চট্টগ্রামের বাঁশখালির উপজেলার প্রেমাশিয়া গ্রামের ছেলে ফরহাদ । পাঁচ বছর আগে বিক্রমপুরের লৌহজংয়ে মামার বাড়ি বেড়াতে এসেছিল। হঠাৎ সেখানেই মামাতো বোন শিউলির সাথে তার তুমুল প্রেম হয়ে যায়। শিউলি তখন মাত্র এইচ এস সি পরিক্ষা দিবে। ভরা বর্ষায় মামাতো ভাইকে সাথে নিয়ে পদ্মা নদীর পাড়ে বসে ঢেউ দেখে।কলেজে যেতে মন চায় না। নদীর বাতাসে এক সাথে মন ডুবিয়ে শুধু ঢেউয়ের খেলা দেখে । সীমাহীন নীরবতায় থাকা পদ্মার অভিমানী ধ্বংস দেখে ।দুকুল নিয়ে শুধু ভাঙ্গনের খেলা।তারপর ও পদ্মার ভেতরে বেঁচে থাকার কি অপার স্বপ্ন খেলে যায় । নিদারুন মায়া মমতার তীরের মানুষ জনের জীবন কে আগলে রেখেছে । এই পদ্মার সাথে তীরের লোকজনের এক ঐশ্বর্যময় ঐশ্বরিক প্রেমের সম্পর্ক । মানুষ এতো ভাঙ্গন দেখে তার পর ও নদী তীর ছেড়ে যায় না । এই নদীর স্রোত থেকে ভেসে আসা সুর ।নদীর কুল জুড়ে অনাবিল মিষ্টি হাওয়া । সব যেন মানুষ কে স্বপ্নাতুর করে রাখে ।
মানুষের জীবনে প্রেম বড় অদ্ভুত। কখন ও আলোতে জ্বলতে থাকে। কখন ও আঁধারে হাটে নিরবে।চারিদিক থৈ থৈ পানি।ভেসে যাচ্ছে নিত্যকার সুখের সাথে হাহাকার ও। আজ হতে কয়েক বছর আগে এমন ভরা বর্ষায় ফরহাদের প্রেমের সাগরও ভরে উঠেছিল।একুশ বছরের ফরহাদ কাজের খোঁজে বিক্রমপুর মামার বাড়ি এসেছিল।তখন মামার টানাপোড়েনের সংসার। পদ্মা নদীর পাড়ে ছোট একটা চা এর দোকান। বর্ষা শুরু হওয়াতে লোকজন তেমন একটা নদী পাড়ে আসে না।চা ও বিক্রি হয় না। এদিকে পদ্মা নদীর বুকে ভয়ংকর উত্তাল ঢেউ।
মাঝে মাঝই সে ঢেউ ফরহাদের বুকের ভিতরে এসেও আঘাত করে যায় । বুকের কোন একটা জায়গা চৌচির করে দিয়ে যায়।ফরহাদকে মামী কোন ভাবেই সহ্য করতে পারে না। ফরহাদ সব বুঝতে পারে। ফরহাদ কে চলে যাওয়ার জন্য দিন রাত মামাকে উৎপীড়নের মধ্যে রাখে।ফরহাদ সব সহ্য করে থেকে যায় শুধু পেটের ক্ষুধার জন্য নয় । মনের গোপন জায়াগায় শিউলির জন্য জমে উঠা গভীর ভালোবাসার জন্য । ফরহাদের সেই দুর্দশার সময়ে শিউলির মায়া ভরা চেহারাটা আর যত্নই ফরহাদকে বাঁচিয়ে রেখেছিল ।
একদিন এক কাপড়ে ফরহাদ কে বিয়ে করে বাঁশখালীর প্রেমাশিয়া গ্রামে এসে নতুন জীবন গড়েছিল ।বঙ্গোপসাগর এবং সাঙ্গু নদীর মিলনস্থলে অবস্থিত গ্রাম প্রেমাশিয়া । এই গ্রামে এসে নতুন করে স্বপ্ন দেখা শুরু করে । কতো অভাব অনটন ,ঝড় ঝাঁপটা আর ছোট ছোট সুখ গুলো সঙ্গী করে ফরহাদের হাতটা ধরে রেখেছিল ।এক মুহূর্তও কোথাও যায়নি । অথচ বিয়ের অনেক বছর হয়ে গেলেও তাদের ঘরে সন্তান ছিল না । তা নিয়ে ফরহাদ আর শিউলির কিছু অপূর্ণতার দুঃখও ছিল । কতো ডাক্তার কবিরাজি করে একটি বাচ্চার জন্য । তারপর শত চেষ্টায় পর বিয়ের চার বছর শেষে একদিন কোল জুড়ে আসে মেয়ে পদ্মমালা । সন্তান আসার পর সংসারে সুখের বন্যা বইতে থাকে । ফরহাদ -শিউলির কাঠখোট্টা নির্মম জীবনে কন্যা পদ্মমালা যেন এক গভীরতম ভালোবাসার পরশ । সুখের আলোতে ফারহাদ শিউলির ভাঙ্গা ঘর সুখ সাগরে পরিনত হয় । মেয়ের জন্মের পর ফরহাদের ভাগ্যটা ও পরিবর্তন হতে থাকে।চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে সাঙ্গু নদীর ঘাঁটেই একটা নতুন টিনের দোকান হয় ।আয় রোজগার ও ভাল হতে থাকে ।নদীর ঘাটে টিনের দোকানটা ভাল করে বেঁধে নেয় ।
নিয়তি প্রকৃতির নিষ্ঠুর খেলার কাছে পরাজিত হয় । সেদিন সব জায়গা থেকেই মাইকিং হচ্ছিল রোয়ানু নামের ঝর আসছে । সবাইকে নিরাপদ দূরত্বে যেতে বলা হচ্ছিল । তিলে তিলে গড়া এই ঘর বাড়ি দোকান পাট রেখে কোথায় যাবে ফরহাদ । এমন অনেক বার মাইকিং করলেও তো অনেক সময় ঝর অন্যদিকে চলে যায় । একটু বেশি দুঃসাহসী আশা ভরসা নিয়ে ফরহাদ নিজের ভিটেতেই ছিল। সেদিন ভোর রাতের দিকে ।কন্যা পদ্মমালা কে বুকে নিয়ে শিউলি ঘুমিয়ে ছিল । ফরহাদ সেই ঘুমন্ত স্ত্রী সন্তানের দিকে তাকিয়ে নতুন কোন স্বপ্ন সাজাচ্ছিল ।
ভাবতে ভাবতে স্বপ্নের টানে ঘুমটা একটু গভীরে চলে গিয়েছিল । ফরহাদের চোখের সামনে থাকা সেই ঘুমন্ত স্ত্রী কন্যা যে চিরদিনের জন্য ঝরের আঘাতে হারিয়ে যাবে ভাবেনি । ভোর রাতের দিকে । চারিদিকে গগনবিদারী চিৎকার । ফরহাদ অনুভব করছিল ঘরের বেরায় লাগানো হারিকেনটা দুলছিল । ঘুমন্ত চোখে মেয়েটার কান্না আর হাত ধরে স্ত্রীর ডেকে তোলার স্পর্শটুকু মনে আছে । তীব্র ঝরের বেগে ঘর মুহূর্তে ডুবে গেল । শিউলি চিৎকার করে বলছিল ," আমার মাইয়াডা কোল থাইকা গেল । আমার মাইয়াডা ডুইবা গেল ।কে আছো বাঁচাও! বাঁচাও! " কয়েক মুহূর্ত সব অন্ধকারে তলিয়ে গেল । ফরহাদের কিছু মনে নেই । দুই দিন হুঁশ ছিল না । চোখ খুলে দেখে হাসপাতালে । নিস্তেজ শরীরটা টেনে তুলতে পারছে না । কেউ একজন পাশ থেকে বলছিল ," আহা! কতো বছর পর মাইডা জন্ম নিল । সুখ দিয়া আল্লাহ্ সব কাইরা নিল । পুলাডা একেবারে নিঃস্ব হইয়া গেল ।" হাসপাতালে কতো জায়গা থেকে আসা রুগী বিছানায় কাতরাচ্ছে। কতো রকমের মানুষ সাহায্যকারী হিসেবে কাজ করছে । কতো ভাষায় দুঃখ দুর্যোগের আলাপ চলছে । ফরহাদের কাঠখোট্টা নিষ্ঠুর নিয়তির গল্পটা সবার মুখের আলাপের অংশ হয়ে গেল । কতো রকমের সাহায্য সহযোগিতার আশ্বাস , কতো রকমের সহানুভূতিশীল মানুষ পাশে ।
কিন্তু কেউ ফরহাদের সব হারানো নিঃস্ব শরীরটার ভেতরের টুকরা হয়ে যাওয়া মানুষটাকে স্পর্শ করতে পারল না ।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
সালসাবিলা নকি
গল্পের নাম প্রেমাশিয়া দেখেই পড়ার আগ্রহ জন্মালো। আমার গ্রামের বাড়ি। তবে সেখানে এখন আমাদের কিছুই নেই। একসময় সব ছিল। নদী ভাঙনে সব হারিয়ে গেছে। এগুলোও শোনা গল্প। আমার জন্মের আগের কথা। আমি খুব ছোট বেলায় বাবা মার সাথে গিয়েছিলাম দেখতে। এখন সে স্মৃতিও ঝাপসা। তাই প্রেমাশিয়া দেখে গল্পটা পড়ার জন্য মনে টান অনুভব করেছি। আপনার লেখার হাত ভালো। সুন্দর করে গুছিয়ে লিখেছেন।
গল্পটা সেই সময়ের একটা ঘটনার অনুপ্রেরনায় লেখা । আমি চট্টগ্রাম এক গবেষণাগারে স্বামীর সাথে তাঁর কর্মস্থলে । বাবুর্চির বাড়ি সেখানেই । সে সেই ঝড়ের সময়ের ঘটে যাওয়া মানুষের দুর্দশার কথা বলছিল । আর ওর বউ কান্না করছিল । দু ফোঁটা চোখের জল আমার ও পড়েছে । তাই কিছু কষ্ট আমাকে ও ছুঁয়ে গেছে ।
লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা
ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য
গল্পের বিষয় ছিল "কাঠখোট্টা" । এই কাঠখোট্টা শব্দটা আমরা বাংলাদেশিরা খুব সাধারন ভাবে নিষ্ঠুরতা কিংবা রুঢ়তা অর্থে বুঝে থাকি । যেখানে ভালোবাসার শূন্যতা থাকে ।আমার গল্প " প্রেমাশিয়া " নিষ্ঠুর কাঠখোট্টা প্রকৃতির কারনে ধ্বংস হয়ে যাওয়া জীবনের আখ্যান । যেখানে জীবন আর প্রকৃতি সত্যিকার অর্থেই ভীষণ কাঠখোট্টা । আমি মনেকরি বিষয়ের সাথে সত্যিকার অর্থে সামঞ্জস্যপূর্ণ ।
০২ নভেম্বর - ২০১৬
গল্প/কবিতা:
১৩ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।