রশিদ করিমের বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছি। তিনি ভদ্রতা করে আমাকে তাঁর বাসায় এককাপ চায়ের নিমন্ত্রণ দিয়েছেন। ভালই হল গতরাতে লেখা তৃতীয় শ্রেণীর কবিতাটা তাঁর হাতে তুলে দেব। আসিফ আদনান তো একটা লেখা চেয়েছেনই। সকালে উঠে যখন কবিতাটা আবার পড়ে দেখলাম, বুঝলাম এটা অতিশয় প্রাচীন পন্থী একটা কবিতা হয়েছে। সাধু আর চলিত ভাষা মিশিয়ে একটা গুরুচণ্ডালী কবিতা লিখেছি। তবে কিছু করার ছিল না। আমার দ্বিতীয় সত্তার কাজ।
রশিদ করিম থাকেন ধানমন্ডিতে। প্রথমে ভেবেছিলাম হেঁটেই চলে যাব। গত আড়াই মাস প্রচুর হেঁটেছি। কাজেই খুব একটা কষ্ট বোধহয় হবে না। ইংরেজিতে ডগ টায়ার্ড বলে একটা কথা আছে। পল্টন চৌরাস্তায় এসে কথাটার যথার্থতা টের পেলাম, কুত্তার মত ক্লান্ত মনে হচ্ছে নিজেকে। মনে হচ্ছে বুকের ছাতি বুঝি ফেটে যাবে। ভয়াবহ গরম আজ। অন্যান্য দিন রোদের সাথে সাথে ফুরফুরে হাওয়াও থাকে। আজ বাতাস একেবারে স্থির। কাকগুলো পর্যন্ত বিদ্যুতের তারে বসে ঝিমচ্ছে। গরমে ঘেমে নেয়ে ফেলেছি। কপালের নোনা ঘাম গড়িয়ে এসে চোখে ঢুকে জ্বালা করছে। এভাবে রোদ চড়তে থাকলে একসময় হয়ত রোদ শরীর ভেদ করে বেরিয়ে যাবে। তখন আর মানুষের ছায়া পড়বে না। সবাই অদৃশ্য হয়ে যাবে। সারা ঢাকা শহরে আড়াই লাখ মানুষ ঘুরছে। কেউ কাউকে দেখতে পারছে না। একে অন্যের সাথে ধাক্কা খেয়ে দমাদম আছাড় খাচ্ছে। এই ধরণের উচ্চমার্গীয় চিন্তা ভাবনা করতে করতে অদূরে দঁড়িয়ে থাকা একটা খালি রিকশার দিকে এগোলাম।
প্যাসেঞ্জারের সিটে ছোকরা মত এক রিকশাওয়ালা চোখ বন্ধ করে পায়ের উপর পা তুলে আধশোয়া হয়ে আছে। সম্ভবত সে মধ্যাহ্ন ভোজ শেষে বিশ্রাম নিচ্ছে। আমি সেদিকে এগিয়ে গেলাম।
'' যাবে নাকি ভাই?"
রিকশাওয়ালা ছোকরা কোন কথা বলল না। চোখ বন্ধ অবস্থাতেই তার চোখের মনি এদিক ওদিক নড়াচড়া করে আবার স্থির হয়ে গেল। আমি ঘড়ি ধরে পঁয়তাল্লিশ সেকেন্ড অপেক্ষা করলাম। তারপর অত্যন্ত ভদ্র ভাবে বললাম,'' যাবে ভাই?"
ছোকরা অনেক কষ্টে চোখ খুলল। ভ্রু কুঁচকে তাকালো। আমার সুরত মোবারক বোধকরি তার পছন্দ হল না। না হবারই কথা। ঝাঁ ঝাঁ রোদে ঘণ্টা দেড়েক হেঁটেছি। চেহারা নিশ্চয়ই গরম তেল পড়ে লোম উঠে যাওয়া নেড়ী কুত্তার মত হয়েছে। পরনের কাপড় চোপড়ও তেমন ভাল না। কে জানে কেন আমি কখনোই নিজেকে ফিটফাট রাখতে পারি না। আমাকে দেখলেই মনে হয় কোথায় যেন একটা আউলা আউলা ভাব আছে। রিকশাওয়ালা ছেলেটা আমার আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করল। হাই তুলতে তুলতে জিজ্ঞেস করল,'' কই যাইবেন?"
'' নয়াটোলা।''
ছোকরা আবারো হাই তুলল,'' ওইদিকে যামু না।"
'' কেন?"
'' ওইদিকে এহন জাম।"
আমি চোখ সরু করে মুচকি হেসে বললাম,'' তোমার নাম কী ভাই?"
একটা মুহূর্ত ছোকরা আমার দিকে চেয়ে থাকল,'' আমির আলি।"
'' আমির আলি তুমি কোনদিকে যাবে?"
'' যেদিকে জাম নাই হেই দিকে।"
আমি রিকশায় উঠে বসলাম,'' চলো তাহলে যাওয়া যাক। ঢাকা শহরের কোন এলাকায় জ্যাম নেই দেখতে ইচ্ছে করছে।"
আমির আলি রিকশা টানতে শুরু করল। সে বোধহয় বিরক্ত হয়েছে। তার চোখে মুখে মহাবিরক্ত ভাব স্পষ্ট। হোক সে বিরক্ত। মানুষের মন মানসিকতা দেখতে গেলে অনেক কিছু হারাতে হয়। আমি যা চাই তা আমাকে আদায় করে নিতে হবে। প্রয়োজন হলে ছিনিয়ে নিতে হবে। রিকশাওয়ালাদের প্রতি আমার একটা ক্ষোভ আছে। এরা মাঝে মধ্যে এমন ভাব দেখায়, যেন এরা ঢাকার রাজপথের সর্বেসর্বা। অল ইন অল। আমি তাই সুযোগ পেলেই এদের বিরক্ত করি এবং কষ্ট দেই। একবার শাহজাহানপুরে এক রিকশাওয়ালাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম বাসাবো মাঠ যাবে কী না। রিকশাওয়ালা বিরস মুখে বলল,'' যামু, পঁচিশ টেকা লাগব।"
আমার মাথায় ফট করে রক্ত উঠে গেল। আমি কোন কথা বলতে পারলাম না। খুব বেশি রেগে গেলে আমার মুখ দিয়ে কোন কথা বের হয় না। মনে হয় মাথায় ভিসুভিয়াস আগ্নেয়গিরি জ্বলছে। শুধু মুখের চামড়া তিরতির করে কাঁপে। সেই কাঁপুনি আমি স্পষ্ট টের পাই।
আমি চুপচাপ রিকশায় উঠে বসলাম। পথে দু' বার রিকশার চেইন পড়ল। আমার রাগ বাড়তে লাগল। রিকশার সিটটাও ঢালু। স্থির বসে থাকা যায় না। বারবার পিছলে যেতে হয়। রিকশাওয়ালা রিকশা চালাচ্ছেও কেমন দায়সারা ভঙ্গিতে। দুই প্যাডেল মেরে চুপচাপ বসে থাকে। রিকশা যখন প্রায় থামে থামে অবস্থা, তখন আবার দুই প্যাডেল। আমার ইচ্ছে করতে লাগল, এক লাথি দিয়ে ব্যাটাকে ড্রাইভারের সিট থেকে মাটিতে ফেলে দেই। বাসাবো পেঁৗছলাম। রিকশাওয়ালা নির্লজ্জের মত ভাড়ার জন্য হাত বাড়িয়ে আছে। আমি তার হাতে পাঁচ টাকার একটা কয়েন দিলা্ম। রিকশাওয়ালা বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকালো। অর্থাৎ '' এইডা কী দিলেন?"
আমি হাসি হাসি মুখ করে বললাম,'' ভাইজান, ভাড়া চাওয়ার বেলায় আপনি মাতব্বরি দেখিয়েছেন, দেবার বেলায় আমি দেখালাম। আপনাকে যে ন্যাংটো করে ছেড়ে দেইনি, এই যথেষ্ট। ভাই যাই? আলবিদা।"
আমি মনে করি, যার যেটা জীবিকা, যে কাজ করে সে তার পেট ভরায়, সে কাজে সবারই সৎ থাকা উচিৎ। যা আমার পাওনা নয়, সেটা যখন আমি কারো কাছে চাইব, তখন আমার কন্ঠ হবে বিনীত। রিকশাওয়ালারা যখন দুই গুণ তিন গুণ বেশি ভাড়া চায়, এমন ভাবে চায় যেন এটা তাদের প্রাপ্য।
আমি বিস্মিত চোখে তাকিয়ে আছি। আমির আলি আমাকে বিস্মিত করেছে। সে আমাকে নয়াটোলায় নিয়ে এসেছে। সব মানুষই গন্তব্য চায়। গন্তব্য বিহীন যাত্রা তার পক্ষে সম্ভব নয়।
অত্যাধিক ফর্সা মানুষের চুল কিছুটা পিঙ্গল হয়। রশিদ করিমের মেয়েটা অতিরিক্ত ফর্সা এবং তার চুল ঈষৎ পিঙ্গল। বয়স বছর পাঁচেক হবে। শুনেছি এর আগে রশিদ করিমের একটা ছেলে হয়েছিল। সে বেঁচেছিল মাস আষ্টেক। জন্মের পর থেকেই নানান অসুখ বিসুখে ভুগছিল। অতি অল্প দিনের জন্য পৃথিবীতে এসেছিল, শুধু যন্ত্রণাই পেয়ে গেল। মেয়েটির নাম অনিতা। বেশ চঞ্চল। খুব ছোটাছুটি করে। ছানাপোনা আমার খুব পছন্দ। ড্রয়িং রুমে বসে মেয়েটির সাথে বঙ্ংি খেলছিলাম। ও-ই জিতছিল। ছানাদের সাথে কে কবে জিততে পেরেছে? বঙ্ংি সবে জমে উঠেছে, তখনি রশিদ করিমের স্ত্রী এসে আমাকে রশিদ করিমের স্টাডিতে নিয়ে গেলেন।
স্টাডিতে ঢুকে আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। বুুঝিবা কিছুটা ঈর্ষান্বিতও হলাম। দেয়াল জোড়া বুকশেলফ, শত শত বই। এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা থেকে শুরু করে বাংলাদেশের নিম্নমানের পেপার ব্যাক বই, কী নেই! কারো ব্যক্তিগত গ্রন্থাগার যে এমন এলাহী একটা ব্যাপার হতে পারে, আমার ধারণা ছিল না। রশিদ করিম অত্যন্ত গোছানো মানুষ বোঝা যাচ্ছে। বইগুলো বিষয় অনুযায়ী আলাদা করে সাজানো। এনসাইক্লোপিডিয়াগুলো একজায়গায় পরপর রাখা। হিউম্যান সাইকোলজির উপর লেখা বইগুলো আলাদা করে রাখা। বাংলা সাহিত্যের কালপুরুষেরা সগৌরবে একজায়গায় অবস্থান করছেন। তার পরপরই ইংরেজী সাহিত্যের দিকপালেরা প্রসন্ন মুখে বসে আছেন পাশাপাশি। ঘরের মাঝখানে বার্ণিশ করা টেবিল। টেবিলের উপর কলমদানি, একরীম কাগজের একটা প্যাকেট, অ্যাশট্রে, সিগারেটের প্যাকেটের মত অতীব জরুরি কিছু জিনিস । রশিদ করিম কিছু একটা লিখছিলেন। লেখা থামিয়ে আমাকে বসতে বললেন তাঁর সামনের চেয়ারে। ভালমন্দ কথা বলতে বলতে চা এল, সিগারেট জ্বলল। জিজ্ঞেস করলাম, ''কী লিখছিলেন? কবিতা?"
রশিদ করিম হেসে বললেন,'' না, জীবনের প্রথম উপন্যাস লিখছি।"
কেন যেন নিজেকে ভাগ্যবান মনে হল। হয়ত রশিদ করিমের কবিতার মত তাঁর এই উপন্যাসটিও বিপুল জনপ্রিয়তা পাবে। চাই কি কালজয়ীও হয়ে যেতে পারে। তখন আমি সবাইকে বলতে পারব,'' রশিদ করিম যখন এই উপন্যাসটি লিখছিলেন, তখন আমি তাঁর সামনে উপস্থিত ছিলাম।"
বললাম, '' কী নিয়ে লিখছিলেন?"
'' কলোনিয়ালিজম। পোস্টকলোনিয়াল ধারার একটা উপন্যাস লিখতে চেষ্টা করছি।"
চেষ্টা! রশিদ করিমের মত লেখকেরা যদি এখনো চেষ্টা করেন, তবে আমরা নবীন লেখকেরা কী করছি? চেষ্টাও তো করতে পারছি না বোধহয়। সিগারেটে টান দিয়ে বললাম,'' কিন্তু বর্তমান যুগে পোস্টকলোনিয়াল লিটারেচার কতটা প্রাসঙ্গিক? আমরা তো এখন আর কলোনাইজড নই।"
রশিদ করিম হাসলেন। কোন মহামূর্খের হাসি দেখে যেমন কোন জ্ঞানী মানুষের মুখে মারফতি হাসি খেলে, সেরকম, '' আমরা এখনো কলোনাইজড, ননতু। জিওগ্রাফিক্যালি নয়, সাইকোলজিক্যালি। বৃটিশ, পাকিস্তানিরা আমাদের পরাধীন করে রেখেছিল সত্যি, তবে এখন কি আমরা স্বাধীন? পাকিস্তানিরা আমাদের সাথে যা করেছে, সেটাও একধরণের কলোনাইজেশন। কলোনাইজাররা আমাদেরকে মানসিক ভাবে যতটা কলোনাইজড করেছে, ভৌগোলিক ভাবে ততটা করেনি।"
কিছুই না বুঝে তাকিয়ে রইলাম।
'' তোমাকে একটা প্রশ্ন করি ননতু। তোমার কি মনে হয়ে, বাংলাদেশের শতকরা কতজন ছেলে বা মেয়ে ভাবে যে তার গায়ের রংটা কেন আরো ফর্সা হল না।"
'' আমার তো মনে হয় শতকরা নব্বই জন।"
'' কতজন আরেকটু লম্বা হতে চায়?"
'' একই উত্তর।"
'' কেন তারা লম্বা হতে চায়? কেন ফর্সা হতে চায়? কী এমন আছে এর মধ্যে?"
'' স্যার, সুন্দর তো সবাই হতে চায়।"
'' আমি আবারো একই প্রশ্ন করছি। কেন? লম্বা আর ফর্সা মানেই সুন্দর? কালো অসুন্দর? নোংরা?"
আমি নিশ্চুপ।
সিগারেটে লম্বা টান দিলেন রশিদ করিম,'' কারণ, একজন ইংরেজ লম্বা এবং ফর্সা। একটু চিন্তা করলে তুমি অবাক হয়ে লক্ষ করবে, আমাদের সকল ইচ্ছে এবং সাধই কীভাবে যেন বৃটিশদের সাথে মিলে যাচ্ছে। আমারা চাই আমাদের চুল সোজা হোক। কোঁকড়া চুল আমাদের পছন্দ না। কোঁকড়া চুল সোজা করতে আমরা বড় অঙ্কের টাকা খরচ করে বিউটি পার্লার কিংবা বিলাস বহুল সেলুনে গিয়ে ভিড় করছি। কেন? কারণ, ইংরেজদের চুল হয় রেশমি এবং স্ট্রেইট। আমাদের মেয়েরা বিউটি পার্লারে গিয়ে ভ্রু তুলে ফেলছে। কারণ, ইংরেজদের ভ্রু পাতলা, কাজেই মোটা ভ্রু আমরা পছন্দ করছি না। আমরা পাতলা ঠোঁট পছন্দ করি, কারণ, তাদের ঠোঁট পাতলা। অধিকাংশ ইংরেজেরই চোখের রং পুরোপুরি কালো না। কিছুটা নীলচে কিংবা হালকা বাদামী। কাজেই আমরা কন্টাক্ট লেন্স ব্যবহার করে আমাদের চোখের রং পাল্টে ফেলছি। ধূতি আর ফতুয়াকে আমরা ফর্মাল পোশাক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারিনি। এসব পোশাক পরে কেউ যদি কোন অনুষ্ঠান কিংবা চাকরির ইন্টারভিউ দিতে যায়, তবে লোকে তাকে ক্ষেত বলবে এবং তার চাকরি হবার প্রশ্নই আসেনা। এই যে বৃটিশদের সাথে আমাদের ইচ্ছা অনিচ্ছার এত মিল, এটা কি নেহাত কাকতালীয় বলে মনে হয়?"
আমি এখনো কিছু বলছি না। এভাবে কখনো ভেবে দেখিনি।
'' না, কাকতালীয় ঘটনা এটা নয়। দু'শ বছর শাসন করেছে ঠিকই, কিন্তু বৃটিশরা আমাদের জাতিগত সত্তার মধ্যে যে উপনিবেশিকতার বীজ বুনে দিয়ে গেছে, সেটা এখন মহীরূহে পরিণত হয়েছে ননতু। আমাদের জমিতে ওরা শুধু নীল চাষই করেনি, আমাদের মনের জমিনে চাষ করেছে উপনিবেশিকতা। '' আমরা সাদা, তোমরা কালো। আমরা সুপিরিয়র, তোমরা ইনফেরিয়র। আমরা সভ্য, তোমরা অসভ্য। কাজেই আমরা যারা সভ্য জাতি, তাদের দায়িত্ব হচ্ছে তোমাদের মত অসভ্য, বর্বর জাতিকে সহবত শেখানো, সভ্য করা।" এই নীতি ওরা আমাদের রন্ধ্রে গেঁথে দিয়ে গেছে। আজো আমরা তাদেরকে সুপিরিয়র মনে করি। সভ্যতার উদাহরণ দিতে গিয়ে এখনো আমরা ইংরেজ জাতির উদাহরণ দেই। এখনো আমরা ফুটফুটে কোন শিশুকে দেখে বলি-একেবারে ইংরেজের বাচ্চা। বিয়ে করতে গিয়ে অধিকাংশ পাত্রই ফর্সা পাত্রী খোঁজে। সভ্যতার সংজ্ঞা কী ননতু? সৌন্দর্যের কি কোন নির্দিষ্ট সংজ্ঞা আছে? কালোকে কেন আমরা অসুন্দর বলি? কেন রং ফর্সা করার ক্রীম বানিয়ে কসমেটিকস কোম্পানি গুলো কেন কোটি টাকার ব্যাবসা করছে? বাজারে যত খেলার পুতুল পাওয়া যায়, সবগুলো কেন সাদা? কোন নিগ্রো পুতুল আমরা কেন বাজারে কিনতে পাই না? একজন নিগ্রোর দিকে তাকিয়ে দেখো। তারপর নিরপেক্ষ ভাবে বিবেচনা করে যুক্তি দিয়ে বল, একজন সাদা মানুষের চেয়ে সে কোন অর্থে কুৎসিত? তাঁর চুল কোঁকড়া, ঠোঁট ও ভ্রু মোটা বলে? ঠোঁট আর ভ্রু মোটা হলে একজন মানুষ কুৎসিত হয়? খ্রীস্টান না হলেই সে অসভ্য? সভ্যতা এবং সৌন্দর্যেও একটা কনসেপ্ট ওরা আমাদের জাতিগত সত্তার হৃৎপিন্ডে গেঁথে দিয়ে গেছে। আজো আমরা সেই কনসেপ্টকেই সৌন্দর্য এবং সভ্যতার মাপকাঠি বলে ধরে নিচ্ছি। ননতু।"
''জ্বী।"
'' সাহিত্যে পোস্ট কলোনিয়াল লিটারেচার বলে একটা ধারা আছে জানো?"
'' জানতাম না।"
'' চিনুয়া আচেবের থিংস ফল অ্যাপার্ট, টনি মরিসনের দ্যা ব্লুয়েস্ট আই, ন্যাডাইন গর্ডিমারের জুলাইস পিপল, ট্রিক হোয়াইটের দি ফ্রিন্জ অব লিভস পড়েছ এগুলো?"
'' জি্ব না।"
'' তাহলে বলব সাহিত্যের একটা তাৎপর্যপূর্ণ এবং বিরাট অংশ তোমার অজানা রয়ে গেছে। টারজান পড়েছ?"
সামান্য চমকে উঠলাম,'' টারজানও পোস্ট কলোনিয়াল নাকি?"
রহস্য মাখা হাসি হাসলেন রশিদ করিম,'' পোস্ট কলোনিয়াল লিটারেচারের দুটি ধারা আছে। কিছু লেখক কলোনিয়ালিজমকে সমর্থন করে লিখেছেন। আবার কেউ লিখেছেন কলোনিয়ালিজমের বিরুদ্ধে। টারজান প্রথম ধারার পোস্টকলোনিয়াল লিটারেচার। এখানে টারজান হচ্ছে সাদা মানুষের প্রতিক। আর বন্য পশুগুলো কালো আর অসভ্যতার প্রতিক। টারজান নিতান্ত শৈশব থেকেই বনমানুষের কাছে মানুষ হয়েছে। কাজেই স্বভাবতই প্রাকৃতিক নিয়ম অনুসারে তার স্বভাব চরিত্র বনমানুষের বাচ্চার মতই হবার কথা। যৌবনে পেঁৗছবার আগ পর্যন্ত সে মানুষের সংস্পর্শে আসেনি। মানুষের আচরণবিধি তার জানার কথা না। অথচ সে মানুষের মত আচরণ করছে। বন্যপশুর সাথে থেকেও সে মানুষের ভাষায় কথা বলছে, দু'পায়ে হাঁটছে। অর্থাৎ দেখানো হচ্ছে, অসভ্য জাতির মধ্যে থেকেও উত্তম উত্তমই থাকে। একজন সাদা মানুষ সাদাই থাকে। সে চিরসভ্য। রবিনসন ক্রশো নিশ্চই পড়েছ। এখানে ক্র্রশো হচ্ছে কলোনাইজার সাদা মানুষের প্রতিক। সে একটি দ্বীপে এসে উপস্থিত হয়। সেখানে বাস করে কিছু কালো জংলী। তাদের নিজস্ব একটা সংস্কৃতি আছে, সভ্যতা আছে, আছে নিজেদের ঐতিহ্য। আগুনকে তারা দেবতা মনে করে। এখানে অসভ্য কালো মানুষের প্রতিক করা হয়েছে ফ্রাইডেকে। টারজানের সাথে রবিনসন ক্রুশোর পার্থক্য হচ্ছে, রবিনসন ক্রুশোতে ড্যানিয়েল ডিফো কালো মানুষকে ডিফেন্ড করেছেন এবং দেখিয়েছেন, গায়ের রং কখনো সভ্যতা অসভ্যতার পরিচায়ক নয়। সাদা মানুষের উচিৎ কালোদের নিজস্ব সভ্যতাকে সম্মান করা। এই উপন্যাসের একটি অসাধারণ সিকোয়েন্স হচ্ছে, ক্রুশো যখন ফ্রাইডেকে ঈশ্বর সম্পর্কে সঠিক ধারণা দেবার চেষ্টা করে, অর্থাৎ ঈশ্বর সম্পর্কে খ্রীস্ট্রিয় মতবাদ তার মধ্যে ঢোকাতে চায়। ফ্রাইডে কিছুতেই ক্রুশোর মতবাদ মেনে নেয় না। অবশেষে ক্রুশোই পরাজয় স্বীকার করে এবং ফ্রাইডের মতবাদকে সম্মান করে। যার যার নিজস্ব নীতি মেনে নিয়েও যে সাদা এবং কালো মানুষ একই ভূ খন্ডে বসবাস করতে পারে, ক্রুশো এবং ফ্রাইডের নিবিড় বন্ধুত্ব দিয়ে সেটাই দেখানো হয়েছে। শেষে ফ্রাইডে ক্রুশোর জন্য নিজের জীবন বিসর্জন দেয়। একজন কালো মানুষও যে মহান হতে পারে, তাই দেখিয়েছেন ডিফো। পোস্টকলোনিয়ালের কিছু বই আমার কাছে আছে, নিয়ে পড়ো। সাহিত্য প্রেমিক একজন মানুষের সাহিত্যের এই ধারার সাথে অপরিচিত থাকা উচিৎ না।"
অনুভব করলাম, দুপুরের সেই রিকশাওয়ালা ছোকরার প্রতি একধরণের মমতা অনুভব করছি, আর নিজের প্রতি করুণা।