ঘরে ঢুকেই শাহানা আগে এক গ্লাস পানি খেয়ে নিল। এ শীতল ঠান্ডা আবহাওয়াতেও তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জড়ো হয়েছে। কেমন যেন অস্থির দেখাচ্ছে তাকে। গ্লাসের পানি শেষ করেই সে তার নিজের রুমে ঢুকে গেল। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ করে দিল সে। পরনের সোয়েটার আর মাফলার খুলে ফ্যানের সুইচে হাত রাখল। এই পৌষ মাসের রাতে তার ঘরে বৈদ্যুতিক পাখা সজোরে চলতে লাগল। সে বিছানায় গিয়ে বসল। তার চেহারা বড্ড মলিন দেখাচ্ছে, যেন তার উপর দিয়ে কত ঝড়ই না বয়ে গেছে! হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ-
-শাহানা! দরজা খোল, মা। এত ঠান্ডার মধ্যে ফ্যান চালিয়েছিস কেন ?
শাহানা নিশ্চুপ। কোনো কথার জবাব দিল না। শুধু তার দু’চোখে পানি টলটল করতে লাগল।
-শাহানা, দরজাটা খোল।
আশরাফ সাহেব এরপরেও বেশ কয়েকবার তাকে ডাকলেন। কিন্তু দরজার ওপাশ থেকে কোনো জবাব এল না। তিনি তার হুইল চেয়ারটার দুটো চাকা দু’হাতে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে জানালার কাছে এসে থামলেন। হাত দুটো সামান্য উঁচু করে জানালার সামনের পর্দাটা দু’পাশে টেনে সরিয়ে দিলেন। খোলা জানালা। বাইরের সমস্ত আকাশটাই এই জানালার ধারে বসে দেখা যায়। দুর্ঘটনায় পা দুটো হারাবার পরে তিনি যখন কিছুটা সুস্থ বোধ করতে লাগলেন, তখন নিঃসঙ্গতা তাকে যেন একেবারে চেপে ধরেছিল। আর এই নিঃসঙ্গ সময়েই তিনি সঙ্গী করে নেন ওই দূরের নীল আকাশটাকে। এখন এই আকাশের দিকে তাকিয়ে তাকিয়েই তার দিন পেরিয়ে যায়।
০০০
এই ছোট্ট একতলা দালানটায় তিনি আর শাহানা থাকেন। নিজেদেরই বাড়ি, পৈতৃক সম্পত্তি। বছর তিনেক আগে শাহানার মা না ফেরার দেশে চলে যান। আর তিনি যাবার পর বছর ঘুরতে না ঘুরতেই এক দুর্ঘটনার শিকার হতে হয় আশরাফ সাহেবকে। এই দুর্ঘটনায় দুটো পা-ই হারান তিনি আর সাথে কাজ করার সামর্থ্যও। অনেক দিনের স্মৃতিবিজড়িত কর্মস্থলটা তাকে ছুটি দেয়। এককালীন যে পেনশন পেলেন, সেটার অর্ধেকটা খরচ হয়ে যায় তার চিকিৎসাতেই। বাকি টাকায় সংসারের খরচ চালানো খুব কষ্টকর হয়ে পড়ে শাহানার জন্য, তার উপরে আবার তার পড়ার খরচও অনেক। সবদিক একা হাতে সামাল দিতে ভীষণ হিমশিম খেতে হয় তাকে। সংসারের খরচ ভালোভাবে চালানোর জন্যে সে একটা কে.জি. স্কুলে চাকরি নেয়, তিনটে টিউশনি যোগাড় করে। এরপরে নিজে যা পায় আর আশরাফ সাহেবের ব্যাংকে যা আছে সবমিলিয়ে মোটামুটি ভালোভাবেই তাদের দিন চলে যায়। তবুও মাঝেমাঝে যখন খুব বেশি অর্থকষ্টে ভুগতে হয়, তখন শাহানার ইচ্ছে হয় নিজের পড়াশোনাটা ছেড়ে দিতে। আর এ ধরনের ইচ্ছে হতেই তার দু’চোখের সামনে ভেসে উঠে মরা মায়ের মুখখানি।
শাহানার এস. এস. সি. পরীক্ষার পর কী ঝঞ্ঝাট করেই না তার মা তার বাবার মতের বিরুদ্ধে গিয়ে তাকে কলেজে ভর্তি করিয়েছিলেন। তার মায়ের ভীষণ ইচ্ছে ছিল নিজের মেয়েকে স্বনির্ভরশীল রূপে দেখবেন। শাহানা অনেক দূর পর্যন্ত পড়াশোনা করবে, চাকরি করবে, নিজের পায়ে দাঁড়াবে- এমনটাই স্বপ্ন ছিল তার মায়ের। সে স্বপ্নের কথা মনে পড়তেই শাহানা আবার ভেবে নেয়- না, না, তাকে পড়তেই হবে। যত কষ্ট করেই হোক, তার মৃত মায়ের স্বপ্ন তাকে পূরণ করতেই হবে।
মেয়ে বড় হয়েছে, দেখতে সুন্দর, পড়াশোনায়ও ভালো। তাই শাহানার বিয়ের প্রস্তাব অনেকবারই এসেছে। কখনো কখনো মনের মতো কোনো প্রস্তাব পেলে আশরাফ সাহেব সেটা নিয়ে কিছুটা ভেবেছেনও। কিন্তু বেশিদূর আর এগোতে পারেন নি। শাহানার জেদের কাছে তাকে হার মেনে নিতে হয়েছে। বাবার অসুস্থ অবস্থায়, মায়ের স্বপ্ন পূরণ না করে সে কিছুতেই বিয়ে করবে না। আবার কখনো বা আশরাফ সাহেব স্বার্থপরের মতো নিজের চিন্তা করেও শাহানার বিয়ের কথা ভাবেন নি। মেয়ের বিয়ে হয়ে গেলে মেয়ে পরের বাড়ি চলে যাবে। তখন তার কী অবস্থা হবে ? কে তার দেখাশোনা করবে ? ছেলে ? সে তো আজ থেকেও নেই!
মাঝে মাঝে আশরাফ সাহেবের নিজের বলা কথাগুলোর উপরে রাগ হয়, মৃত স্ত্রীর প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতাবোধ জন্ম নেয়।
শাহানার এস.এস.সি পরীক্ষার পরপরই তার বিয়ের জন্য ভালো একটি প্রস্তাব এসেছিল। ছেলে সিঙ্গাপুর থাকে, প্রবাসী। লেখাপড়ায় একটু কম, কিন্তু বেশ উঁচু ঘরের ছেলে। সবদিক ভেবেচিন্তে আশরাফ সাহেব রাজি হয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু বাধ সাধলেন তার স্ত্রী, শাহানার মা। তিনি কিছুতেই এত কম বয়সে মেয়ের বিয়ে দেবেন না। তিনি মেয়েকে অনেকদূর পর্য ন্ত পড়াশোনা করাবেন, মেয়ে চাকরি করবে, নিজের পায়ে দাঁড়াবে। তাই অনেকবার বুঝানোর পরেও যখন আশরাফ সাহেব নিজের মর্জিমত মেয়ের বিয়ের ব্যবস্থা করতে লাগলেন, তখন তিনিই শক্ত মন নিয়ে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন নিজের স্বামীর মতামতের বিরুদ্ধে। শাহানার বিয়ে তো তিনি বন্ধ করলেন, কিন্তু কলেজে ভর্তি হওয়ার জন্য যে টাকা প্রয়োজন সেটা কিছুতেই আশরাফ সাহেব দিতে রাজি হলেন না। তার শুধু একটাই কথা, ‘এত টাকা পয়সা খরচ করে মেয়েকে পড়িয়ে কী লাভ হবে ? সেই তো মেয়েকে শ্বশুর বাড়িতেই পাঠাতে হবে। আর তাছাড়া এত ভালো ছেলে.....’। কথাগুলো শুনে শাহানার মা উচ্চস্বরে বলে উঠেছিলেন, ‘এত কিছু আমি বুঝি না। মেয়েকে যখন পড়াশোনা করাব ভেবেছি তখন আমি করাবোই। আর ভালো ছেলে ? আমাদের মেয়ে যেদিন পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়াবে না, তখন এর চেয়েও ঢের ভালো ছেলের সাথে ওর বিয়ে দিতে পারব।’
কিন্তু কোনো লাভ হলো না। আশরাফ সাহেব কিছুতেই মেয়েকে কলেজে ভর্তি হতে দেবেন না। অবস্থা বেগতিক দেখে শায়লার মা নিজের জমানো টাকা থেকে খরচ করে তাকে কলেজে ভর্তি করে দিলেন।
সেদিন যদি শাহানার মা এত বড় সিদ্ধান্ত নিয়ে কাজটা না করতেন, তবে যে আশরাফ সাহেবের আজ কী অবস্থা হত, সেটা ভেবে তিনি শুধুই চোখের জল ফেলেন।
আশরাফ সাহেবের বড় ছেলে শাহীন। কতই না আশা করেছিলেন একমাত্র ছেলেকে নিয়ে! ছেলেকে এঞ্জিনেয়ারিং পড়াবেন, ছেলে মানুষের মতো মানুষ হবে। এরপর তিনি শুধু ছেলের আয়ে পায়ের উপর পা তুলে খাবেন। কিন্তু কোথায় সেই স্বপ্ন! কোথায় সেই আশা! ছেলে এঞ্জিনেয়ারিং পড়ল, পাশ করল, মোটা টাকার মাইনেও পায়। কিন্তু বৃদ্ধ, অসুস্থ বাবার খোঁজ একবারের জন্যও নেয় না। সে তার মতো করে নিজের সংসার নিয়ে সুখে আছে, ভালো আছে। মাঝেমাঝে আশরাফ সাহেব নিজেই ফোন দেন তাদেরকে। ছেলের সাথে কথা বলেন, নাতির সাথে কথা বলেন। কিন্তু তার ছেলে ভুল করেও তাকে বলে না যে, ‘বাবা, তোমাকে দেখার জন্য আজ বিকেলের ট্রেনে আমরা বাড়ি আসছি।’ নাতিটা অবশ্য মাঝেমাঝে খুব বায়না করে দাদাকে দেখবে বলে। কিন্তু ওটুকুনি ছেলের কথায় কী আর জগৎ চলে ? আর ছেলের বৌ ? ওরা একা একা বিয়ে করেছিল। বিয়ের পর শ্বশুর মশাইয়ের সাথে দেখা করার জন্য একবার-ই এসেছিল। বোধ হয় এই বৃদ্ধ, অসুস্থ শ্বশুরকে তার পছন্দ হয় নি। তাই আর কখনো খোঁজ-খবর নেয়ার কোনো প্রয়োজন মনে করে নি সে। শামীমের ছেলের জন্মের সংবাদ আশরাফ সাহেব আর শাহানা দু’জনেই পেয়েছিল। কিন্তু এত দূরে তো আর শাহানার পক্ষে একা যাওয়া সম্ভব নয়। আর আশরাফ সাহেব তো....।
খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে আশরাফ সাহেব মাঝে মাঝে ভাবেন, যে দায়িত্ব তার শক্ত সমর্থ ছেলের নেয়ার কথা ছিল, সেই দায়িত্ব এখন তার এত ছোট্ট মেয়েটির পালন করতে হয়। তাই তার নিজের উপর রাগ হয়। কেন তিনি ভেবেছিলেন মেয়েদের পড়াশোনা করার কোনো প্রয়োজন নেই ? কেন তিনি ভেবেছিলেন যে মেয়েরা কখনো কোনো দায়িত্ব নিতে পারে না ? মেয়েরা শুধুই বোঝা হয়ে থাকে- প্রথমে বাবার, পরে স্বামীর ! কেন তিনি এসব কথা ভেবেছিলেন ?
তার এতগুলো ভুল চিন্তাধারা ভঙ্গ করতে যে মহীয়সী নারী সাহায্য করেছিলেন, সেই নারীর প্রতি অর্থাৎ তার মৃত স্ত্রীর প্রতি সে মনে মনে অশেষ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। আর তার সাথে সাথে নিজেরই অজান্তে দু’চোখের জল ফেলে।
০০০
-বাবা, খোলা জানালার কাছে বসে আছো কেন ? ঠান্ডা লেগে যাবে তো।
-তোর কী হয়েছে মা ? চোখমুখ ওরকম দেখাচ্ছে কেন ? আর তখন এত ঠান্ডার মধ্যে ফ্যান কেন চালিয়েছিলি ?
-কিছু না, বাবা। আমার কিছু হয় নি। তুমি খেতে এস, ভাত বাড়ছি।
আশরাফ সাহেবকে ভাত বেড়ে দিয়ে শাহানা সেই খোলা জানালার ধারে এসে দাঁড়ালো। আজ সন্ধ্যার আলো আঁধারিতে ঘটে যাওয়া অনাকাঙ্খিত ঘটনাটি মনে পড়তেই তার দুটো চোখ আবারো জলে ছলছল করতে লাগল।
শাহানাদের বাড়ি থেকে একটু দূরে একটি বেশ নিরিবিলি রাস্তা আছে। খুব বেশি মানুষের যাতায়াত নেই সে রাস্তায়। কিন্তু রোজ সন্ধ্যায় শেষের টিউশনিটা সেরে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরার জন্য তাকে ও পথ ধরেই আসতে হয়। অনেকদিন যাবত যাতায়াত করতে করতে তার অভ্যেস হয়ে গিয়েছে। কখনো কোনো ঝামেলায়েও পড়তে হয় নি তাকে। তবে বেশ কয়েকদিন যাবত কয়েকটি ছেলে তাকে ভীষণ বিরক্ত করে আসছিল। আসার পথে নানা ধরনের আজেবাজে কথাও বলত। শাহানা সেসব কথা শুনেও না শোনার ভান ধরে চুপচাপ চলে আসত। কিন্তু....আজ হঠাৎ করে ছেলেগুলো তার সামনে এসে পথ আটকে দাঁড়ালো। তারপর....!
এক নিমিষেই যেন শাহানার আলোময় পৃথিবী ঘন কালো অন্ধকারে ঢেকে গেল।
এরপর কখন, কীভাবে সে ছুটতে ছুটতে বাড়ির সদর দরজায় এসে দাঁড়ালো- সেটা যেন পুরোটাই একটা ঘোরের মধ্যে।
শাহানার চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে। আজ যেন সে তার জীবনে বেঁচে থাকার সমস্ত আশা হারিয়ে ফেলেছে।
কিন্তু সে নিজের মনকে শক্ত করে। দু’চোখের পানি জোর করে আটকে রাখার চেষ্টা করে, চোখের বাইরে বেরোতে দেয় না। নিজেই নিজেকে বলে, ‘না, আমি কিছুতেই ভেঙে পড়ব না। ভেঙে পড়লে চলবে না। আমাকে শক্ত হতে হবে। আমাকে আমার পড়াশোনা চালিয়ে যেতে হবে। আমাকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। আমাকে আমার মায়ের স্বপ্ন পূরণ করতে হবে, বাবার দায়িত্ব নিতে হবে।’
আর পাঁচ সাতটা মেয়ের মতো শাহানা জীবনের ধ্বংসাত্মক রূপ দেখে এসেও থমকে যায় না। জীবনের রণক্ষেত্রে সে নতুন সাহস সঞ্চয় করে আবারো নেমে পড়ে। তার লক্ষ্য হয়ে ওঠে এক সাধারণ মেয়ের থেকে অসাধারণ, সাহসী, দৃঢ় প্রত্যয়ী রমণী হয়ে ওঠার লক্ষ্য; যে রমণীকে প্রয়োজন, এই একবিংশ শতাব্দীতে খুবই প্রয়োজন।