আমাদের শহরের একটা হাসপাতালের বারান্দা এটা।অনেক মানুষ হাটাহাটি করছে,চিতকার করছে,কথা বলছে,ফিসফাস করছে,কাঁদছে।কিন্তু এতো কিছুর পরেও কেমন একটা নীরবতা ঘিরে রেখেছে চাদরের মত।ভারী একটা নীরবতা।অসহ্য রকমের ভারী…।প্রতিটা হাসপাতালের একটা নিজস্ব নীরবতা থাকে।
হাসপাতালের একটা কেবিন থেকে সাদা কাপড়ে ঢাকা একটা লাশ বের হচ্ছে,তার চারদিকে কিছু মানুষ ছুটোছুটি করছে।কেউ লাশের স্ট্রেচার টা ধরে আছে,কেউ পাশে রেখে দৌড়াচ্ছে।সামনে রাস্তা পরিষ্কার করছে,মানুষদের ঠেলে সরিয়ে দিচ্ছে।তবে একজনকে কেউ দেখছে না।মেঝেতে একটা ডায়রী হাতে নিয়ে বসে কাঁদছেন এক মধ্য বয়সী মহিলা।কেউ তাকানোর সময়ই পাচ্ছেনা।সবাই স্ট্রেচারের লাশটার পিছনেই ছুটছে।কে কি রেখে গেল তার খবর নেওয়ার কোন মাথাব্যাথা নেই,আর যারা পিছে পড়ে গেছে তারা পিছেই থাকুক।
আমি একজন অদ্ভুত মানুষ,আমি নিজেও পিছে পড়ে যাওয়া এক মানুষ,সামনে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টায় ব্যস্ত।কিন্তু আমার গল্পটা পিছে কি রয়ে গেল তা নিয়ে।আমাদের গল্পটা এই ডায়রীতেই আবদ্ধ।
মে ৭,
এই ডায়রীতে আজই আমার প্রথম এন্ট্রি।এই ডায়রীটা অনেক পুরাতন।প্রায় চার বছর আগে আমাকে একটা মেয়ে উপহার দিয়েছিল।মেয়েটার সাথে আমার তেমন কোন সম্পর্ক ছিল না।মেয়েটা আমাদের পাশের বাসায় থাকত।তার বাবা অফিস থেকে ডায়রী পেয়েছিলেন।এর মাঝে আবার একটা অতিরিক্ত ছিল।সেটা আমাকে এসে দিয়ে গিয়েছিল।আমার মনে আছে আজও সেদিনের কথা।মেয়েটা হালকা নীল রঙের ফ্রক পড়েছিল।আমার ঘরে এসে বলল, “এই…তুমি যে সারাদিন ঘরের মাঝে শুয়ে থাকো তোমার বিরক্ত লাগেনা?কি করো সারাদিন?সময় কাটাও কিভাবে?”
আমি এত প্রশ্ন একসাথে শুনে হকচকিয়ে গেলাম।আমি আমতা আমতা করে উত্তর দিলাম, “কোনরকমে কেঁটে যায়।বই পড়ি,ঘুমাই।চিন্তা করি।এভাবেই কেঁটে যায়”।
মেয়েটা মুখ বাঁকিয়ে বলে উঠলো, “এভাবে করে সময় কাটানো যায় নাকি আবার?এইটা রাখো।এইটা চিনো তো?এইটা কে ডায়রী বলে।বুজছো?”
“বুঝলাম”,উত্তর দিলাম আমি।
“এইটার কাজ কি জানো”?
“হুমম”।
“কি?”
“মানুষ ডায়রীতে তাদের মনের কথা লিখে।দিন কিভাবে কাটায় এসব লিখে।চিন্তাভাবনা লিখে রাখে শুনেছি”।
আমার এই উত্তর শুনে হিহিহি করে হেসে উঠল মেয়েটা।
“কোন বই থেকে মুখস্ত করেছো উত্তরটা?”
“মুখস্ত করিনাই তো।কোন একটা বইয়ের মাঝে এরকম কিছু একটা পড়েছিলাম অবশ্য”।লজ্জামাখা মুখ করে বললাম আমি।
“তোমার উত্তরটা ঠিক ছিলো।কিন্তু মনে হয়েছে মুখস্থ করে উত্তর দিচ্ছো তাই হাসি পেয়েছিল খুব”।
আমি আবার লজ্জা পেলাম।
“আচ্ছা,আমি উঠি আজকে।আবার আরেকদিন আসবো।তুমি তো ঘরেই থাকো। আমি মাঝে মাঝে আসবো”।
এই বলে মেয়েটা চলে গেল।আমি আর তাকে কোনদিন দেখিনাই।সে তার কথা রাখতে পারেনি।সে ডায়রী দেওয়ার প্রায় ২ সপ্তাহের মাঝেই দেশ ছেড়ে চলে গেল।আমি অবশ্য আশায় আশায় শুয়ে থাকলাম।সে আমার কথা ভুলে গিয়ে অবশ্য ভালোই করেছে।কারন তার দেওয়া ডায়রীতে যে আমি কি লিখবো ভেবে পাচ্ছিলাম না।পরে সে এসে ব্যাথিত হত খুব।
আজ আমি হাসপাতালে বসে ডায়রীটা খুললাম।মনে হচ্ছে কিছু লিখা উচিত।ডায়রীটা সবসময় সাথে থাকতো।কিন্তু কোনদিন কিছু লেখা হয় নাই।এটা আমি সাথে রাখতাম একটাই কারনে।আমার পরিবারের ৪-৫ জন ছাড়া আর কেউ যে আমার অস্তিত্ব নিয়ে সামান্য হলেও চিন্তিত তার দলিল হল এই ডায়রী।আর কিছুই না।আমি যে এই পৃথিবীর মানুষদের একজন তার প্রমান এই ডায়রী।আজ আমি হাসপাতালের বেডে কেন সেটার গল্পটা বলি।
তার আগে আমাদের বাসা ও বাসার মানুষদের কিছু কথা বলি।আমাদের বাসাটা ২তলা,ডুপ্লেক্স টাইপের।আমার যখন বয়স যখন ১০-১১ তখন একদিন আমি সিড়ি দিয়ে নামছিলাম ভাত খেতে।সিড়িটা মাত্রই আমাদের কাজের মহিলা মুছে দিয়েছেন।আমি ভেজা সিড়ি দিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে নামছিলাম।ওদিন আবার ইলিশ মাছের ডিম ভেজেছিল।যা কিনা আমার খুবই প্রিয়।আমার তর সইছিল না।আমি সিড়িতে পা দেওয়ার সাথে সাথে পা পিছলিয়ে গড়াতে গড়াতে পড়লাম।পড়ার পর মাথায় প্রচন্ড যন্ত্রনা অনুভব করলাম।সেই সাথে আমি আমার কোমর থেকে নিচে পায়ের পাতা পর্যন্ত আর কিছুই অনুভব করতে পারছিলাম না।একি সাথে ২ ধরনের অনুভুতি।একটা তীব্র যন্ত্রনার অনুভুতি আরেকটা হল অনুভূতিহীনতার অনুভূতি।
আমাকে ডাক্তারের কাছে কোলে করে নেওয়া হল।কোলের মাঝে থাকা অবস্থাতেই ডাক্তার বলল, “আমার কাছে এনে লাভ নাই।ও প্যারালাইজড হয়ে গিয়েছে”।
এই কথা শুনে আমার বাবা অশ্রাব্য ভাষায় গালি দিয়ে ডাক্তারকে বললেন, “তোর কাছে দেখামুনা।শালা,প্রশ্ন কিনে ডাক্তারীতে ভর্তি হইছস।পরে নকল কইরা এমবিবিএস করছস।কিছু না দেইখা আন্দাজী কথা বলস”।
এই কথা বলে আমরা আবার বের হয়ে গেলাম।এরপর আবার গাড়ী করে প্রায় ৪৫মিনিট জার্নি করে আরেক ডাক্তারের কাছে গেলাম।প্রায় ১ঘন্টা হাত পা টেপাটেপি করে সেই ‘ভালো’ ডাক্তার রায় দিলেন।ওর ব্রেন এ আঘাত লেগেছে কিন্তু ওটা তেমন সিরিয়াস না।সমস্যা হবেনা।কিন্তু ওর কোমর থেকে নিচের অংশ প্যারালাইজড হয়ে গিয়েছে।ও বোধহয় প্রিম্যাচুর ছিলো।ওর শরীর দুর্বল।এজন্যে এত ক্ষতি হয়েছে”।এধরনের কিছু কথা বলে ডাক্তার আমাকে আমার জীবনের প্রথম সার্টিফিকেট টা ধরিয়ে দিলেন।প্যারালাইজড হওয়ার সার্টিফিকেট।আমি আর লিখতে পারছিনা।আমার মাথার যন্ত্রনাটা আবার সহ্যের বাইরে চলে গিয়েছে।আমার মাথা ব্যথার গল্পটা নাহয় কালকেই বলি।
৮মে,
মাথার যন্ত্রনাটা তীব্রতর হচ্ছে।কালকে রাতে একফোঁটা ঘুমোতে পারিনি।যন্ত্রনাটা এতই বাড়ে মাঝে মাঝে যে নাক থেকে রক্ত পড়া শুরু হয়।তবে নাক থেকে রক্ত পড়ার সময় অবশ্য আরাম বোধ হয়।খারাপ লাগেনা।মনে হয় ব্যথাগুলো নাক বেয়ে চলে যাচ্ছে।তবে ব্যাপারটা ডাক্তাররা একদম পছন্দ করেনা।নার্স যদি একগাদা ঔষুধ ধরিয়ে দেয়।আমিও বুঝি ব্যাপারটা আসলে তেমন ভালো না।নাক থেকে রক্ত পড়ার ৩০-৪৫ মিনিট পর পর্যন্ত ব্যাথা থাকেনা কিন্তু আবার যখন ব্যথাটা ফিরে আসে তখন দ্বিগুন শক্তিতে ফিরে।তখন ব্যথায় আমার বিভ্রম হতে থাকে।
আমার হাসপাতালের কেবিনটাতে মাথার কাছে কিছু জটিল প্রকৃতির যন্ত্রপাতি রয়েছে।যেগুলোর একটাতে আমার দুর্বল হৃদপিন্ডের প্রতিটা স্পন্দন এর রেখাচিত্র দেখা যায়।বিভ্রমের মাঝে আমার কাছে এটাকে আমার মনে হয় কোন মানুষ যে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।আবার রুমের এসিটা বিভ্রমের মাঝে মনে হয় টেলিভিসন।আর আমার কেবিন থেকে একটু দুরেই একটা ছোট পোলিও আক্রান্ত ছেলের কেবিন।সে সারারাত শুয়ে থেকে কান্না করে।আমার বিভ্রম হলে ওটাকে আমার সারা জীবনে শোনা ২-১টা গানের মতো মনে হয়।কান্নাটাকে সুরেলা মনে হয়।আর রুমটাকে মনে হয় গুহা।তার দেয়াল জুঁড়ে যেন আমার নাম লিখা।
মাথা ব্যথার কথা বলে আরো মাথা ব্যথা বাড়ছে।শুনেছিলাম একবার,কষ্টের কথা যত কম স্মরন করা যায় ততো কম কষ্ট লাগে।আমিও মাথা ব্যথার কথা না বলি আর।আমার পরিবারের কথা বলি।আমার সময় নেই বেশি আর বুঝতে পারছি।এখনি অনেক কষ্ট হচ্ছে লিখতে।
আমার বাবা একজন ব্যবসায়ী,মা আইনজ়ীবি,বড় ভাই দেশের সেরা ভার্সিটি থেকে পাশ করেছে অর্থনীতি থেকে।সামনের মাসেই লন্ডন চলে যাওয়ার কথা।ও আর ভাইয়া পাশ করেই পরিবারের মত নিয়েই উনার এক বান্ধবীকে বিয়ে করে ফেলেছেন।উনিও অবশ্য যাচ্ছেন ভাইয়ার সাথে।আমার পরিবারের সবাই খুবই ব্যস্ত।তারপরেও হাসপাতালে আমার ভাবী ও মা এখন উপস্থিত আছেন।তবে তাঁরা একটু আগেই ঘুমোতে গিয়েছেন।সেই ফাঁকেই লিখতে বসলাম।
আমার পরিবারের সবাই তাদের শত ব্যস্ততার মাঝেও সময় দেয়।ওরা তো আর আমার মতো সার্টফিকেটধারী প্যারালাইজড ও ব্রেন ড্যামাজড না।সেহেতু তারা যতটা পারে সময় দেয়।আমি তাতেই খুশি।আমি প্রথম এতকিছুর পরেও বসে,শুয়ে পড়ালেখা করার চেষ্টা করতাম।বাসায় এসে ভাইয়ার এক বন্ধু এসে আমাকে পড়াতো।আমি ভালোই করতাম।স্কুলেও মাঝে মাঝে যেতাম বাবার গাড়ী করে।আমি স্কুল ছাড়লাম শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে কারন টানা ক্লাস করার কারনে আমার প্রচুর কষ্ট হত।একদিন স্কুলে গেলে আমাকে ২ দিন শুয়ে থাকতে হত।পরে আমি স্কুলে যাওয়া বাদ দিলাম।১৪ বছর বয়স আমার তখন।আজ আমার বয়স ১৮।কিন্তু মানসিক ভাবে কিছু কিছু দিক দিয়ে আমার বয়স আমার অনেক বেশি।আমি সহজেই মৃত্যুর চিন্তা করতে পারি।তেমন কষ্ট হয় না।একা একা সারাদিন একটা ঘরে থাকতে পারি।সারাদিন শুয়ে শুয়ে চিন্তা করতে পারি আকাশ পাতাল।
১৬ বছর বয়সটা আমাদের দেশের ছেলেমেয়েদের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ন একটা বয়স।সবাই তাদের জ়ীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষার মুখোমুখি হয়।আর আমার জন্য ১৬ তম বছর টা গুরুত্বপুর্ণ,কারন আমার সে বছর প্রথম নাক থেকে রক্ত পড়া শুরু হয়েছিল আর আমার বড় ভাইয়ের বিয়ে হয়েছিল।আমার ভাইয়া অনার্স পাশ করেছিল তার আগের বছরেই।মাস্টার্সে ভর্তি হয়ে ভাইয়া চাকরি খোঁজা শুরু করে।২-৩ মাসের মাঝে পেয়ে যায়।তার ১ মাসের মাঝেই ভাইয়া বিয়ে করে ফেলে।ভাবী আমি দেখেছি আগেও।আমাদের বাসাতেই আসতো প্রায়ই।সবাই খুব পছন্দ করত।ভাবী আমার দেখতেও বেশ।মাঝারি গড়ন ও শ্যামলার মাঝেই বাংগালীয়ানার ছাপ পড়া সুন্দরী।তবে আমার সাথে তেমন কথা হয়নি কখনোই।ভাইয়ার জন্য ভাবীর টান ছিল অন্যরকম ধরনের বেশি।ভাইয়ার একবার জ্বর হলো তখন সকাল থেকে সারাদিন ভাইয়ার সেবা করল।প্রায় তিনদিন ধরে।এভাবে সকাল-সন্ধ্যা সেবা করে ভাইয়াকে সুস্থ করে ভাবী বিদায় নিলেন।
ভাইয়া সবসময় আমার সাথে দূরত্ব বজায় রাখতেন।তেমন কথা বলতেন না।মাঝে মাঝে এসে খুবই ফর্মাল,ভদ্রতার হিসেবে কথা বলতেন।কুশলাদি জিজ্ঞেস করতেন,কি দরকার ইত্যাদি জিজ্ঞেস করে চলে যেতেন।ভাইয়াকে সবাই বেশ আদর করত।ভাইয়া ভদ্র,নম্র,পড়াশোনায় ভালো,দেখতেও বেশ সুদর্শন।আমি যা না তার সবই হল ভাইয়া।আমার সাথে এত ভালো সম্পর্ক না হলেও আমি ভাইয়ার বিয়ে নিয়ে অনেক উতসাহী ছিলাম।মানুষ দেখতে পাবো,আমাকেও মানুষ দেখতে পাবে,নিজেকেও মানুষের মতো লাগবে।আমি এসব নিয়ে প্রচন্ড উতসাহী ছিলাম।কিন্তু বিয়ের এক সপ্তাহ আগ থেকে মানুষ যারা আসতে শুরু করল তাদের কাউকে আমি চিনি না।তারাও আমার ঘরে ঢুকতে চায়না।আমারো কাউকে ডাকতে ইচ্ছা করেনা।শুয়ে থেকে সব শুনি,দেখি।ভাবীর গাঁয়ে হলুদের আগের দিন সকালে হঠাত করে দেখি হন্তদন্ত হয়ে ভাবী আমার রুমে ঢুকলো ভাইয়াকে বকতে বকতে।“বলছিনা,তুমি আসবানা।ওর সাথে আমার কথা আছে।তোমাকে ডাকলে আসবা।কোন কথা না আর”।চোখ গরম করে উনি এই কথা গুলা বললেন।এরপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন “কি খবর তোমার?ভালো আছো?”
“জ্বী,আছি।ভালো”।আমি আমতা আমতা করে জবাব দিলাম।
“তোমার সাথে আগে কখনো কথা হয়নি এজন্যে আমি দুঃখিত।আসলে আমি নিজেও ইতস্তত বোধ করতাম।তার উপর তোমার ভাইও কখনো তোমার কথা বেশি বলতনা।কখনো দেখাও করিয়ে দেয়নি।এসব কারনে আগে কথা হয়নি”।ভাবী ক্ষমা প্রার্থনার সুরে কথাগুলো বললেন।মজার ব্যাপার একটাই আমার কানে উনার কথাগুলো অন্যদের বানোয়াট ভদ্রতার মুখোশ আটা বাণীর মতো লাগলোনা।মনে হল হৃদয়ের গভীর থেকে আসছে।কি সহজেই বলে ফেললেন কথাগুলো।
আমি উত্তরে বললাম “কোন সমস্যা নাই।তাও তো আসলেন,দেখা দিলেন।এতেই ভালো লাগছে”।
ভাবী মাথা নিচু করলেন আর একবার চোখে হাত দিলেন।মনে হল চোখে পানি চলে এসছিল উনার।আহা,করুণা এক অদ্ভুত জিনিস।আমার কখনো ভালো লাগেনি করুণা ব্যাপারটা।নিজেকে পরাজিত মনে হয়।হ্যা,আমি নিজের দোষে পরাজিত দের জীবনে ঘুরপাক খাচ্ছি।কিন্তু সেটা এভাবে প্রতিমূহুর্তে মনে করিয়ে দেওয়ার কি কোন কারণ আছে?
ভাবী বললেন এবার হাত বাড়িয়ে আমার পরনের জামাটা ধরে বললেন “আজকে কি পড়বা তুমি?এই কাপড় পড়লে হবেনা মোটেও।আর এইটা আমার বিয়ে সবাইকে সুন্দর ভাবে থাকা লাগবে”।
“আমার তো এত ভালো কাপড় নেই।আমি তেমন বের হই না তো।আমার জন্য খুবই কষ্টের কাজ বের হওয়া”।উত্তর দিলাম আমি।
“হ্যা আমি জানি।তাই তো এগুলো নিয়ে আসলাম”।এই বলে উনি একটা ব্যাগ থেকে একটা খুবই সুন্দর সবুজ পাঞ্জাবী বের করে দিলেন।“তুমি আজ এটা পরবে।কালকের জন্য এটা”।এই বলে আরেকটা পাঞ্জাবী বের করে দিলেন।আমি পাঞ্জাবী দুটো হাতে নিয়ে বসে থাকলাম।
“আমি এখন উঠি।তোমার সাথে তো এখন আরো অনেক কথা হবে সামনে।আরো সময় আছে।পাঞ্জাবীটা পড়বে”।এই বলে উনি উঠলেন।দরজার কাছে গিয়ে হঠাত দাঁড়িয়ে বললেন “তোমার সাথে দেখা হয়ে,কথা বলে গর্ব লাগছে।এতকিছুর পরেও তুমি বেঁচে আছো।অথচ কতো জন কত সহজেই আত্মহত্যার পথটা বেছে নেয়।কিন্তু তুমি বেঁচে আছো”।
আমার এই কথাটা শুনার পর হাসি পেল।আমি হেসে দিলাম।আটকাতে পারলাম না।
“আমার মা একবার ভাইয়া কে বুঝাচ্ছিলেন ‘ব্যাটা তোর যেটা পড়তে ইচ্ছা সেটা পড়বি।তোর যেটা ভালো লাগে।নাহয় পস্তাবি জীবনে।সবসময় যা করতে ভালোবাসিস,যা করতে ভালো লাগে সেটাই করবি।আজ়ীবন ঘৃণার বা অপছন্দের কাজ করলে আত্মা নষ্ট হয়ে যায় আস্তে আস্তে”।টানা কথাগুলো বলে আমি থামলাম।
“এগুলো কেন বলছো?”ভাবী জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে প্রশ্নটা করলেন।
“কেন বলছি?আমার এভাবে বেচে থাকতে ঘৃণা হয়।আমি আফসোস করি সারাদিন কেন যেদিন এক্সিডেন্টের সময় একেবারে মরলাম না।এখন তাহলে এই ফার্ণিচারের মত জীবন কাটাতে হতো না।আপনাকেও কষ্ট করে পুরাতন ময়লা ফার্ণিচার ঢাকতে ৪ হাজার টাকা দিয়ে কাপড় কিনা লাগতোনা”।
“স্যরি”।
“আপনার স্যরি বলার কিছু নেই।আপনার কোন দোষ নেই।কারোর কোন দোষ নেই।এটা জীবন।আমার নিজের কারনেই এই অবস্থা আমার।আপনাকে ধন্যবাদ পাঞ্জাবী গুলোর জন্য।আমি পড়বো এগুলো।আর আমি স্যরি অনেক কিছুই বলে ফেললাম যা আপনাকে বলা উচিত হয়নাই।আপনি একজন ভালো মানুষ,আমার ভাই অনেক ভাগ্যবান”।
গায়ে হলুদ আর বিয়ে অনেক জমজমাট হল।আর বিয়ের দিন রাতের বেলাতেই সানাইয়ের আওয়াজে মাথায় প্রচন্ড ব্যাথা উঠে আমার প্রথম নাক থেকে রক্ত বের হল।ভাবী মানুষটা যে ভাল তার প্রমান টা ওই দিন পেলাম।উনি নিজে স্টেজ থেকে নেমে এসে আমাকে ধরে নিয়ে এম্বুলেন্সে উঠিয়ে দিয়ে আসলেন।উনার দেখাদেখি ভাইয়াও আসলেন।এই দিনের পর থেকে আস্তে আস্তে আমার অবস্থার অবনতি শুরু হল।আর এখন আমি হাসপাতাল পাহারা দেই কলম আর ডায়রী নিয়ে।এই দিনের পর থেকে আমি একটা ঘোরের মাঝে বসবাস করছি।জ্ঞান আসে,জ্ঞান যায় এভাবেই চলছে গত ২ বছর।যেখানে আমার আমার ছোটকালের বন্ধুরা দৌড়াদৌড়ী করে সুন্দরী মেয়েদের পিছনে,ফিজিক্স,কেমিস্ট্রি,ম্যাথ স্যার দের পিছনে।আমি অবশ্য সেইদিক থেকে ভি আই পি স্ট্যাটাসে আছি।সবাই আমার পিছনে ঘুরছে।আমার সুন্দরী ভাবি,মা থেকে শুরু করে নার্সরা সবাই।এছাড়া আবার ভারী চশমা দেওয়া ডাক্তাররা তো আছেই।সবাই আমার পিছনে দৌড়াচ্ছে।সবাই আমাকে বাঁচানোর উদ্দেশ্যে ছুঁটছে।কিন্তু আমি যে বাঁচতে চাইনা।আমার মনে হচ্ছে এইবার আমার ইচ্ছামত কিছু হবে।আজকে আর কিছুনা।আর লিখতে পারছিনা।এত বেশি লিখা উচিত হয়নি।কিন্তু আমার মনে হচ্ছে আমার হাতে সময় কম।তাই লিখে চলেছি।
৯মে,
আজকেও প্রচন্ড যন্ত্রনায় ভুগছি।মাথার ব্যথাটা তীব্র হয়ে গিয়েছে।সকাল থেকে এখন পর্যন্ত ২বার নাক থেকে রক্ত পড়েছে।মাথাটা এখন ব্যথায় ভারী হয়ে আছে।কিছুক্ষন ডানপাশে,কিছুক্ষন বামপাশে,কিছুক্ষন সামনে,কিছুক্ষন পিছনে।ঘুরে ঘুরে ব্যথা হচ্ছে।লেখাটা ডাক্তারদের কথা অনুযায়ী একদম উচিত হচ্ছেনা।তারপরেও লিখছি আমি,লিখে যাব সব।বাবা-মা এর কথা বলি আজ।আমার মা একজন পরিবেশ রক্ষাকারী আইনজীবি।বাপার সদস্য।আর বাবা বিশাল ব্যবসায়ী।উনি এতই বিশাল একজন ব্যবসায়ী যে আমি মারা যাচ্ছি তাতেও উনার ভ্রুক্ষেপ নেই।উনি এখন মালয়েশিয়াতে একটা ডিলের মাঝে আছেন।প্রায় ১০০-১৫০ কোটি টাকার চুক্তি।এত টাকা রেখে উনি কেন আমার মত একটা জড় পদার্থের সাথে সময় কাটাবেন?আমারো অভিমান হয় না তেমন।দেশ যেখানে আমাদের মত সবাইকে জড় পদার্থের মত ভাবলে আমার বাবা’র কি দোষ?
মা মানুষ টা অনেক ভালো।আমাকে উনি ধরে ধরে স্কুলে নিয়ে যেতেন,নিয়ে আসতেন।আমার তখন পৃথিবীটা অনেক বড় ছিল।মা আমাকে স্টিফেন হকিংস বানানোর স্বপ্ন দেখতেন।সেই সাথে আমিও দেখতাম।অনেক স্বপ্ন।আমি অনেক স্বপ্ন দেখতাম।তখনকার সময়ে ঘুমটাও ভালো হত।কিন্তু হঠাত একদিন পড়তে গিয়ে মাথার যন্ত্রনার কারনে টেবিলে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গিয়ে এক বাজে অবস্থা।এরপর থেকে আমার স্বপ্নগুলো ঘুমের হাত ধরে পালালো।মা অনেক গান গেয়ে,গল্প বলেও ঘুম কে ফিরাতে পারলোনা।স্বপ্নদের নিয়ে আমার থেকে দূরে থেকে সে সুখেই আছে।হঠাত হঠাত আসে,কিন্তু আমাকে তার আর ভালো লাগেনা।
মা অনেক চেষ্টা করেন আমাকে সাহস দেওয়ার।আমাকে বাচিয়ে রাখার।একটা গল্প বলি এখানে,
একদিন মা এসে আমাকে এক মেক্সিকান মহিলা পেইন্টারের গল্প বললেন।নাম তার ফ্রিডা কাহলো।৬ বছর বয়সে পোলিও ধরা পড়ে তার।এরপর আবার ১৯-২০ বছর বয়সে উনি একটা বাস এক্সিডেন্টের কবলে পড়েন।উনার সারা শরীরের বেশির হাড় ভেঙ্গে যায়।এরপর নাকি উনাকে ৩৫বার অস্ত্রোপচারে বসতে হয়েছিল সারা জীবনে।উনার বিভিন্ন শারীরিক সমস্যাও দেখা দেয় এর ফলে।কিন্তু তাও তিনি উনার প্রিয় কাজ ছবি একে গিয়েছেন।
এরপরে আবার একটা ফ্রেঞ্চ সিনেমা দেখালেন নাম “ডাইভিং বেল এন্ড দি বাটারফ্লাই”।
এক ফরাসী ফ্যাশন ম্যাগাজিনের প্রখ্যাত সাংবাদিক স্ট্রোক করেন।উনার সারা শরীর অবশ হয়ে যায়।শুধুমাত্র এক চোখের পাতা ফেলতে পারতেন।ওভাবেই একটা সিস্টেমে একটা বই লিখে ফেলেন।
আমার ভালোই লেগেছিল।আমি উদ্যমী হয়ে কিছুদিন লেখালেখির চেষ্টা করলাম।কিন্তু আমার নিজের লেখাগুলো মোটেও ভালো হচ্ছিলনা।আমি বুঝতে পারছিলাম।তাই আবার গল্পের বই পড়তে শুরু করলাম।কিন্তু পড়তে পারতাম না একদমই।মাথার ব্যথাটা ফিরে আসতো।কিন্তু আমার মা নিরাশ না হয়ে আমাকে জীবনের মানে বুঝানোর জন্য সবকিছু করতে লাগলেন।এক ভয়াবহ অবস্থা হল আমার মনের।আমি কিছুই করতে পারিনা তার উপরে এই যন্ত্রনা।মানসিকভাবে পুরোই ভেঙ্গে পড়লাম আমি।কারণ মা এর স্বাভাবিকভাবে ছেলের কাছে আবদার ছেলে ভালো কিছু করবে।এভাবে ছেলের জায়গায় ফার্ণিচার কে চায়?তাই ফার্ণিচারকে মানুষ বানানোর মিশনে নেমেছিলেন উনি।কিন্তু এটা কি এতই সহজ?
প্রতিটা দিন উনি আমার সামনে এসে বলতেন “অমুকের ছেলে এটা করেছে,ওটা করেছে।অমুকের মেয়ে এটা করছে,ওটা করছে…”
আমি শুনতাম আর মুখ লুকিয়ে চোখের পানি ফেলতাম।একদিন মা আমার জন্য একটা সিনেমা নিয়ে এলেন।আর বললেন “দেখ এটা এক পংগু…”
আমি এতটুকু শুনে চিতকার করে বললাম “চুপ করেন।আমি আর দেখবোনা আপনার এসব জীবন বাদী ও আশাবাদী সিনেমা।আমি আর আপনার সাফল্যমন্ডিতদের গল্পও শুনতে চাইনা।আপনি এখন যান এখান থেকে।কথা বলতে ইচ্ছা করছেনা”।
“কেন?কি হয়েছে আব্বু?”
“কিছু হয়নাই।যান”
“বলো”
আমি ভেংগে পড়লাম একেবারে।চিতকার বলতে লাগলাম “এগুলো দেখলে আমার মরে যেতে ইচ্ছা করে।আপনি কেন বুঝেন না?ওদের সবাই যুদ্ধে জয়ী হয়ে ফিরে আসছে।আর আমি পরাজিত আহত হারিয়ে যাওয়া সৈনিকের মত পরে আছি এখানে।আমিতো ওদের মতই হতে চাই।আমিতো ওরকমই হতে চাই।আমি অনেক চেষ্টা করেছি কিন্তু আমার মাথার যন্ত্রনার সাথে আমি আর পেরে উঠিনা।আর আপনার হতাশ মুখ দেখতেও আমার একদম ভালো লাগেনা।আপনাকে আমি হতাশ করতে চাইনা।আপনাকে হতাশ করার মানসিক কষ্ট টা আমাকে দিবেন না।প্লীজ”।
“ব্যাপারটা এরকম না।আমি তুই ঘরে আটকা থাকিস সারাদিন,এজন্যেই এগুলো দেখাই তোকে।যাতে তুই সারা বিশ্ব সম্পর্কে জানতে পারিস।তুই যাতে বেচে থাকার শক্তি পাস”।
“আমি বাচতে চাই না মা।এখন যান মা।আর কথা বলবেন না”।
মা কিছুক্ষন চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে চলে গেলেন।আর সহজে আমার সাথে উনার আর বেশি কথা হয়নি।তবে আমি প্রায় রাতে শুনতাম।উনি কান্না করছেন,চিতকার করে।আর বলছেন “খোদা আমি কি দোষ করলাম যে তুমি আমার ছেলেটাকে এভাবে শাস্তি দিলে।আমি কি করেছি?”
আমি একজন ভালো শ্রোতা তাই সব শুনে যেতাম,চুপচাপ থেকে।
বাবার সাথে আমার তেমন কোন স্মৃতি নেই।একদম ছোটবেলায় একসাথে ঘুরতাম অনেক।কিন্তু এক্সিডেন্টের পর বাবা অন্যরকম হয়ে গেলেন।আস্তে আস্তে।সবসময় গম্ভীর,চুপচাপ।আমার মনে হত উনি বুঝি উনার জীবনের একটা মানে হারিয়ে ফেলেছেন।কারোর সাথে কথা বলতেন না।খালি ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন।যেই বাবা সারা বাড়ি জমিয়ে রাখতেন হৈ-হুল্লোড় করে তিনি হয়ে গেলেন সবচেয়ে নীরব।যেই বাবা আমার মা এর একটা ধমক খেলে মা এর পা ধরে ফেলতেন ছেলেদের সামনে,যেই বাবা মা এর চোখে পানি দেখলে অস্থির হয়ে ছুটোছুটি করতেন,যেই বাবা মা এর সামান্য অসুখে রাত জেগে থাকতেন সেই বাবার এখন মা এর ক্রমাগত চিতকার,কান্নাতেও কোন বিকার হয়না।আমার মনে হয় মাঝে মাঝে উনি আমার মত ঈশ্বরে অবিশ্বাসী হয়ে গিয়েছেন।জীবনের আশা ভরসা,সম্ভাবনা সব হারিয়ে ফেলেছেন।হ্যা,আমি একজন নাস্তিক ছিলাম।আমার জীবনের এতকিছুর পর ঈশ্বরে বিশ্বাস রাখাটা বেমানান ছিলো।কিন্তু হাসপাতাল আমাকে ঈশ্বরে বিশ্বাস করিয়েছে।সেই কথা আরেকদিন হবে।মনে হয় কালকেই লিখবো।ডাক্তার রা আমাকে সময় ধরে দিয়েছেন।কাল পরশু আমি মারা যাবো।
যাই হোক আজ আর লিখবোনা……এখানেই শেষ করি…মাথার যন্ত্রনা টা আমাকে
ছিড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলছে।
১০মে,
আজ আমি মারা যাব,বেশিক্ষন নেই আর।এইতো হয়তোবা আর ৪০-৪৫ মিনিট সময় আছে আমার হাতে।আমার বিশেষ কিছু অভিজ্ঞতা লিখে রেখেই চলে যাব।হাসপাতাল জায়গাটা বড় অদ্ভুত।এটা যেন এক বিশাল বড় আশাবাদীদের মিছিল।যারা মনে মনে ভাবে এখানকার চশমা পড়া লোকগুলোর হাতে যাদু কাঠি আছে তারা রোগীর দিকে তাকালেই রোগী সুস্থ হয়ে উঠে দৌড়ানো শুরু করবে।ক্যান্সার আক্রান্ত মানুষ,যাদের কিনা বাচানো প্রায় অসম্ভব,তারাও এখানে এসে ডাক্তারদের দেখে চরম আশাবাদীতার অভিনয় করে।এটা যে কিভাবে সম্ভব বুঝতাম না আমি।তাকিয়ে থাকতাম।অবাক,বিস্ফারিত চোখে।এদের দেখে মনে হত আমিও আশাবাদী হতাম।আমিও হয়তবা বেচে ফিরবো।আমার মা-ভাবী,ভাইও খুব আশাবাদী।কিন্তু আজ আমি জানি আমি মারা যাব।কিন্তু এতে আমার কোন অভিমান নেই,রাগ নেই।একধরনের প্রশান্তি হচ্ছে মনের মাঝে।শান্তি লাগছে।তার কারনও আছে।
আমি হাসপাতালে ঢুকেছিলাম “নিহিল”রূপে।ভবিষ্যত কিংবা নিয়তিতে আমার বিন্দুমাত্র বিশ্বাস ছিলো না।দিন যেভাবে কাটা উচিত সেভাবেই যেন কেটে যাচ্ছিল আমার জীবনে।কিন্তু যখন আমি এসে হাসপাতালে এসে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর জিনিসটা দেখলাম আমার মনে হল,পৃথিবীর সবকিছুরই কোন একটা মানে আছে,কারণ আছে।আর এগুলোকে নিয়ন্ত্রন করছে কোন এক অসংজ্ঞায়িত শক্তি।এই পৃথিবীর মানুষদের মাঝে এত ভালোবাসা,আশা,আনন্দ,বেদনা থাকা সম্ভব না।কোন কারন ছাড়া।এটা আমার কাছে অসম্ভব মনে হয়।
আমি প্রথমদিন যখন হাসপাতালে ঢুকি সেদিন করিডোর দিয়ে আসার সময় এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখে আমার মনটা অন্যরকম হয়ে গেল।এক সুন্দর যুবতীর লাশের উপর মাথা রেখে এক সুন্দর যুবক কাদছে আর বিড়বিড় করে কথা বলছে।অস্পষ্ট হওয়ায় আমি কিছুই শুনতে পারছিলাম না।আর আরেকপাশ দিয়ে এক বুড়ো মানুষ তার নাতি-নাতনি,বুড়ী স্ত্রী,ছেলেমেয়ে বেষ্টিত অবস্থায় বের হয়ে যাচ্ছে ক্রাচে ভড় দিয়ে।মুখে হাসি নিয়ে।আশেপাশের সবাই হাত মিলাচ্ছে।আর বলছে “আর আসবেন না কিন্তু এখানে”।“আবার ক্যান্সার হলে আসবো।নাহয় এসব জায়গায় এসে আমার কাজ নেই”।হাসিমুখে বৃদ্ধের উত্তর।এই দৃশ্যটা আমার মনটা বিক্ষিপ্ত করে দিলেও এই পৃথিবী আর নিজের উপর রাগ,অভিমান আমাকে তখনও পুরোপুরি দখল করে রেখেছিল তাই আমার কাছে এই দুটো দৃশ্যের কোন তাৎপর্য ছিলোনা।কিন্তু অনেকদিন পর আমি আবার স্বপ্ন দেখলাম এখন আমি শান্তি নিয়ে মারা যেতে পারবো।
স্বপ্ন দেখিনা অনেক দিন।যা দেখতাম সেগুলো ছিলো আসলে বিভ্রম।ঔষুধের প্রভাবে সৃষ্ট বিভ্রম।কিন্তু গতরাতে যা দেখলাম সেটা কে মনে হয় স্বপ্নই বলে।আমি নিশ্চিত না।তাও মনে হয় এটাকেই স্বপ্ন বলে।
আমি গতরাতে কোন ঔষুধ ছাড়াই ঘুমিয়েছিলাম।রাত ৩-৪টা বাজে।ভাবী আমার ঘরের সোফাতে ঘুমাচ্ছেন।মা বাইরে চোখ বড়বড় করে বসে আছেন।ভাইয়া বাসা পাহাড়া দিতে চলে গিয়েছে।আমার তখন কেন জানি চোখ লেগে আসলো।হঠাত করে দেখি,সব নাই হয়ে গিয়েছে।আমি একটা বিশাল প্রান্তরে বসে আছি।চারদিকে মরুভূমির মতো বালি কিন্তু তার মাঝে মাঝে পানির লেক।আকাশটা জানি কেমন হয়ে আছে।আমার মাথার ভিতর একটা কন্ঠ যেন বলে চলছে “সামনে যাও”।আমি এখানে দেখি আমি হাটতে পারছি।আমি আমার পা অনুভব করতে পারছি।আবার প্রায় ১২ বছর পর।আমি আবার হাটছি!আমি ভাষাহীন আনন্দে চিতকার করতে লাগলাম।১২ বছর আমি আমার কোমরের নিচের অংশ অংশ অনুভব করতে।অনুভূতির এই আনন্দ ভাষাহীন।আমি দৌড়ানো শুরু করলাম।চিতকার করতে করতে দৌড়াতে লাগলাম।ছুটতে ছুটতে দেখি সেই নীল ফ্রক পড়া মেয়েটা।নীল পানির একটা লেকের সামনে।আনন্দে ভাষা হারিয়ে আমি তাকে আলিঙ্গন করলাম।সে বলে উঠলো “যাক তুমি এসেছো।দেখো তোমার জন্য সবাই বসে আছে”।আমি তাকিয়ে দেখি মা,বাবা,ভাইয়া,ভাবী সবাই হাসিমুখে আকাশের মাঝে দাঁড়িয়ে আমার দিকে হাত নাড়ছে।সবাই বলছে একসাথে “তুই পেরেছিস শেষ পর্যন্ত”।এই কথা শেষ হওয়ার সাথে আমার ঘুমটা ভেঙ্গে গেল।
ঘুম থেকে উঠার পর দেখি ভাবী,মা,ভাইয়া সবাই আমার পাশে দাড়িয়ে।মা আমার মাথায় হাত রেখে কান্না করছে।ভাবী চুপচাপ দাড়িয়ে।আমি বুঝলাম আমার সময় প্রায় শেষের দিকে।আমার আর যত অভিমান ছিলো সব নেই হয়ে গিয়েছে হঠাত।আমার হাটতে না পারার কষ্ট,দৌড়াতে না পারার কষ্ট,মন খুলে কোন কারণে হাসতে না পারার কষ্ট,সবার সাথে খেলাধুলা করতে না পারার কষ্ট,কোন প্রেয়সী না থাকা,মনের কথা গুলো কাউকে না বলতে পারা,কেউ জড়িয়ে ধরে বলেনা সব ঠিক হয়ে যাবে তার কষ্ট, “তুই আমাদের মুখ উজ্জ্বল করেছিস” এই কথাটা শুনতে না পারার কষ্ট,বাবার মুখে হাসি না দেখার কষ্ট,বন্ধুদের কাছ থেকে পাওয়া নীরবতার কষ্ট,ভাইয়া-ভাবীর সাথে কোনদিন বেড়াতে না যাওয়ার কষ্ট,সারাটাদিন বিছানায় একভাবে পড়ে থাকা,দূরে আটকা পড়ে থেকে অন্যদের এগিয়ে যাওয়া দেখার যে কষ্ট ও অভিমান ছিলো তা নিমেষেই চলে গেলো এক ছোট স্বাপ্নিক অনুভূতির কাছে দুঃখ-অভিমানের পরাজয় টা আমার কাছে অবাক করা লাগলো।ছোট-ছোট ব্যাপারগুলো যে আসলে কতটা তাৎপর্যপূর্ন সেটা বুঝলাম আজ।সবকিছুরই একটা মানে আছে,এই পৃথিবী।অভিমান-কষ্ট দিয়ে আনন্দগুলোকে মেরে ফেলতে দেওয়া যায়না…এই ছোট জীবনে।
এখানেই শেষ করলাম।আমার আবার ঘুম পাচ্ছে।খুব ঘুম পাচ্ছে।আমি ঘুমাবো…এটাই মনে হয় আমার শেষ ঘুম………………………………………