পলাতক

মা (মে ২০১১)

আহমেদ সাবের
  • ৪১
  • 0
  • ৩৩
আমার ছোট ভাই রিপনের পালানোর স্বভাবটা নতুন নয়। এর আগেওে সে পালিয়েছিল দু বার। প্রথম বার, সেই আট বছর বয়সে। ওর তখন একটা পোষা বেড়াল ছিল; আর ওটা ছিল মহা চোর। যত খাবারই দেয়া হোকনা কেন, চুরি সে করবেই। একবার চুরি করে পাতিল থেকে দুধ খেয়েছিল বলে, মা বেড়ালটাকে মেরেছিলেন। মায়ের উপর রাগ করে বাড়ী থেকে পালিয়েছিল সে। যাবে আর কোথায়? মোল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্ত। পালিয়ে ছোট খালার বাড়ী চলে গিয়েছিল পাশের গ্রামে, তিন কিলোমিটার পথ ডিঙ্গিয়ে। খবর পেয়ে পরদিন বাবা ওকে নিয়ে আসেন।

পরের বছর আবার পালিয়েছিল সে। আমরা দু ভাই একই স্কুলে পড়তাম। ওর তৃতীয়, আর আমার পঞ্চম শ্রেণী। গ্রামের প্রাইমারী স্কুল; বেশীর ভাগ ক্লাস, পরীক্ষা – একসাথেই হতো। ফাইন্যাল পরীক্ষার সময় পরীক্ষার খাতার চেয়ে নিসর্গের প্রতি ওর অধিকতর মনোযোগ দেখে আমার সন্দেহ হয়েছিল, এবারও কিছু একটা ঘটবে। আমার সন্দেহের কারণে হোক, কিংবা অন্য কোন কারণেই হোক, যেদিন পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হলো, সে দিন বিকেল থেকেই রিপন লা-পাত্তা। এক দিন যায়, দু দিন যায়, কোন খবর নাই। মা প্রথম দিন প্রকাশ্যে বেশ কিছু কাঠিন্য দেখালেও, পরদিন সেটা আর ধরে রাখতে পারলেন না। ভোর থেকেই কান্নাকাটি শুরু করে দিলেন। মায়ের কান্না, কিংবা সন্তানের প্রতি মমত্ববোধ থেকেই হোক, বাবা ক্ষেতের কাজ ফেলে বেরিয়ে পড়লেন রিপনকে খোঁজার জন্য। আমার উপরও দায়িত্ব পড়লো, কাছাকাছি যায়গা গুলো সন্ধান করার। বেশ রাত করেই ফিরলেন বাবা। মুখ দেখেই বুঝলাম, কোন সুসংবাদ নাই।

পরদিন সকালে বাবা বসে বসে ভাবছিলেন, এর পর কি করনীয়। বড় চাচাও পাশে বসে। মা আমাদের পড়ার ঘরের এক কোনে বসে গুন গুন করে কাঁদছিলেন।
চিন্তা কইরা কি করবি সালাম। বাবাকে উদ্দেশ্য করে বললেন বড় চাচা। পোলাপান মানুষ; কই আর যাইবো? হয় মামা, না হয় খালার বাড়ী। দুই একদিনের মধ্যেই খবর পাইয়া যাইবি।
সব মামা খালার বাড়ী খবর নিছি। কোনহানেও যায় নাই। বাবা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উত্তর দেন।
চেয়ারম্যান সাবের বাড়ীত গেলে কেমন হয়? তাইনে একখান পথ বাতলাইয়া দিতে পারবো। বড় চাচার প্রস্তাব।
ভাবছি যামু। বাবা সম্মতি দেন।
ল, এখনি যাই। দেরী হইলে তাইনে গঞ্জে চইলা যাইবো। বলে বাবাকে তাড়া দেন বড় চাচা।

বাবা ঘরে ঢুকে গামছাটা মাথায় পেঁচিয়ে বেরুতেই দেখা গেল, আমাদের গ্রাম সুবাদে আসমত চাচার হাত ধরে, উঠানের মাঝখানে মাটির দিকে মাথা ঝুঁকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রিপন। বাবার মুখ রাগে কঠিন হয়ে উঠলো। উনি কিছু একটা অঘটন ঘটাবার আগেই, মা এসে জড়িয়ে ধরলেন রিপনকে। আর রিপন সবার সামনে হাউ মাউ করে কেঁদে উঠলো। রিপনের কান্নাটা বাড়ীতে ফেরার আনন্দের, না বাবার মারের ভয়ের, সেটা বুঝে উঠতে পারলাম না।

আসমত চাচা গঞ্জের পাটকলে কাজ করেন। ওনার বয়ানে জানা গেলো, গতকাল সন্ধ্যের সময় পাটকলের দু নম্বর গেইটের বাইরে, রিপনকে দেখতে পান তিনি। সে আমাদের গ্রামের ষ্টেশন থেকে ট্রেনে উঠে পড়েছিল নিরুদ্দেশ যাত্রায়। পরের ষ্টেশনে রেল পুলিশ দেখে, ভয়ে নেমে পড়েছিল। সাথে টাকা পয়সা কিছুই ছিলনা বলে দু দিন ধরে ছিল অভুক্ত।

এবার পালালো সে তিন বছর পর। সময়ের হিসেবে তিন বছর অতিক্রম করলেও, ক্লাসের হিসেবে সে প্রায় বৃক্ষের মতই স্থাণু। প্রাইমারী স্কুলের গণ্ডি পেরুতে পারেনি এখনো। এদিকে আমি সপ্তম শ্রেণীতে উঠে গেছি। বাবা বুঝে ফেলেছেন, ওকে দিয়ে আর লেখা পড়া হবে না। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, ওকে স্কুল থেকে ছাড়িয়ে ক্ষেতের কাজে লাগিয়ে দেবেন। রিপন ভাল মন্দ কিছু বললো না। একদিন দেখা গেল, সে আবার লা-পাত্তা। আমরা সবাই ধরে নিয়েছিল, অন্য বারের মত এবারও তার খবর পাওয়া যাবে। দেখা যাবে, একদিন কাক ডাকা ভোরে কাচু মাচু মুখ করে উঠানের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে সে।

দেখতে দেখতে বছর ঘুরে গেল। না সে আর ফিরে এলো না। এর মধ্যে স্থানীয় খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেয়া হয়েছে। পুলিশে খবর দেয়া হয়েছে। গ্রামের বাজারে মাইকিং করা হয়েছে। কিন্তু কোন ফল হয়নি। মাঝে মাঝে উটকো খবর আসে, রিপনকে অমুক যায়গায় দেখা গেছে। তমুক ষ্টেশনে দেখা গেছে। মা আমাদের গ্রামের পীরের দরগায় যাওয়া শুরু করলেন। দরগার খাদেম বলেছেন, রিপন আরব দেশে আছে। ভাল আছে। মায়ের কান্না ধীরে ধীরে কমে এলো। আমি ভেবেছিলাম, মা বোধ হয় রিপনের শোকটা সামলে উঠতে পেরেছেন। কিন্তু আমার ধারনা ভুল প্রমাণিত হলো শেষ পর্যন্ত।

আমার সপ্তম শ্রেণীর ফাইন্যাল পরীক্ষার ফলাফল দিয়েছে। গত দু বছর দ্বিতীয় স্থানে থেকে এবারে প্রথম বারের মত ক্লাসে প্রথম হয়েছি। বাড়ীতে আসতেই আনন্দের হাট বসে গেল। বাবা চাচা, চাচী সবাই খুশীতে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। কিছুক্ষণ পরে মায়ের কথা খেয়াল হলো। আরে, মা কই। কিন্তু মাকে আশে পাশে কোথাও দেখতে পেলাম না। আমি রান্না ঘরে গেলাম। না, মা সেখানে নাই। উঠানের কোথাও মাকে দেখা গেলো না। আমার এত বড় একটা আনন্দ সংবাদ। আর মা আমাকে একটু আদর করলেন না। আমার একটু অভিমানই হলো।

আমাদের বসত ঘরের এক পাশটা বেড়া দিয়ে আমার আর রিপনের পড়ার যায়গা করা হয়েছে। আমি সেখানে যেতেই দেখি, মা মাটিতে বসে রিপনের স্কুলের ব্যাগটা বুকে চেপে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে যাচ্ছেন।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
এস, এম, ফজলুল হাসান আমার দৃষ্টিতে মা সংখ্যার সেরা গল্প-কবিতা গুলি হলো (১) প্রথম : # সাত মা # লেখক : মামুন ম.আজিজ , (২) দ্বিতীয় : # ভিখারিনী মা # কবি : Oshamajik , (৩) তৃতীয় : # আমার ভালোবাসার ফুল মায়ের হাতে দেব # কবি : মোহাম্মদ অয়েজুল হক জীবন , (৪) চতুর্থ : # মা # কবি : Khondaker Nahid Hossain , (৫) পঞ্চম : # ২০০০০০০০৯৭ সালের মা # লেখক : মাহাতাব রশীদ (অতুল) , আমার দৃষ্টিতে বিজয়ীদের বলছি , " আপনারা গল্প-কবিতা থেকে বিজয়ী হবেন কিনা তা জানি না তবে , আমার অন্তর থেকে রইলো আপনাদের জন্য বিজয়ী শুভেচ্ছা , ধন্যবাদ সকলকে " ,,
শাহ্‌নাজ আক্তার চমত্কার একটি গল্প , কিন্ত ফিনিশিং টা তে মন টা ভরলোনা, আহারে ..... খুব ভালো I
আহমেদ সাবের ojhor dhara - ছোট গল্পের কি পরিনতি থাকে? এ তো জীবন নদীর একটা বাঁক মাত্র। এর আদি নেই, অন্ত নেই।
সোশাসি খুব সুন্দর >..............
ojhor dhara সত্যি অসাধারন চোখে পানি এসে গেল । রিপনের শেষ পরিনতি জানতে খুব ইচ্ছে হচ্ছে । ২য় খন্ড পাব কি? পাঠক হিসাবে লেখকের কাছে চাওয়া ।
প্রজ্ঞা মৌসুমী সাবের ভাই লেখা পড়ে একদম ইমোশনাল হয়ে গেলাম। রিপনের উপর ভারী রাগ,, আগ্রহ দুটোই হচ্ছে। কেন এমন পালিয়ে যাওয়া। ঘরছাড়া ছেলের মন না পারছে বাবা-মা বুঝতে, না পারছে সে বাবা-মার মন বুঝতে। একটা অদৃশ্য দেয়াল। একপাশে মায়ের বিষন্ন মন। আপনি খুব সুন্দরভাবে প্রকাশ করলেন। আপনার লেখার প্রসার কামনা করছি। সামনে আরো লেখা পাব আশা করি।
শিশির সিক্ত পল্লব আচ্ছা আঙ্কেল,এটাকি আপনার বাস্তব জীবনের.....যদি হয়ে থাকে তো বলবেন রিপনকে পাওয়া গিয়েছিল কিনা আর।.... গল্পটা সুন্দর....ভোট করলাম
kolin মন দিয়ে লিখা বুঝায় যাচ্ছে.
লক্ষীছাড়া নিস্সন্দেহে আপনার লেখার হাত আছে, এটা আমাকে স্বীকার করতেই হবে, সামনে আরো ভালো ভালো লেখা আশা করি l

০৭ ফেব্রুয়ারী - ২০১১ গল্প/কবিতা: ৩৫ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪