মাগো বাজানের কতা কওনা হুনি! সোনা আমার তোর বাজানের কতা হুইনা বুঝি তোর পরান ভরে না! নাগো মা, তোমার মুহে যতবার বাজানের কতা হুনি ততবারই নতুন লাগে। জান মা, আমি বাজানরে কত জাগায় খুজি? তিতাস নদীর ধারে যহন দুইটা হাত দুইদিকে ছডাইয়া দৌড়াইয়া যাই শন শন বাতাস আমার কানে কানে কি কয়? কি কয়রে পাগলা? বাতাস আমার কানে কানে কয়, \"সুরুজ এই যে হু হু মুক্ত বাতাসে বুক ফুলাইয়া দৌড়াইয়া যাইতাছস এই মুক্তি আনার লাইগাই তোর বাজান...\" পাগল পোলা কি কয়! বাতাস তোর লগে কতা কয়? হুদা বাতাস না মা, কছি ধানের চারা গুলাও মাথা দুলাইয়া ওডে, হেরাও তাল মিলায় বাতাসের লগে... দ্যাহো পোলা আমার...
ছোট বেলার দুরন্তপনায় বাধ সাধতে সময় খুব বেশি সময় নেয়নি। খাবারের জন্য হেলেঞ্চা আর খ্যাতা শাক তুলতে তুলতেই মা একদিন পটল তুলে ফেললেন। পড়ে রইল শুধু মাল্লাহীন খালি নৌকো। জীর্ণ কুঁড়ে ঘরটাও যে বাবা-মায়ের মতো একদিন পর হয়ে যাবে, সেদিনের সেই দূরন্ত শিশু আমার মনে কোনভাবেই আসেনি।
ঘর হারিয়ে... হারিয়ে ফেললাম আমার থাকার জায়গাটাও। গোদের উপর বিষফোড়া বলে একটা কথা আছে, আমার বেলায় সেটা হাড়ে হাড়ে টের পেলাম। মানুষের ফুট ফরমাস খেটে আর এখানে সেখানে চেয়ে চিন্তে দুটো অন্ন পেটে দেয়ার ব্যবস্থা হয়ে যায়। সমস্যা হয় রাতের বেলায়। কখনো হাটের খালি চালার নিচে, কখনো গাছতলায় দূর আকাশের তাঁরা দেখে দেখে ঘুমপরীর দেশে চলে যাই। অঘ্রাণ মাসের মাঝা মাঝি যখন উত্তরী হাওয়া বইতে শুরু করল তখনই আমার কষ্টের ষোলকলা পূর্ণ হতে লাগল। ছেড়া পলিথিন, চটের ছেড়া বস্তা গায়ে মুড়ে হাটের চালার নিচে কাটতে লাগল আমার কষ্টের রাত। মাঘ মাসের মাঝামাঝি জুম্মার নামাজের দিন মসজিদের পাশ দিয়ে হেটে যাওয়ার সময় ভেতর থেকে আসা মুসুল্লীদের গায়ের গরম বাতাস আমায় মাতাল করে তোলে। জানালার পাশে অনেকক্ষণ দাড়িয়ে থেকে শরীরে ওম নেই আর ভাবতে থাকি রাতে যদি এখানে এই গরমে শুয়ে থাকতে পারতাম!
ভাবনাটা কাজে লেগে যায়। এশার নামাজ শেষ হয়ে গেলে মসজিদের মূল ঘরটায় তালা লাগিয়ে খাদেম যখন ঘুমাতে চলে যান আমি চুপি চুপি বারান্দায় গিয়ে শুয়ে থাকি। ভেতরের মত এখানে অতটা গরম না লাগলেও মোটামুটি খারাপ না। অন্তত হাটের খোলা চালার নিচে যেমন শীতে কাঁপতে হয় এখানে তার চেয়ে অনেক ভাল। দিনগুলো ভালই চলে যাচ্ছে...
আজ ত্রিশ বছর পর আমার নিজের গ্রামে ফিরে কত অনায়াসে সেই স্মৃতি মনে পড়ে যায়, যেন এই একটু আগের ঘটনা।
২. বিকেলে ফেরি ঘাটে নৌকায় চড়ে আসা একটা পরিবার তাদের ভারী ব্যাগগুলো নিয়ে বেশ বেকায়দায় পড়ে গেছে। মাঝি যদিও ধরে সেগুলো নামিয়ে দিয়েছেন তবু গাড়িতে উঠতে হলে আধামাইল পায়ে হেটেই যেতে হবে। এদিকে খুব বেশি মানুষ পারাপারও হয় না তাই চাইলেই কুলি শ্রেণীর কাউকে পাওয়া সম্ভব না। আমি গিয়ে তাদের একটা ব্যাগ তুলে নিলাম। ছোট বলে কষ্ট হবে তাই পরিবারের কর্তা আমাকে সেটা নামিয়ে রাখতে বললেন। তবুও আমি ব্যাগটা নিয়ে তাদের সাথে চললাম। যেতে যেতে আমার সম্পর্কে জানতে চাইলেন। আমার কথা শুনে অবাক হয়ে গেলেন। মমতা মাখা স্বরে জানতে চাইলেন আমি তাদের সাথে যেতে চাই কিনা। সাত কুলে আমার কেউ নেই, এই গ্রাম আমার কাছে যা ওদের বাড়িও তা। আমি রাজি হয়ে গেলাম।
পৃথিবীতে ভালো মানুষের সংখ্যা নেহায়েত কম। সহিদ সাহেব একজন সত্যিকার ভালো মানুষ। ছোট মুদির দোকান করে সংসার চালান। আমি নিজের বাবার কথা কিছুই মনে করতে পারি না তবে মনে হয় যদি বাবা বেচে থাকতেন সহিদ সাহেবের মতো এত আদর করতেন না। টানাটানির সংসারে আমাকে কোনদিন একপ্রস্থ কাজের হুকুম করেননি। বাড়িতে এনে আমার লেখাপড়ার ব্যবস্থা করে দেন। উনার একটা পরীর মতো মেয়ে ঊর্মি। সুন্দরী মেয়ে নাকি গরীবের গলার কাটা। উনার বেলায় আমি সেটা নিজের চোখে দেখেছি। ঊর্মির বিয়ের সময় সহিদ সাহেবের সবকিছুই শেষ হয়ে যায় শুধু বর পক্ষের লোকজনদের আপ্যায়ন করতেই।
আমার লেখাপড়া যেদিন শেষ হলো ডেকে নিয়ে বললেন
সুরুজ আমি তোমাকে আমাকে বাবা বলতে নিষেধ করেছি বলে তুমি একদিন কেদেছিলে। তোমার মুক্তিযোদ্ধা বাবার জায়গা আমি কখনোই নিতে পারতাম না। একজন মুক্তিযোদ্ধার কারনে আমাদের পুরো পরিবার রক্ষা পেয়েছিল। যুদ্ধের সময় ঊর্মি ওর মায়ের পেটে ছিল। আমার বৃদ্ধা মা ছাড়া আমাদের কেউ ছিল না যার কাছে তাদের রেখে আমি যুদ্ধে যেতে পারি। ওরা নিজেরে বিলিয়ে দিয়ে আমাদের সুখ দিতে চেয়েছেন। এমন মহতি মানুষদের জায়গা আমার মতো দূর্বল লোক কখনোই নিতে পারে না।
আমি তোমাকে নিজের ছেলের মতোই লালন পালন করেছি, গরীব মানুষ হয়তো আরো কিছু করার ছিল। আর্থিক অনটনে তা পারিনি। তোমার লেখাপড়া শেষ হয়েছে। এখন নিজের পায়ে দাড়াতে শিখ।
আমি ছল ছল চোখে তাকিয়ে শুধু তার কথা শুনছিলাম। পুরোটা সময় উনার স্ত্রী উনার পাশে বসেছিলেন একটা কথাও বলেননি।
আমরা কদিনের জন্য গ্রামে যাবো তুমি এ কটা দিন অন্য কোথাও থাকার ব্যবস্থা করো। সহিদ সাহেব বললেন আমাকে।
আমি কিছু বলতে পারছিলাম না। আমার মনে হচ্ছিল তিনি কোন ঋণ শোধ করেছেন। দায়িত্ব শেষ হওয়ায় এখন আমাকে চলে যেতে বলছেন। পরের দিন ব্যাগ গুছিয়ে উনারা চলে গেলেন। আমি একটা মেসে থাকতে শুরু করি। একদিন দুইদিন করে অনেকগুলো মাস চলে গেল। উনারা আর ফিরে আসলেন না। আমি তার মুদির দোকানে গিয়ে জানলাম ঊর্মির বিয়ের আগে দোকানের সব কিছু বিক্রি করে দিয়েছেন। পরিবারের খরচ আর বিয়েতে অনেক টাকা খরচ হয়েছে, গ্রামের সবকিছুও বিক্রি করে দিয়েছেন।
আমার বুক চিড়ে কান্না আসে। আমাকে রাস্তা থেকে তুলে এনে যে মানুষটি আমার জীবন পাল্টে দিয়েছেন আজ তিনিই সব হারিয়েছেন, কোনদিন জানতেও দেননি তার কষ্টের কথা।
অনেক কষ্ট বুকে চেপে আমি যুদ্ধ করে যাই, যে করেই হোক আমাকে টাকা উপার্জন করতে হবে। অনেক টাকা। সৃষ্টি কর্তার ইচ্ছায় আমি সফলও হই।
৩. অনেকগুলো বছর পেরিয়ে আমি সেই নৌকার ঘাটে এসে দাড়াই। যেখান থেকে সহিদ সাহেব আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন একটা সফল জীবন দেয়ার অদম্য বাসনায়। আজ আমার বাবার কথা মনে পড়ছে যে বাবা আমাকে একটা স্বাধিন দেশ দেয়ার যুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন, মায়ের কথা মনে পড়ছে যে আমাকে খাবার তুলে দেয়ার যুদ্ধ করতে করতে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। আর সহিদ সাহেব... আচ্ছা উনি আমাকে নিষেধ করলেই কেন আমি তা শুনেছি? কেন আমি তাকে বাবা বলে ডাকিনি? আমার কি মনে হয়নি ইনিই আমার বাবা? বাবা বেচে থাকলে কি উনার চেয়ে বেশি কিছু করতে পারতেন?
বাবা তুমি কোথায় আছ? তোমরা আমাকে শুধু ঋণীই করে গেলে একটু কি ঋণ শোধ করার সুযোগ দিবে না?
তিতাসের বুক চিড়ে এক পসলা ঠান্ডা হাওয়া শন শন আওয়াজ তুলে কানে কানে বলে "......এই মুক্তি আনার লাইগাই তোর বাবা..."
ঘাটের দিক থেকে একটা ছেলে পরম নির্ভরতায় তার বাবার হাত ধরে সামনে দিয়ে ভবিষ্যতের দিকে হেটে যায়।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মনির মুকুল
হৃদয়টাকে নাড়া দিয়ে যাওয়ার মত প্রবল একটা শক্তি আছে গল্পটির মধ্যে। একটা চিরসত্য কথা বলে গেছেন- বাবারা শৃধু ঋণী করেই যান, শোধ করার সুযোগ দেন না।
Lutful Bari Panna
কাহিনীর বিচিত্রগামীতা তোমার গল্পগুলোর অন্যতম বৈশিষ্ট। আমি কখনো নিজের গন্ডি ছেড়ে বেরোতে পারি না। এত শেখার চেষ্টা করি তবু পারি না। ছোট ছোট কারুকাজগুলো ও খুব ভাল লেগেছে। আর একটা কথা না বললেই নয়- তোমার আকা ছবিগুলো একেবারে ঝকঝকে স্পষ্ট।
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।