মাধু

কোমল (এপ্রিল ২০১৮)

মিঠুন মণ্ডল
  • ১২

আজ ২৬ শে ডিসেম্বার মাধবীলতার জন্মদিন। শ্যামলবাবুর মন ভাল নেই। গত বছর ঠিক একই দিনে মাধু সকলকে ছেড়ে চলে যায়। মাধুর যখন ৪ বছর বয়স তখন গ্যাসের সিলিন্ডার ফেটে শ্যামলবাবুর স্ত্রিও মারা যান। তারপর আত্মীয়স্বজন পাড়া প্রতিবেশী বন্ধু বান্ধব প্রায় সকলেই বলেছিলেন দ্বিতীয় বিবাহ করার জন্য কিন্তু তিনি করেননি। মাধুর মা মারা যাবার পর শ্যামলবাবু প্রায় ৫ বছর সব কিছু ছেড়ে দিয়েছিলেন। স্কুল থেকে বাড়ী আর বাড়ী থেকে স্কুল। যদিও মাধুকে দেখা শোনার জন্য একজন ভদ্র মহিলাকে রাখা হয়েছিল তবুও তিনি মাধুর দেখাশোনা নিজের হাতে করতেই ভালবাসতেন। সেটা ওকে খাওয়ানো হোক বা পড়তে বসানো। শ্যামলবাবুর সমস্যা হত মাধুর শরীর খারাপ হলে। শহরের সব চেয়ে ভাল ডাক্তার কে দেখিয়েই ক্ষান্ত হতেন না, নিজে দু-চারটে হোমিওপ্যাথি বই পড়ে ওষুধ দিতেন আর প্রায় সারা রাত মেয়ের বিছানার পাশে জেগে থাকতেন। ৫ বছর বয়সে মাধু বাথরুমে পড়ে হাত ভাঙে। শ্যামলবাবু টানা দিন২০ মেডিক্যাল লিভ নিয়ে নেন। এর জন্য অবশ্য শ্যমলবাবুকে অনেক টিপ্লনীও শুনতে হয়েছে। অনেকে মজা করে বলেছেন মেয়ের বিয়ে হয়ে গেলে কি আপনিও মেয়ের শ্বশুর বাড়িতে থাকবেন না জামাইকে ঘর জামাই করে রেখে দেবেন। নিন্দুকেরা বলতেন দেখব মেয়ে কত মনে রাখে! শ্যামলবাবু এর উত্তরে বলতেন সে সব অনেক পরের কথা আপনারা আশীর্বাদ করুন মাধু জানো সুস্থ থাকে, ভাল থাকে। ৬ বছর বয়সেই মাধুকে নাচের স্কুলে ভর্তি করে দেওয়া হয়। বাড়িতে একজন আসতেন গান শেখাতে। ৪ বছর প্রত্যেক রবিবার মাধুকে নাচের স্কুলে শ্যামলবাবু দিয়ে আসতেন তারপর অপেক্ষা করতেন ক্লাস শেষ না হওয়া পর্যন্ত। ১০ বছর বয়সে একদিন মাধু বলল, “বাপি তোমাকে আজ নাচের স্কুল যেতে হবে না, আমি একাই যেতে পারব, শুধু শুধু তুমি একা বসে থাকো আমার ভাল লাগে না। শ্যামলবাবু মাধুর মুখের দিকে চেয়ে থাকলেন তারপর বললেন, “ঠিক আছে আমি যাব না”। কথাটা এমন ভাবে বললেন মাধুও ঠিক বুঝতে পারল না শ্যামলবাবু রাগ করে বললেন না শুধু মাধুর কথার উত্তর দিলেন। গত পাঁচ বছর মাধুর দেখা শোনায় শ্যামল বাবু নিজেকে এতোটাই ব্যস্ত রেখেছিলেন যে আলাদা করে নিজের জন্য সময় বার করার প্রয়োজন অনুভব করেন নি। আজ হটাৎ করে রবিবারের বিকেলটা ফাঁকা পেয়ে গিয়ে কি করবেন বুঝতে পারছিলেন না। তবে এটা বুঝতে পারছেন মাধুকে একটা ‘স্পেস’ দিতে হবে, সব সময় আগলে রাখলে হবে না।
II
বাড়ীতে বাৎসরিকের জন্য বেশ কিছু আত্মীয় স্বজনকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। জামসেদপুর থেকে মাধুর পিশিও এসেছেন। মাধুর পিশি, উমাদেবী শ্যামলবাবুর থেকে প্রায় ১২ বছরের বড়ো। কিন্তু মাধুর মৃত্যুর পর শ্যামলবাবু এতটাই ভেঙে পড়েছেন যে শ্যামলবাবুকেই উমাদেবীর থেকে বড়ো মনে হচ্ছে। মুখে সাত- আট দিনের সাদা –কাঁচা দাড়ি, অবিন্যস্ত চুল, অন্যমনস্ক মন- এক ঝটকায় শ্যামলবাবুর বয়স অনেকটায় বাড়িয়ে দিয়েছে। উমাদেবী প্রথমে বাৎসরিকে ভূরিভোজনের আয়োজন করতে মানা করেছিলেন। কিন্তু শ্যামলবাবু উমাদেবীর কোন কথাই শুনতে চাননি, তার মতে মেয়ের বিয়েতে তো খাওয়াতে পারলাম না... । কথাটা অসম্পূর্ণ রেখেই বাচ্চা ছেলের মতো কাঁদতে থাকলেন। ছোটো বেলায় এই রকম কাঁদতে কাঁদতে আবদার করত, “দিদি মা-কে বলে দাও না আমি আজ স্কুলে যাব না কিংবা আজ মাস্টার মশাই এর কাছে পড়ব না, তোমার কাছে পড়ব”। উমাদেবী পাশের বাড়ির বাগান থেকে কুল বা পেয়ারা আনার শর্তে ভাইকে সেই যাত্রায় রক্ষা করতেন। এখন আর তার মুখ থেকে কোন কথা বের হয়নি, তিনি চাননি তার ভাই বাকি জীবনটা শোক সভার ফ্যান্টাসির মধ্যেই কাটিয়ে দিক। তাই জামসেদপুর থেকে ফোনেই বলে দিয়েছিলেন ১০০ এর বেশি যেন আমন্ত্রণ জানানো না হয় এবং এদের মধ্যে যেন ৭ জন ব্রাম্ভন হয়। তাঁর মতে মাধুর আত্মার শান্তির জন্য আত্মীয় স্বজনের থেকে ব্রাহ্মন ভোজন টা বেশি প্রয়োজন। বাৎসরিকের আয়োজন থেকে আত্মীয় স্বজনকে আতিথিয়তা সব কিছুই নিজের হাতে সামলাচ্ছেন উমাদেবী। কিছুক্ষণ পূর্বেই এক কাপ চা খাওয়ার পরেও শ্যামলবাবু আবার এক কাপ চা চাইলে উমাদেবী মৃদু ভৎসনা করেন, “বুড়ো মানুষের মতো এতো চা খাস কেন? সকাল থেকে তিন কাপ হয়ে গেছে, একটু অপেক্ষা কর আমি সন্ধ্যাকে দিয়ে সরবৎ করে পাঠাচ্ছি।
“ছেড়ে দাও লাগবে না”। শ্যামলবাবু কথাটা বলে পেপার পড়তে লাগলেন। কিন্তু দুলাইন পড়তে না পড়তেই মাথা ধরে এল, কারো সাথে কথা বললে যেন হালকা লাগে। আজ খুব বেশি করে ললিতা দেবীর কথা মনে পড়ছে। একটা সময় ললিতা দেবী অভিযোগ করতেন, “ তুমি একদম আমাকে সময় দাও না, সব সময় স্কুল, টিউশন, রাজনীতি এতোই যখন ব্যস্ত বিয়ে করতে কে বলেছিল”।
“তুমিতো বই পড়তে ভালোবাস, বাড়িতে শরৎ সমগ্র, রবীন্দ্র সমগ্র তো আছেই তাছাড়াও তুমি লাইব্রেরী থেকেও বই এনে পড়তে পারো”।
“তবুও তুমি আমার জন্য সময় বার করবে না, তাইতো?” কথাটা বলে ললিতা মুখটা অন্য দিকে ঘুড়িয়ে নিলেন।
“আহা রাগ করছো কেন? নতুন সংসার করেছি টাকাপয়সাও তো দরকার। শ্যামলবাবু ললিতা দেবীকে এই ভাবে বুঝিয়ে নিজে নানান কাজে ডুবে থাকতেন। আজ ভগবান যেন কড়াই গণ্ডায় হিসেব নিচ্ছেন, এখন শ্যামলবাবুর অফুরন্ত অবসর সময় কিন্তু দুটো কথা বলার লোক নেই।
তবে শ্যামল বাবু একেবারে বেরসিক মানুষ ও ছিলেন না। মাধু হওয়ার পূর্বে ললিতা দেবী সমরেশ মজুমদারের ‘কালবেলা’ উপন্যাসটি পড়েছিলেন। মেয়ে হওয়ার পর শ্যামলবাবু বিভিন্ন নামে ডাকলেও কোন নামই ললিতা দেবীর ঠিক পছন্দ হচ্ছিল না। তিনি অনেক ভেবে বললেন, “ ‘মাধবীলতা’ রাখলে কেমন হয়?”
শ্যামলবাবু ললিতা দেবীকে রাগানোর জন্য বলেছিলেন, “নামটা মন্দ নয়! আমার মনে হচ্ছে ‘মাই মাদার ইন ল’ আই মীন ‘তোমার মা’ ‘তুমি’ হওয়ার আগে শরৎ বাবুর ‘পরিণীতা’ উপন্যাস টি পড়েছিলেন”।
“গুরুজনদের নিয়ে ইয়ার্কি আমার একদম ভাল লাগে না, আর আমার মা মানে? ‘তোমার মা’ কে আমি মা বলে ডাকি না”। ললিতা দেবী গাল ফুলিয়ে কথা গুলো বলেছিলেন।
সন্ধ্যা সরবতের গ্লাসটা টি –টেবিলের উপর রাখলে শ্যামলবাবুর সম্বিত ফেরে। “ পিশিমা বলেছেন সরবত খেয়ে স্রানে যেতে, ঠাকুর কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসবে”। সন্ধ্যা কথাটা শেষ করেই রান্না ঘরের দিকে চলে গেল। শ্যামলবাবু যেন কথাটা শুনেও শুনলেন না।
III
মাধুর বয়স তখন ৬ বছর।শ্যামলবাবু স্কুল থেকে ফিরে এসেই মাধুকে পড়াতে বসতেন। মাধুর মনে অসংখ্য প্রশ্ন এবং সে বিশ্বাস করে তার বাবা সব প্রশ্নের উত্তরই জানে। ‘ABCD’ লিখতে লিখতে মাধু জিজ্ঞেস করল, “বাবা আমার বই-এ যে বিড়াল টা রয়েছে সেটা সাদা কিন্তু আমাদের বাড়িতে যে বিড়ালটা আসে সেটা কালো কেন”?
“সোনা বিড়াল তো সাদা কালো দুই রকমই হয়”। উত্তর শুনে মাধু খুশি হল কিনা বোঝা গেল না, এরপর তার পরের প্রশ্ন , “ জানো বাপী ভুলু না আজ খুব চিৎকার করছিল, মনে হয় ওর খুব শরীর খারাপ”।
“ কোন ভুলু”?
“ওই যে রতন কাকুদের বাড়িতে থাকে না”।
“ও! হবে হয়তো! এখন তুই পড়, ‘ABCD’ তাড়াতাড়ি শেষ কর এর পর অঙ্ক করব। তোমাকে আজ মাল্টিপ্লিকেশন শেখাব”। শ্যামলবাবু পারলে তখনই মাষ্টার ডিগ্রীর সিলেবাসটাও পড়িয়ে দিতে পারে কিন্তু মেয়ের সে দিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। মাধু ‘C’ টা লিখে জিজ্ঞেস করল,
“বাপী কালকে তুমি চকলেট দেবো বললে, দিলে না তো?”
“পড়া শেষ হলে দেবো, ‘ABCD’ টা শেষ কর তাড়াতাড়ি”।
কোন রকমে ‘ABCD’ টা শেষ করে মাধু বলল, “বাবা আজ আর পড়ব না আমার আঙুলে লাগছে”।
শ্যামলবাবু মনে মনে বললেন এটাই ভাবছিলাম, মাধুর হাতটা মুখের কাছে নিয়ে এসে একটু ‘ফু’ দিয়ে বললেন এবার ভাল হয়ে যাবে, এখন তোমার ছুটি । মাধু চুপ চাপ বসে আছে দেখে শ্যামলবাবু একটু ভয় পেলেন, মেয়ের কী সত্যি খুব লেগেছে নাকি! ‘মাধু খুব ব্যাথা করছে ডাক্তারের কাছে যাবি’?
‘না তুমি চকলেট দেবো বললে’!
‘ড্রয়ারে আছে নিয়ে নাও’!
মাধু প্রায় ফ্রাকসন্ অফ্ সেকেন্ডের মধ্যে উধাও। কে বলবে একটু আগেই মেয়ের আঙুলে ব্যাথা করছিল। শ্যামলবাবু মনে মনে কথা গুলো ভাবতে ভাবতেই হাসতে লাগলেন। এদিকে উমাদেবী ঘরে ঢুকে দেখলেন ভাই কে যে অবস্থায় দেখে গেছেন সেই অবস্থাতেই বসে আছেন।
“ঠাকুরতো চলে এসেছে তুই এখনও স্নানে যাসনি কেন”?
“হ্যাঁ এই তো যাবো, দিদি এক কাপ চা-হবে”?
একটা মানুষ কতবার চা খায়! চা- খেয়ে খেয়ে শরীরের কি অবস্থা করেছিস দেখেছিস?
শ্যামলবাবু আর কোন কথা না বাড়িয়ে স্নানে চলে গেলেন।
IV
শ্যামলবাবু স্নান সেরে ধুতি পড়তে গিয়ে একটু থমকে গেলেন, আলমারি থেকে সাদা পাঞ্জামা- পাঞ্জাবী বার করে ধুতিটা ঢুকিয়ে দিলেন। কোন পূজোপার্বণে শ্যামলবাবু ধুতি পড়তে চাইলেও মাধু পড়তে দেয়নি। মাধু বলত, ‘বাপী তুমি ধুতি পড়বে না, ধুতি পড়লে তোমাকে এজেড লাগে, তুমি পাঞ্জামা- পাঞ্জাবী পড়বে। বাৎসরিকের কাজকর্ম শেষ হলে শ্যামলবাবু কম্পিউটারে পুরানো ফোল্ডার থেকে মাধুর তোলা ছবি গুলো দেখতে লাগলেন। মাধ্যমিকে ভালো রেজাল্ট করার পর শ্যামলবাবু জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘কি চাস বল’? ‘বাপী আমাকে একটা এস্লার ক্যামেরা কিনে দেবে’? ‘এস্লার ক্যামেরা নিয়ে কি করবি? তুই তো ঘর থেকে বেরোসই না। শ্যামলবাবু ভেবেছিলেন মাধু হয়তো চাইবে একটা ভালো হারমোনিয়াম বা তানপুরা বা নিদেন পক্ষে একটা ভালো মোবাইল। এস্লার ক্যামেরা নিয়ে মাধু তার হাত সেট করেছিল তার বাপীর ছবি তুলেই। শ্যামলবাবু খাচ্ছেন তখন মাধু একটা স্ন্যাপ শট নিল, কখনও বা উদাসমনে কিছু ভাবছেন, শ্যামলবাবুকে কিছু না জানিয়েই ক্যামেরা বন্দি করছে মাধু। এই রকমই দৈনন্দিন জীবনের টুকরো টুকরো মুহূর্ত গুলোকে সাজিয়ে উপহার দিয়েছিল তার আদরের বাপিকে। অ্যালবামে একটা ছবি দেখেতো শ্যামলবাবু অবাকই হয়েগিয়েছিলেন। একই ফেমে শ্যামলবাবু, ললিতাদেবী এবং তরুণী মাধু। চোখে মুখে বিস্ময় নিয়েই শ্যামলবাবু জিজ্ঞেস করেছিলেন এটা কি করে সম্ভব? মাধু একটু গলার স্বরকে গম্ভীর করে বলেছিল, “ Everything is possible in the real world”. তারপর আদরের মেয়ে বাপির গলা জড়িয়ে বলে, খুব সহজ, ফটো শপে গিয়ে এডিট করলেই করা যায়। বাবা! কত জানে আমার মেয়ে! একটু বুদ্ধিতো পড়াশোনাতেও লাগাতে পারিস? H.S এর রেজাল্ট যা হয়েছে ফিজিক্সে অনার্স পাবি কিনা জানি না? ফিজিক্স আমি পড়ব না বাপি। মাস কমিউনিকেশন নিয়ে পড়ব। কি হবে পড়ে? চাকরি পাবি? আর যদি পেয়েও যাস ক টাকা মাইনে পাবি? তার থেকে ফিজিক্স নিয়ে পড়, পরে যদি সাংবাদিকতা করতে ইচ্ছে করে তো করবি।
বড় বড় ব্যাঙ্কে , কর্পোরেট সেক্টরে MBA করা ছেলে মেয়েকে বেশি মাইনে দিয়ে নেওয়া হয় কেন বলতো? Because they are specialized for the particular job. মাস কমিউনিকেশন পড়লে আমি কিছুতো অ্যাডভান্টেজ পাবো।
সেটা ঠিক। শ্যামলবাবু একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ছেড়ে বললেন। কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর শ্যামলবাবু বললেন, আমি ভাবছিলাম ফিজিক্সে এম.এস.সি করে তুই স্কুলে বা কলেজে পড়াবি, সাংবাদিকতায় অনেক ছোটা ছুটি করতে হয়, পারবি তুই?
মাধু শ্যামলবাবুর অবিন্যস্ত চুলগুলোকে ঠিক করে দিতে দিতে বলে, ‘বাপি, তুমি কেন এত টেনশন করছ, আমি ঠিক পাড়ব। সাংবাদিকতা মানে ছোটা ছুটি কে বলেছে তোমাকে, অনেক সাংবাদিক ডেক্সে বসেও কাজ করে।
V
রাত্রি ১১.৩০ বেজে গেছে, কিরে খাবি না? উমা দেবী জিজ্ঞেস করলেন।
হ্যাঁ তুমি যাও, আমি যাচ্ছি।
উমাদেবী চলে যেতে গিয়েও থমকে দাঁড়ালেন, শ্যামলবাবুর কাছে এসে বললেন, ‘আমাকে দুতিনদিনের মধ্যেই চলে যেতে হবে, বুঝতেই পারছিস ‘তোর জামাইবাবু’ একা, তুই আবার টিউশন শুরু কর। ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে থাকলে তোর ভালো লাগবে। সব সময় মন মরা হয়ে বসে থাকলে...’ উমাদেবী কথাটা অসম্পূর্ণ রেখেই কাঁদতে লাগলেন। দেওয়ালের মাঝখানে মাধুর হাসিমাখা একটা ফটো টাঙানো রয়েছে। হয়তো মাধু দূর থেকেই সবই দেখছে। উমাদেবী আসলে মাধু পড়াশুনা ভুলে গিয়ে পিশির পাশে পাশেই থাকত। এই নিয়ে শ্যামলবাবু ভীষণ রাগারাগি করতেন, কখনও সখনও মাধুকে বকতেন। মাধু সমস্ত অভিযোগ নিয়ে পিশির কাছে আসত। ‘তোর বেশি বাড়াবাড়ি, দুচারদিন না পড়লে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে না। ভাইকে কপট বকাবকি করে মাধুকে প্রশয় দিতেন। ‘চল মাধু তোকে একটু সাজিয়ে দিই, চুল গুলোর কি অবস্থা, কতদিন যে চুলে তেল পড়েনি, বিকেলে আমরা মাধু ফুচকা খাবো, ঠিক আছে’? মাধু, পিশির গলা জড়িয়ে কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, ‘কালকে আমি নাচ শিখতেও যাবো না, তুমি বাপিকে বলে দাও’। উমাদেবী চোখ দুটোকে বড়ো করে চাপা গলায় বলতেন, এটা কি করে বলব? তোর বাপিতো আমাকে বকবে’। মাধু হয়তো মুখ শুকিয়ে বসে আছে। উমাদেবী অনেক বুদ্ধি খাটিয়ে ভাইকে বলল, ‘শ্যামল, মাধুর তো পায়ে লাগছে বলছে, কালকে নাচের স্কুলে না পাঠানোই ভালো, ব্যাথা যদি বেড়ে যায়’। ‘তুমি আসলেই তো ওর মাথা ব্যাথা, পায়ে ব্যাথা, পেটে ব্যাথা শুরু হয়ে যায়, তোমরা পিশি ভাইঝিতে যা খুশি কর আমি আর কি বলব’? এর পর শুরু হতো পিশির আস্কারায় মাধুর দস্যিপনা।
‘ও পিশি, শুভমদের বাড়ির পেয়ারা গাছটাতে অনেক বড়ো বড়ো পেয়ারা হয়েছে যাবে পারতে’?
‘ওরা তো বকবেন’।
‘আমরা ছাদ থেকেই পাড়তে পারব, পেয়ারা গাছটার একটা ডাল তো আমাদের ছাঁদের কাছেই আছে’।
‘অন্যের জিনিস না বলে নিলে কি হয়’?
‘চুরি করা বলে, কিন্তু পিশি পেয়েরা গাছটা তো আমাদের ছাদের উপরে এসেছে, একটা পেয়ারা নিলে কি হবে’?
‘ বুঝলুম! কিন্তু তোর বাপি জানতে পারলে খুব বকাবকি করবে’।
‘ঠিক আছে ছেড়ে দাও, কাল বাপি অনেক চালতা এনেছে চল নুন লঙ্কা দিয়ে খায়’।
উমাদেবী মাধুর সাথে কখনও চালতা কখনও কাঁচা তেঁতুল খেতে খেতে নিজের ছোট বেলায় ফিরে যাচ্ছে। এরপর হয়তো সারাদিন দস্যিপনা করে মাধু না খেয়েই রাত্রে ঘুমিয়ে পড়েছে। উমাদেবী মাধুর মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে নিজের মনকে বোঝাছে, একটু আগেই খাইয়ে দিলে হতো।
উমাদেবী নিজের চোখ মুছে বললেন, ‘আমি নিচে যাচ্ছি , সন্ধ্যাকে বলছি খাবার বাড়তে, তুই তাড়াতাড়ি আয়’।
VI
রাত্রি ১২ টা বাজে। শ্যামলবাবু খেয়ে ব্যালকনিতে গিয়ে বসলেন। চারিদিকে এক অদ্ভুত নিস্তবদ্ধতা। শ্যামলবাবু আকাশের দিকে চেয়ে আছে। ছোটবেলায় মাধু যখন বার বার জিজ্ঞেস করত মা কোথায় গিয়েছে, শ্যামলবাবু আকাশে সব চেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্র কে দেখিয়ে বলতেন, ‘ ঐ যে সবচেয়ে বড় তারাটা তোমার মা, তুমি ভালোভাবে থাকলে, পড়াশোনা করলে মা অনেক চকলেট নিয়ে আসবে’। বেশ কিছুদিন পর হয়ত আবার মাধু জিজ্ঞেস করত, ‘মা তো এলো না’। শ্যামলবাবু পকেট থেকে চকলেট বার করে দিয়ে বলত এসেছিল তো, তুমি ঘুমাছিলে তো তাই ডাকতে মানা করেছিল, এই চকলেট গুলো তোমার মা ই আমাকে দিয়ে গিয়েছিল, আমি ভুলে গিয়েছিলাম। একটু বড় হয়ে গেলে আর জিজ্ঞেস করত না, হয়ত বুঝতে পেরেছিল মা আর কোন দিন ফিরবে না, মা আকাশের ‘তারা’ হয়েগেছে। শ্যামলবাবু আকাশের দিকে চেয়ে ‘মাধুকে’ খোঁজার চেষ্টা করছিলেন। কিছুতেই নিজেকে ক্ষমা করতে পারছেন না। একবার ভাবছেন আমিও মরে যায়, সব জ্বালা চুকে যাবে! কিন্তু কাপুরুষের মতো আত্মহত্যা করবেন। মাধু মারা যাবার দিন সাতেক আগে একবার কথা কাটাকাটি হয়েছিল। এই জন্য মাধু এতো বড় সিদ্ধান্ত নেবে, ভাবতে পারছেন না শ্যামলবাবু। মা-বাবা ছেলে মেয়েকে খাওয়াবে পড়াবে মানুষ করবে ব্যস এই টুকু, ছেলেমেয়েদের উপর কোন অধিকার নেই। বাবামায়ের কোন স্বপ্ন থাকতে পারে না! শ্যামলবাবু কিছুতেই মেলাতে পারছিলেন না। এখন মনে হচ্ছে ছাত্রছাত্রীদের এতদিন যে উপদেশ দিয়েছেন সব ভুল কারণ তিনি নিজেই সেটা মানেন না। সব মানুষ সমান এটা বলতে যতটা সহজ এটা মেনে নেওয়া মনে হয় ততটাই শক্ত। মাধু সুইসাইড নোটে লিখেছিল আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়। মাধু রোজ রাত্রে ডাইরি লিখত। ডাইরির শেষ দু-পাতায় যা লেখা আছে তা পড়ে শ্যামলবাবু নিজেকেই মাধুর মৃত্যুর জন্য দায়ী মনে করেন।
“আজ ২৫ শে ডিসেম্বার। এখন রাত্রি ১১.৪৫। আজকে সারাদিন খুব সুন্দর করে ঘরটাকে সাজালাম। নিজেও খুব সাজলাম। আয়নার সামনে গিয়ে দেখলাম সুন্দরী লাগছে কিন্তু মায়ের মতো নয়! আমার রংটা বাবার মতো। একটু চাপা তবে কালো নই। আজকে ফ্রাই রাইস বানালাম। জামশেদপুরে পিশির কাছে গিয়ে শিখেছিলাম। বাপি খুব খুশি হয়েছেন। তিনি বললেন, ‘তোর শ্বশুর বাড়ির লোকজন বলতে পারবে না যে মেয়েকে রান্না না শিখিয়েই পাঠিয়ে দিয়েছে’। বিকেলে রাতুলের সাথে ব্যান্ডেল চার্চে গিয়েছিলাম। প্রার্থনা ঘরে অনেকক্ষণ চুপ-চাপ বসেছিলাম। ভগবানের কাছে কি প্রার্থনা করব! ভগবান রাতুল আর বাপিকে খুব ভালো রাখবে। সন্ধ্যাবেলায় বাপি একটা বড়ো কেক এনেছিল। আমার পছন্দের চকলেট ফ্লেবার। সত্যি দিনটা খুব ভালো কাটল। ছোটোতেই মা মারা যাওয়ায় খুব বেশি কিছু মনে নেই। মনে আছে মা আমাকে খুব সুন্দর করে বেনুনী বেঁধে দিত। পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়লে আমার বেনুনী ধরে টান মারত। মা আমাকে বকলেই বাপী রেগে যেতেন। এই নিয়ে মা’র সাথে ঝগড়াও হয়ে যেত। বাপী আমাকে কোনদিন বকতেন না। যেদিন রাতুলের কথা জানতে পারলেন সেদিন কেমন মন মরা হয়ে গেছিলেন। রাত্রে খাওয়ার পর বলেছিলেন, তুমি এখন বড়ো হয়ে গেছ, তুমি নিজের ইচ্ছে মতো প্রেম বা বিয়ে করতেই পারো। আমি নাক গলাতে যাবো না। তবে পাড়াতে আমার একটু সম্মান আছে তো, যদি এই সব করতে হয় বাড়ি থেকে বেড়িয়ে গিয়ে করতে হবে। রাতুল সোরেন, আমার স্কুল মেট। ওর বাবা কিছু দিন পূর্বে খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। রাতুল কোন ধর্মই মানে না। কিন্তু বাপীকে বোঝাবে কে? তার মতে, ‘ আমরা যতই নিজেদের প্রোগ্রেসিভ বলি না কেন, এখনও সমাজটা সম্পূর্ণ পাল্টাই নি। হয়তো একদিন এই সব কিছুই থাকবে না কিন্তু যতদিন আছে মেনে তো চলতেই হবে। লুকিয়ে রাতুলের সাথে দেখা করছি এটা বাপী একদিন জানতেই পারবে। বাপীকে আমি কষ্ট দিতে চায় না! এই দিকে রাতুল কেও ভুলতে পারছি না! এই পৃথিবী টা খুব সুন্দর! এখানে অনেক সুন্দর সুন্দর মানুষ আছেন! কিন্তু নিয়ম গুলো বড্ড কড়া! আমি দ্বন্দ্ব আর নিয়মের ঘেরাটোপে থাকতে চায় না। অনেকদিন ‘মা’ তোমাকে ছেড়ে থাকলাম। আজ তোমার অভাব খুব অনুভব করছি। আমি খুব তাড়াতাড়ি তোমার কাছে আসছি”।
শ্যামলবাবু ডাইরিটাকে নিয়ে ছাদের উপরে উঠে গেলেন। তারপর ডাইরির শেষ পাতা দুটোকে ছিঁড়ে পুড়িয়ে ফেললেন। রাত্রের অন্ধকারে আকাশের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করতে লাগলেন, ‘লতিতা অনেক দিন তো হল, একাই সংসারের বোঝা টেনেছি। তুমি চলে যাবার পর মাধুকে বড়ো করাই ধ্যানজ্ঞান হয়ে উঠেছিল। মেয়েটাও কেমন, ফাঁকি দিয়ে তোমার কাছে চলে গেল। আমি আর কার জন্য বেঁচে থাকব বলতে পারো! হটাৎ করেই ছাদের কার্নিশের দিকে এগিয়ে এলেন, তারপর একটা আত্মনাদের শব্দ। উমাদেবী বাইরে বেড়িয়ে এসে দেখলেন, ভাই মাটিতে পড়ে আছে, রক্তে ভেসে যাচ্ছে চারিদিক।



আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মিঠুন মণ্ডল ধন্যবাদ ভাই... ভালো থাকবেন...
ওয়াহিদ মামুন লাভলু শ্যামলবাবু প্রথমে স্ত্রীকে হারালেন, তারপর মেয়েকে। অবশেষে তিনিও চলে গেলেন! গল্পের পরিণতিটা খুব বেদনাদায়ক। অনেক ভাল একটি গল্প। আমার শ্রদ্ধা গ্রহণ করবেন। আপনার জন্য অনেক অনেক শুভকামনা রইলো।
মিঠুন মণ্ডল ধন্যবাদ ভাইয়া...
মোঃ নুরেআলম সিদ্দিকী দারুণ একটি গল্প পেলাম। এত চরিত্র আর এত কাহিনী বিন্যাস বেধ করে গল্পের সমাপ্তি বেশ গর্ব করার মত। গল্পের পরিণতি আমার কাছে বেশি ভালো লেগেছে। শুভকামনা রইল, ভালো থাকুন মিঠুন দা....।।
মিঠুন মণ্ডল ধন্যবাদ দাদা...
মনজুরুল ইসলাম মাধুর শেষ পরিনাম কি হতে পারে বিসয়তি জানবার আগ্রহ জন্মানো লেখকের সফলতা. সন্তানের প্রতি অতিমাত্রিক আগ্রহ জেমন খতিকর একইভাবে একগুএ মনভাব সন্তানের জন্ন নেতিবাছক.অনেক সাবলিল বরননা.ভোট রইল.
মিঠুন মণ্ডল আমাদের ম্যাগাজিন আবার পুজোর আগে বেরোবে। তুমি মে মাসের মধ্যে লেখা পাঠাও। আমার মেল আই ডি- mithun.sainthia@gmail.com
সাদিক ইসলাম আপনার লিটলম্যাগে লিখতে আগ্রহী। খুব ভালো উদ্যোগ। এগিয়ে যান। শুভ কামনা। গল্পে সময় পেলে আসবেন। খুশি হবো। গল্পটি খুব ভালো লাগলো আপনার।
সাদিক ইসলাম খুব ভালো লাগলো। শুভ কামনা ভোট। গল্পে, কবিতায় আমন্ত্রণ।
ধন্যবাদ সাদিক...
মিঠুন মণ্ডল ধন্যবাদ আপা...

২৬ জুলাই - ২০১৭ গল্প/কবিতা: ১২ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪