এক//
টপ টপ করে ঝড়ে পড়ছে মিষ্টি খেজুরের রস। গাছের নিচে সারি বেঁধে দাড়িয়ে আছে রবু, দেলু, আছিয়া আর নুরু। সবারই উদ্দেশ্য গাছ থেকে ঝড়ে পড়া খেজুরের রসের ঠিক নিচটায় আকাশ পানে মুখটা "হা" করে তাকিয়ে থাকা। খেজুরের মিষ্টি রস যখন ফোটায় ফোটায় মুখে এসে ছিটিয়ে পড়ে তখন তাদের চেহারায় একটা সুখের আবেশ বয়ে যায়। আছিয়া হা করে থাকে আর পেছনের সবাই তখন হাতের কড়া ধরে গুনতে থাকে এক, দুই, তিন, চার..... ........ দশ।
ঐ সর, তর দশ ফোডা শেষ অইছে। অহন দেলু খাইব।
এ্যা-এ্যা-এ্যা....... একটা ফোডা যে বাতাসে বাইরে পড়ল, হেইডা বাদ দিবি না!
বাতাসে কী আমাগো কতায় বাইরে ফালাইছে? যা গিয়া বাতাসরে জিগা গা। আমরা জানিনা।
এমন করে দেলুর দশ ফোটা আর রবুর দশ ফোটা যখন শেষ হয়ে নুরুর পালা আসে, ঠিক তখনই সানু মিয়া খালি রসের কলস হাতে এসে হাজির। সানু হল এই গাছটা সমেত পুরো জঙ্গল বাড়ীটার মালিক। বাবা গত হয়েছে অনেক আগেই। বৃদ্ধা মা আর একটা বোনের খরচ চলে বলতে গেলে এই বাড়ীর বাগানের আয়ে। পূর্ব দিকে মরচে পড়া টিনের দো-চালা একটা ঘর সানুর অসহায় বৃদ্ধা মায়ের মতো কোন রকমে বেঁচে আছে। আর বাকি সবটা জায়গা ঘিরে বিভিন্ন রকম ফলফলাদির গাছপালা। দূর থেকে দেখলে এটাকে জঙ্গলের মতোই দেখায়। বিবাহ যোগ্যা বোনের বিয়ে না দিয়ে নিজে বিয়ে করবেন না বলে এখন বয়সটা ভয়াবহ রকম বাড়িয়ে ফেলেছেন।
ঐ পুলাপাইন অহন যা। সক্কালে মজিদে যাওনের নাম নাই এই হানে আইয়া পরছস। যা যা মজিদে যা আরবি শিখ গিয়া।
সাতদিন ধইরা সুরজ্য ওডে না। সাড কাপুর ধুইতে পারে নাই মায়। এই না-পাক কাপুর পইরা মজিদে গেলে আল্লায় গুনা দিব না! ্#৬১৬৩০; নুরু অনেকটা হতাশ ভাব নিয়ে কথাগুলো বলে যায়, অন্যরাও মাথা দুলিয়ে সহমত প্রকশ করে।
যা বাগ আর নাপতালি করন লাগত না। কত বড় শয়তান এক একেকটা।
সবাই মিলে এক দৌড়ে বেরিয়ে আসে সেই জঙ্গল বাড়ি থেকে। সানু লোকটা যদিও ভাল মন্দ বলে, তবে তাকে ভয় পাওয়ার মতো কারন কখনো ঘটেনি। দৌড়ানোর আসল উদ্দেশ্য হলো সেই ভোরে রস খেতে এসে ঠান্ডায় জমে যাওয়া শরীরে উষ্ণতা ফিরিয়ে আনা।
কালকা কইলে আমার সিরিয়াল পরথম। পত্যেকদিন আমি শেষে যাই আর আমার সময় আইলেই কলসি লইয়া সানু আইয়া পড়ে।
ঠিক আছে কালকা নুরুর সিরিয়াল পথ্যমে। রবুর কথায় আর কেউ দ্বিমত করে না।
ঐ চল চধরি বাড়িতে যাই। আম্মায় না কইছিল কিছু পরান গরম কাপুর দিব। গিয়া লইয়া আয়ি। আছিয়ার কথায় সবাই দল বেধে চৌধুরী বাড়ির দিকে ছুটে চলে।
"চৌধুরী"রা আসলে নামেই আছে। জমিদারীর শেষ পুরুষ, তার সম্পত্তি কে খাবে বলে বলে যখন মাটি বিক্রি করা শুরু করল, সেই থেকে আর জমি কেনা হয়ে উঠেনি। এখন শুধু মাত্র বাড়ীটাই সম্বল। তবে এ পরিবারে সবাই শিক্ষাদীক্ষায় অন্য সবার চেয়ে এগিয়ে আছে। বিস্তর টাকা পয়সার অভাবে সমাজে ভাল অবদান না রাখতে পারলেও, সীমার ভিতরে থেকে যতটুকু পারা যায় তা করতে কখনো পিছপা হয়নি এ বাড়ির মানুষগুলো। নিজেদের প্রয়োজনের বাইরে যা কিছুই থাক অন্যদের প্রয়োজন হলে দুহাতে তা বিলিয়ে দিয়ে তৃপ্ত হন সবাই।
আট-দশ বছরের ছোট দলটা চৌধুরী বাড়িতে এসে দাড়ালে সবাই পুরোনো গরম কাপড় হাতে পায়। খুশিতে সবার মন উদ্বেলিত হয়ে ওঠে। কুয়াশার চাদর ভেদ করে সূর্যটা কখনো উকি দিয়েই আবার হারিয়ে যায়।
নুরু দুদিন আগে সুতো মাঞ্জা দিয়েছে। রোদ না থাকায় সে সুতা এখনো শুকানো হয় নি। হাল্কা একটু রোদের দেখা পেয়ে খুশিতে ওর মন নেচে ওঠে। অন্যদের দাড়াতে বলে দৌড়ে বাড়ি থেকে নাটাই ঘুড়ি নিয়ে আসে। দলবেধে সবাই চরের দিকে ছুটে যায়।
পুরো চর জুড়ে আলি ক্ষেত (ধানের বীজতলা অনেকে একে জ্বালাও বলে থাকেন) যেন সবুজের গালিচা বিছানো। কিছু দূরে হলদে ফুলের সরিষা ক্ষেত সবুজে-হলুদে সুন্দর একটা আবহ সৃষ্টি করে রেখেছে। রবু আলির উপরে হাত বুলিয়ে নেয়। আলির ডগায় জমে থাকা শিশিরে ওর হাত ভিজে যায়।
নুরু তোর গুড্ডি খেতে পড়লে কিন্তু শেষ। পুরা ভিজা রইছে।
কি করমু দুই দিন থেইক্কা ভিজা সুতা নাটাইয়ে পইরা রইছে। আজকা শুকাইতে না পারলে পইচ্চা যাইব গা।
হাল্কা এক টুকরো রোদ ওদের আশায় দোলা দেয়, সাথে ঠান্ডা বাতাস। তবে আজ ঠান্ডা বাতাসটাও খুব একটা ভোগাচ্ছে না ওদের। চৌধুরীদের দেয়া গরম কাপড়ে সেটা অনেকটা পরাস্ত হয়েছে। নুরু নাটাই ধরে সুতো ছাড়তে থাকে আর রবু ঘুড়িটা নিয়ে দূরে চলে যায়। হলকা একটা বাতাসে রবু যখন ঘুড়িটা ছেড়ে দেয়, নুরুর সুনিপূণ নাটাই চালনায় সেটা মুহুর্তেই আকাশ ছুয়ে ফেলে। রবু সব ব্যাপারে এগিয়ে থাকলেও এই ঘুড়ি উড়ানোতে নুরুর কাছে সবসময়ই হার মানে। কতবার যে চরের পাশে বয়ে চলা বালু নদীতে ঘুড়িগুলোকে "চা" খাইয়েছে। ঘুড়ির নদীর পানিতে পড়ে যাওয়াকে ওরা চা-খাওয়া বলে। এখানে নুরু ই সব কিছু।
একে একে সবাই নাটাই ধরে ঘুড়ি ওড়ানোর স্বাদ নেয়। আছিয়া যখন নাটাই ধরে সামনে পিছনে নেয় তখন ছেলেগুলো সবাই হেসেই খুন।
ঘুড্ডি উরানডা মাইয়া মানসের কাম না। তুইতো খালি নাডাই সামনে পিছে নিতাছস, সুতা ছারতেও পারস না পেছাইতে ও পারস না। দে রবুরে দে, হে তর থেইক্কা বালা উরাইতে পারে।
রবুর হাতে নাটাই তুলে দিয়ে নুরু বলে-
কালকা কিন্তু আমি পরথমে রস খামু, হেইডা মনে থাহে যেন্ । আবার বুইলা জাইস না।
ঠিকাছে, আমি আজকা গুড্ডি উরানো শিখখা ফালামুই। তুই আমারে বেশি বেশি গুড্ডি উড়াইতে দে তাইলে তরে পত্যেকদিন আগে রস খাইতে দিমু।
মিষ্টি ঠান্ডা খেজুরের রস আগে খেতে পারার লোভে নুরু আর রবুর কাছ থেকে নাটাই ই চায় না।
দুই//
গ্লাস ভর্তি করে ঠান্ডা খেজুরের রস চুক্ চুক্ আওয়াজ তুলে খাচ্ছে নুরু। আর ওর মা জগটা হাতে নিয়ে দাড়িয়ে আছে।
বাজান তাড়াতাড়ি খা, রস খাইতে অয় ঠান্ডা ঠান্ডা। গরম অইয়া গেলে রসে মজা থাকে না, মাতলা মাতলা লাগে।
মা এট্টু খাড়াও গেলাসেটা শেস কইরা লই।
গ্লাশের রসটা এক চুমুকেই খেয়ে নেয় নুরু। আহ্ কি তৃপ্তি।
মা মুতে ধরছে। মুইত্তা আয়ি, হের পরে খামুনে বাকিডা।
প্রস্রাবের বেগ হওয়ায় হঠাৎ সুন্দর স্বপ্নটা ভেঙ্গে যায় নুরুর। মসজিদে ফজরের আজানের শেষ অংশটা মাত্রই বলে ফেললেন মুয়াজ্জিন।
সালার মুতে ধরনের আর সময় হইল না। পুরা রস খাইলে মুত আইলে কি অইত।
খেদোক্তি করতে করতে ছেড়া ফাড়া কাথাটা আলতো করে সরিয়ে মায়ের অগোচরে বিছানা থেকে নেমে যায় নুরু। গতকালের পাওয়া গরম কাপড়গুলো গায়ে জড়িয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে। অল্পক্ষনের মধ্যেই সবাই হাজির হয়। সানুর বাড়িতে ঢোকার রাস্তাটা পূর্ব দিকে যেখানে ভাঙ্গাচোড়া ঘরটা দাড়িয়ে আছে। বাড়িতে ঢোকার সময় একজন অসহায় মানুষের ককানোর আওয়াজে সবাই থমকে দাড়ায়। অনেকটা ভয়ে ভয়ে ঘরের দরজার সামনে এসে নুরু ডাক দেয়-
সানু নানা ও সানু নানা।
ককানোর আওয়াজ ছাড়া আর কিছুই শোনা যায় না। রবু বলে ওঠে-
রাতে নোয়াপাড়ায় পালা গান অইব হুনছিলাম। নানায় মনে লয় হ্যানেই গেছে। ল গরে গিয়া দেহি খালায় মনে অয় একলা পইরা রইছে।
সবাই ভয় তাড়িয়ে ঘরে ঢুকে দেখতে পায় সানুর মা চৌকি থেকে নিচে মাটিতে পরে আছে। মাটির ঠান্ডা আর হিমেল হাওয়ায় হাড় সর্বশ বুড়িটা ঠকঠক করে কাঁপছে। উপরে উঠার শক্তিটুকুও আর অবশিষ্ট নেই। নুরু বুড়িটার হাত ধরে চমকে যায়। হাতদুটো বরফ ঠান্ডা হয়ে আছে। দৌড়ে বাইরে বেরিয়ে যায় সাথে আছিয়া আর দেলু ও সাথী হয় তার। রবু বুড়ির কাছে বসে থাকে। অল্পক্ষন পরেই তিন জন কিছু খড়কুটো, কাগজ আর লাকড়ির কয়টা টুকরো নিয়ে ঘরে ঢোকে। ছোটখাট একটা আগুন জ্বালায় ওরা। বুড়িকে ধরে আগুনের কাছে বসায়। আছিয়া আর নুরু বুড়ির হাত-পা ঘষে ঘষে গরম করার চেষ্টা করে। আগুনের উত্তাপে আর এই ছোট দলটার চেষ্টায় বুড়ির শরীরে উষ্ণতা ফিরে আসে। এমন সময় সানু বাড়িতে আসে। ধাতস্ত হয়ে যখন পুরো ঘটনা মায়ের কাছে শুনতে পায় আহাজারী করে কাঁদতে থাকে।
আল্লাহ আমার মা'র কিছু অইলে আমি মাইনসেরে মুখ দেখাইতাম ক্যামনে। আমারে কোন শয়তানে ধরছিল, বইনডা বাড়িত নাই জাইনাও আমি গেছিলাম গান হুনতে............।
বুড়িটার অবস্থার উন্নতি দেখে ওরা সবাই ঘর থেকে বেরিয়ে চলে আসে। ওদের আর খেজুরের রস খাওয়ার কথা মনে থাকে না। আলাদা একটা রস ওদের পরিতৃপ্ত করে রাখে। আজ আর কারো মন খারাপ নেই।
তিন//
বাজান ও বাজান ওডছনা। পত্যেকদিন সকাল সকাল উইট্টা যাছ আজকা উডছনা ক্যা! দ্যাখ খেজুরের রস। খাবি না।
উহু স্বপ্নে রস খাইয়া মজা নাই। খামু না। সানুর মা বুড়িটা বালা অইলে আবার গাছতলায় গিয়া খামু।
ঘুমের ঘোরে কথাগুলো বলে নুরু আবার পাশ ফিরে শুয়ে থাকে।
নুরুর মা জগ থেকে টাটকা খেজুরের রস গ্লাশে ঢালেন। ছেলেকে তুলে ঘুমন্ত অবস্থাতেই খাওয়াতে থাকেন। হঠাৎ মিষ্টি স্বাদে নুরুর ঘুম ভেঙ্গে যায়। চোখদুটো কচলে বলে-
সত্যি! মা সত্যি রস আনছো! কই পাইলা মা? সব আমারে দিও না দেলু, রবু আর আছিয়ার লাইগ্গা ও রাইখো।
হাসতে হাসতে মা বলেন-
অগর চিন্তা করতে অইব না। তগর সানু নানা আজকা রস বেঁচে নাই সব রস তগর লাইগা পাঠায়া দিছে।
খুশিতে নুরুর চোখ দুটো চক্ চক্ করে ওঠে। আর ওর মা পরম তৃপ্তি নিয়ে ছেলেকে ভাবেন। অতটুকু ছেলে শুধু বুদ্ধির গুনে দায়িত্ব মনে করে সানুর মা\'কে বাঁচিয়ে দিল। মায়ের দু\'চোখ বেয়ে উষ্ণ দুফোটা গর্বের জল গাল গড়িয়ে ঝড়ে পড়ে।
১৯ জানুয়ারী - ২০১১
গল্প/কবিতা:
৩৫ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ এপ্রিল,২০২৫