বাস থেকে নেমে খানিকটা থেমে থেমে পথ চললাম। চারদিক শোঁ শোঁ বাতাস। ঝিম.... ঝিম... ঝো.. ঝো.. শব্দ আর ভয়ংকর শেয়ালের ডাক। কলা গাছের আড়ালে চুপটি করে লুকিয়ে থাকা পেঁচার চোখ দেখে কেঁপে ওঠে বুক। শীতে থরথর করে কাপঁতে কাঁপতে রিকশা খুজঁছিলাম রাত ১২.৩০ মিনিট। কোথ্থাও রিকশা নেই। যেদিকে তাকাই ঘুটঘুটে অন্ধকার। নিজের হাত পা গুলো ঠিকমতো দেখা যাচ্ছে না। মনের ভেতর চিনচিন করা ভয় জেগে ওঠে। এই প্রথম বন্ধুর গ্রামে আসা। এক অজনা শব্দে ভয়ে চিৎকার করে উঠি। বন্ধু ওয়াকিলকে ডাকতে শুরু করি। ‘‘ওয়াকিল তুই কোথায় দেখা যাচ্ছে না। ” ওয়াকিল একটা ম্যাচ লাইট জ্বালিয়ে আমার হাত ধরে বললো ‘‘ভয় পাইছ না, আয় সামনে রিকশা পাওয়া যাবে। কিছুদূর অগ্রসর হওয়া মাত্রই একটি রিক্শা দেখা গেলো। লোকটি হুঁ.. হুঁ... করে সিগারেট টানছে। মাথায় আজব ধরনের সাদা গোল টুপি। ইয়া বড় বড় টানা টানা মোছগুলো হাত দিয়ে মুড়াতে মুড়াতে ক্ষয়ে যাওয়া কালচে দাঁত বের করে হাঁসি দিয়ে বললো “ কৈই যাইবেন মিয়া ভাইরা ” খানিকটা ভয় পেয়ে ওয়াকিল বললো ‘‘জী রুইথ্যা গ্রামে। ফজলুল হকের বাড়ি। বড় খালটার উত্তরে জঙ্গলের পাশ দিয়ে দিয়া যাইবা।” ওয়াকিলের মুখে খাল জঙ্গলের কথা শুনে ভয়ে গাঁ শিউরে উঠে। রিকশাওলা ঃ “হ্যাঁ যামু তয় ৩০ টাকা লাগবো” ওয়াকিল ঃ “ নোন্তা মিয়া আমাকে ২০ টাকা দিয়া নিয়া যায়। রিকশাওয়ালা ঃ “ আমার নামাই নোস্তা মিয়া। অন্ধকারে চিনতে পারেন নাই। যাওগ্যা চলেন। রুইমাছগুলো আনা হবে। ” এই কথা বলেই নোস্তা মিয়া টুপিটা খুলে হাতে নিয়ে আবার মাথায় পড়লো। মুখ থেকে জিহ্বাটা বের করে কুচকুচে কালো ঠোটে চুষে আবার ভিতরে ডুকিয়ে নিলো। আমি ভয় পেয়ে গেলাম তার কান্ডকারখানা দেখে। রিকশাওয়ালা নোন্তামিয়াকে বললাম রুইমাছ আবার কোথ্থেকে আনবেন ? ” নোন্তামিয়া ঃ রইথ্থ্যা গ্রামের ঐ খালটায় কয়েকটা বড়শি পেতে রেখেছি। আমি অর্ধেক রাত পর্যন্ত রিকশা চালাই। ফেরার পথে মাছ নিয়ে বাড়িতে যাই। বেশ বড় বড় মাছ। কথাগুলো স্বাভাবিক ভাবে বলায় কিছুটা শান্তি খুজে পেলাম। খুব শীত করছে। কানে কনকন শীতের বাতাস । ব্যাগ থেকে ইয়া লম্বা উলসুতোর লাল টুপি পড়ে রিকশায় বসলাম। ঘোর অন্ধকার । আকাঁবাকাঁ উচুনিচু রাস্তা দিয়ে রিকশা চলছিলো। কখনো বাশঁ বাগানের ভেতর দিয়ে কখনও লাউ আর ছিমের ঝাকের মাচার নীচ দিয়ে। রিকশাওয়ালা নোন্তা মিয়া মাঝে মাঝে পেছন দিকে কেমন কেমন করে তাকাচ্ছিলো। আমাকে লক্ষ করে বলছিলো “ কি মিয়া ভাই ডর লাগে” ডরাইয়েন না আমার নাম পালোয়ান নোন্তামিয়া । আমার বাবা চকিদার মোঃ খেদমত আলী মিয়া ছিলো মুক্তিযোদ্ধা কত রাজাকার আলবদল আর ভু’ত পেতনী মারছে’’ । মনে মনে ভাবছি খেদমত আলী মিয়া খানসেনাদের খেদমত করতো না কি । নোন্তামিয়া তো এক্কেবারে রাজাকারের বেশ ধরেছে। তাই মনে হচ্ছে আর কি। নোন্তামিয়ার কথাবার্তা চালচলনে ভয় ভয় লাগছিলো। ভয়ে নোন্তামিয়া কোনো কথার জবাব না দিয়ে ওয়াকিলকে বললাম বাঁশি বাজাঁতে। ওয়াকিল সুমধুর সুরে বাশিঁ বাজাতে পারে। ওর বাশিঁ সুর শুনলে মনের ভয় ডর দূর হয়ে যাবে। আবার মনে পরলো বাশিঁর সূরে যদি পরীরা চলে আসে। পরীরা ভালো। দেখতে খুব সুন্দর। রুপকথার গল্পে অনেক পরীর গল্প শুনেছি। তবুও ভালো নোন্তামিয়ার কাছ থেকে বাচাঁ যাবে। হঠাৎ একটা গাছ “ ঝাউ.... চু... শো.. করে শব্দ হওয়া মাত্রই চিৎকার করে ওয়াকিলকে ধরলাম। ধুর কি পাগলামি করছিস। এটা একটা বুড়ো বাদার লাফ দিয়েছে। নোন্তামিয়া পেছন ফিরে হাসঁছিলো। ওয়াকিল আমাকে শান্তনা দেওয়ার জন্য বাশিঁ বাজাতে শুরু করলো। রিকশা চলছে আকাঁবাঁকা পথ দিয়ে “ ওয়াকিলের বাঁশির সূর খুব ভালো লাগছিলো। অবাক করা বাশিঁর সুর শুনে চোখে ঘুম ঘুম ভাব। নিজেকে অনেকটা হালকা মনে হলো। রিকশা চলছে ঝিং ঝিং শব্দে। কিছুদুর এগুতেই জঙ্গলটার মাঝ দিয়ে যেতে হবে। জঙ্গলটার পাশে কতোগুলো উদোম করা কবর । একটু ভয় লাগছে। মনে হচ্ছে পরীদের মাতো বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছি। ওয়াকিলের বাশিঁর সুরে যাদু আছে। মনের ভেতর ভয়-ডর আতংক দূর করে দিয়েছে। রিকশা প্রায় খাল পেড়িয়ে কিছুদুর অবস্থান করলো। চারদিক চু...চু... লুররর রা ধর ধর ধপস ধপ । কী সব আজগুবি শব্দ। রিকশার নীচের হারিকেনটার বাতিটা ঠুস...ঠাস... করে নিভে গেলো। আচমকা থেমে থেমে নানান ধরনের হাসি শব্দ ভেসে আসছে। মাথার লাল টুপিটা কে যেনো উড়িয়ে নিলো। রিকশাচালক নোন্তামিয়া জোরে জোরে দোয়া দরুদ পড়তে থাকে। হঠাৎ দেখলাম রিকশা চালক নোন্তামিয়ার টুপির উপর একটি ভয়ংকর কালো চোখ। কাধেঁ বিড়ালের পায়ের থাবা। আবার কে যোনো রিকশার পেছন দিকটা উচু করে রেখেছে। রিকশার চাকা প্রচন্ড বেগে ঘুরছে। আমি বুঝে গেছি ভুত । ... আল্লাহ্ নাম স্বরন করে বললাম। ‘‘তোমাদের সাহস থাকলে দেখা দাও” বলার সাথে সাথে ঠুম্বস ঠুম্বস ডুম্বুস করে । তিনজন বেল মাথা চেহারা আগুনে পোড়া অসষ্পষ্ট । একজন আসম্পূর্ন অর্ধেক মানুষ আর্ধেক মাটি। রিকশার সামনে এসে ধপ ধপ করে দাড়াঁলো । এবং আকাশ প্রানে বিকট ভয়ংকর শব্দ করতে লাগলো। নোন্তামিয়া তাদের দেখে মুখ স্তব্দ হয়ে যায়। মুখ থেকে দোয়া দরুদ কিছুই বেরুচ্ছে না। পালোয়ান নোন্তামিয়া ভ’তের ভয়ে বিড়ালের মাতো পালায়ন করার জন্য সুযোগ খুঁজতে থাকে। কুল কিনারা না দেখে শরীরের শার্ট, লুঙ্গি, জুতা খুলে উলঙ্গ অবস্থায় প্রশ্রাব করতে করতে দৌড়ে পালিয়ে যায়। আর জোরে জোরে বলতে থাকে ভ’তেরা আমাদের ছারবে না। সাহসি ওয়াকিল অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে যায়। কিন্তু আমি শক্ত হয়ে ওদের বললাম তোমরা তিন নাইড়া ভুত আমাদের কাছে কি চাও ? ভুতেরা ঃ “হা... হা.. হি... কুঁ... কুঁ...চ্যে.. চৌঁ আমরা ‘‘ আড়াই নাইড়া ভুত ’ দেখতে পাচ্ছে না । একজন অসম্পূর্ন । আমরা তোদের আগুনে পুড়েঁ ভর্তা বানিয়ে খাবো” রাজাকারের বাচ্চা বলতে বলতে রিকশা থেকে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দেয়। আমার বুক পকেট থেকে আমার পরিবারের ছবিটা পড়ে যায়। অর্ধেক লাইড়া ভুতটা ছবিটা পেয়ে চিৎকার দিয়ে কাদঁতে শুরু করে। আর একজন রিকশাটাকে কামড়িয়ে কামড়িয়ে খাচ্ছিলো। আরেকজন ভূত আমাকে ধরবার জন্য এগিয়ে আসতে থাকে। হঠাৎ অর্ধেক ন্যাড়া ভূতঁ চিৎকার দিয়ে বলে খবরদার ওর গাঁয়ে হাত দিবিনা । ও একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নাতি। সেই ছবিটা বের করে অর্ধেক ন্যাড়া ভূতাঁ দুই ন্যাড়া ভূতকে দেখালো ‘‘ দেখ ‘‘ দাদা-দাদী মা-বাবার সাথে এই ছেলেটির তোলা ছবি। ছবিটি দেখা মাত্রই সবগুলো ভ’ত মানুষের মতো ফুপিঁয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে থাকে । ভ’ত গুলোর কান্না আমার মনে কষ্ট হলো। উঠে দাড়াঁলাম, বললাম তোমরা কাদঁছো কেনো ? নাইড়া ভ’তেরা বলতে লাগলো .. আমরা এই তিনজন ছিলাম ঘনিষ্ট বন্ধু । তোমার দাদা ছিলো একজন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার । খান সেনাদের গতিবিধি লক্ষ করে বিভিন্ন খবরা খবর এনে দিতাম তোমার দাদার কাছে। আহত মুক্তিযোদ্ধাদের ঔষুধ এনে দিতাম। ক্ষুদার্থ মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার এনে দিতাম। চুরি করে ডাব পেরে আনতাম আরো অনেক কিছু। আমাদের চোখে একটি মাত্র স্বপ্ন ভাসতো । দেশ স্বাধীন হলে লাল-সবুজের পতাকা নিয়ে মাঠে মাঠে দৌড়াঁবো হাসবো খেলবো। কিন্তু রাজাকারেরা আমাদের ধরিয়ে দেয় খানসেনাদের হাতে। খানসেনারা আমাদের রাইফেলের বাট দিয়ে মারতে মারতে এই খানে নিয়ে আসে । পেট্টলের আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মারে। বলতেই যেনো প্রতিশোধের ঝড় নেমে যায় তাদের মাঝে। আমি বললাম তোমরা আমাকে ধরছো কেন ? ভ’তগুলো সমস্বরে বললো “ তুমি আমাদের বন্ধু। তুমি খুব ভলো ছেলে । কিন্তু দোহাই ওই লাল সোয়েটারের টুপিটা কখনও পড়বে না। ঐ টুপিটা পড়ে রাজাকার গোলাম আলী আমাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছিলো । আমার আদরের ছোট্ট ফুটফুটে বোন রেশমা. . . . . বলে আর বলতে পারলো না । রেশমা.... রেশমা .... বলে বুক ফুপিঁয়ে ফুপিঁয়ে কান্নার ঝড় তুলছিলো। অর্ধেক ভ’তটি আমার হাতের ছবিটি আর একটি পিস্তল দিয়ে বললো ‘‘ এই জঙ্গল থেকে বের হতে পারি না । এই উদোম কবরে আমাদের পড়ে থাকতে হয়। সর্বোচ্চ ৫০ গজ পর্যন্ত চলাচল করতে পারি। সমাজে উচু স্থানে বসা গোলাম আলী রাজাকারটির প্রতিশোধ তোমাকে নিতে হবে। যারা তোমার দাদাকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। যারা আমার মায়ের মতো হাজার মা বোনদের বদ্ধ ঘরে আটকিয়ে নির্যাতন করে মেরেছে। মা ... মা... বলে নাইড়া ভ’তটি চিৎকার করে কাদঁতে থাকে। কাদঁতে কাদঁতে ভ’তটির গলা দিয়ে রক্ত বেরুচ্ছিলো। এবং নিমিশেই অদৃশ্য হয়ে যায় নাইড়া ভ’তগুলো। আমি উম্মাদের মাতো চিৎকার করে ডাকতে থাকি। “ তোমরা যেও না । তোমাদের নাম বলে যাও । হাউমাউ করে কাদঁতে কাদঁতে ঘুম ভেঙ্গে যায়। মা‘কে বলতে লাগলাম ওরা এসেছিলো। আমি এখানে কেন ? পকেটে হাত দিয়ে দেখি সেই পিস্তল বুক পকেটে সেই ছবি। মাকে দেখালাম বিশ^াস করার জন্য। এর মধ্যে বাবা ও বন্ধু ওয়াকিলের আগমন। বাবা বললেন, রাতে তুই বাসা থেকে না বলে বেরিয়েছিলি। সাথে একটি খেলানা পিস্তল নিয়ে। তোকে তোর দাদা শাহীদ মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর শফিকুর এর কথা বলেছিলাম। রাজাকাররা এখনও বেচেঁ আছে। তুই প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য পিস্তল আর লাল টুপিটা নিয়ে রাতে বেড়িয়ে পড়েছিলি। ঐ লাল টুপিটা তোর দাদাকে যে রাজাকার মেরেছিলো তাদের একজনের ।
ওয়াকিল বলতে লাগলো আনোয়ার পথে তোর অদ্ভুদ কান্ড কারখানা দেখে বাশিঁ বাজানো শুরু করি। তুই বাশির সুরে ঘুমিয়ে পড়লি। কথা বলতে না বলতেই প্রতিশোধের ঘোর কাটেনি আনোয়ারের সকলের দিকে টপ আঙ্গুল দেখিয়ে বলে কিন্তু ওরা . . . . . ......
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মোঃ মোখলেছুর রহমান
নোন্তা মিয়া চরিত্র,ও মাছ ধরার বিষয়টি ভাল লাগল।সার্বিক ভাবেও গল্পটি ভাল হয়েছে।
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
বিজ্ঞপ্তি
“জানুয়ারী ২০২৫” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ জানুয়ারী, ২০২৫ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।