ফোন।
কিরে, কি খবর তোর, নীলা? খুব পড়াশোনা হচ্ছে?
তা হচ্ছে কিছুটা। আর ক-টা দিন। তারপর ই তো ভর্তিপরীক্ষা।
যাই হোক। খেতে যাবি কালকে?
কোথায়?
বাইরে। রাফিদ খাওয়াবে।
রাফিদ কে?
অরে রাফিদ-নতুন বয়ফ্রেন্ড।
নতুন বয়ফ্রেন্ড? আগেরটার আবার কি হলো?
আরে ধুর-আগেরটাও আছে। ও তো এখন দেশের বাইরে। কিছু জানতে পারবেনা। সব ব্যবস্থা করে রাখবো আমি। বুঝলি? আমি তোর মতো গাধী না।
বুঝলাম।
কি বুঝলি?
কিছু না। প্রেম করবি ভালোকথা, একজনের সাথে কর। এতজনের পিছনে সময় নষ্ট করলে নিজের জীবন এর ই বারোটা বাজবে।
হু হু। মরুব্বির মতো উপদেশ দেয়া হচ্ছে এখানে। না গেলে নাই। আমি একই যাবো। ফোন রাখ গাধী।
হুম, যা। রাখলাম।
কিছুটা বিরক্তি নিয়েই ফোন রেখে দেয় নীলা। রিতু টা এমনই। অনেক বড়লোকের মেয়ে কিনা। চিন্তা ভাবনা তার নেই বললেই চলে!
বই খাতা নিয়ে বসতে না বসতেই কলিং বেল বেড়ে ওঠে। বাবা উঠেছেন বুঝতে পেরে নীলা আবার পড়ায় মনোযোগ দেয়। অবশ্য বেশীক্ষণ আর লেগে থাকতে পারেনা টেবিল চেয়ারের সঙ্গে। তার আগেই ডাক পড়ে নীলার।
মা, দু-কাপ চা করে আন তো!
যাচ্ছি, বাবা।
বই খাতা বন্ধ করে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ায় সে। ড্রয়িং রুম থেকে ভেসে আসছে গল্প গুজবের শব্দ। রিয়াজ সাহেব এসেছেন। তিনি নীলার বাবার বন্ধু। হঠাৎ এই সময় তাদের বাড়িতে আসার কোনো কারণ আঁচ করতে পারেনা নীলা।
চা হয়ে গেলে ড্রয়িং রুমে আসে সে। তাকে দেখে যেন বেশ খু্শিই হয় রিয়াজ সাহেব। আপাদমস্তক একবার দেখে নেয় মেয়েটিকে। নিজের ঘরে ফিরে যাওয়ার পথে বাবার গলা কানে আসে নীলার।
মেয়ে আমার খুব লক্ষী। একে বারে সেরা সুন্দরী না হলেও ওকে পেয়ে শশুরবাড়ির লোকজনের খুশি হবে।
কিন্তু বিয়ের পর পড়াশোনা কিংবা চাকরি বাকরি করাটা-
বলছিলাম কি- আর কটা দিন অপেক্ষা করা যায় না? সামনে মেডিকেল এর ভর্তি পরীক্ষা। টিকলে পড়বে আর না টিকলে তো আর পড়াশোনার প্রশ্নই আসে না! চাকরি বাকরি তো দূরের কথা-
আরে-ছেলের এমনিতেই অনেক টাকা। বেশি যোগ্যতা আমার ভাই বা ভাবি কেউই চায় না। আসলে মানে- ছেলের লেখাপড়া বেশিদূর হয়নি তো। তবে পয়সা আছে। পড়াশোনা দিয়ে আর কি হবে। বয়স একটু বেশি, কিন্তু একেবারে ঘাটের মড়া তো আর নয়!
বুঝলাম। পাত্র হাতছাড়া করাটাও বোকামি। নীলার গায়ের রংটা একটু চাপা। তবুও ছবি দেখে যখন ওনারা পছন্দ করেছেন, সে তো আমার সৌভাগ্য। ওর মা মরার পর নীলাকে নিয়ে আমার যত চিন্তা। ওকে একবার পার করতে পারলে আমিও ঝামেলা মুক্ত। বাকি দিনগুলি নাইলে গ্রামেই কাটিয়ে দিলাম।
তাইলে তো আর কোনো অসুবিধাই নাই। আমি আমার ভাইকে আজই সব জানিয়ে দিই বরং।
আরেকটু অপেক্ষা করা যায় না? ভর্তি পরীক্ষাটা হয়ে নিক। না টিকলে আমি আর দেরি করবো না। মানুষকে অন্তত বলতে তো পারবো যে পরীক্ষা দিয়েছিলো। আর কিছুদিন একটু দেখো না ভাই-
এসব কথা শোনার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলোনা নীলা। বিয়ের কথা এখন সে চিন্তাও করতে পারেনা। এক দৌড়ে নিজের বিছানার উপর আছড়ে পড়ে সে। মাথা কাজ করছে না তার। একবার মনে হলো কাঁদবে কিছুক্ষন, কিন্তু আর যেন চোখের পানিও বাঁধা পাচ্ছে।
কিছুদিন পর।
কোচিং সেন্টার থেকে একাই বেরিয়ে আসে নীলা। রিতুর ডাক শুনে পেছনে ফিরে তাকায় সে।
তুই এখনো মন খারাপ করে আছিস? আঙ্কেল ওসব এমনি বলেছেন। তোর কি বিয়ের বয়স হয়েছে নাকি? মেডিকেল এ চান্স না পেলে অন্য কোথাও পড়বি। আঙ্কেল কে বুঝিয়ে বললে তিনি ঠিক বুঝবেন।
বুঝবে না রে, আমার বাবা কে তুই চিনিস না। আচ্ছা রিতু, তুই কোথাও চান্স না পেলে কি করবি?
চান্স না পেলে আর কি করার! প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি তে পড়ব। আঙ্কেল কে একবার প্রাইভেট মেডিকেল এর কথা বলে দেখিস।
অত টাকা কোথায় পাবে বাবা?
চিন্তা করিস না, তুই ঠিকই চান্স পাবি। প্রাইভেট মেডিকেল এ যেতে হবেনা।
কোনো উত্তর দেয়না নীলা। তার পাশে চুপচাপ হাটতে থাকে রিতু। নীলার মতো এতো চিন্তা তার কোনোদিনই করতে হয়নি। বাবার প্রিন্সেস সে। না চাইতেই সব পেয়ে যায়। বাবা-মার থেকে না কথাটি খুব একটা শুনতে হয়নি তার। সেজন্যই হয়তো কিছুটা বখে গেছে সে।
আরো কিছুদিন কেটে যায় একইভাবে। ঘনিয়ে আসে পরীক্ষার তারিখ। কেমন যেন এক অনুভূতি হতে থাকে নীলার। জীবনে এমনটা আর কোনোদিন হয়েছে বলে সে মনে করতে পারেনা।
দরজায় কড়া নাড়ছে ভর্তি পরীক্ষা আর সেই শব্দ যেন অবসন্ন করে রেখেছে তাকে।
বাজতে থাকা ফোনটিকে তুলে নেয় নীলা। ওপর প্রান্তে থাকা রিতুর কন্ঠস্বর কিছুটা অন্যরকম শোনাচ্ছে, কিছুটা কাঁপছে বলেই ধরে নেয় সে।
এই নীলা, প্রশ্ন লাগবে?
কিসের প্রশ্ন?
জানিস না কিসের প্রশ্ন?
উম... সাজেশান নাকি?
ধুর! তুই আসলেই একটা গাধী। মেডিকেল এর ভর্তি প্রশ্ন। ফাসঁ হয়ে গেছে।
রিতু-
কি হলো? মেডিকেল এ টিকাটা আর কোনো ব্যাপারই হবেনা! অনেকেই পাচ্ছে প্রশ্ন। আরে-একটু লিংক থাকলেই হয়, সহজেই পাওয়া যায় এসব। তুই ও নে।
ফোন রাখ।
কি তোর লাগবে না? সব পারিস?
পারি আর না পারি, এভাবে পরীক্ষা দিয়ে পাস করতে চাইনা আমি। ফোন রাখ।
রিতু আর কিছু বলেনা। নীলাটা এমনই। তার মতে বোকা।
ফোন বন্ধ করে বিছানায় ছুড়ে ফেলে নীলা। রাগে ফুঁসতে থাকে সে। এস.এস.সি ও এইচ.এস.সি পরীক্ষার সময় তাকে এমন প্রস্তুাব দিয়েছিলো রিতু। হাতের কাছে পেয়েও প্রশ্ন নেয়নি নীলা। মা তাকে এই শিক্ষা দেয়নি। সারাজীবন সততার জয়গান করা এক নারীর সন্তান হয়ে সেই ফাঁস হওয়া প্রশ্নের দিকে দৃষ্টিপাত করাও তার কাছে পাপ।
যথাসময়ে হলে পৌঁছে যায় নীলা। রিতুর সিট্ খুব একটা দূরে ছিলোনা তার থেকে। চোখাচোখিও হয়েছিল, তবে কথা হয়নি। প্রশ্ন হাতে পেয়ে চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে যায় রিতুন, সঙ্গে আরো অনেকেরই। কারণটা নীলার জানা। ব্যাপারটা নিয়ে সে আর মাথা ঘামায় না। কলম তুলে নিয়ে প্রশ্নের দিকে মনোযোগ দেয় সে।
প্রশ্ন ফাঁসের বিষয়টি নিয়ে তোলপাড় কম হয় না। তবে এবারও বিশেষ কোনো লাভ হয়নি। হয়তো এর পুনরাবৃত্তি ঘটবে আগামী বছরও।
আজ ফলাফল প্রকাশের দিন। কিছু সময় যেতেই জানা গেলো রিতু চান্স পেয়েছে। চান্স পেয়েছে পাশের জনের খাতা নকল করে এস.এস.সি ও এইচ.এস.সি পরীক্ষায় জিপিএ ৫ পাওয়া আরো অনেক শিক্ষার্থী। সীমিত আসনগুলো জুড়ে এখন তাদেরই অবস্থান।
কিছুদিন পরে নিজ ফ্ল্যাটের বারান্দায় হতোদ্যম হয়ে বসে থাকতে দেখা যায় রিতুকে। মন খারাপ তার প্রিয় বান্দবীর জন্য।
কার নীলার গায়ে হলুদ।
০৪ অক্টোবর - ২০১৭
গল্প/কবিতা:
২ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪