তখন আমি ২য় শ্রেণিতে পড়ি। বাবার চাকুরির সুবাদে আমরা কোয়াটারে থাকি। নিচতলায় আঙ্কেলের ছোট বোন এসেছে বেড়াতে। আঙ্কেলের নাম মনে নেই। আমি আমাদের বাসায় তিনতলার বেলকোনী থেকে দেখেছিলাম নতুন মেয়েটিকে। তারা বাগানে গোল্লাচুট খেলছিল। মেয়েটিকে প্রথম দেখেই আমি একদম ফিদা হয়েগিয়েছিলাম। তারপর থেকে হয় জানালা না হয় বেলকোনীতে দাড়িয়ে শুধু অপেক্ষা করতাম কখন সে বাগানে আসবে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, বাগানটি ছিল তাদের ব্যক্তিগত। ইচ্ছা করলেই যেকেউ ঢুকতে পারবে না। তাই আমিও পারি না। রাতে ঘুমাতে খুব কষ্ট হত। শুধু এপাশ ওপাশ করতাম। আর শুধু মেয়েটির হাসির শব্দ ও সেই হাসির অপরূপতা কল্পনায় আমাকে বিমোহিত করত। ভাবলাম, না! এভাবে থাকা যায় না। মেয়েটির নাম জানতে হবে। কমপ্লেক্সের ছোট খেলার মাঠেটিতে বিকাল বেলা বসে ছিলাম। আরো অনেক ছেলেমেয়েরা খেলাধুলা করছিল। হঠাৎ দেখি সেই মেয়েটি তার ছোট ভাইপো-কে নিয়ে মাঠের এককোনে বসে আছে। আমি কাছে যেতে সাহাস চাচ্ছিলাম না। পাশের বাসার আরেকটি মেয়ে তাকে খেলতে ডাকতে শুনলাম। আর তখনই জানলাম ওর নাম রোকসানা। এভাবে প্রতিদিন। দিনের পর দিন আর রাতের পর রাত। কি করব কিছুই ভেবে পাচ্ছিলাম না। আমি আবার ছোট বেলা থেকেই একটু ভিন্ন স্বভাবের। এসব পারসনাল বিষয়ে তৃতীয় কাউকে জড়াতাম না। একটি চিঠি লিখে বেশ কিছুদিন থেকে পকেটে নিয়ে বেড়াচ্ছি। কিন্তু দিতে সাহস হয় না। কি লিখেছিলাম অত মনে নেই। তবে একটা কথা মনে আছে যে, ভালবাসার বহিপ্রকাশ ছিল একদম খোল্লামখোল্লা। ২য় শ্রেণির ছাত্রের প্রেমপত্র, হা..হা..হা..হা…….। সেও আমাদের স্কুলে ১ম শ্রেণিতে ভর্তীি হল। একদিন সাহস করে বিকাল বেলা মাঠে লোকচক্ষুর অন্তরালে প্রেমপত্রটি ওর হাতে দিয়েই দৌড় দিয়ে পালালাম। অনেক দুর গিয়ে পিছন ফিরে ওর দিকে তাকালাম। ওকে দেখে আমি অবাক। সে আগের মতই একদম সাবলিল ভঙ্গিতে বসে আছে। কিছু যে একটা হয়েছে তার কোন চিহ্নই নেই। আমার কাছে বিষয়টা বিভ্রান্তিকর মনে হল। সত্যিই কি আমি চিঠিটি দিয়েছি নাকি মনের ভুলে দৌড়াচ্ছি। সেদিন সারারাত অঘুম। যাক পরের দিন আবার যথারীতি আমি মাঠে বসে আছি। অনেক ছেলেমেয়েরা ছুটাছুটি করছে। সেও এককোনে বসে আছে তার ভাইপো সহ। হঠাৎ মাঠে একটা হট্টগোল। সবছেলেমেয়েরা একসাথে জমে আছে। আমারও সেদিকে মনোযোগ। আমার দেহটা হঠাৎ নিথর নিস্তব্ধ হয়ে গেল। হাত-পা নাড়াতে পারছিলাম না। কয়েক মুহুর্ত পর অনুধাবন করতে পারলাম কেউ আমাকে স্পর্শ করেছে। হাতে এক টুকরো কাগজ আবিষ্কার করলাম। হুস হলে এপাশ ওপাশ তাকালাম। দেখি রোকসানা দৌড়ে মাঠের মাঝখানে যাচ্ছে আর আমার দিকে পিছন ফিরে তাকাচ্ছে। সে মাঠে ছেলেমেয়েদের জটলার মধ্যে ঢুকে গেল। আমি কাগজের টুকরাটা নিয়ে এক দৌড়ে ছাদে উঠে পড়তে শুরু করলাম। কি লিখা ছিল মনে নেই। কিন্তু প্রেম আবেদন গ্রহণ করেছিল খোল্লামখোল্লা তাই লেখা ছিল এটুকু বলতে পারি। আমার আজও মনে আছে সেই হলুদ রঙের চিঠিটার কথা। ততক্ষণে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। মাঠে আর ছেলেমেয়েদের দল নেই। আমার বাসায় ফিরে যেতে ইচ্ছা করছিল না। ইচ্ছা করছিল কোথাও হারিয়ে যাই। কিন্তু বাসায়তো সময়মত ফিরতেই হবে নইলে আম্মা পিঠের চামড়া তুলে ফেলবে। সেদিন বাসায় ফিরে আমার প্রচন্ড জ্বর হল। আব্বা তাড়াতাড়ি ঔষধ আনলেন। জ্বরে একদম অচেতন। কোন কিছুই মনে নেই। সকালে উঠে একদম সুস্থ। আমার মনেই হচ্ছিল না যে গতরাতে আমার এমন অবস্থা হয়েছিল। স্কুলে যাইনি। সারাদিনমান শুধু তাকে নিয়েই ভাবনা। সারাদিন বেলকোনীতে দাড়িয়ে থাকলাম কিন্তু ওর দেখা পেলাম না। বিকালে মাঠেও আসেনি। বাসায় ফিরে আবার গতদিনের মত জ্বর হল। পরদিন সকালে আবার আগের দিনের মত ফুরফুরা। এই দুই তিন দিন খাওয়া-দাওয়া সবকিছুতে অরুচি। বিকালে যথারীতি মাঠে গেলাম। মাঠের এককোনে রোকসানা তার ভাইপোকে নিয়ে বসে আছে। কিন্তু ওকে খুব দুর্বল দুর্বল লাগছে। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। বাসায় ফিরে যাচ্ছে সবাই। শুধু সে আর আমি মাঠে বসা। সে আমার কাছে এসে বসল। আমার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গলা শুকিয়ে যাচ্ছিল। সে বলল, সেদিন যখন সে আমাকে চিঠিটা দিতে এসেছিল তখন তার ভাইপো মাঠে পড়ে গিয়ে পা কেটে গিয়েছিল। বাসায় যাওয়ার পর তার ভাই ও ভাবি তাকে অনেক মেরেছে। তার কথা শুনে আমি কেদেই ফেলেছিলাম। সে আমার চোখের জল মুছে দিয়ে বাসায় যেতে তাগাদা দিচ্ছিল। এভাবে প্রায় মাস দুই/তিন। আমার আজও মনে আছে, অপরিপক্ষ বয়সে এক পরিপক্ষ প্রেমের কথা। হঠাৎ একদিন থেকে সে আর মাঠে আসে না। আমিতো অস্থির। খবর নিয়ে জানতে পারলাম, সে বাড়িতে চলে গেছে, আর আসবে না। তার ভাই-ভাবি ওকে প্রায়ই খুব মারধর করত। আমার খুব কষ্ট হত। সে আমাকে প্রায়ই তার গায়ে মারের দাগ দেখাত আর আমি কান্না ধরে রাখতে পারতাম না। সে প্রায়ই বলত বাড়িতে চলে যেতে চায় কিন্তু আমার টানে নাকি যেতে পারে না। সেই দুই/তিন মাসের প্রেম। আহ! আমার জীবনের প্রথম প্রেম। তারপর………। তারপরের কাহিনী আরো করুণ। আমার নাওয়া-খাওয়া বন্ধ, সবকিছুতে অনিয়ম। যেদিকে তাকাই শুধু খালি খালি লাগত। এভাবে বিরহে বিরহে আমি অসুস্থ্য হয়ে পরলাম। পেটে খিদা থাকা সত্বেও কিছু খেতে পারতাম না। রাতে ঘুম আসে না, শুধু ছটফট করি। আম্মা-আব্বা খুব টেনশনে পরে গেল। আমার কি হয়েছে? এভাবে মাস ছয়। একদিন আব্বা ডাক্তারের কাছে নিল। ডাক্তার কয়েকটা টেস্ট করতে দিল। টেস্ট-রেজাল্ট দেখে ডাক্তার বলল আমার নাকি জন্ডিস হয়েছে। ওহ! সে কি অবস্থা। আমি প্রায় মৃত্যুর মুখে ঢলে গিয়েছিলাম। কিছুতেই রোকসানাকে মন থেকে সরাতে পারছিলাম না। যখন খুব বেশি অসুস্থ্য হয়ে গেলাম তখন বাসায় প্রায় কান্নাকাটি তখন একদিন খবর পেয়ে আমার দাদি আসলেন। দাদি আমাকে কোলে নিয়ে সেকি কান্না। দাদী আমাদের বাসায় অনেকদিন ছিল। দাদির মায়া-মমতায় ধিরে ধিরে রোকসানার স্মৃতিগুলো ফিকে হতে শুরু করেছিল আর আমিও ধিরে ধিরে সুস্থ্য হতে থাকলাম। সেই আমার প্রথম প্রেম। মাঝে মাঝে হাসিও পায় আবার মাঝে মাঝে মনের গহিনে আজও তাকে খুঁজি। এছাড়া আমার আর কিইবা করার আছে। আমি জানি না সেই ছোট্ট বেলার রোকসানা আজ কোথায় আছে, কেমন আছে। প্রার্থনা করি যেখানেই থাক ভাল থাক।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
কাজী জাহাঙ্গীর
হা হা হা... ঐশ্বরিক বটে, ২য় শ্রেণীর ছেলের প্রেম ! অনেক শুভকামনা আর আমার পাতায় আমন্ত্রণ।
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।