আপন ব্রীড়া

লাজ (জুন ২০১৮)

মৌরি হক দোলা
  • ১৪
  • ৪৫
ভার্সিটির ক্যানটিনে তনয়ার সাথে শিউলি বেশ কয়েকবারই এসেছে। এমনিতে সে বাইরের খাবার খুব একটা পছন্দ করে না। তাই ক্যানটিনে তার আসা কেবলমাত্র তনয়াকে সঙ্গ দেবার উদ্দেশ্যেই। তনয়া এটা ওটা কেনে, আর ও শুধু ওর সঙ্গে আসার দায়িত্বটাই সম্পন্ন করে। ভুলেও কোনো খাবার মুখে দিয়েও দেখে না। এমন কি তনয়ার অনুরোধ সত্ত্বেও এক কাপ চা পর্যন্ত সে কখনো ছুঁয়ে দেখে নি। চুপচাপ ‍শিউলি এরকমই। সবসময় আপন জগতে তার বিচরণ। আপন মনে তার পথ চলা। নিজে যেটা মনে করবে, সেটাই তার কাছে বড়। তাই বলে অন্য কারো সাথে নিজের মত বিরোধ হলেই যে তার মুখে বুলি ছুটবে, তাও নয়। একা একাই কাঁদবে, দোর বন্ধ করে থাকবে, তবুও কারো সাথে তর্কে নিজেকে জড়িয়ে ফেলার মতো ভুল সে কখনোই করবে না। তার এরকম নিজস্ব এক জগতের কারণেই মনে হয় আর সবার থেকে সে আলাদা। আর সবার মতো অনেকের সাথে বন্ধুত্ব সে গড়ে তুলতে পারে নি। এরকম স্বভাবের মেয়ে হওয়া সত্ত্বেও কিভাবে যে তনয়ার সাথে তার বন্ধুত্বটা হয়ে গেল, তা সে বুঝতে পারে না। মাঝে মাঝে তার মনে হয় হয়তো তনয়া ওকে খুব বুঝতে পারে তাই!

কিন্তু তনয়া আর শিউলি- দু’জন সম্পূর্ণ বিপরীত চরিত্রের দুই মানুষ। শিউলি যতটাই নিজেকে একাকী রাখতে পছন্দ করে, তনয়া ততটাই সকলকে নিয়ে আনন্দ হৈ হুল্লোড়ে নিজেকে ব্যস্ত রাখতে চেষ্টা করে। বৈপরীত্য সত্ত্বেও তাদের বন্ধুত্ব যেন আর সকলের চেয়েও অনেকটাই আলাদা, অনেকটা বেশিই গভীর।

তনয়া আর শিউলি যে কয়েকদিনই ক্যানটিনে এসেছে, তার প্রতিটি দিনই তারা দুজনে বাঁ দিকের এক টেবিল দখল করে নিয়েছে। তনয়ার গরম চায়ে চুমুক দেয়ার সময় শিউলি যথেষ্ট আনমনা। তখনই তার কানে ভেসে আসে গিটারের চমৎকার ছন্দময় এক সুর আর তার সাথে এক সুরেলা কন্ঠস্বর। ‘বাহ! কি সুন্দর!’ শিউলির ঠোঁটে অস্ফুট স্বরে কথাটি বেরিয়ে আসে। কিন্তু এই কথাটিও তার আপনগন্ডিতেই ঘুরপাক খায়। কারণ তার ভালোলাগা মন্দলাগা সব যে তার একান্ত নিজেরই।

০০০
গতরাত পর্যবন্ত শিউলির মনটা ঠিকই ছিল। কিন্তু সকাল সকাল মা যে কেন হুট করে এমন রেগে গেলেন! মায়ের এই এক অভ্যাস- হুটহাট করে রেগে যাবেন আর যা ইচ্ছে তাই বলবেন। কিন্তু শিউলির তো আর সেসব কথা কখনোই সহ্য হয় না। মায়ের মুখের উপর দু’টো কথা বলার মতো বদ অভ্যাসও তার মধ্যে নেই। সে শুধু কাঁদবে, দোর বন্ধ করে কাঁদবে- তবুও কাউকে মুখ ফুটে কিছু বলবে না।

ভেবেছিল ভার্সিটিতে এসে তনয়ার সাথে দু’টো কথা বললেই মন কিছুটা ঠিক হবে। মন খারাপ থাকলেই তনয়া কিভাবে যেন সেটা ঠিক করে দেয়! এ ব্যাপারে তার বেশ আশ্চর্যারকম এক দক্ষতা আছে। কিন্তু, আজ সকাল থেকেই শিউলির দিনটা হ য ব র ল। তাই হয়তো সেই ভাগ্যের টানেই তনয়াও আজ আসে নি। ক্লাস শেষে আজ হঠাৎ করেই শিউলি নিজের প্রয়োজনের তাগিদে ক্যানটিনে এল। কিছুটা সময় কাটাতে। এখনই তার বাসায় ফিরতে ইচ্ছে করছে না। তাই ভাবল আজ একটু ক্যানটিনে গিয়ে কিছুক্ষণ সময় কাটানো যাক।

এক কাপ কফির কথা বলে সে চুপচাপ বসে আছে। এমন সময় কোনো এক অচেনা কন্ঠ শোনা গেল। ‘ম্যাম, এখানে একটু বসতে পারি ?’ শিউলি স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে আছে। একজন সুদর্শন যুবক, নীল চেকের শার্ট গায়, কাঁধে একটি গিটার। সে কিছু বলার অনেক আগেই সেই যুবক আসন দখল করে নিয়েছে। তার থেকে চেয়ে নেয় অনুমতির জন্য সে আর অপেক্ষা করে নি। ক্যানটিন বয়কে ডেকে সে ও এককাপ কফির অর্ডার দিল। তারপর টুন টুন শব্দে বেজে উঠল কাঁধের গিটার।

শিউলি চুপচাপ সমস্ত ব্যপারটা দেখছে। কিন্তু কিছু বলছে না। অপরিচিত এক ব্যক্তি যখন তার সাথে একই টেবিলে এসে বসল তখন তার উঠে যাওয়া উচিৎ ছিল। তার স্বভাব এটাই নির্দেশ দেয়। কিন্তু সে উঠে গেল না কেন ? কি আশ্চর্য্য ! সে এখনও এখানে বসে আছে এবং সমস্ত বিষয়টা খুব মনোযোগ সহকারে লক্ষ্য করছে। এমন তো হওয়ার কথা নয়। তবে কি মানুষ কখনো কখনো তার রীতিসিদ্ধ স্বভাবের বাইরেও কোনো আচরণ করে ফেলে ?

০০০

শিউলি তাদের বাড়ির ছাদে একা একা দাঁড়িয়ে আছে। আজ আকাশে রোদ্দুর তেমনভাবে চাড়া দিয়ে উঠে নি। বৃষ্টি যে হয়েছে- তাও নয়। কেমন যেন থমথমে একটা ভাব। নীল আকাশের বুকে ছাই রঙটা খুব গভীরভাবে লেপ্টে আছে। সেই রঙটাই কেমন অদ্ভুতভাবে চারপাশের পরিবেশটাকে সম্পূর্ণ পাল্টে ফেলেছে। মৃদু মৃদু হাওয়া অপরিচিত পরিবেশটাকে যেন আরো ভারী করে দিয়ে যায়।
-বেশ ভালোই তো ছিলাম! কেন আমার সাথে এমন হল ? কেন হল!

দিনারের গিটারের সুর আর শিউলির গিটারের সুর সেদিন ক্যানটিনে কফি খাওয়ার পর থেকেই কেমন যেন একীভূত হতে শুরু করল। শিউলির কিছু বুঝে উঠার আগেই কিভাবে যেন সেটা এক হয়েও গেল। আগের শিউলি ক্রমাগত পাল্টে যেতে থাকল। পাল্টাতে লাগল তার মন। এই ওলটপালট কাহিনি একটু একটু করে বাড়তেই থাকল। আর সেই বাড়াবাড়িটা বাড়তে বাড়তে আজ তিন বছর। এই তিন বছরে ‍শিউলির আচরণেও ঢের পরিবর্তন। আগে কখনো যে কাজগুলোর কথা ভাবতেও পারত না, সেগুলোই সে করতে শুরু করল। যখন তখন বাসায় যেকোনো অযুহাত দেখিয়ে দিনারের সাথে ঘুরতে বেরোনো, অকারণে অযথা রাগারাগি সবার সাথে- কিভাবে যেন শিউলির পুরো দুনিয়াটাই পাল্টে গেল।

কিন্তু যে মানুষটার সংস্পর্শে আসার পর থেকে এই অদ্ভুত পরিবর্তন, সেই কিভাবে দ্বিতীয়বারের মতো তার দুনিয়াটা উল্টে দিয়ে চলে গেল! শিউলি কখনো একবারের জন্যও কল্পনা করতে পারে নি যে, তিন বছরের এই সম্পর্কে কোনো ফাঁক থাকতে পারে! কখনো সব ভাবনা উলোটপালট হয়ে যেতে পারে!

এখন তার মনে হয়, আগের শিউলির জীবনটাই বেশি ভালো ছিল! চুপচাপ, শান্ত, বন্ধুহীন! এত বেশি ভালো বন্ধুর কোনো প্রয়োজন কি তার ছিল! যে বন্ধু মুখোশের আড়ালে ক্রুরহাসি হেসে নেয়! যাক, শেষ জিতটা তো সেই ক্রুরহাসিরই হল!

আকাশের মতো শিউলির সুন্দর মুখটাতেও একটা থমথমে ভাব। তার দু’চোখের কোণে জল চিকচিক করছে। কোথা থেকে যেন তাকে অজস্র লজ্জা ক্রমশই ঘিরে ধরছে। সে লজ্জা নিজেকে অহেতুক হঠাৎ করে এভাবে বদলে ফেলার, হঠাৎ করে নিজেকে একটা ভুল পথের দিকে ধাবিত করার। কিন্তু আজ আর তার কিছুই করার নেই। তিন বছর আগে যে ভুলটার শুরু হয়েছিল, সেই ভুলটা অসমাপ্তভাবেই শেষ হয়ে গেল। এই শেষ কখনো সম্পূর্ণতা পাবে না, পাওয়া সম্ভব না!

শিউলি ছাদের যে দিকটাতে দাঁড়িয়ে আছে, ঠিক সেখানেই ছাদের রেলিঙের ওপারে একটা কদম গাছ। সবুজ পাতার আড়ালে হলুদ-সাদা কদম! সেই কদমগুলোকে দেখে মনে হয়, তারাও যেন কোনো এক লজ্জার কারণে নিজেকে গুটিয়ে রাখতে চাচ্ছে, কিন্তু পারছে না! বারেবারে তাদেরকে অনিচ্ছাসত্ত্বেও সবার সামনে বেরিয়ে আসতে হচ্ছে। কিন্তু শিউলি ভাবে, তার লজ্জাটা যেন একান্তই তার নিজের। এই লজ্জার কথা কেউ জানে না। এই লজ্জার কারণও কারো জানা নেই। তাই অন্য কারো কাছ থেকে তাকে এভাবে মুখ লুকিয়ে বেড়াতে হবে না। কিন্তু তাকে নিজের কাছ থেকেই পালিয়ে বেড়াতে হবে। এই লজ্জার থেকে নিস্তার পাওয়ার কোনো পথ তার জানা নেই, হয়তো আদৌ কোনো পথই নেই!
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মাইনুল ইসলাম আলিফ দোলা নামের আরেকজন ফাহমিদা বারী আসছেন.....................।শুভ কামনা আর ভোট রইল।আসবেন আমার পাতায়।
দোয়া করবেন, ভাইয়া....যেন এই ক্ষুদ্র চেষ্টাটুকু এগিয়ে নিতে পারি। অনেক দেরী হয়ে গেল ব্যস্ততার জন্য ধন্যবাদ জানাতে.....শুভকামনা চিরন্তন......
নুরুন নাহার লিলিয়ান লেখকের জন্য শুভ কামনা রইল ।
ধন্যবাদ, আপু......আপনার জন্যও শুভকামনা......
বিশ্বরঞ্জন দত্তগুপ্ত গল্পটি পড়ে আমার ভাল লেগেছে । শুভেচ্ছা আর শুভকামনা সহ ভোট রইল ।
ধন্যবাদ......আপনার জন্যও শুভকামনা রইল..........
সেলিনা ইসলাম নিজের কাছে নিজেকেই জবাবদিহি দেয়া বা নিজের মুখোমুখি হওয়া যে কত কষ্টের তা কেবল শিউলির মত ভুক্তভোগীরাই জানে। বেশ ভালো লেখা। আরও ভালো ভালো লেখা পড়ার প্রত্যাশায় শুভকামনা নিরন্তর।
অসংখ্য ধন্যবাদ....শুভকামনা.......
Shamima Sultana শুভ কামনা রইল
Shamima Sultana খুব ভাল লাগল
ধন্যবাদ.....শুভকামনা.....
রবিউল ইসলাম Very nice expression, best wishes and vote for you. I invite you to my page. Cheers!
তানি হক ঝরঝরে... চমৎকার লেখনী
%3C%21-- %3C%21-- ভোট রেখে গেলাম। অনেক শুভকামনা রইল।
মোঃ নুরেআলম সিদ্দিকী আপনার গল্পটি আগেই পড়া হয়ে গিয়েছিল। আপনার গল্পের হাত আগের চেয়ে পেকেছে সহজে বুঝা যাচ্ছে। যদি এ গল্পের কথা বলি, প্রথমে তনয়া ও শিউলির আলাদা আলাদা চরিত্রের রূপ টেনেছেন। দুজনের ভিতরে শিউলির চরিত্র একটু কষ্টদায়ক বটে, কিন্তু এ বেপারটা তনয়া সহজে বুঝতে পারে। আবার শিউলি ছাদের উপরে একা একা যে অনুতপ্ততার যে বর্ণনা দিয়েছেন, তাও বেশ ভালো লাগলো। আবার দীনার শিউলির সংস্পর্শে আসার পর থেকেই শিউলি অনেখানি পরিবর্তন হয়ে গেছে, অথচ সে দীনারই আবার শিউলির দুনিয়াটা উল্টে দিয়ে চলে গেল। এখানে খুব বেদনাদায়ক, কিন্তু কেন দীনার এতটা কষ্ট দিয়ে চলে গেল সে কারণ বর্ণনা করলে আরও চমৎকার গল্প পাইতাম বলে মনে হয়। তবুও আপনি গল্পেতে যে ভাব আর চারিত্রিক বর্ণনা দিয়েছেন সেখানে অসাধারণ বলা ছাড়া কোন উপায় নেই। বরাবরের মতই শুভকামনা রইল। ভালো থাকুন...।
অনেক ধন্যবাদ.......শুভকামনা ও শুভেচ্ছা রইল আপনার জন্যও.....

লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য

সাধাসিধে মেয়ে শিউলি। আপন জগতেই তার বিচরণ। কিন্তু একটিমাত্র ভুল তার চেনা জগতটাকে পাল্টে দেয়, পাল্টে দেয় তার নিজস্ব জীবন ধারণা। কিন্তু যখন সে ভুলটা বুঝতে পারে, তখন আর কিছুই করার থাকে না। অজস্র লজ্জা তাকে ঘিরে ধরে। এ লজ্জা তার নিজের, শুধু মাত্র নিজের। কিন্তু এই লজ্জা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য কোনো পথ তার জানার বাইরে! শিউলির এই একান্ত নিজস্ব লজ্জাটাই সম্পর্কযুক্ত ‘লাজ’ বিষয়টির সাথে।

২৮ এপ্রিল - ২০১৭ গল্প/কবিতা: ১৪ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪