১.
পুরেনো বইয়ের সাথে প্রেম আমার জন্ম থেকেই মনে হয় । পুরনো বইয়ের গন্ধ,ধূলাবালি,বইয়ের পোকা সবই ভালো লাগে । কারণ আছে। কারণ হচ্ছে এইসব বই খুললেই মনে হয় আলাদিনের চেরাগের মত কিছু বের হয়ে আসবে,মনে হয় রহস্যে ভরা এই বই । মাঝে মাঝে রহস্য পেয়েও যাই । আবার মাঝে মাঝে খুব কষ্টে আশা ভঙ্গ হয় । তবে যেসব রহস্য পাই,,তাও খারাপ না । চলে । অনেকের গোপন কথা লেখা থাকে,আবার কারও গোপন প্রেমের চিঠি বা নম্বর গোজা থাকে বইয়ে । সবচেয়ে যেটা কমন,তা হল শুকনো ফুলের পাপড়ি । বইয়ের প্রয়োজন শেষ হলেই,বই বেঁচে দেয়া হয় । বইয়ের সাথে স্মৃতিও যেন বেঁচে দেয়া হয়,যেগুলো পুরনো বইয়ের মলিন পাতায় আটকা পড়ে । আমি তাদের দেখাশোনা করি,যত্ন করি । এমন একটা মলিন বই কিনে এনেছিলাম কিছুদিন হল । এনে আমি যা পেলাম তাকে এক বাক্যে প্রকাশ করলে,”সাদা কালো টিভি এনে চালিয়ে দেখি,টিভি শুধু রঙ্গিন নয়,সাথে থ্রিডি ।“ কিনেছিলাম ঈশপের গল্পের বই । ভাবলাম পড়ে একটু নীতি শিক্ষা নেই,নাহলে আবার কবে দুর্নীতিবাজ হয়ে যাই । বইয়ের প্রথমের গল্পগুলো তুমূল উত্তেজনা নিয়ে পড়ছিলাম,পড়ছি আর পড়ছি । যে টেবিলে বসে পড়ছি সেখান থেকে এক চুলও নড়ছি না । ( আমি আবার টেবিলে বসে ,চেয়ারে পা দিয়ে পড়ি। রাজকীয় ভঙ্গিতে ।) কাঠবিড়ালি আর শিয়ালের গল্প,মাঝে এক নেউলের আগমন ঘটবে ঠিক সেই মুহূর্তেই পাতা উল্টে দেখি বইয়ের পাতা গায়েব,সব ডায়েরীর পাতা । যার ডায়েরী তার নাম সুখী । সেই সুখীর ডায়েরীর পাতায় প্রমাণ ছিল,তার নাম সার্থক নাকি সার্থক নয় ।
২.
“ সে আসে লাশ হয়ে “
আমি সুখী । সকালে বারান্দায় বসে ছিলাম । লক্ষ্য করলাম আকাশটা বেশ পরিষ্কার । শুধু নীল আর সাদা । নীলটা হচ্ছে সমুদ্রের নীলের মত আর সাদাটা সুমনের সাদা শার্টের মত । মনে মনে হাসিও দিলাম । আমার এখনও মনে আছে প্রথমবার যখন সুমনকে দেখেছিলাম,ও একটা ধবধবে সাদা শার্ট পড়ে ইউভার্সিটিতে এসেছিল । এত বেশি সাদা ছিল যে মনে হচ্ছিল সার্ফ এক্সেলের নতুন কোন বিজ্ঞাপনের শুট করতে এসেছে এই ছেলে ।তারপর তো এই সাদা শার্টের মালিকের পিছে পিছে ঘুড়েও পাত্তা পেতাম না । তারপর একসময় যখন হয়েই গেল,তখন তো শুধু প্রণয় আর লেগে থাকা । আমরা ফেভিকলের মত লেগে থাকতাম,সবখানে সবসময় ।ঐ সাদাশার্টে আমার কুমারীত্ব বিসর্জনের চিহ্নও লেগে গেল । না ইচ্ছে করে বা পরিকল্পনা করে না । অবচেতন মনেই ও ঐ শার্টটা পড়ে এসেছিল । কী যে ভয়ে ভয়ে ছিলাম দুইজন ! কী লজ্জা ছিল আমাদের । সুমনকে যখন ছেড়ে দিতে হলও তখনও,আমার শুধু মনে হচ্ছিল ঐ শার্টটার কথা । ওটা ওর কাছেই থেকে গিয়েছে । আজকে তার কথা মনে হচ্ছিল আর ভাবছিলাম,ও কী সেই শার্টটা সাথে নিয়েই কানাডা গিয়েছে । বলেছিল,আর কোনদিন সে শার্টটা ধুঁয়ে দিবে না,ওটা কী ও এখনও ওভাবে রেখে দিয়েছে ?সুমনকে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলেছি অনেকদিন । কিন্তু কাল রাতের স্বপ্ন,আর বারান্দার চেরীর গাছে ফুলে দেখে সুমনের কথা মনে পড়ে গেল । একটা বিশেষ দিনে সুমন আমাকে এই গাছটা উপহার দিয়েছিল । তখন এটা ছোট্ট একটা বনসাই গাছ ছিল মাত্র । আর এখন! আমি তাকে মুক্তি দিয়েছিলাম কয়েক বছর আগেই ,এখন সে বৃক্ষে পরিণত হয়ে উঠছে,অবাধ্য ডালপালা ছাড়িয়ে সে যৌবনে পা দিয়েছে,আছ ফুল ফুটেছে গাছে । গাছটা আমাকে সুমন যেদিন দিয়েছিল সেদিন আমি মানসিক ও শারীরিকভাবে ভীষণ ভেঙ্গে পড়েছি ।সুমন আর আমার ফুটফুটে একটা মেয়ে সন্তানকে মেরে ফেলেছি সেদিন । আমার কেন জানি মনে হয় ,সে মেয়েই ছিল । আমি সুমনকেও অনেকবার বলেছিলাম,কিন্তু ও সবসময় বলতো,”তুমি আমি দুজনেই মেয়ে বাবু পছন্দ করি তো,তাই তোমার এমন মনে হয় । আর বাদ দাও তো এসব ভাবা ।“ তারপর আসলেই বাদ দিয়েছিলাম,সুমন আমাকে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক করে তুলেছিল । যা হোক ,দোষটা আমারই ছিল । ভুল তো দুজনেরই ছিল,কিন্তু আমি একটু বেশিই অবহেলা করেছিলাম বলেই বুঝতে পারিনি যে ভীতরে অন্য কারও ছোট হৃদপিন্ডও আমার হৃদপিন্ডের সাথে তাল মিলিয়ে ধুক বুক করে বের উঠছে । যখন বুঝতে পারলাম তখন অনেক দেরী হয়ে গিয়েছিল । আমি হত্ববিহ্বল হয়ে পড়েছিলাম । সুমনের ভীতরে ভীতরে কী হয়েছিল জানি না ,তবে বাহিরে ও খুব শান্ত,ধীর,স্থির ছিল । সবসময় এমন একটা ভাব নিত যেন বাবা হওয়াতে সে খুব খুশি,আমি যদি রাজি থাকি তাহলে সে যেভাবে হোক সবকিছু ঠিকঠাক করে নিবে । কিন্তু আমি সুমনের মত ভাবতে পারছিলাম না ।বারবার মনে হচ্ছিল দুজনেই আমরা ইউনিভার্সিটিতে পড়ি কেবল,বিয়ে হয়নি,পরিবার জানে না,তার উপর দুজনের ক্যারিয়ার। আমারটা না হয় বাদ দিলাম,কিন্তু সুমন?ও অনেক ভালো ছাত্রও ছিল । সব ভেবে আমি সেই কঠিন সিদ্ধান্ত নিলাম । যখন হাসপাতাল থেকে ফিরছি তখন, সারা রাস্তায় সুমন আমার হাতটা শক্ত করে ধরে ছিল । মাথা ওর ঘাড়ে মাথা দিয়ে চোখ বন্ধ করে আছি । কিছুদূর যেয়ে ও রিকশা থামিয়ে আমার জন্য এক গাদা দোঁলনচাঁপা ফুল আনলো । আমি রিকশায় একা বসে ছিলাম,আর মনে হচ্ছিল আমি অনাথ,কেউ নেই আমার,অনন্তকাল ধরে একা আমি বসে আছি ।রাস্তার ওপারেই একটা নার্সারি ছিল। আমি ওদিকে তাকিয়ে আছি দেখে সুমন বললো,”গাছ কিনবে?” আমি মাথা নাড়ালাম কিন্তু আসলে মাথা এক চুলও নড়লো না ,কিন্তু সুমন আমার মনের কথা পড়তে পারতো বলেই আমার উত্তর বুঝে নিল । ও মনে হয় আমার জন্য নার্সারির সবচেয়ে সুন্দর গাছটা নিয়ে এসেছিল । গাছটা দেখে কিছুটা ভালো লেগেছিল । তারপর ঐদিন বাসায় যেয়েই গাছটাকে বনসাই অবস্থা থেকে মুক্তি দিয়েছিলাম । গাছের নতুন জন্ম হল আর আমার মেয়ের মৃত্যু হল। বিয়ের পর বাবু করে পাগল হয়ে গিয়েছি অথচ এখন অভিশাপ ভোগ করছি । একটা সন্তানের জন্য আমি কাঙ্গালিনী হয়ে গিয়েছি । একদিকে সন্তান শোক অন্য দিকে আরেক সন্তানের আসা । সাইকোলোজিস্ট,ওষুধ কোনটাই বাদ রাখছি না । তবুও প্রতিরাতে ঘুম ভাঙ্গে ,মনে হয় কেউ আমার ঘড়ে আসে । সাদা একটা শার্ট পড়ে আসে । খুব সুন্দর হাসে । আমি ছোটবেলায় যেমন দেখতে ছিলাম ঠিক তেমন দেখতে ,মনে হয় সুখীর আয়নার প্রতিবিম্ব । ঐ চেরী গাছটার নিচে বসে সে পুতুল খেলে । আমি একদিন সকালেও দেখেছি ওকে। চা নিয়ে যাচ্ছিলাম বারান্দায় বসে খাওয়ার জন্য ,বারান্দায় পা দেয়া মাত্র ও ডেকে উঠলো ,”মা”। আর গরম চায়ের কাপটা হাত থেকে পড়েহাত,পা পুড়েও গেল । প্রথমে কাউকে বলতে পারতাম না । পরে স্বামীকেই বললাম যে,”কোন সমস্যা আছে এই বাসায়,আমি এমন স্বপ্ন দেখি।“ কেউ মানতে চায় না,সবাই হেসে উড়িয়ে দেয়,বলে মানসিক চাপের জন্য এমন হচ্ছে । আবার পাশের বাসার ভাবী নতুন তথ্য দিয়েছে,বলেছে ,বলেছে অনেক আগে এই ফ্ল্যাটের বারান্দা থেকে পড়ে নাকি একটা বাচ্চা মারা গিয়েছিল । তারপর থেকে বারান্দায় গ্রিল দেয়া । কিন্তু আমি যাকে প্রতি রাতে দেখি সে আসলে কে ? আমার মেয়ে নাকি সেই মেয়ে ! আচ্ছা আমি আসলেই মানসিক ভাবে অসুস্থ,পাগল হয়ে যাচ্ছি না তো? সুমন বলতো ,”বেশি ভাবতে ভাবতে তুমি পাগল হয়ে যাবে একদিন।“ ওর কথাই কী সত্যি প্রমাণিত হতে যাচ্ছে । নকি আসলেই কেউ আসে তার মায়ের ভালোবাসা নিতে। আমার মেয়ে কে খুন না করলে ঐ বনসাই গাছটার মতই সেও তিলে তিলে বড় হয়ে উঠতো,তারওগৈাছের মত জীবনে ফুল ফুঁটে কৌশর,যৌবনে পা দিত। আচ্ছা ঐ চেরীর গাছটাতে কিছু নেই তো আবার! নাহলে মেয়েটা কেন শুধু শুধু মেয়েটা চেরী গাছের নিচে বসে খেলবে । আর পারছি না নিতে ।
সুখী
( আজকে আমি অসুখী)