বোবা পিশাচ

আমার আমি (অক্টোবর ২০১৬)

আহা রুবন
  • ৪৭
লাইটগুলো একে একে আলো হারিয়ে ফেলতে লাগল। মনে হল সেগুলোতে রেগুলেটর যুক্ত। আর কেউ একজন তা ঘুরিয়ে আলো কমিয়ে ফেলছে। পট করে একটা শব্দ—হয়ত লাইন অকেজো হয়ে গেল। বেড-সুইচ ধরে টেপাটেপি করলাম কোন কাজ হল না। পাশের রুমগুলোয় ঘুটঘুটে অন্ধকার, ভয় ঘাপটি মেরে আছে।
কাজের-মেয়েটি পাশের ঘরে ছিল—নাম জ্যোতিকা। কিন্তু এবার যে ঘরে ঢুকেছে সে অগ্নিকা—জিজ্ঞেস করায় বলল। চেহারা অবিকল জ্যোতিকার কিন্তু ওর কোন যমজ বোন ছিল বলে আমার জানা নেই। ওর কোনও বোনই নেই—একটি মাত্র ছোট ভাই।
ঘুমিয়েছিলাম একাই। মনে হল কেউ একজন মশারি ঘরে টানছে। হাত দিয়ে দেখলাম ‘কেরে?’ গায়ে হাত লেগে গেল।
‘তোমার সঙ্গী—অঞ্জন। পেশাব করতে গিয়েছিলাম।’
কিছুক্ষণ পর খেয়াল হল আমি তো একাই ঘুমিয়েছিলাম...’
ঘার ফেরালাম বাঁয়ে অন্ধকারের মধ্যেও বেশ বুঝতে পারছিলাম জ্যোতিকা আমার পাশে শুয়ে। ওর নরম চুল আমার গালের নিচে সুড়সুড়ি দিল। সুন্দর একটা ঘ্রাণ— শ্যাম্পু করেছে নিশ্চয়। দিনের বেলায় পাশ দিয়ে যাবার সময় শরীরের বোটকা গন্ধে দম আটকে আসে। আশ্চর্য—আমার পাশে শুয়ে আছে অথচ কিছুই টের পাইনি। হয়ত গোসল করে এসেছে... আসলে ভুল আমারই ও তো জ্যোতিকা নয়—অগ্নিকা। তাই হয়ত গন্ধটা এত মিষ্টি...

কিন্তু অঞ্জন গেল কোথায়? সেদিন বিকেলে সাইকেল নিয়ে বেরিয়েছিলাম দুজন। পড়ন্ত সূর্যের আলোয় গল্প করে পথ চলতে বেশ লাগছিল। সিগারেটের অভ্যেস নেই তবু দুজনে সিগারেট ধরিয়ে মনের সুখে ধোঁয়া ছাড়তে লাগলাম। ডালিম বাগানটার সামনে এসে আমাদের গতি কমে গেল। বাগানের ভেতর থেকে মেয়েদের হাসির শব্দ ভেসে আসছে। অনেকটা ভরা কলসি থেকে জল ঢালার সময় প্রথমে যেমনটা হয়। গোপনে খুব সাবধানে সাইকেল রেখে এগোতে থাকলাম। চারটি মেয়ে যেন রূপের নদীতে ডুব দিয়ে মাত্র উঠে এসেছে। ওরা চুল আঁচড়াচ্ছে সবারই মুখের অর্ধেকটা চুলে ঢেকে আছে। চিরুনিতে উঠে আসা চুলগুলো পেছন দিকে দলা পাকিয়ে ছুঁড়ে দিচ্ছিল। তার কয়েকটি নাকে ধরে শ্বাস নিলাম। ঘ্রাণে মাদক মেশানো যেন—চোখ মুদে এল। বুকের ভেতর শিরশির করে উঠল। ঠোঁটে চেপে ধরে চুমো খেলাম পাগলের মতো। হয়ত পাগলই হয়ে উঠেছিলাম ক্রমশ। হাত আপনা থেকেই সচল হয়ে উঠল, দু-হাতে প্যান্টের পকেটে পুরতে থাকলাম। একবার ভাবলাম এসব কী করছি আমি! কিন্তু কাজটি থামাতে পারছিলাম না। কোন পৈশাচিক শক্তি অনুভব করলাম। আবার মনে হতে লাগল আমি নিজেই তো একটা পিশাচ...
আমাদের উপস্থিতি টের পেয়ে একসঙ্গে ওরা কপাল থেকে চুল সরিয়ে তাকাল। কাজল আঁকা দেবীর চোখ! কিন্তু সবার চেহারাই তো জ্যোতিকার মতো, তবু আলাদা আলাদা! বিস্ময়ে অঞ্জনকে দেখাতে চাইলাম। হঠাৎ খেয়াল হল অঞ্জন তো চট্টগ্রামে ও এখানে কী করে আসবে!

চিৎকার করে উঠলাম ‘কে রে?’
দেখি জ্যোতিকার নয়ত অগ্নিকার পাশে আরও একজন শুয়ে আছে। বয়স্ক ব্যক্তি। দুজনকেই মারতে চেষ্টা করলাম। হাত-পায়ে কোনও জোর পেলাম না। ভাল করে খেয়াল করে দেখি লোকটি মোটেই বয়স্ক নয় নিতান্তই শিশু। আর মেয়েটি তাকে বুকের দুধ খাওয়াচ্ছে। ওটি ওর ছেলে, নাম রেখেছে ভোলা। তাই বলেই তো ডাকল ‘ভোলা সোনা কাঁদে না, কাঁদে না...’
হঠাৎ করে অন্ধকারের মধ্যেও আমি দেখতে শুরু করলাম। সত্যি বলতে হঠাৎ করে কিন্তু নয়—কখনও কখনও আমি এমন আঁধারেও দেখতে পাই। তখন আমার সমস্ত শরীরে কোটি কোটি চোখ গজাতে থাকে। সেই চোখগুলো কিছু দেখার জন্য তৃষ্ণায় ছটফট করতে থাকে। আমি হেরে যাই ওদের অতজনের কাছে। আয়নায় নিজেকে দেখে একদিন ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। ঠিক একটা শুঁয়োপোকার মতো দেখাচ্ছিল। কিন্তু মুখটা ছিল ইঁদুরের মতো। তারপর ভয় পেয়ে ঘরের আয়নাটা ভেঙ্গে ফেললাম।

আমাকে চমকে দিয়ে সেই বয়স্ক লোকটি কোথা থেকে যেন আবির্ভূত হল। লোকটি ওদের মা-ছেলেকে নিয়ে যেতে চাইল। ওরাও উঠে যাবার প্রস্তুতি নিতে লাগল। ভাবলাম বাধা দেই ওর বাবা তো সন্তানের জন্য পাগল হয়ে যাবে!
‘কিছুতেই নিতে পারো না ওদের—ওর বাবা কাকে নিয়ে থাকবে? ওকে হারালে তো সে মরেই যাবে!’
‘তাতে তোমার কী? তুমি তো আর ওর বাবা নও?’
‘ওরা এখানেই কাজ করবে—ভাল থাকবে...’
‘সারা জীবন কি শুধু পরের কাজই করবে? ওর কি কোনও ঘরের স্বপ্ন হয় না? শিশুটাই-বা কী কাজ করবে?’
‘ওদের আবার স্বপ্ন থাকে নাকি! ওদের কোনও মুখ থাকতে পারে না। সংসার তো কেবল মানুষেরই থাকে...’
‘ওরা কি তবে মানুষ নয়?’
তীব্র ঘৃণায় আমার মুখে কোনও কথা ফুটল না।

বারবার চেষ্টা করলাম আলো জ্বালতে কিছুতেই পারলাম না। এক সময় দেখলাম দুলালকে। চাইলাম ঘটনাটি খুলে বলতে। পরে দেখি সেও ওদেরই দলে। আসলে সে দুলাল ছিল না। চিৎকার করে উঠলাম জোরে ‘ওদের কিছুতেই নিয়ে যেতে পারো না! ওরা আমার কাছেই থাকবে।’
ওদের গালাগাল দিলাম—শোনাল মাতালের মতো। কিছুতেই ‘না’ শব্দটি উচ্চারণ করতে পারছিলাম না। তাই কথাটি হয়ে গেল ‘ওদের কিছুতেই নিয়ে যেতে পারো...’
লোক দুটো বিশ্রীভাবে হাসল।‘বেশ তাহলে সুমতি হল এতক্ষণে?’
ক্রোধে আমার দুচোখ জ্বলতে লাগল। একজন বলল ‘দেখ লোকটার চোখ দুটো কেমন পিশাচের মতো!’
‘...আমি পিশাচ...’ এবারও না শব্দটি উচ্চারণ করতে কোনও শব্দ হল না। ওরা হা হা করে হাসতে লাগল।
‘দেখ পিশাচটাকে দেখ...’
ক্ষোভ, লজ্জা, ব্যর্থতায় গলার মধ্যে হাত ঢুকিয়ে একটানে আলা-জিহ্বাটা ছিঁড়ে ফেললাম।

তার পর থেকে বোবা হয়ে আছি। ঘরে-বাইরে আমি একজন সম্মানিত ব্যক্তি—কেননা বোবার কোনও শত্রু থাকে না।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
নিয়াজ উদ্দিন সুমন পড়েছি গল্পখানা, যাক অবশেষে আপনার কথায় কাজ হল। ভালবাসা নিবেন।
কী কাজ হল, সুমন? ঠিক বুঝলাম না।
এই যে লিখতে পারছি এখন...
সেলিনা ইসলাম প্রতিনিয়ত বিবেকের দংশনে আত্মগ্লানিতে বোবা হয়ে আছে পুরো সমাজটাই! আর তাই স্বপ্নের মাঝে প্রতিবাদী হয়ে বেঁচে থাকার কিছুটা শক্তি অর্জন করে নেয়া! এমন স্বভাবী মানুষ এখন চারিদিকেই। চমৎকার থিম এবং উপাস্থাপনা! সতত শুভকামনা।
আপনার মন্তব্য আমাকে অনুপ্রাণিত করে। অনেক ভাল থাকবেন।
আল মামুন খান আপনার লেখায় গতির সাথে ছন্দ আছে। যা পাঠ্র তীব্র সুখ আনে মনে-পাঠকের। শুভেচ্ছা-ভালবাসা রইল।
ভাল লেগেছে জেনে প্রীত বোধ করছি। অনেক ধন্যবাদ।
কাজী জাহাঙ্গীর আমি মনে করি পারায়/সমাজে/রাষ্ট্রে ঘটতে থাকা অনিয়ম গুলোর প্রতিবাদ করতে না পারার যন্ত্রণাটা রাতে ঘুমের মধ্যে বোবায় ধরার যন্ত্রনায় রুপক হয়েছে, অনেক ধন্যবাদ রুবন দা, ভোট রেখে গেলাম।
চমৎকার ব্যাখ্যা! পাঠক তার নিজের মতো করে পড়বে মানে সেও কিছু সৃস্টি করবে। তবেই না লেখক ও পাঠক উভয়েই আনন্দ পাবে। আপনি যেভাবে গল্পকবিতা চষে বেড়াচ্ছেন, খুব ভাল লাগছে। কেউ কেউ একখানা পোস্ট দিয়ে হাওয়া হয়ে যায়। মনে হয় তারা অন্য কারও লেখা পড়ে না, পড়লে তো তাদের মন্তব্য দেখা যেত। না পড়ে সাহিত্য চর্চা করবে, কবি হবে এতই সহজ?! ভাললাগা... অনেক অনেক ধন্যবাদ প্রিয়।
সমাধিরঞ্জন শ্রী শ্রী আহা রুবন মহাশয়, আপনার এই লেখাটির জন্যে আপনাকে আমার ঈর্ষা করতে ইচ্ছে করছে, তার কী হবে। চমৎকার আইডিয়া! এই লেখার প্রশংসা করার যোগ্যতা কজনের আছে জানিনা। অনেক পাকা পরিণত লেখা ভাবনা। আমাদের (মুলতঃ আমার ভাই চালায়) একটি সাহিত্য পত্রিকা আছে। পত্রিকার সাইট www.suryabarta.com একবার ঘুরে আসুন। আমার সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করতে পারেন ronnjone.sam@gmail.com. সময় করে আমার লেখা গল্পটিতে চোখ বোলাতে পারেন। ধন্যবাদ - সমাধিরঞ্জন
'শ্রী শ্রী আহা রুবন মহাশয়' শব্দটা পড়ে চোখে জল এসে গেল! যদি সুযোগ ঘটে, আপনার হাতে লেখা ওই ক-টি শব্দ লিখিয়ে নেব। বাঁধিয়ে রাখতে চাই... এতটা প্রশংসার কি যোগ্য? হয়ত না, তবে যেন হতে পারি। যতটা পরিশ্রম, চিন্তা-ভাবনা, সময় নিয়ে লেখি সেই হিসেবে আমার গল্পের পাঠক নেই। তবে অগ্রসর পাঠকের অনপ্রেরণা পাচ্ছি এতে আপ্লুত। যোগাযোগ হবে। শ্রদ্ধেয় লেখকের মঙ্গল কামনা করছি।
শাহ আজিজ বর্ণিত মুল ঘটনার সাথে শেষের লাইনটির কেমন একটা বৈপরীত্য আছে । আমারত মনে হচ্ছে গল্পে একটা পরিচ্ছন্ন মেসেজ থাকা দরকার । কেননা স্বপ্ন কখনো বাস্তবে রুপ নেয়না।
মনের ভেতরে ঘুরপাক খাওয়া ভাল বা মন্দ বিষয়গুলো, লুকানো পাপবোধ তো কখনও-সখনও স্বপ্নে এসে হাজির হয়। আর শেষ লাইনে আক্ষরিক অর্থে কিছু বলতে চাইনি। মনের মধ্যে পাপবোধ থাকলে খুব স্বাভাবিক কারণেই অনেক ব্যাপারেই জোর গলায় কিছু বলা যায় না। যে স্বামী বাইরে গোপনে লাম্পট্য করে বেড়ায়, তারাই স্ত্রীর কাছে বেশি বেশি উপহার, মিষ্টি কথা নিয়ে ফেরে, আমরা বলি আহা কত ভাল মানুষ! অনেকে কেবল প্রশংসা করে সমালোচনা করে না। আপনি দুটোই করেন বলে কৃতজ্ঞ। আমার তো এখন সমালোচনাই বেশি প্রয়োজন। অনেক ধন্যবাদ।
বড় সত্যি ,সবাই সমালোচনা সইবার ধৈর্য রাখেনা। আসলে আগ্রহী হবার বাসনা সবার মধ্যে থাকে, এখানেই বিপদ । রুবন ,৬০ এর দশকের পর বেশ কজন আধুনিক ধারার কবি আমাদের অফুরন্ত দিয়ে গেছেন যা অনুসরন করলে একসময় নিজের একটা স্টাইল গড়ে ওঠে। শুভ কামনায়।
আসলে আগ্রহী হবার বাসনা সবার মধ্যে থাকে না। (সংশোধন)
কেতকী মানুষের ভেতরে মানুষ ! রীতিমতো একেঁছেন মনে হলো। গল্পে ভোট রইল।
'মানুষের ভেতরে মানুষ' ছোট্ট এই বাক্যটায় কী সুন্দর প্রকাশ! হ্যাঁ ঠিক, আরও কিছু ইঙ্গিত আছে। অনেক ধন্যবাদ।

২১ এপ্রিল - ২০১৬ গল্প/কবিতা: ১৭ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪