টুটুল জানালা দিয়ে একমনে বাইরের আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। সে গালে হাত দিয়ে ওই দূর আকাশে কি যেন একটা দেখছে। এদিকে মতিউর স্যার দশ নম্বর অঙ্কটাও সকলকে বুঝিয়ে দিলেন। এতক্ষণে হয়তোবা দু’একজন বাদে সকলের খাতায় অঙ্কটি তোলাও হয়ে গেছে। বিষয়টি লক্ষ্য করেই মতিউর স্যার সকলকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আচ্ছা, finally, তোমরা সবাই অঙ্কটা বুঝেছো তো ?’ সকলে সমস্বরে বলে উঠল, ‘জ্বী, স্যার।’
‘আচ্ছা, টুটুল, তবে তুমি বল তো, আমরা এই যোগটা কীভাবে করলাম ?’ স্যার কথাটা শেষ করেই অঙ্কের একটা নির্দিষ্ট স্থানে দাগ দিয়ে উল্টো দিকে ফিরে তাকিয়ে দেখলেন টুটুল গালে হাত দিয়ে বসে আছে।
-টুটুল! টুটুল!
খুব সম্ভবত টুটুল স্যারের কথা শুনতে পেল না। তাই সে একই অবস্থানে রয়ে গেল।পেছন থেকে কেউ একজন কলমের খোঁচা দিতেই সে যেন একেবারে লাফিয়ে উঠল,
-কে ? কে?
সঙ্গে সঙ্গে পুরো ক্লাসে হাসির রোল পড়ে গেল।
-এই চুপ !
স্যারের এক ধমকে পুরো ক্লাস একেবারে ঠান্ডা। কারও কোনো সাড়া শব্দ নেই।
-টুটুল, দাঁড়াও।
টুটুল মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে অাছে।
-কী হয়েছে তোমার ? কতবার ডাকলাম। আচ্ছা, এখন বল, এই যোগটা কীভাবে হল ?
টুটুল নিঃশব্দে একবার বোর্ডের দিকে তাকিয়ে আবার মাথা নিচু করে ফেলল।
-কী হল ? আমার প্রশ্নের উত্তর দাও।
টুটুলের নিশ্চুপ অবস্থান দেখে স্যার আবার জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি কী অঙ্কটা বুঝ নি ?’
টুটুলের পাশে বসে থাকা ছেলেটি বলল, ‘স্যার, ওতো অঙ্কই করে নি।’
- তুমি অঙ্ক কর নি ? তবে কী করেছ বসে বসে ? দেখি খাতাটা....
স্যার খাতায় অঙ্ক কেন, কলমের এক বিন্দু কালিও দেখতে পেলেন না।
-আজ সারাটা ক্লাস তুমি কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকবে।
টুটুল চুপচাপ কান ধরে দাঁড়িয়ে রইল।
০০০
-এই টুটুল, দাঁড়া, দাঁড়া।
টুটুল অনেকক্ষণ পরে সীমান্তের ডাক শুনতে পেয়ে দাঁড়ালো। পেছনে ফিরে দেখল সীমান্ত হাঁপাতে হাঁপাতে দৌড়ে আসছে।
-কতক্ষণ ধরে ডাকছি, শুনতে পাস নি না কি ?
টুটুল কথা না বলে আবার হাঁটতে শুরু করল।
-এই কী হয়েছে রে তোর ? কয়েকদিন ধরে তুই কারও সাথে কথা বলছিস না, বিকেলে খেলতে আসছিস না, ক্লাসেও কেমন চুপচাপ থাকিস!
.......
-হ্যাঁ রে, কী হয়েছে তোর ? বাসায় কোনো সমস্যা ? কিছু বলছিস না কেন ?
সীমান্ত ব্যাকুল হয়ে উঠেছে। কিন্তু টুটুল আগের মতই নিঃশ্চুপ। সীমান্ত তার থেকে কোনো প্রত্যুত্তর পেল না। দুজনে নিরিবিলি হেঁটে চলেছে, কোথাও কোনো শব্দ নেই।সীমান্তের চোখ দুটো টুটুলের দিকে স্থির, কী জানি, কেন তার সবচেয়ে চন্ঞ্চল বন্ধুটা আজ সবচেয়ে বেশি চুপচাপ !
কিছুদূর এগিয়ে গিয়ে রাস্তার মোড়, তিনদিকে তিনটি পথ চলে গিয়েছে। টুটুল ধরবে বামের পথ, আর সীমান্ত ডানেরটা। মোড়ের কাছে আসতেই টুটুল সীমান্তের হাত ধরে বলল, ‘ভালো থাকিস।’ কথাটা শেষ করতে না করতেই টুটুল চলে গেল, একমূহূর্তের জন্যও দাঁড়ালো না। ওদিকে সীমান্ত অনবরত ডাকছে, ‘টুটুল, টুটুল!’ সে যেন চোখের নিমিষে ঘটে যাওয়া ঘটনার কিছুই বুঝতে পারল না।
০০০
সীমান্ত অসময়ে শুয়ে আছে। আজ সে খেলতে বেরোয় নি। তার কিছু ভালো লাগছে না। তার কাছে সমস্ত কিছুই কেমন যেন এলোমেলো লাগছে। সে কিচ্ছু বুঝতে পারছে না। হঠাৎ তার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু কেন এমন পর হয়ে গেল, কেন ক্লাসের সবচেয়ে হাসিখুশি ছেলেটা আজ চুপচাপ।কেনই বা সে আর কারও সাথে কথা বলছে না, খেলছে না....! উফ..অসহ্য!!!
আচ্ছা, ওর বাসায় কি কোনো সমস্যা হয়েছে ? মা এলে জিজ্ঞেস করতে হবে। না, না, তাহলে ও এটা কেনো বলল, ‘ভালো থাকিস’ আর এভাবেই কেনো বলল ? তাহলে কি ওরা অন্য কোথাও চলে যাচ্ছে ? তাই যদি হয়......! উফ! কিচ্ছু ভালো লাগছে না, কিচ্ছু না।
এলোমেলো চিন্তাভাবনাগুলো মাথায় আসতে আসতেই সীমান্ত কীভাবে যেন ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঘুম ভাঙলো সন্ধ্যের পরে, মায়ের ডাকে।
-এই সীমান্ত, সীমান্ত। জলদি ওঠ, বাবা।
-কী হয়েছে ?
সীমান্ত দু’হাতে চোখ কচলাতে কচলাতে উঠে বসল।
-একটা ব্যাড নিউজ আছে।
-ব্যাড নিউজ!
-মি. জামানের ছেলে মানে তোর বন্ধু টুটুল সপ্তাহখানেক আগে পানিতে পড়ে গিয়েছিল। আজ ওর লাশ খুঁজে পাওয়া গেছে। আমরা এখনই বেরোব, তুই জলদি তৈরি হয়ে নে।
সীমান্ত হতভম্ব হয়ে বসে আছে। সে তার মায়ের কথার আগাগোড়া কিছুই বুঝতে পারছে না। টুটুল মরে গেছে ?! তবে...?
০০০
কিছুক্ষণ আগে সীমান্ত টুটুলের গ্রাম থেকে ফিরল। তারা সবাই সেদিনই চলে গিয়েছিল।আজ তিনদিন পর তারা সবাই ফিরে এসেছে। সীমান্ত খুব ভেঙে পড়েছে। তার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধুকে সে চিরশান্তির বিছানায় শুইয়ে দিয়ে এসেছে।কিন্তু সে এখনও এই সকল ঘটনার কোনো অর্থ খুঁজে পাচ্ছে না।তার বন্ধু এক সপ্তাহ আগে কীভাবে মারা যেতে পারে ? সে তো সেদিনও স্কুলে এসেছিল! টুটুলের মৃত্যুর সংবাদ পাবার পর হতে সে কেবল এই একটি কথাই ভেবে চলেছে। কিন্তু কারও কাছে বলতে পারছে না। কেন যেন তার কারও কাছে এই কথাটি বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না। কিন্তু না, আজ সে তার মাকে সব বলবে।
কিন্তু বাসায় এসে আর সেটা বলবার কোনো প্রয়োজন হল না। সে তার রুমে এসেই দেখতে পেল তার বিছানায় একটা কাগজ পড়ে আছে। একটা চিঠি।
সীমান্ত,
তুই আমার খুব ভালো বন্ধু। যতদিন বেঁচে ছিলাম তোকে আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ বন্ধু ভেবে ভাবতাম, আজ পরপারে চলে যাবার পরও আমি তাই ভাবি। আজ তোরা সবাই জানিস, আমি এ পৃথিবীতে আর নেই। জানি তুই আমাকে খুব ভালোবাসিস। কিন্তু আমি আর তোর সাথে এই সুন্দর পৃথিবীতে রইতে পারলাম না।তুই এটা ভাবছিস তো, এটা কীভাবে হল ? আমি কীভাবে এই একসপ্তাহ তোর সাথে, তোদের মাঝে ছিলাম ?
দিন দশেক আগে আমি বাবা-মায়ের সাথে গ্রামে যাই। সেখানে মকবুল নামের একটা ছেলের সাথে আমার পরিচয় হয়। আমি ওর সাথেই সারাদিন ঘুরতাম। ও আমাকে সারা গ্রাম ঘুরিয়ে দেখিয়েছিল, কেবলমাত্র পশ্চিম দিকটা ছাড়া। অামি একদিন ওদিকটায় যেতে চাই। কিন্তু সে আমাকে নেয় না। বারণ করে আমি যেন কখনও ওদিকটায় না যাই। কারণ জিজ্ঞেস করলে সে এড়িয়ে যায়। আস্তে আস্তে আমার মনে কৌতুহল জাগতে শুরু করে। আমি একদিন কাউকে কিছু না জানিয়ে সেই পশ্চিম দিকের পুকুরটায় চলে যাই।পুকরটা ভীষণ সুন্দর। আমি পাড়ে গিয়ে দাঁড়াতেই হঠাৎ আমার পিছন হতে কে যেন একটা ধাক্কা দিল।আমি পড়ে গেলাম। সেদিন আমাকে না পেয়ে সবাই সব জায়গায় খোঁজ নিতে শুরু করল। থানায় ডাইরি করল। কিন্তু পুকুরটার দিকে কেউ এল না। তিনদিন আগে কেউ একজন কোনো প্রয়োজনে এদিকে আসতেই আমার লাশ দেখতে পেল।তখনই সবাই জানতে পারল যে আমি আর নেই!
এই কয়েকদিন তোরা সবাই আমাকে দেখতে পেয়েছিলি। কারণ আমার মৃত্যুর পরে আমি এক বিশেষ শক্তি পেয়েছিলাম। আমার আত্মা যখন যেখানে খুশি চলে যেত। বাবা-মায়ের কাছে যেতাম। কিন্তু তাদের কান্না দেখে ভালো লাগত না। তাই কখনও তাদের সামনে যেতাম না। তোরা এখানকার কেউ আমার নিখোঁজ হওয়ার সংবাদ তখনও পাস নি। তাই তোদের সামনে আমি নির্দ্বিধায় আসতে পারতাম। আমার কিছু ভালো লাগত না, তাই সবসময় চুপচাপ থাকতাম। আড়াল থেকে তোদের খেলা দেখতাম। সেদিন যখন তোকে বললাম, ভালো থাকিস, তখনই সবাই আমার লাশ খুঁজে পেয়েছে।সেদিনের পর আর আমি কোথাও আসতে পারতাম না। তাই তোর কাছ থেকে আমি চিরবিদায় নিয়ে নিলাম।
সবশেষে বলব, ভালো থাকিস।খুব ভালো থাকিস।
ইতি-
তোর প্রিয় মৃত বন্ধু
টুটুল
সীমান্তের দুচোখে জল জমে আছে।সেদিন টুটুলকে কে ধাক্কা দিয়েছিল ? কেন কেউ ওই পুকুরের দিকে যায় না ? কী আছে ওই পশ্চিমা পুকুরে?
সীমান্ত খোলা আকাশটার দিকে তাকিয়ে নিরবে প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজছে। তাহলে কী সত্যি অশরীরী কিছু আছে ?!!!