ক্যাম্পাসের ঠিক কম্পিউটার ফ্যাকাল্টির সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলাম ক্লাসের জন্য। স্যার আসতে দেরি হবে, কি আর করা, অপেক্ষা করতে হবে। একটা বিষয় নিয়ে আলোচনা করছিলাম বন্ধুদের সাথে। হঠাৎ একটি ছোট্ট ছেলে আমাদের কাছে এসে বললো, ভাইজান, চা খাইবেন? এক কাপ মাত্র দু'টাহা (দুই টাকা), বন্ধুরা কেউ ওর দিকে না তাকিয়ে বললো, যা লাগবেনা। কিন্তু পরক্ষণে ছেলেটির দিকে তাকিয়ে সবাইতো অবাক, এত সুন্দর একটি বাচ্চা ছেলে এতটুকু বয়সে মানুষের ধারে ধারে চা বিক্রি করছে! জীবনের চলার পথে এই ধরনের অনেককিছুইতো দেখেছি, কখনো মেনে তেমন দাগ কাটেনি আমার , সম্ভবত আমার বন্ধুদেরও তাই হয়েছিল। যাক, আমাদের সকলকে চা দিতে বললাম। ছেলেটি আমার হাতে চায়ের কাপটি দিতেই জিজ্ঞেস করলাম, তোমার নাম কি? ছেলেটি বলে,'আমার নাম নয়ন'। সত্যি, সৃষ্টি কর্তার ইচ্ছা বটে। যেমন তার নাম, তেমনি তার নয়ন কারা চেহারা। মনে প্রশ্নের জোয়ার উঠতে লাগলো। হঠাৎ এত সুন্দর একটি ছেলে যাকে দেখলে যে কারো মন সুন্দর হয়ে উঠতে বাধ্য, সেই ছেলেটি কেনো আজ তার ওজনের চেয়েও ভারী একটি চায়ের ফ্লাক্স নিয়ে মানুষের ধারে ধারে চা বিক্রি করতে হচ্ছে? জানতে চাইলাম নয়নের কাছে, নয়নও বলতে শুরু করলো তার কথা গুলো।
নয়ন: আমার মায়ের একডা দোহান আছিল, একবার আমগো দোহান ঐ বেডারা বাইঙ্গা দিছে। আর আমার মায়রে ঐ বেডারা ধইরা খুব মারছে? আবার চা'র গরম পানি দিয়া মা'র মায়ের হাতে পায়ে মারছে, মা অহোন কোনো কাম করবার পারেনা। আমি ঐ ছোড স্কুলডায় পড়তাম ক্লাস টুতে। এহন পাশের বাসার এক আপায় চা বানাই দেয়, আর আমি বেচি।
কথাগুলো শুনতে শুনতে পায়ের রক্তগুলো মাথায় চড়ে বসল। কিছু একটা করতে হবে, আমার বন্ধুরাও শুনে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল। নয়নকে বললাম ওই লোকদেরকে চিনো? নয়ন বললো, না ভাইজান আমি চিনিনা, আমার মায় চিনে। আমরা নয়নকে এক জায়গায় দাড়ঁ করিয়ে আমি সহ বন্ধুরা সবাইকে অন্যদের একসাথ করলাম, সকলকে ঘটনা খুলে বললাম। অবাক করার মত সবাই ভয়ংকর প্রতিবাদী হয়ে উঠল, সবাই বলে উঠল চল এখুনি ঐ শালাদের একটা চরম শিক্ষা দিয়ে আসি। আর নয়নের মায়ের জন্য বা নয়নের পরিবারের জন্য কিছু করা যায় কিনা দেখ। আমি আর বোরহান মিলে সি,আই এর কাছে বেপারটা খুলে বললাম। স্যার প্রথমে বিষয়টি তেমন গুরুত্ব দিতে চাইনি, তবে আমাদের সকলকে একত্রিত দেখে বেপারটি আমলে দিল। সি, আই স্যার আমাদের কলেজ কোষাদক্ষ থেকে কিছু সহযোগিতা করেন, আর বাকিটুকু আমরা সবাই পুরো কলেজ থেকে কালেকশান করি।( "একটা কথা বলে নেওয়া দরকার বুঝার জন্য, আর তা হলো নয়নের বাসা আমাদের কলেজের ঠিক পাশে")। আমরা সকল বন্ধুরা নয়নকে হাতে নিয়ে গেলাম তার মায়ের কাছে, ওর মাকে দেখেত আমরা রীতিমত স্তব্দ। ওই পাষুন্ডরা ওর মায়ের হাত-পা গরম পানি দিয়ে জ্বলসে দিয়েছে। নয়নের মায়ের কাছে জানতে চাইলাম ঘটনা কি ঘটেছিল, নয়নের মা বললো গত পরশুদিন পাঁচজন লোক আইছিলো আমার দোহানে। আইসা আমার কাছে দু;হাজার টাহা চাইছিলো। আমি করতেহে এত টাহা দিমু, আর কেন দিমু? ওরা কইলো ব্যবসা করিবেল্লাই বলতি এডে চাঁদা দওন পইরবো। টাহা দিতে পারিনায় বইলা আমারে ওরা মাইরা আমার দোহান ভাইঙ্গা হালাইছে, আর জাওনের সময় আমার গায়ে চাএর গরম পানি ঢাইলা দিছে। আল্লাহ ওগো বিচার করুক। জিজ্ঞেস করলাম কারা তারা, উত্তরে তিনি বললেন আমি ওগোরে চিনিনা বাপ। শুনে রাগ আরও বেড়ে গেল, কারণ ওই শালাদের ফেটাতে পারলামনা। যাক, আমাদের সংগ্রহকৃত টাকাগুলো নয়নের মায়ের হাতে দিলাম। এরপর পাশে একটি লাইব্রেরীর দোকান ছিলো, সেখানে আমাদের কয়েকজনের নাম্বার দিয়ে আসলাম। যেন এরপর কোনো কেউ যদি এসে কোনো গণ্ডগোল পাকাতে চাই, সাথে সাথে যেন আমাদের জানায়। কিন্তু অবাক বিষয় হলো আর কোনো সমস্যা হয়নি নয়নদের। এরপর আমাদের পরোক্ষা শেষ হলো, কলেজ থেকে বিদায় নিয়ে আসলাম। চাকুরী নিলাম, এভাবে চলতে থাকলো। মনের অজান্তেই ভুলে গেলাম নয়নের কথা। হঠাৎ বোরহানের একটা কল বেজেঁ উঠলো, বলল চল, আমরা সবাই ক্যাম্পাসে আরেকবার একসাথ হই। অনেকদিন কারো সাথে দেখা নাই। ১২ই জানুয়ারী সবাই একসাথ হলাম, খুব মজা করলাম, খুব ভালো লাগল। কিন্তু অবাক বিষয়, তখনও নয়নের কথা করো মনে পরেনি। এটাই বোধহয় আমাদের চিরাচরিত স্বভাব। আমরা বিদায় নেয়ার পাক্কালে হঠাৎ লাইব্রেরীয়ান রফিক ভাইয়ের সাথে দেখা, উনি আমদের দেখে না হেসে মুখ ভার করে বললো, আপনারা এতোদিন পর এলেন? শুনে প্রথমে একটু অবাক হলেও পরে জানতে চাইলাম কেন তিনি এ কথা বললেন! তিনি উত্তর দিল, নয়নের কথা ভুলেগেছেন আপনারা? নয়নের কথা মনে পড়তেই কেমন যেন লাগলো, তারপরেও জিজ্ঞেস করলাম নয়নের কি অবস্থা? রফিক ভাই বলল, আমি আপনাদের মোবাল নাম্বার হারায় ফেলেছিলাম তাই জানাতে পারিনাই। আপনারা চলে যাবার পর ওই বদমাইশরা আবার আসছিলো, আর নয়নের মাকে খুব ভয় দেখিয়ে গেছিল। নয়নের মা ভয় পেয়ে ছেলেকে নিয়ে বাড়িতে চলেগেছে। কথাগুলো শুনার পর মুহুর্তেই হারিয়ে গেল আমাদের আনন্দ, চুপসে গেলাম আমরা। আমার বন্ধুদের কেমন লাগছিল জানিনা, তবে নিজের প্রতি খুব ঘৃণা হচ্ছিল। এই আমি! এই আমরা! এই আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশের স্বাধীনতা!