-১-
আমি সুতপার সাথে ধরে আম বাগানে লুকোচুরি খেলছি। মাথার উপরে সবুজ পাতার ক্যানোপি। সে কোন একটা আম গাছের আড়াল থেকে আমার নাম ধরে ডাকল। আমি এদিক ওদিক তাকিয়ে, পা টিপে টিপে এক গাছ থেকে আরেক গাছে ছুটাছুটি করছি ভীত খরগোসের মত। আকাশ কাল করে কাল বৈশাখীর মেঘ জমছে। বাতাস স্তব্ধ হয়ে আছে। হঠাৎ করে একটা আম পড়ল গাছ থেকে। আমি আর সুতপা ছুটে গেলাম সেটা কুড়াতে। হঠাৎ করে একটা দমকা হাওয়ার ঘূর্ণি আমাদেরকে ছুঁয়ে গেল। বাতাসে পাতা উড়তে লাগল এদিক ওদিক। আমি শূন্য থেকে একটা পাতা ধরার জন্যে ছুটে গেলাম। ''বাবা, বাবা...'', দূর থেকে একটা ডাক ভেসে এলো। কেউ যেন আমার গা ধরে ধাক্কা দিচ্ছে। অনেক কষ্ট করে চোখ খুলে দেখি, আমার দশ বছরের মেয়ে মুনা আমার পাশে বসে আমাকে ডাকছে ''বাবা, বাবা'' বলে। আমি শোয়া থেকে উঠে বসলাম। চোখ কচলে দেখি, মাথার উপর সবুজ গাম ট্রির পাতার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিচ্ছে নির্মল নীল আকাশ।
বাবা, উঠ উঠ। সবাই তোমার জন্যে বসে আছে। খাবার দেয়া হচ্ছে। চল, চল। মুখে খই ফোটাল মুনা।
যাচ্ছিরে মা। তুই যা। আমি আসছি। বলতেই মুনা ছুটে চলে গেল ওর বন্ধুদের কাছে।
স্বপ্নটার কথা মনে পড়েতেই নিজের মনে হেসে উঠলাম। কত দিন আগের কথা। প্রায় তিরিশ বছর তো হবে। আজ সেই রামও নেই, সেই অযোধ্যাও নেই। তখন আমার বয়স কত? বোধ হয় নয়-দশ বছর হবে। সুতপা আমার মামাত বোন, চট্টগ্রাম থেকে বেড়াতে এসেছিল আমাদের গ্রামের বাড়ীতে। আমাদের বাড়ীর পেছনে কালীদহের খাল। সেই খালের পারে আমাদের একটা ছোটখাটো আম বাগান ছিল। সেটা ছিল আমাদের ছোটকালের খেলার ঘর। আজ সেই সুতপা কোথায় আর আমি কোথায়। সুতপা প্রায় পনের বছর থেকে আমেরিকার বাসিন্দা। আর, আমারও তো অষ্ট্রেলিয়ায় প্রায় পাঁচ বছর হতে চলল। আমাদের সারা দিন কাটত সেই বাগানে। আজ সেই আম বাগানও আর নেই। আগে আমাদের বাড়ীতে আসতে হলে বর্ষা কালে একটা ছোট সাঁকো পেরুতে হত। আমাদের ছোট চাচা খালের মুখ মাটি দিয়ে ভরাট করে দিলেন আর আমাদের বাড়ী বরাবর মাটি ভরাট করে একটা রাস্তা বাধিয়ে দিলেন। দেখতে দেখতে খালটা সে অংশটুকু ভরাট হয়ে মরে গেল আমাদের চোখের সামনে। আর এদিকে জানি না কি কারণে আম গাছ গুলোও একটা দুটা করে মরা শুরু হল। মরা গাছ গুলো গত তিরিশ বছরে একে একে চলে গেছে চুলার পেটে। সেখানে ছোট চাচারা দুটো ঘর তুলেছেন। আম বাগানের শেষ সাক্ষী হিসেবে এখনো একটা গাছ নিঃসঙ্গ হয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে। মনটা নস্টালজিয়ায় ভারাক্রান্ত হয়ে যায় আম বাগানটাকে ঘিরে। একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে বুকের পাঁজর থেকে। পানির তৃষ্ণা পেয়েছে। পাশে রাখা বোতলটা আলতো হাতে তুলে নিয়ে ছোঁয়াই ঠোঁটে।
বাবা, তুমি এখনো এখানে বসে। আস না। মুনার ডাকে সম্বিত ফিরে পাই আমি। আবার ফিরে এসেছে সে। এবার আর একা না। সাথে এসেছে ওর বন্ধুরা। টিনা, ক্যাথি আর অমিয়।
আসছি রে মা আসছি বলে উঠে দাঁড়াই আমি। হাতের পানির শূন্য বোতলটা পাশের সবুজ ঝোপে ছুড়ে ফেলে এগিয়ে যাই খাবার যায়গায়। পেছনে আসতে থাকে মুনা আর ওর বন্ধুরা।
-২-
আমরা কয়েক জন বন্ধু সপরিবারে পিকনিকে এসেছি। এখন এখানে এখন শীতের শেষ। আমার ছোট বেলার বন্ধু বুলবুল সব আয়োজন করেছে। সাথে আরও এসেছেন আজিম ভাই, পাপ্পু ভাই আর শামীমরা। গত পরশু ঠিক হল, আজ আমরা পিকনিকে যাব। এখানে তো পিকনিক স্পটের শেষ নেই। পার্কে, নদীর আর সমুদ্রের ধারে একটু পরপরই সুন্দর ব্যবস্থা। প্রতি সপ্তাহান্তে অনেকেই বাইরে বেরিয়ে পড়ে। খাওয়া দাওয়ার জোগাড়যন্ত্রের তেমন ঝামেলা নেই। বুচার শপে বার-বি-কিউ'র গোস্ত পাওয়া যায়। গোস্ত কিনে রাতের বেলা একটু মশলা মাখিয়ে রেখে দিলেই হল। পরদিন যাবার পথে কিছু রুটি, প্লাস্টিকের গ্লাস-প্লেট আর আনুষঙ্গিক সরঞ্জাম কিনে পিকনিক স্পটে হাজির হলেই চলবে। সেখানে ইলেকট্রিক বা কাঠের চুলা আছে, হট প্লেট বসানোই আছে। সেখানে বার-বি-কিউ করে শুধু গোস্ত কিংবা রুটি দিয়ে গরম গরম খাওয়া। সেটার মজাই আলাদা।
আমরা সবাই বেলা এগারটার দিকে পিকনিক স্পটে এসে হাজির হলাম। আজিম ভাই বার-বি-কিউ এক্সপার্ট। আমি ওনার সাথে চুলা ধরানোর কাজে লেগে গেলাম। বাচ্চারা মতে উঠলো খেলায়। বুলবুল হল তাসের পোকা। সে, পাপ্পু ভাই, শামীম আর ওর বউ তিন্নি বসে পড়ল তাস খেলায়। পাপ্পু ভাই এর স্ত্রী মীনা ভাবী আর আমার গিন্নি থাকল বাচ্চাদের তদারকিতে আর আজিম ভাবীর সাথে সালাদ কাটায়। চুলা ধরানো হয়ে গেছে। আজিম ভাই একাই একশ। আমার করার কিছু নেই বলে তাসের দলের কাছে এসে বসলাম খানিক টা। দেখলাম, খেলা বেশ জমে উঠেছে। ভাবলাম, ঘুরে ফিরে একটু দেখি আসি চারপাশটা।
নিপিয়ান নদীর তীরে আমাদের পিকনিক স্পট। এ নদীটা হল অষ্ট্রেলিয়ার বড় নদীগুলোর একটা। নদীর জল দেখে প্রাণটা জুড়িয়ে গেল আমার। কি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন চারিদিক – যেন ছবির মত সাজিয়ে রাখা। আশে পাশে অনেক লোক; সবাই এসেছে পিকনিক করতে। কেউ ছবি উঠাচ্ছে, কেউ খেলছে, কেউ নদীর ধার ধরে হেটে চলেছে। পার্কের আশে পাশে অনেক পায়ে হাটার রাস্তা আছে। বনে হাটা অনেকের হবি; তারা দল বেঁধে মাইলের পর মাইল হাঁটেন এসব রাস্তায়। আমি একটা গাছের নীচে বসে পড়লাম। গাছের ফাঁক দিরে রোদ পড়েছে। বেশ ভালই লাগছে শেষ শীতের মধ্যাহ্নের রোদ। হাতের তালুতে মাথা রেখে কাত হয়ে শুয়ে পড়লাম গাছের নীচের সবুজ ঘাসে। মনে হল, আমার শৈশবের সেই কালীদহ খালের পাশে শুয়ে আছি। ধীরে ধীরে ফিরে গেলাম অতীতে। ভাবতে ভাবতে কখন যে চোখ দুটো ঘুমে জড়িয়ে এলো টেরই পেলাম না। সেই ঘুম ভাঙ্গল মুনার ডাকে।
তুমি ঘুমাতে এসেছ না পিকনিক করতে এসেছ? দলের বাকীদের কাছে ফিরে যাবার সাথে সাথে গিন্নি চৈতীর প্রশ্ন।
বলবেন না আর ভাবী। ওকে নিয়ে এই এক সমস্যা। আমি উত্তর দেবার আগেই বলে উঠে বুলবুল। যেখানেই যাবে, ও ঘুমাবে। আপনি তো ওকে দেখছেন বার বছর ধরে, আর আমি ওকে চিনি সেই ছোট কাল থেকে। একবার ক্লাস নাইনের পরীক্ষার সময় প্রশ্ন পত্র আসতে দেরী হচ্ছিল। স্যার সবাইকে চুপচাপ বসে থাকতে বলে টিচারদের কমন রুমে গেছেন। আধা ঘণ্টা পরে প্রশ্ন নিয়ে এসে দেখেন, বাবাজী বেঞ্চির উপর মাথা রেখে নাক ডাকিয়ে ঘুমাচ্ছে।
সবাই হেসে উঠল বুলবুলের কথা শুনে।
আমরা তাস খেলতে বসলাম একটু আর আপনি কেটে পড়লেন। আমাকে লক্ষ্য করে বললেন পাপ্পু ভাই।
আমিতো তাস খেলা জানি না। আমতা আমতা করে বললাম আমি। তাই ভাবলাম, একটু এদিক ওদিক ঘুরে দেখি।
তুমি হলে একটা ফাঁকিবাজ। আজিম ভাই 'এর সাথে তোমাকে দেওয়া হল ওনাকে সাহায্য করার জন্য। আর তুমি কাজ কর্ম ফেলে দিব্যি ঘুমিয়ে পড়লে। চৈতী খোঁচা দিল আমাকে। যাও, চুলা পরিষ্কার করতে ওনাকে একটু সাহায্য কর।
গিন্নীর কথায় আমি আজিম ভাই 'এর কাছে এলাম। যার যার রান্না হয়ে গেলে চুলোর হট প্লেট পরিষ্কার করে রেখে যাবার একটা অলিখিত নিয়ম আছে সব পার্কে। আমি আজিম ভাই 'এর সাথে হাত লাগালাম। উনি খুন্তির মত একটা জিনিষ দিয়ে হট প্লেটে লেগে থাকা পোড়া মশলাগুলো তুলতে লাগলেন। আমি তার উপর গরম পানি ঢেলে ধুতে লাগলাম। দেখতে দেখতে চুলোটা আগের মত পরিষ্কার হয়ে গেল।
খাবার দেয়া হয়েছে, আসুন সবাই। ডাকলেন আজিম ভাবী।
ঘাসের উপর মাদুর বিছিয়ে সুন্দর ব্যবস্থা। আমরা সবাই বসে পড়লাম খেতে।
-৩-
খেতে খেতে মনটা বারবার পেছনে ছুটে যেতে লাগল। আমাদের বাড়ীতে কত গাছ-পালা ছিল। আমাদের অযত্নে প্রায় সব নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। আমাদের দেশের পলি মাটি কত উর্বর। পানির অভাব নেই। গাছ লাগালেই তরতর করে বেড়ে উঠে। অথচ আমাদের কত অবহেলা। অথচ এখানে পানির কত অভাব। বৃষ্টি হয়না বললেও চলে। আর, পাথরের মত শক্ত মাটি। তবুও ওরা কত কষ্ট করে চারিদিক সবুজ করে রেখেছে। বাতাসে থাকলে যেমন বাতাসের মর্ম বুঝা যায় না, তেমনি আমরা সবুজের মধ্যে থাকি বলে সবুজের মর্ম বুঝে উঠতে পারি না। এখানে কত কম বৃষ্টি হয়। তবু নদীর পানি কেমন টলটলে। অথচ আমাদের দেশে প্রতিবছর হিমালয় থেকে স্ফটিকের মত স্বচ্ছ পানি নামে। সেই পানি বুড়িগঙ্গায় আসতে আসতে কয়লার রঙ হয়ে যায়।
এসব ভাবতে ভাবতে খাওয়া শেষ হল। খাওয়ার পর আমরা সবাই দল বেধে নদীর কিনার ধরে হেটে আসলাম। শীতের বিকেলের ছায়া দীর্ঘ হতে শুরু করেছে। চা পর্বের পর শুরু হল ফুটবল খেলা। পিকনিকের অন্য গ্রুপ থেকেও কয়েকজন আমাদের সাথে খেলায় যোগ দিল। খেলা চলতে চলতেই বিকাল হয়ে এলো। এবার ঘরে ফেলার পালা।
সপ্তাহের শেষের ছুটির দিনে এই পিকনিক স্পটে শত শত লোক আসে। এখানে পরিষ্কার করার জন্য কোন ক্লিনার নেই। ঘরে ফেরার সময় সবাই নিজের নিজের যায়গাটা পরিষ্কার করে যায়। আমরাও আমাদের যায়গাটা পরিষ্কার শুরু করলাম। মুনা, টিনা, ক্যাথি আর অমিয় মহা উৎসাহে পরিষ্কার করার কাজে লাগল। তারা এখানে সেখানে ছড়ানো গ্লাস, প্লেট, টিস্যু তুলে ডাস্টবিনে ফেলল। দেখতে দেখতে যায়গাটা ঝকঝক করে উঠল।
সূর্য প্রায় ডুবুডুবু। যায়গাটায় অন্ধকার নেমে এসেছে। সবাইর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চৈতী আর মুনা গাড়ীতে উঠে বসেছে। আমিও গাড়ীতে উঠতে যাব, এমন সময় গাড়ীর দরজা খুলে মুনা নেমে এলো।
বাবা, একটু অপেক্ষা কর; আমি এক্ষুনি আসছি। বলে মুনা নদীর দিকে ছুটে গেল।
ও কি বাথরুমে গেল? চৈতীর উৎকণ্ঠিত প্রশ্ন।
না, বাথরুম তো অন্যদিকে। দেখি তো সে কোথায় গেল, বলে আমিও ওর গমন পথের দিকে এগিয়ে গেলাম।
দূর হতে দেখলাম, একটা ঝোপের মধ্যে উপুড় হয়ে মুনা কিছু করছে। আস্তে আস্তে ওর কাছে এগিয়ে গিয়ে দেখি, মুনা ঝোপের গাছপালার মাঝ থেকে সে কিছু একটা উঠাতে চেষ্টা করছে। আরও কাছে গিয়ে দেখি, ঝোপের মাঝখানে আমার ছুড়ে ফেলা বোতলটা পড়ে আছে। মুনা প্রাণপণে সেটা ধরার চেষ্টা করছে। কিন্তু ওর ছোট হাত দুটো সেখানে পৌঁছচ্ছে না। আমি মাটিতে শুয়ে পড়ে পানির শূন্য বোতলটা এনে ওর হাতে তুলে দিলাম।
ও বোতলটা নিয়ে ছুটে গিয়ে ডাস্টবিনে ফেলে আমার কাছে ফিরে এলো।
''ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বালি কণা, বিন্দু বিন্দু জল / গড়ে তোলে মহাভূমি, সাগর অতল'' কথাটা হঠাৎ করেই মনে পড়ে গেল। আমাদের ছোট ছোট ভুল গুলো জমা হতে হতে অনেক বড় ভুল হয়ে যায়। তখন আর শোধরানোর উপায় থাকে না। সবাই যদি আমার মত একটু একটু করে ভুল করে ঝোপে ঝোপে এটা সেটা ফেলে যেত, তবে এই পিকনিক স্পটের সবুজও আমার ফেলে আসা আম বাগানের মত উধাও হতে দেরী লাগত না
সরি মা, আমার ভুল হয়ে গেছে। বলে আমি মুনাকে জড়িয়ে ধরে গাড়ীর দিকে এগিয়ে গেলাম।
০৭ ফেব্রুয়ারী - ২০১১
গল্প/কবিতা:
৩৫ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪