সকালের মিষ্টি রোদ আর হালকা শীতের আমেজ। আসি আসি করে শীতটা প্রায় চলেই এল। এ বছর বোধ হয় একটু তাড়াতাড়ি-ই শীত শুরু হতে চলল। অন্যান্য বছর তো এত তাড়াতাড়ি শীতের দেখা পাওয়া যায় না। শুনেছি নভেম্বরের শেষের দিকটায় গ্রাম এলাকায় শীত শীত আমেজটা শুরু হয়। আর আমাদের রাজধানীতে তো তা হয় আরও পরে। কিন্তু এ বছর যেন নভেম্বর মাস আসতে না আসতেই একেবারে শীতের ধুম পড়ে গেল। আমরা রাজধানীতেই সিলিং ফ্যান চালানো বন্ধ করে দিয়েছি আরও আগে, না জানি গ্রামের দিকটায় কী অবস্থা।
আচ্ছা, দেশের জলবায়ুর কী পরিবর্তন হচ্ছে ? কারণ, এখন তো শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা- কেবল এ তিনটি ঋতুই বেশ ভালোভাবে অনুভব করা যায়। শহরে থাকার কারণে তো বাকি তিনটির আমেজ একেবারেই বুঝতে পারি না। জানি না, গ্রামে ঐ তিনটি ঋতু ভিন্ন কোনো বার্তা নিয়ে আসে কি না। হয়তো বা আসে, হয়তো বা না। আর যদি না-ই আসে তবে তো বলতেই হবে যে, বাংলাদেশ তিন ঋতুর দেশ !
সে যাক গে, এখন আর বাংলাদেশের ঋতুবৈচিত্র্য নিয়ে গবেষনা করে লাভ নেই। আজ এমনিতেই ঘুম থেকে উঠতে খুব দেরী করে ফেলেছি। এখন তাড়াতাড়ি গোসল সেরে, তৈরি হয়ে অফিসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়তে হবে। নইলে আজ কপালে বসের ঝাড়ি একেবারে শতভাগ নিশ্চিত!
আমি হলাম দেশে বহুল প্রচলিত একটি সংবাদপত্রের রিপোর্টার। সংবাদপত্রের তালিকায় আমাদেরটার নাম একেবারে প্রথম সারির প্রথম দিকে। ছেলেবেলা থেকে ভীষণ শখ ছিল টেলিভিশনে সংবাদ পড়ার। কিন্তু সে সৌভাগ্য এখনও হয়ে উঠে নি। তবুও এ পেশার যেকোনো একটা দিকের সাথে তো যুক্ত আছি। নিজের স্বপ্নের পেশার সাথে যুক্ত থাকবার আনন্দটাই আলাদা।
স্কুলে পড়াকালীন সময়ে কেন যেন এ পেশার প্রতি আমার অদ্ভুত এক ভালোলাগা, শ্রদ্ধাবোধ জন্ম নিল। কেন যেন মনে হচ্ছিল যে এটাই আমার জীবন পরিচালনার মাধ্যম। অন্য কোনো পেশার প্রতি আর কখনও কোনোরকম আগ্রহ এলই না। বাবা-মায়ের থেকেও সবসময় নিজের স্বপ্ন পূরণের জন্য উৎসাহ পেয়েছি। আর তাই হয়তো বা মেয়ে হয়েও আজ এই রকম একটা পেশার সাথে যুক্ত আছি, যেখানে সবাই জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে ভয় পায়।
আজ অফিসে যেতেই বস একটি দায়িত্ব দিয়ে দিলেন। বিজয় দিবস আসতে খুব বেশি দেরী নেই। আর এই বিশ দিনের মতো বাকি। এবার বিজয় দিবস উপলক্ষে একটি বিশেষ সংখ্যা বের করা হবে। সেখানে দেশের বিভিন্ন এলাকায় বসবাসকারি পাঁচজন মুক্তিযোদ্ধার সাক্ষাৎকার ছাপানো হবে। এই সাক্ষৎকার নেবার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে পাঁচজনকে, তার মধ্যে আমি একজন। আমি যাঁর সাক্ষৎকার নেব, তাঁর বাড়ি দক্ষিণান্ঞ্চলের এক গ্রামে। তবে রাজধানী থেকে খুব বেশি দূরে নয়, কাছাকাছিই।
আমি পুরোপুরি শহরের মেয়ে, শহরে জন্ম আর এই শহরেই বেড়ে ওঠা। গ্রামে তো স্বপ্নের মধ্যেও কখনো যাই নি। ফিল্মে, ফটোতে যা দেখেছি আর সবার কাছ থেকে গ্রামের যে মোহনীয় বর্ণনা শুনেছি, তার থেকে মনে হয়েছে আমাদের দেশের গ্রামগুলো স্বর্গের চেয়েও সুন্দর। বর্ণনা শুনে আমি আমার মনের মানসপটে গ্রামের এক স্নিগ্ধ, শীতল ছবি একেঁছি। ওহ্, সে তো অপরূপ! অসাধারণ! শুনেছি গ্রামের পরিবেশ, প্রকৃতি, মানুষ- সমস্তকিছুই সরল, স্বচ্ছ। প্রকৃতির মতো ওখানকার মানুষগুলোর মনগুলোও না কি সতেজ।
অন্যান্য বারের তুলনায় এবার কাজটার প্রতি একটু বেশিই আগ্রহ বোধ করছি। কারণ এবার কাজটার মাধ্যমে এমন একজনের সাথে কথা বলা হবে যিনি দেশ রক্ষার জন্য জীবনবাজি রেখেছিলেন, যিনি কখনো হেরে যাবার ভয় করেন নি। আবার একই সাথে আমাদের দেশের প্রকৃত রূপও স্বচক্ষে দেখা হয়ে যাবে। এক ধরনের যান্ত্রিক পরিবেশের মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠা একটি মেয়ের কাছে এর চেয়ে পাওয়া আর কী হতে পারে ?
মনে মনে যেমনটা কল্পনা করেছিলাম ঠিক তার চেয়ে হাজার গুন বেশি সুন্দর আমাদের এই গ্রামবাংলার প্রকৃতি, যেন ভাবনার বাইরে! কী সুন্দর গ্রামের আঁকাবাঁকা মেঠোপথ আর তার দু’পাশের মাঠের ফসলের সারি। যতদূর চোখ যায় সবুজের সমারোহ। কোথাও কোথাও স্বচ্ছ পানির জলাশয়- কোনোটা বড়, কোনোটা ছোট, কোনোটা আবার মাঝারি। কোনো কোনো জলাশয়ে আবার জাল পেতে রাখা, নিশ্চয়ই মাছ ধরবার জন্য রাখা হয়েছিল ? সত্যি, লাখো শহীদের রক্তে কেনা বাংলাদেশ বোধ হয় এটাই, যেখানে সমস্তকিছুই খাঁটি, একেবারে নির্ভেজাল।
মুক্তিযোদ্ধা মো: হাশেম মিয়ার বাড়ির উত্তর দিকটায় আমাদের বসবার জন্য ব্যবস্থা করা হল। ও দিকটায় রোদ আসে ভালো। শীতের দিনে রোদ পোহাবার জন্য ওটাই না কি উনাদের বাড়ির সবচেয়ে ভালো স্থান। তাই এরকম ঠান্ডা ঠান্ডা আবহাওয়ায় আমাদের বসার জন্য তারা ঐ জায়গাটাতেই ব্যবস্থা করলেন। বেশ সুন্দর বাড়িটা। আমি বেশ কিছুক্ষণ বাড়ির চারপাশে ঘুরাঘুরি করে কয়েকটা সুন্দর ছবি তুলে নিলাম। এরপর শুরু করলাম আমার মুখ্য কাজ। আমাদের শ্রদ্ধেয় বীর মুক্তিযোদ্ধা হাশেম মিয়ার সাক্ষাৎকার নিতে শুরু করে দিলাম।
সাক্ষাৎকার নিতে নিতে তাঁর কাছ থেকে জানতে পারলাম তাঁর স্বচক্ষে দেখা মুক্তিযুদ্ধের কথা, তাঁর মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করবার গল্প আর পাক-হানাদার বাহিনীর নৃশংসতম হত্যাকান্ডের ইতিহাস। তাঁর সাথে কথা বলার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের নানা অজানা বিষয় জানতে পারলাম। তিনি বেশ উৎসাহ নিয়ে আমার সমস্ত প্রশ্নের উত্তর দিলেন।
সাক্ষাৎকারের সবশেষে আমি তাঁকে অনুরোধ করলাম বাংলাদেশের স্বাধীনতা সম্পর্কে তার অনুভূতি ব্যক্ত করার জন্য। তখন তিনি আমায় অবাক করে দিয়ে একটু মুচকি হেসে বললেন, ‘ দেখুন, বাংলাদেশ আমার দেশ, আমাদের দেশ। আমরা জীবন বাজি রেখে, রক্ত দিয়ে এ দেশকে শত্রুমুক্ত করেছিলাম। বিজয়ের পতাকা ঐ নীল আকাশে উড়িয়েছিলাম। কিন্তু স্বাধীনতা ? হ্যাঁ, বাংলাদেশ আজ সত্যি স্বাধীন, তবে তা শুধুমাত্র খাতাকলমে, বাস্তবে নয়। আমার কথা শুনে অবাক হচ্ছেন ? হ্যাঁ, তা আপনি হতেই পারেন। কিন্তু একটাবার ভেবে দেখুন তো, জাতির পিতা যে আমাদের দেশকে স্বাধীন করবার জন্য অনুপ্রানিত করেছিলেন, সেটা কিসের জন্য ? ত্রিশ লক্ষ মানুষ যে নিজেদের শরীরের রক্ত দিয়েছিলেন সেটা কিসের জন্য ? শুধুমাত্র পাকসেনাদের দেশ থেকে তাড়াবার জন্য ?
না! আমরা সবাই দেশের জন্য লড়াই করেছিলাম এমন একটি দেশের আশায়, যেখানে প্রতিটি মানুষ স্বাধীনভাবে বাঁচতে পারবে, যে দেশের মাটিতে সবসময় ন্যায় বিচার হবে আর যেখানে কেউ তার প্রাপ্য অধিকার থেকে বন্ঞ্চিত হবে না। কিন্তু... কোথায়!’
কথা বলবার এই সময়টাতে এসে তিনি একটু থামলেন। চোখেমুখে নিরাশায় ভরা হাসির ভাব এনে তিনি আবার বলতে শুরু করলেন, ‘রোজই তো পত্রপত্রিকা পড়ি। খুন, ধর্ষন- প্রতিদিন, প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে। কিন্তু এর কোনো সঠিক বিচার হচ্ছে কি ? না কি এসব অন্যায় অত্যাচার বন্ধ হচ্ছে ? আর সবচেয়ে বড় বিষয় যেটি সেটি হল এই দেশকে যিনি স্বাধীন করে দিয়ে গেলেন, তাঁকেই তাঁর নিজের দেশের মাটিতে নির্মমভাবে হত্যার শিকার হতে হল। তাহলে আপনিই বলুন, বাংলাদেশ কী সত্যিই স্বাধীন হয়েছে ?
না, বাংলাদেশের স্বাধীনতা আজও অর্জিত হয় নি। আমাদের এই দেশ কেবলমাত্র একটি পৃথক রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। এছাড়া আর কিছই না! বাংলাদেশ স্বাধীন হতে এখনও বহুপথ বাকি।’
আমাদের শ্রদ্ধেয় মুক্তিযোদ্ধার কাছ থেকে এ কথাগুলো শুনবার পর আমি যেন আর আমিতে ছিলাম না, অনেক বড় একটি সত্যির ভিড়ে হারিয়ে গিয়েছিলাম। তাঁর প্রতি আমার শ্রদ্ধাবোধ যেন আগের চেয়ে অনেক বেশি বেড়ে গেল। সাক্ষাৎকার শেষ করে আমি তাঁর থেকে বিদায় নিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পরলাম। ফিরতে ফিরতে প্রায় সন্ধ্যে হয়ে এল। কি জানি, সন্ধ্যের গ্রামটা কেমন দেখতে!
সকাল বেলা ঘুম থেকে জেগেই আগে খবরের কাজটা হাতে নিলাম। আজ ডিসেম্বরের ১৬ তারিখ, বিজয় দিবস। আজ আমাদের পত্রিকার বিশেষ সংখ্যা বের হয়েছে। সেখানে আমাদের সবার নেয়া সাক্ষাৎকারগুলো ছাপা হয়েছে, আমারটা প্রথম পাতাতেই। আমি পত্রিকাটা হাতে নিয়ে অন্যদের নেয়া সাক্ষাৎকারগুলো পড়তে শুরু করলাম। পড়ার সময় আমার ফোনে হঠাৎ একটি কল এল। কলটা রিসিভ করতেই শুনতে পেলাম, ‘মিস্ সুলতানা, গত রাতে সেগুন বাগিচার এক রোডে একটি মেয়ে গণধর্ষনের শিকার হয়েছে। আমাদের এখুনি ওখানে রিপোর্ট করবার জন্য যেতে হবে। আপনি এখুনি অফিসে চলে আসুন।’
ওহ্, আবার খুন, আবার ধর্ষণ। মুক্তিযোদ্ধা মো: হাশেম মিয়ার বলা কথাগুলো আবার মনে পড়ে গেল। তাহলে বাংলাদেশ সত্যিই স্বাধীন হয় নি, তাই না ?
কী জানি! প্রশ্নটার উত্তর আমি বুঝতে পারছি না। প্রশ্নটার চারপাশে ঘন কুয়াশা জমাট বেঁধে রয়েছে। সেই কুয়াশা কবে কাটবে কে জানে! আচ্ছা, বাংলা মায়ের কোলে কী আবার এমন কেউ জন্ম নিতে পারে না, যে এই সমস্ত কুয়াশার জাল ছিড়ে ফেলবে ?
কয়েক দিন ধরে শীতটাও তো বেড়েই চলেছে। বাইরে এখন ঘন কুয়াশাও হয়, দূর হতে কিছুই পরিষ্কার দেখা যায় না। পৃথিবীর সবকিছুকেই যেন ঘনকুয়াশা আচ্ছাদিত করে রেখেছে, যাকে ভেদ করে আলোর রেখা আসতে পারছে না!!