ঘৃণিত জনমে সেই শিশুটি
শাহ আজিজ
শিঞ্জির পর্বতমালায় হাজার হাজার ইরাকী ইয়াজিদি ও কুর্দি আশ্রয় নিয়েছিল । তাদের গ্রাম ও শহরগুলো ইসলামিক স্টেটের জিহাদিদের হাতে দখল হয়েছে । ওদের বিশ্বাস নেই , ওরা আমাদের মেয়েদের ধরে নিয়ে গেছে অজানা জায়গায়। আমাদের ছেলেদের হত্যা করেছে ঘাড়ে গুলি করে ।
ভোর বেলাতেই শরণার্থীরা আবার হুড়মুড় করে পালাতে শুরু করল সিরিয়ার বর্ডার অভিমুখে। ইসলামিক স্টেটের জ্বিহাদীরা নাকি এখন শিঞ্জির ভ্যালির পথে। অনেক মৃত্যু আর রক্ত দেখে ভীষণ ভীত এই শরণার্থী দল ।
চার বছর বয়েসি আজিজ একটি চাদরের উপর শুয়ে তার আর তিনটি ভাই বোনের সাথে খেলছিল। কয়েকদিন হয় তারা এখানে এসেছে। চারিদিকে শুধু লালচে রঙের পাহাড় এবং নিরেট বৃক্ষহীন । পানির বড্ড অভাব এই শিঞ্জির প্লেটোতে । পানির কষ্ঠে আর দুপুরের উত্তপ্ত পাহাড়ের অসহনীয় তাপে আজিজ ও তার ছোট ছোট ভাই বোনেরা নাকাল।
আজিজ জানেনা কেন তারা পালাচ্ছে !
শুধু জানে ইরাকী মুসলিম খলিফারা তাদের বাড়িঘর ও জমি থেকে তাদের তাড়িয়ে দিতে চায় , ওদের আদেশ না মানলে গলা কেটে শাস্তি দেবে। কিন্তু কেন ? মাথায় আসেনা আজিজের।
আজিজ জন্মগত পঙ্গু। তার মা সময় হলেই খাবার দেন , রাতে মা বাপ দুজনে মিলে তাকে ভাইবোনের কাতারে শুইয়ে দেন। সে শুয়ে শুয়েই খেলে প্লাস্টিকের পিস্তল দিয়ে।
চারিদিকের দৌড়ঝাঁপ দেখে ছেড়া তাঁবুর আড়াল থেকে বোঝার চেষ্টা করে কি ঘটছে !
তার মা মাথায় নেবার পুটলি গোছাতে ব্যাস্ত । বাবা বাইরে অনেক লোকের সাথে উচ্চকণ্ঠে আলাপ করছে।
মা আমরা কোথায় যাবো?
সিরিয়ায়, মায়ের দ্রুত উত্তর ।
কেন?
মুসলিমরা আসছে আমাদের হত্যা করতে !
চুপ মেরে গেল আজিজ। তার মাথায় ঢোকেনা এসব । তার দুশ্চিন্তা আঙ্গুর গাছ ঘেরা তাদের বাড়িতে কবে ফিরবে তারা। আজিজ দেখল তাঁবুর বাইরে বাবা ও মা নিচুস্বরে আলাপ করছে। মা তার দিকে তাকিয়ে চোখ মুছছেন । বাবা কাছে এসে বললেন ‘পুত্র আজিজ , তুমি এখানে এই তাঁবুর নিচেই থাকবে । , তোমাকে নেয়ার জন্য কোন লোক পাওয়া গেলনা , আমি ও তোমার মা দুটি পুটলি ও ছোট তিনটিকে নিয়ে যাচ্ছি। তুমি অপেক্ষা কর । আজিজ মাথা নাড়ল । মা এসে বুকে জড়িয়ে তাকে চুমু খেল । ছোটরাও তাই করল। ছোট পাত্রে পানি আর কখানা শুকনো রুটি তার পাশে রেখে বাবা দ্রুত তাঁবুর বাইরে চলে গেল।
অবাক চোখে আজিজ তাই দেখল।
বাইরে ভিড় কমে এসেছে। সবাই চলে যাবার বেশ পরে আরেক দল লোক এসে আজিজকে দেখল ও তাঁবুটা পরখ করল ।
তারা বেশ আদরমাখা গলায় বলল তোমাকে ছোট তাবু দিচ্ছি , ছোট মানুষ ছোট তাবু ,বড় মানুষ বড় তাবু , তাইনা?
নিস্পলক তাকিয়ে আজিজ , বাকরুদ্ধ ! সে সক্ষম হাতটি দিয়ে তার রুটি ও পানির পাত্র আরও কাছে নিয়ে এলো , তার মনে আতঙ্ক এসে গেছে। রুটি সরাতে তার এত কষ্ট হয়েছে যে আজিজ চুপ করে শুয়ে বেদনা দূর করার জন্য সময় নিল। ক্রমশ রোদ তাতিয়ে উঠলো । সে অনুভব করল তার আশপাশ দিয়ে কেউ নেই। চোখ জ্বলছে । খুব কষ্ট করে সামান্য পানি খেতে পারল, কিছুটা পড়ে গেল,খারাপ লাগলো পানি নষ্ট হল বলে। তার ফিডার দিতে ভুলে গেছে মা। ওটা থাকলে এই কষ্ট হতোনা। হতাশা, বেদনা আর শরীরের যন্ত্রনা নিয়ে আজিজের চোখে তন্দ্রা নেমে এলো। আজিজ ঘুমিয়ে পড়ল।
**
এক দুপুর হেটে কয়েক হাজার মানুষের কাফেলা খেজুর গাছ ও আঙ্গুর ক্ষেতের বিশাল ছায়ায় বসে পড়ল।
একজন চিৎকার করে বলল ‘আমরা সিরিয়া বর্ডারের খুব কাছে, ওখানে পর্যাপ্ত খাবার পানি আর রুটি আছে’।
ঘোষণা এজন্য দিল যাতে এই অভুক্ত মানুষগুলো তাদের সঞ্চিত খাবার খেয়ে তীব্র ক্ষুধা নিবারন করে। সবাই আশ্বাস পেয়ে তাদের খাবারের টোপলা খুলে কদিন আগে বানানো শুকিয়ে রাবার হয়ে যাওয়া রুটি চিবুতে শুরু করল। খাবার গিলবার জন্য পানিই ভরসা তাও মেপে মেপে বিতরন। রাদিলা , আজিজের ছোট বোন জিদ ধরল ভাই কোথায় ?আমি ভাইয়ের সাথে খাব । একেবারে ছোট দুটি পানিতে ভেজানো রুটি খাচ্ছে । । তারা অবশ্য পথে মায়ের দুধ খেয়েছে পালা করে । জালাল বদর , আজিজের পিতা চিত হয়ে শুয়ে দীর্ঘশ্বাস নিচ্ছে। বাচ্চার বায়নাতে মা ক্ষিপ্ত হয়ে বলল যদি না খাস তোকেও রেখে আসব শিঞ্জিরে । রাদিলা কাদতে শুরু করলো । একসময় রাদিলা জিদ ছেড়ে খেতে লাগলো।
**
সূর্য ঢলে দুরের পাহাড়ের মাথায় । আরেকটু হলেই আঁধার নামতে শুরু করবে। চিন্তিত আজিজ বুঝতে পারল তার বিকলঙ্গতা তাকে ফেলে যাবার কারন । চারিদিক যখন অন্ধকারে ছেয়ে যেতে লাগলো একাকী আজিজ নির্জন এই প্রান্তরে ভয়ে কাপতে শুরু করলো। বাবা বাবা বলে ডাকল কিছুক্ষন । কিন্তু বাবা তখন নিজের জীবন বাচাতে সিরিয়ার রেডক্রসের তাবুতে, নিরাপদে। আজিজ নামক বিকলাঙ্গ এক পুত্রের কথা সে ভুলেই গেছে। কণ্ঠ ক্ষীণ হয়ে এলো তার, খুব কাহিল এই শরীরে আর না ডেকে চুপ করে আকাশের দিকে সদ্য ফোটা তারার দিকে তাকিয়ে , তার চোখ বেয়ে দর দর করে পানি পড়তে লাগলো। পৃথিবীর তাবৎ দুঃখ এখন আজিজের বুকে। সে বুঝল বাবা মাকে ডেকে পাওয়া যাবেনা । তার চোখ দুটো জ্বলছে , দৃষ্টি ঝাপসা । চারিদিক ঘন অন্ধকার হয়ে গেলে সে তাঁবুর একটি অংশ টেনে চোখ আর মুখ ঢেকে পড়ে রইল । ভয়ানক ক্লান্ত শিশুটি ঘুমিয়ে গেল সহসাই ।
**
নতুন কম্বলের ঘ্রানে এক কিনারে জালাল শুয়ে বড্ড নিশ্চিত বোধ করছিল । যাক বাবা আই এসের জ্বিহাদী জানোয়ারদের হাত থেকে বাচা গেল । ভবিষ্যৎ এর কথা ভবিষ্যতই বলবে। সুযোগ পেলে ইউরোপ যাওয়া যাবে । সাদ্দাম মেরেছে, মারকিনিরা মেরেছে এখন মারছে আপন আরব ভাই । ধর্ম পালনে কিছুটা ভিন্নতা আছে কিন্তু বাকি বিষয় তো তেমন জটিল নয়। সাদ্দাম তাড়িয়ে দেয়নি । তার শিশু বয়েসে কেমিক্যাল বোমা মেরেছে কুর্দিদের ওপর কিন্তু কুকুরের মত তাড়িয়ে দেয়নি , মেয়েদের ধরে নিয়ে ইজ্জত হরন করেনি, বেচে দেয়নি ।তার পুলিশের চাকরিটা ভালই ছিল । সে হিসাব করতে লাগলো গত এক মাসে কি পরিমান তরুন যুবকদের ধরে নিয়ে খোঁড়া কবরে শুইয়ে এক এক করে গুলি করে হত্যা করছে। তারা পুলিশ সহকর্মীরা এক হয়ে বসে এই সব হিসাব কিতাব করত। হটাত ঘর বাড়ি ছাড়ো না হয় মরো শুনেই স্থির করে ফেলল এসব ছেড়ে যেতে হবে । পুরো গ্রাম ধরে সবাই সবকিছু ছেড়ে আজ এই শিবিরে শুয়ে ।
ধুম করে দৃশ্যপটে ভেসে উঠলো পুত্র আজিজের মুখখানি । সে এই অন্ধকারে কি করছে একাকী, বিচলিত জালাল মাথা উঠিয়ে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে ফিস ফিস করে বলল তোমার কি আজিজের কথা মনে পড়ছে?
হ্যা , পড়লেও কি করব? নিজ হাতে ছেলেটিকে ছেড়েছি , হয়ত হায়েনায় খাবে না হয় মুসলিম জানোয়ারের হাতে মরবে। মালিক তাউস তাকে নিয়ে যাক , আমি তাকে মালিকের হাতে ছেড়ে দিয়েছি !
জালাল একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল ।
এক বছর বয়েসি আজিজকে ডাক্তাররা জন্ম পঙ্গু বলে ঘোষণা করলে তারা ভেঙ্গে পড়ল । তারা পুত্রকে লালিস এ নিয়ে গেল তীর্থ যাত্রায়। জালাল পাহাড়ের লেকে নেমে মালিক তাউসের শরীর ধোয়ায় অংশ নিল। ওই উৎসবে ষাঁড় জবাই হয়, ইয়াজিদিদের জমজম থেকে পানি পান করাল পুত্রকে । এক সপ্তাহের তীর্থযাত্রা শেষে লালিস থেকে তারা বাড়িতে ফিরল। কিন্তু পুত্র আজিজের কিছুই হয়নি।
ভাবতে ভাবতে ক্লান্ত জালাল এক সময় ঘুমিয়ে পড়ল ।
**
আকাশে আলো ফুটতেই আর ইগলের তীক্ষ্ণ আওয়াজে আজিজের ঘুম ভেঙ্গে গেল।
কিন্তু কি আশ্চর্য সে তার চোখ খুলতে পারছে না। আজিজ বোঝার চেষ্টা করলো ব্যাপারটা কি! সক্ষম হাতখানা আস্তে তুলে আনল এক চোখে এবং অনুভব করলো চোখ জুড়ে শক্ত ময়লা জমে আছে। হাতখানা এখন বেশ সচল । ময়লা খুঁটতে শুরু করলো সে এবং সফলতার সাথে কিছুটা তোলার পর সে পরিস্কার আকাশ দেখতে পেল। হটাৎ সে অনুভব করলো এটা একটা জনমানবহীন পাহাড়ি এলাকা এবং কাল রাতে সে এই শক্ত পাথরের ওপর ঘুমিয়েছে । তার মা বাবা তাকে এখানে রেখে গেছে। একটা লোক এসে তাকে নিয়ে যাবার কথা ছিল , কিন্তু কেউ আসেনি তাই সে এখানে শুয়ে। মা বাবা কি সিরিয়ায় গেছে? রাদিলা? তাকে কখন নেওয়া হবে? এক ঝাপটা ঠাণ্ডা বাতাস এসে তার সম্বিৎ ফেরাল । হ্যা তার কাছে তো রুটি ছিল , একটু পানিও ছিল । ডান হাত যতদুর যায় আজিজ ঘুরিয়ে রুটি খুজে ব্যার্থ হল তবে পানির পাত্র পাওয়া গেল তাও খালি, একফোটা পানি নেই তাতে। চুরি গেছে তার খাদ্য। পেটটা মোচড় দিল ক্ষুধাতে , গলা শুকিয়ে কাঠ । মনে হলো একটু পানি পেলে তার কি ভাল লাগত।
সূর্য উঠলো ।
আজিজ এবার শক্তি নিয়ে বাবাকে ডাকতে লাগলো ।
নাহ বরং দুর্বল কণ্ঠ আরো দুর্বল হলো । চুপ করে শুয়ে রইল সে । সূর্যের আলো তার চোখে মুখে জালা ধরাতে লাগলে আজিজ ভাবলো ঈশ্বর সূর্য এত নিষ্ঠুর কেন ? বাবা তো সকাল সন্ধ্যা এই সূর্যকেই সিজদা দিত।
দুপুর এলে গরমের ফুল্কি ফুটতে লাগলো চারিদিক। আজিজ তার বোধশক্তি হারিয়ে ফেলেছে।তার বন্ধ চোখের সামনে বাবা মা আর রাদিলার মুখ ঘুরতে লাগলো । একসময় তীব্র ঝলকে মুখগুলো হারিয়ে গেল। তার মাথা বন বন করে ঘুরছে আর এক অদ্ভুত যন্ত্রনা তার মাথা ঘিরে খেলছে। আস্তে আস্তে আজিজ কোমায় চলে গেল।
**
পড়ন্ত দুপুরে সাঁজোয়া যানের বহর দেখা গেল । এরা স্বাধীন কুর্দি সেনাবাহিনী । তারা দূরে থাকতেই তিনটা গোলা মারল এই উচু ঢিবির পিছন দিকে। এবার রাস্তা বেয়ে ঢিবির উপর এসে থামল, পেছনে বাকি সাঁজোয়া যান পাহাড়ের ঢালে । প্রথম সেনা বহনকারি গাড়ী থেকে সেনারা লাফ দিয়ে অস্ত্র উচিয়ে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল । কুর্দি বাহিনীর লেফটেন্যান্ট দুরবিন দিয়ে দূরে সতর্ক চোখে দেখছেন। ঢিবির উত্তর দিকে ছেড়াখোঁড়া তাবু , কাগজ পেরিয়ে তিনি আশ্চর্য হয়ে আবিস্কার করলেন একটি শিশু একটু কাত হয়ে ঘুমিয়ে আছে বা মৃত ঠিক বোঝা যাচ্ছেনা। হাক পাড়লেন দুতিনজনকে । তারা দ্রুত এগিয়ে এলে তিনি ইশারায় দেখিয়ে দিলেন। ওরা অবাক হয়ে শিশুর শরীরটি দেখল, হাত পা ধরে, মাথা স্পর্শ করে কাপড়ের ভিতর দিয়ে বুকে হাত রেখে কিছুই আন্দাজ না করতে পেরে একজন সৈনিক তার মুখ ও চোখের উপর বসা মাছি তাড়িয়ে কোলে তুলে নিল শিশুটিকে। এবার শিশুর বুকে সতর্ক কান পাতা এবং একটু জোরেই লেঃ কে বলল শিশুটি জীবিত, স্যার !! লেঃ আগ্রহ ভোরে এগিয়ে এসে বললেন এ আমাদেরি কুর্দি ইয়াজেদি কোন শিশু, ওরা গতকাল এই জায়গা ছেড়ে সিরিয়ায় পালিয়েছে। তার ওয়াকি টকি চালু হল। একটি অজ্ঞান মুমূর্ষ শিশুকে নিকটের হাসপাতালে নিতে হবে ;ওভার । অ্যাম্বুলেন্স কি বহরের পেছনেই থাকবে; ওভার। হ্যা তাই থাক; ওভার। যে সৈনিক শিশুটিকে কোলে নিয়ে বসে ছিল লেঃএর ইশারায় সে দৌড়াতে শুরু করলো। লেঃ তখন বলছেন সিরিয়াস ডিহাইড্রেশন কেস, এ সি চালাও আর স্যালাইন রেডি কর ।; ওভার। দৌড়ে যাওয়া সৈনিককে বাকি ট্রাকের সেনারা জিজ্ঞাসা করছে জীবিত কিনা। এলহাম, ওই সৈনিকের নাম, চিৎকার করে বলছে জীবিত তবে খুব খারাপ। বহরের শেষ গাড়িটি অ্যাম্বুলেন্স । ঠাণ্ডা হয়ে থাকা গাড়িটি চলতে থাকল আর একজন সেনা ডাক্তার তাকে প্রথমেই অক্সিজেন মাস্ক পরিয়ে একটি জীবনরক্ষাকারি ইঞ্জেকশন পুশ করলেন এবং খুব দ্রুত স্যালাইন পুশ করলেন কারন তার নাড়ি খুজে পাওয়া যাচ্ছিলনা । আবার ওয়াকিটকি কমান্ডার , আমরা ওকে কোথায় নেব; ওভার। কামিশলি হাসপাতাল ভাল ও নিরাপদ;ওভার ।
কামিশলি সিরিয়ার একটি ছোট্ট শহর । সিরিয়ার একটি কোনা চিকণ হয়ে ইরাক ও তুরস্কের মধ্যে ঢুকেছে , হাসপাতালটা ওখানেই । সিরিয়ার যুদ্ধ এই এলাকা স্পর্শ করেনি। আগত কুর্দি শরণার্থীরা এই এলাকার মধ্যেই বা কাছে পিঠে রেডক্রসের তাবুতে থাকছেন।
শিশুর হার্ট বিট বেড়েছে , মনিটরে দেখা যাচ্ছে , প্রেশার নর্মাল । এলহাম ও সেনা ডাঃএর মুখে হাসি যে তারা একটি জীবন রক্ষা করতে পেরেছেন । শিশুর চোখ ভেজা তুলা দিয়ে সাফ করলেন ডাঃ , হাত ও পায়ের নিচ একইভাবে। শিশুর জ্ঞান ফেরেনি । এটি একটি অত্যাধুনিক অ্যাম্বুলেন্স যাতে সার্জারি পর্যন্ত করা যায়।
ভরা সন্ধ্যায় তারা হাসপাতালে পৌছতেই ডাঃ ও নার্সের একটা দল টাকে ইনটেন্সিভ কেয়ারে নিলেন। সবাই যার যার মত নিরবে তাদের কাজ সমাপন করলেন এবং শিশুর নোংরা শরীরটিও পরিস্কার হল । শেষ রিপোর্ট লিখে নিয়ে কুর্দি সেনাবাহিনীর ডাঃ সেনা অ্যাম্বুলেন্সে রওনা হলেন ট্রুপের সাথে মিলিত হতে। বিদায়ের প্রাক্কালে এলহাম শিশুর হাত ধরে ছল ছল চোখে নিরবে বিদায় নিলেন। কার বুকের ধন ফেলে গেছে অনাদরে , এলহামের সৈনিক মন নরম হয়ে এলো।
হাসপাতালের ডাঃ পরিক্ষা করে শিশুটির চোখে মারাত্মক ত্রুটি দেখতে পেলেন । মাঝ রাতে আজিজের ঘুম ভাঙল বা জ্ঞান ফিরল । তার মুখে কোন কথা নেই , নেই প্রতিক্রিয়া, চাহিদা বা অভিযোগ । নির্বাক শিশুটি ঠোট নাড়িয়ে কিছু খাওয়ার ভঙ্গি করতেই নার্সরা বড় ড্রপার দিয়ে শিশুটিকে শীতল পানি খাওয়াতে গিয়ে দেখলেন সে ক্রমাগত পানি পান করছেই। হয়ত ওর পেটে কিছুই নেই।
ভোর থেকেই রেডক্রস ও অন্যান্য দাতা দেশগুলোর ডাক্তারে হাসপাতাল ভর্তি হয়ে গেল। ডাক্তাররা যার যার বিষয় যত্ন করে দেখলেন।ভোর রাতের মুত্র রিপোর্ট ,রক্তের প্রায় সব পরিক্ষার রিপোর্ট দেখে তারা সিদ্ধান্তে এলেন শিশুটি প্রচণ্ড রৌদ্র তাপের নিচে থাকার ফলে তার ব্রেইন শকড হয়ে এলোমেলো হয়ে গেছে । তার চোখের কর্নিয়া ক্ষতিগ্রস্থ , রক্তনালিতে রক্ত জমাট বেধেছে , চোখের ওপরের পর্দা খুবই ক্ষতিগ্রস্থ বিধায় সে পরিস্কার দেখতে পাচ্ছেনা এবং প্রচণ্ড শকড হওয়ায় সাময়িক প্যারালাইজড শরীরে তার অনুভুতি লোপ পেয়েছে বলে কথা বলার বা কিছু বোঝার ক্ষমতা তার নেই। ডিহাইড্রেশন ব্যাপারটা আরো জটিল করেছে ।সবচে বড় বিষয় তার কিডনি দুটো মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্থ । ঈশ্বরের ইচ্ছায় সে জীবিত বিশেষ করে কুর্দি সেনা ডাক্তারের দ্রুত সেবায় । দীর্ঘ সময় নেবে এগুলো সারতে। রোগীর কোন পূর্ব ইতিহাস তাদের জানা নেই । অজানা এই শিশুটিকে শিঞ্জির পর্বত ভ্যালিতে ৫৩ ডিগ্রি তাপমাত্রা সইতে হয়েছে বলে সেনা উদ্ধারকারী দলের রিপোর্ট বলছে । সবাই তাদের গাড়িতে রক্ষিত প্রয়োজনীয় ওষুধ দিলেন । তারা প্রতিদিন সিরিয়ার এই অঞ্চল ও আর কিছু নিরাপদ এলাকায় বহু জাতি গোষ্ঠীর লক্ষ শরণার্থীকে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন।
নার্সরা ভাগ করে নিল ডিউটি। দুপুরের নার্স শিশুটির চোখের সামনে হাত ঘোরালে শিশু কোন প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। মনে হয় সে পরিস্কার দেখতে পাচ্ছে না তাইতো বলেছিলেন ফরাসী ডাক্তার। অনেক বার কথা বলানোর চেষ্টা করলো নার্সদের চিফ মায়মুনা। সবার আগ্রহ কেরে নিয়েছে এই অজানা শিশুটি । ব্রিটিশ সংবাদ মাধ্যম সচিত্র খবর দিল অজানা শিশুটিকে নিয়ে। নাহ শিশু কোন প্রতিক্রিয়া দেখায়নি কথা বলতে বা শুনতে । তার একদিকের হাত ও পা খাটো । ডাক্তাররা এটি খেয়াল করেছেন এবং বলে গেছেন হাত বা পা যদি নাড়ানো শুরু হয় তবে যেন ডাক্তারকে তা জানানো হয়। তৃতীয় দিনে ডান হাত নড়তে দেখে ডাক্তারকে খবর করতেই তিনি হাজির হলেন। ইনি সুইডেনের ত্রান কার্যক্রমের চিকিৎসা বিষয় দেখাশোনা করেন। বেশ চেষ্টা করে তিনি বুঝলেন শিশুটির বা হাত ও পা জন্মের পর থেকেই অসাড়। ডান দিক ভাল আছে এবং তাকে কিভাবে থেরাপি দিতে হবে তা দেখিয়ে দিলেন । চোখের ও কিডনির ডাক্তার এসে পরীক্ষা করে বললেন কর্নিয়া বদল করা যাবে কারন অসংখ্য মানুষ মারা যাচ্ছে এবং সেই সাথে দুটি কিডনিও। বেওয়ারিশ লাশ গুলো রেডক্রসের মাধ্যমে দাফন হয় । যুদ্ধ আহত অনেক সৈনিককে এরকম সুবিধা দেওয়া হচ্ছে । তবে শিশুটিকে দামেস্কে তাদের হাসপাতালে নিলে আরো উন্নত চিকিৎসা দেওয়া যাবে। তাকে চকোলেট , দুধ, বাটার দিয়ে গেছে সংস্থাগুলো । চকোলেট ব্যাপারটা শিশুর খুব প্রিয় মনে হল। কিডনি বিপাকে তাই পরিমিত খাবারের কঠোর নির্দেশ। দুজন সিরিয়ান সাংবাদিক এলো তাকে দেখতে। তারা বিষয় জানল এবং ছবি তুলল। এদের একজন ফেসবুকে সাহায্য চাইল শিশুটির স্বজনদের খোঁজ নিতে। এক মর্মস্পশী বর্ণনা সবাইকে উদ্ভুত করলো এটাকে শেয়ার করে ছড়িয়ে দিতে। মাত্র ছয় ঘণ্টায় ১ কোটি লোক জেনে গেল এই হৃদয়বিদারক ঘটনাটি। প্রস্তাব এলো শিশুর চিকিৎসা ব্যয় ও রিহ্যাবিলাইটেশন বিষয়ে ফান্ড গঠনের। তিন চার দিনের মধ্যেই ২০ হাজার ডলার জমা পড়ল রেডক্রসে। কর্পোরেট ফান্ড গঠন করলো ব্রিটেনে , ৮০ হাজার ডলারের । প্রথম দশদিন আজিজ ভাল থাকলেও এবার তার শরীরের অবনতি হবে লাগলো । এই ছোট হাসপাতালে ডায়ালাইসিস মেশিন নেই। নেই অনেক যন্ত্রপাতি । এই ছোট কামিশলি শহরের সব মানুষ জেনে গেছে এবং মানুষের ভিড় বেড়েছে শুধু একনজর দেখার জন্য।
**
ইয়াজিদিদের যে রিফিউজি ক্যাম্প তা এখান থেকে ১৫০ কিলোমিটার হবে। আজিজের মা বাবা এখন দুর্ভাবনাহীন সন্তানের ভাগ্যের ব্যাপারে। কিন্তু শিশুটিকে নিয়ে দুনিয়া তোলপাড় হচ্ছে এখবর এই নির্জন এলাকার ক্যাম্পে পৌছায় না। আগে ভাগে আসা এক যুবক তার ল্যাপটপে ফেসবুকিং করে। সময় কেটে যায় তার। হটাত সে একটি শেয়ার করা ছবি আর খবর পেল একটি অনাথ শিশুর ব্যাপারে। শিঞ্জির পর্বতমালা থেকে উদ্ধার হয়েছে জেনে তার আগ্রহ বাড়ল। বেশ কিছু আরব ফেসবুকার বলল এই শিশু অবশ্যই ইয়াজিদি অথবা মুল কুর্দি হবে কারন শিঞ্জির পর্বতে অন্য কেউ আসেনি। যুবক এবার তার প্রতিবেশীদের ক্যাম্পে ঢুকে তাদের দেখাতে লাগলো শিশুর ছবি। নাহ! নিজেরাই দুর্ভাবনায় আছি কার খোঁজ কে নেয়। বড্ড হতাশাগ্রস্ত অবস্থা এখানকার মানুষের মনে যারা ছেড়ে এসেছে আপন ভুবন , ঘরবাড়ি , ক্ষেত খামার , চাকুরি । কবে বা আদৌ তারা ফিরবে কিনা কেউ জানেনা। পরদিন একজন ইয়াজিদি পুলিশের কর্মকর্তা এখন শরণার্থী, ছবি দেখে তার পঙ্গুত্বের লেখা পড়ে বললেন আমাদের একজনের সন্তান এরকম । সে আশেপাশের কোন ক্যাম্পে সবে এসেছে, দেখাও হয়েছে কিন্তু তার সন্তান সে ফেলে আসবে কেন? বেশ কষ্ঠ করলো যুবক, পুলিশের সাবেক কর্মকর্তা আর স্বেচ্ছাসেবীরা । জালাল বদর পিসোকে খাতায় খুজে তার কাছে গেল ওরা। জালাল বদর বিস্মিত তার পুত্রের ছবি দেখে। ওরা ঠিকানা লিখে দিল। আজিজের মা আর বাবা খুশী হলো তাদের সন্তান কারো কাছে আশ্রয় পেয়েছে। ফিরিয়ে আনতে অনীহা তাদের । এই বোঝা সারাজীবন কে টানবে ,তার থেকে ও ভাল আছে, আশ্রয়, খাদ্য সব পাচ্ছে।
যুবক ফেসবুকে খবর চাউর করে দিল জালাল বদরের । তারা যে স্বেচ্ছায় সন্তান ফেলে এসেছে তাও জানাল সে। মিডিয়াগুলো নড়েচড়ে উঠলো । তাদের টার্গেট কামিশলির হাসপাতাল।
**
শিশু আজিজের অবস্থা খারাপ । তার শরীর ক্রমশ অবনতির দিকে। আগামিকাল তাকে হেলিকপ্টারে করে দামেস্ক নেয়া হবে এই সিদ্ধান্ত হল এবং এটিও ফেসবুকে ছড়িয়ে গেল । আজিজ এখন লিড নিউজ । তার নাম ও বয়স ক্যাম্পের যুবক আগেই বলে দিয়েছে । আজিজ কোমায় চলে গেছে বিকাল নাগাদ। ডাঃ নার্সরা তার শরীরের রক্ত চলাচল ও হৃদ স্পন্দন ঠিক রাখার চেষ্টা করছেন।
সন্ধ্যাতেই যুবক আবারো দৌড়ালো জালালের ক্যাম্পে । আশ্চর্য হয়ে যুবক দেখল বিকারহীন এক পিতাকে।
আপনার পুত্র এখন শেষ অবস্থায় । দেখতে চাইলে আজই যান ।
গোটা ক্যাম্প আগেই জেনেছিল এই দুর্ভাগ্যের কাহিনী আজ ছড়িয়ে পড়ল নৃশংস এক পিতার কাহিনী। জালাল বলল সে এখনি রওনা দিচ্ছে। শিঞ্জির পাহাড়ে জালালের পাশে অনেকেই এই দৃশ্যটি দেখেছে কিন্তু তারা ভাবতেও পারেনি জালাল শিশুটিকে একেবারেই ত্যাগ করে জীবন বাচাতে ব্যাস্ত। জানাশোনা পরিবারের মধ্যে হাহাকার পড়ে গেল ।
আজিজের হৃদ স্পন্দন ক্ষীন হয়ে এসেছে। বিবিসির হেডলাইনে খবর এলে শহরের লোক ভেঙ্গে পড়ল হাসপাতালে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ নিয়োগ হল। মায়মুনা এই ১৩ দিন সামান্য সময় ঘুম ছাড়া বাকি সময় কাটিয়েছে শিশুটির পাশে । রাত্রিকালীন ডাঃ নার্সরা ভিড় করে আছে রুমের মধ্যে । রাত তিনটার দিকে আজিজ আমাদের পরিচিত পৃথিবী ছেড়ে অসীম অনন্তে ঠাই নিল। বড় অভিমান নিয়ে চলে গেল শিশুটি । উপস্থিত সবাই ডুকরে কেদে উঠলো । হাসপাতালে তো কত রোগীই মারা যায় কিন্তু এই শিশুর মৃত্যু সবাইকে নাড়া দিয়ে গেল।
ভোরে আজিজের মিডিয়ায় আসা একটি বড় ছবি হাতে জালাল হাজির। সে বলল আমিই আজিজের বাবা ।
খবর পেয়ে মায়মুনা পোশাক পরে ঘুম ঘুম চোখে বারান্দায় এসে জিজ্ঞাসা করল কে আজিজের বাবা।
আমি ।
যে বাবা মা একটি পঙ্গু শিশুর ভার সইতে না পেরে ৫৩ ডিগ্রি তাপে গরমে পাহাড়ের উপর পরিত্যাগ করে আনন্দে দিন কাটায় তারা মা বা বাবা হতে পারে না। তারা মরুভূমির নেকড়ে । তুমি অভিশপ্ত বাবা, পৃথিবীর তামাম লানত তোমার জন্য , দূর হও শুকর দূর হও ------। ডাক্তার নার্সরা মায়মুনার পতনশীল শরীরটিকে ধরে ফেলল। অতি উত্তেজনায় জ্ঞান হারাল মায়মুনা ।
মর্গে আজিজের গোসল শেষে কাফন পরানো হচ্ছে। জালালের দিকে কারো ভ্রুক্ষেপ নেই। সে বসে আছে বেঞ্চে ছবি হাতে। রেডক্রস চিফ বললেন যে কেউ দাবি করলেই মৃতদেহ তাকে দেওয়ার নিয়ম নেই। বেচে থাকাকালিন শনাক্ত হলে ভিন্ন ব্যাপার আর সেইবা কোথায় তাকে কবর দেবে। কামিশলি শহরের বাইরে খেজুর বাগানে অসংখ্য বেনামী কবরে আজিজের দাফন হল । একজন ইমাম জানাজা পড়ালেন । একটি হেলিকপ্টার এসেছিল দাফনের পর কিন্তু তারা ফেরত চলে গেল খালি হাতে। আজিজের কবরে রেডক্রসের একটি কাগজের ফলকে লেখা “ Anonymous Baby rescued from mount shinjar.He was 4 years old”.