এক
কলেজের টিচার রুমের পারসোনাল লকার বন্ধ করতে করতে সুজাতা বললো,
‘এই শিমু...তোর জুনায়েদকে মনে আছে? সেই যে...জুনায়েদ ভাই! আমাদের দুই ব্যাচ সিনিয়র ছিল। তোদের পাড়ায় থাকতো!’
গলাটা ভিজিয়ে নেওয়ার জন্য পানির বোতলটার মুখ খুলছিলাম। সুজাতার কথা শুনে হাত থেকে বেশ খানিকটা পানি ছলকে পড়লো। দু’একটা হার্টবিটও মিস করলাম মনে হয়।
জুনায়েদ ভাই! মনে নেই আবার!
আমার জবাব না পেয়ে সুজাতা বলে যেতে লাগলো,
‘আরে...মনে নেই? আজিজ স্যারের কাছে প্রাইভেট পড়তে গেলে মাঝে মাঝে সামনাসামনি দেখা হয়ে যেত। ফর্সা...লম্বা...একমাথা এলোমেলো চুল...কত মেয়ের যে গোপন ক্রাশ ছিল!’
আমি খুবই সন্তর্পণে নিজেকে যথাসম্ভব আড়াল করে উত্তর দিলাম,
‘উ...ম...হুম মনে আছে। কেন কী হয়েছে উনার?’
সুজাতার গলায় চাপা উচ্ছ্বাস। মুখটাকে হাসিতে উদ্ভাষিত করে বললো,
‘আরে... আর বলিস না! আজ কলেজে আসার জন্য রিক্সা খুঁজছি। হঠাৎ দেখি জুনায়েদ ভাই! একটা গাড়ি থেকে নেমে এলো। আমি তো উনাকে দেখেই একেবারে থ হয়ে গেছি। সেই কতদিন আগের কথা! পঁচিশ বছর তো হয়েই গেল! কিন্তু কী আশ্চর্য! তেমন একটা চেঞ্জই হয়নি উনার বুঝলি! প্রায় একই রকমই আছে বলতে গেলে!’
আমার বুকের মধ্যে কেমন যেন শিরশিরে একটা অনুভূতি হলো। চাপা স্বরে প্রায় ফিসফিসিয়ে বললাম,
‘তা...উনি সেখানে কী করছিলেন?’
‘একটা বাসা খুঁজছিলেন। আশেপাশে কাউকে না পেয়ে আমার দিকে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন।’
‘তোকে চিনতে পেরেছে?’
‘নাঃ! আমাকে কীভাবে চিনবে? সেই মফঃস্বল শহরে পিচ্চিবেলায় দেখা! তাছাড়া...আমার সাথে কি উনার সেভাবে পরিচয় ছিল নাকি? প্রাইভেট পড়তে গিয়ে মাঝে মাঝে দেখা হতো শুধু। আমরা তখন ক্লাস নাইনে, আর উনারা এস এস সি পরীক্ষার্থী। আমাদেরকে ঠিকমত দেখারও তো প্রশ্ন আসে না!’
আমি নিজেকে লুকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করলাম। জুনায়েদ ভাই...জুনায়েদ...নামটা মনে মনে আওড়ালাম বারকয়েক। নিজের কাছেই নিজে প্রশ্ন করলাম,
‘এখনো কি আলোড়ন ওঠে কোনো? নাকি সময়ের অতলে হারিয়ে গেছে সব?’
জবাব পেলাম না সেই প্রশ্নের। মনের খুব গভীরে উঁকি দিয়ে খুঁজতে লাগলাম একটা চৌদ্দ পনের বছরের ঝলমলে কিশোরীকে। মাথাভর্তি ঝাঁকড়া ঘন চুল...সেই চুলগুলোকে বহুকষ্টে দলবদ্ধ করে উঁচু করে বেঁধে রাখা একটা পনিটেইল। দু’চোখের ঘনকালো পল্লবের ছায়ায় মুড়ে রাখা হাজার কথকতা। কই সে? আমি ব্যাকুল আগ্রহে খুঁজে বেড়াতে লাগলাম তাকে।
‘কী রে? কী এত ভাবছিস? চল যাবি না? সবাই তো চলে গেছে! তুই আর আমিই বসে আছি।’
সুজাতার ব্যগ্রসুর ভেসে আসতেই হুড়মুড়িয়ে ফিরে এলাম বর্তমানে।
কীসের খোঁজ করতে বসলাম আজ এই অবেলায়! কোথায় সেই রঙিন প্রজাপতির পালকে ওড়া স্বচ্ছ কাঁচের মতো দিনগুলো আর কোথায় এই বর্তমান! কোন অজানা দূরদেশে ফেলে এসেছি তাদের! দৃষ্টির সীমানা অতিক্রম করে তাকে খুঁজতে চাওয়া আজ আর বাতুলতা ছাড়া অন্য কিছু নয়। আজ যেখানে দাঁড়িয়ে আছি সেখানে শুধু বাস্তবতার মোটা চশমা...যে চশমার কাঁচ সময়ের ভারে অস্বচ্ছ...ঘোলাটে!
সুজাতা আর আমি হাঁটতে হাঁটতে পেরিয়ে এলাম কলেজের কম্পাউন্ড। আমি আর সুজাতা সেই ছোটবেলার বান্ধবী। আমি অবশ্য ক্লাস নাইনে থাকতেই ঢাকায় চলে আসি। সুজাতা ভার্সিটিতে পড়তে এলে আবার দেখা হয় দুজনের। তারপরে ঘটনাচক্রে একই কলেজে চাকরি।
সুজাতা হালকা তালে এগুতে এগুতে গল্প বলার ভঙ্গিতে বলতে লাগলো,
‘আমি তো সেই বাসার ঠিকানা দেখে একেবারে হাঁ! আমার বাসার দুই বাসা সামনেই বুঝলি? কিছু জিজ্ঞেস করবো কী না ভাবছি। জুনায়েদ ভাই নিজে থেকেই বললেন, উনার ট্র্যাভেল এজেন্সির জন্য নাকি বাসাটা ভাড়া নিয়েছেন। ট্র্যাভেল এজেন্সের ব্যবসা করে বুঝলি?’
আমি কিছু বললাম না। চুপচাপ হেঁটে যেতে লাগলাম মাথা নীচু করে। সুজাতা হাঁটতে হাঁটতে মাঝে মাঝেই আমার দিকে তাকাচ্ছিল। আমার অন্যমনষ্কতা হয়ত ওর নজর এড়াচ্ছিল না। একবার বলেও ফেললো,
‘কী রে তুই দেখি আজ একেবারে চুপচাপ! সারাদিন তো ভালোই ছিলি! শরীর খারাপ লাগছে নাকি? মাইগ্রেনের ব্যথাটা উঠেছে?’
আমি ছোট্ট করে শুধু বললাম,
‘নাহ্ শরীর ঠিকই আছে। এমনি ক্লান্ত লাগছে একটু।’
মাইগ্রেনের ব্যথাটা আমার মাঝে মাঝেই ওঠে। কবে থেকে এই ব্যথার উৎপত্তি তা কেউ না জানলেও আমি জানি। সেই সেদিনের বিকেলের পরে বাসায় ফিরেই কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়েছিলাম। অবেলায় ওভাবে শুয়ে থাকতে দেখে বাবা-মা অস্থির হয়ে ডাকাডাকি শুরু করে দিয়েছিল। আমি কাঁথার নীচ থেকে অবরুদ্ধ অশ্রুকে চাপাতে চাপাতে বহুকষ্টে বলেছিলাম,
‘আজ খুব ঘুম পাচ্ছে। ঘুমাবো আমি। খেতে ইচ্ছে করছে না। প্লিজ আমাকে ডাকাডাকি কর না!’
বাবা-মার মুখটা না দেখতে পেলেও বেশ বুঝতে পেরেছিলাম, তাদের বিস্মিত মুখে চিন্তার ছাপ ফুটে উঠেছে। নিয়ম না ভাঙা মেয়েটি হঠাৎ কেন আজ নিয়ম ভেঙে অসময়ে শুয়ে পড়লো, এই জিজ্ঞাসা তাদের ঘিরে ধরেছে।
একটু পরে পায়ের শব্দ মিলিয়ে যেতে আমি ঘরের বাতি নিভিয়ে দরজার ছিটকিনি টেনে দিয়েছিলাম।
বাইরে তখন ঘোর অন্ধকার। বর্ষার নিমগ্ন বিষণ্ন প্রকৃতি তার সারাগায়ে কালি মেখে নিয়ে যজ্ঞে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছে। সেই অন্ধকার কালিমাখা বিকেলে এক হাজার বর্ষাকে বুকে নিয়ে আমি অঝোরে ঝরতে লাগলাম। কিছুতেই সেই প্লাবন যেন থামার নয়।
পরদিন বেশ বেলা করে বিছানা ছাড়লাম আমি। প্রচণ্ড ব্যথায় আমার মাথার সমস্ত শিরা উপশিরা যেন ছিঁড়তে বসেছে। দু’চোখ টকটকে লাল। আমার এই বিধ্বস্ত দশা দেখে বাবা-মা আঁতকে উঠলো। আমি শান্তভাবে আশ্বস্ত করলাম তাদের। বোঝাতে চাইলাম, কিছুই হয়নি আমার!
কিন্তু মাথাব্যথাটা সেদিনের পর থেকে আর পিছু ছাড়তে চাইলো না আমার। সারাজীবনের জন্য সঙ্গী হয়ে থেকে গেল।
আর আরেকটা জিনিসকেও সেদিনের পর থেকে সঙ্গী করে নিলাম...বুকের খুব গভীরে তাকে গোপনে লুকিয়ে রাখলাম। পাথর চাপা দিয়ে...সবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে!
চোখের আড়ালেই লুকিয়ে রইলো সে। কখনো সামনে আসার কিছুমাত্র আকুতি জানালো না।
আমার একাকী গোপন সেই মেয়েবেলা...আমার প্রথম পাওয়া কষ্ট!
দুই
জুনায়েদ ভাইরা আমাদের বাসার ঠিক সামনের বাসাটাতেই থাকতো। বারান্দার টবগুলোতে পানি দেওয়ার ছলে প্রায়ই বারান্দায় এসে উদাস চোখে তাকিয়ে থাকতাম আমি। নীচে ছুটে চলা মানুষের দল অথবা আকাশের সীমানা ঘেঁষে ভেসে বেড়ানো মেঘ...সবকিছুতেই উপচে পড়তো আমার অকারণ উদাস দৃষ্টি। শুধু সামনাসামনি তাকাতে পারতাম না সুস্পষ্ট লক্ষ্যভেদ করে। কখনো কখনো প্রখর রোদে হঠাৎ নামা বৃষ্টির মতোই সামনের বারান্দাটা উদ্ভাষিত হয়ে উঠতো কারো সতেজ উপস্থিতিতে।
চোখে চোখ পড়ে গেলে লজ্জার সীমা থাকতো না।
জুনায়েদ ভাইকে আমাদের পাড়ার হিরো বললেও কম বলা হয়। যেমন সুন্দর হ্যাণ্ডসাম দেখতে ছিল, তেমনি দুর্দান্ত খেলতো। পাড়ার সামনের মাঠটাতে তাকে প্রায়ই ব্যাডমিন্টন আর ক্রিকেট খেলতে দেখা যেত। ধুসর ট্রাউজার, সাদা টি শার্ট...বুদ্ধিদীপ্ত চোখে লুকিয়ে রাখা কৌতুহলী দৃষ্টি।
জুনায়েদ ভাই ল্যাবরেটরী স্কুলে পড়তো। তাদের স্কুলের আজিজ স্যারের কাছে আমাদের গার্লস স্কুলের কয়েকজন বান্ধবী প্রাইভেট পড়তাম। একদিন স্যারের বাসা থেকে বেরুবার সময়ে হঠাৎ একদল ছেলের হৈ হৈ শব্দে সিড়ির মুখেই আটকে গেলাম। বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতোই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলাম, বন্ধুদের সাথে গল্প করতে করতে জুনায়েদ ভাই উঠে আসছে।
সেদিন থেকেই জানলাম, সেও স্যারের কাছে পড়ে। স্যারের কাছে আমরা সপ্তাহে তিনদিন যেতাম। সেই তিনদিনের একদিন তাদের সাথে আমাদের রুটিন মিলে যেত। মনে মনে প্রার্থনা করতাম, ‘আজ যেন স্যার আমাদের একটু দেরি করে ছাড়েন!’
কারণ আর কী! দেরি করে পড়ানো শেষ হলে যদি জুনায়েদ ভাইয়ের একটুখানি দর্শন পাই! কিছুদিন পরেই তো তাদের এসএসসি পরীক্ষা। আর মাত্র কয়েকটা দিন বাদেই এই একটুখানি দেখাদেখি...সেটুকুও তো বন্ধ হয়ে যাবে!
জন্মাবধি আমি মুখচোরা। জুনায়েদ ভাইকে দেখলেই গলার কাছে কী যেন আটকে যেত। অক্সিজেনের অভাবে হাঁসফাঁস করতাম। চোখের সামনে দিনেদুপুরে লক্ষ তারার মেলা বসতো।
আমাদের ক্লাসের মহুয়াটা ছিল ছেলে নাচানি মেয়ে। সেই বয়সেই পাঁচ ছ’টাকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরিয়েছে। ঘুরাবেই বা না কেন? ছেলেগুলো সব এসে পটাপট পড়ে যেত মহুয়ার পায়ের কাছে। তার একটুখানি দর্শনীর আশায় স্কুলের গেটের কাছে কতজনকে যে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি!
মহুয়া ছিল ফাটাফাটি সুন্দরী। কাটাকাটা নাকমুখ...উদ্ধত রাজহংসীর মতো সুডৌল গ্রীবা, বাঁকা ভ্রুভঙ্গি। আর সেই বয়সেই শরীরের খাঁজে খাঁজে ফুটে উঠেছিল ধেয়ে আসা সুনামীর সুনিশ্চিত সম্ভাবনা।
মহুয়া যে রূপেই শুধু আটকে ফেলতো সবাইকে, তা মোটেও নয়। ওর ঠোঁটকাটা বাক্যবাণে কেউ আর মুখ খোলার সাহসই পেত না। তাই ছেলের দল ওকে দূর থেকে দেখেই প্রাণের আঁশ মেটাতো। কাছে যাওয়ার সাহস পেত না। যাদেরকে সে কৃপা করে কাছে টানতো, তারাই শুধু মহুয়ার বিশেষ সান্নিধ্যের সুযোগ পেত।
জুনায়েদ ভাইরা পড়তে এলে আমি মোমের মতো গলে গলে স্তুপাকার হয়ে পড়ে থাকতাম। আমার আলাদা কোনো অস্তিত্বই যেন থাকতো না। আশেপাশে কাউকে দেখতে পেতাম না তখন। মনে হতো, বিশাল ধু ধু প্রান্তরে পৃথিবীর জন্মলগ্নের কোনো সূচনা পর্বে যেন দাঁড়িয়ে আছি আমরা দুজন...আমি আর জুনায়েদ ভাই।
সেদিনও সিঁড়ির মুখে তাকে দেখেই আমার পা দুটো শক্ত হয়ে জমে গেল। একটুও এগুতে পারলো না সামনে। ছেলেরা বার কয়েক গলা খাকারি দেওয়ার পরেও কারো কোনো কথাই কিছুমাত্র কানে গেল না আমার। মাথা কেমন ঘুরছে! চোখের সামনে হলুদ সরিষা ক্ষেত।
এক ইঁচড়ে পাকা বদ ছোড়া ঠিক আমার সামনে এসে আমাকে উদ্দেশ্য করে দু’হাতে তুড়ি বাজিয়ে বললো,
‘এই যে খুকি, একটু সরবে নাকি ভূতে পেয়েছে?’
আমি ইতস্তত মুখে সরে আসতে যাবো, এমন সময় মহুয়া এসে সেই ছেলের সামনে সটান দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো,
‘এই যে, খুকি কাকে বললেন? আমাদের বান্ধবীকে? আমরা খুকি আর আপনারা বুড়ো? কত বছরে বুড়ো হয়েছেন?’
মহুয়ার মারমুখি ভঙ্গি দেখে সেই ছেলে তো পালাতে পারলে বাঁচে। একটা কথাও না বাড়িয়ে পিছু হঠতে যাচ্ছে এমন সময় জুনায়েদ ভাই এসে খপ করে ছেলেটির শার্টের কলার চেপে ধরে বললো,
‘কী রে, এটুকুতেই হাওয়া বেরিয়ে গেল তোর! এই যে ম্যাডাম ফুলনদেবী! খুকি বলে যদি আমার বন্ধু আইন ভেঙে থাকে তাহলে আমি শুধরে নিলাম। এবার খুশি হয়েছেন তো? এখন দয়া করে কি আপনাদের রাস্তাটা ছেড়ে দিতে আজ্ঞা হবে? নাকি আমরা আপনাদের ডিঙিয়ে ডিঙিয়ে পার হব?’
মহুয়া রক্তচোখ দিয়ে জুনায়েদ ভাইকে ভস্ম করতে করতে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। আমি তাড়াতাড়ি সিড়ির মুখ থেকে সরে এসে তাদের যাওয়ার জন্য জায়গা করে দিলাম।
হৈ চৈ করতে করতে চলে গেল তারা। সেদিকে তাকিয়ে ফোঁস ফোঁস করতে করতে মহুয়া বললো,
‘কত বড় বজ্জাত! আমাকে বলে ফুলন দেবী! ঐ ছেলের নিজের নাম যদি না ভুলিয়ে ছেড়েছি তাহলে আমিও ...’
মহুয়া আরো কী কী যেন বলে গেল। আমার কানে তখন কিছুই ঢুকছে না। একটু আগে উচ্চারিত হওয়া কিছু শব্দ আর সেই শব্দকে ছাপিয়ে উঠে আসা একটা কণ্ঠস্বর তীব্রতর বেগে প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো আমার মনের অলিতে গলিতে।
বজ্রাহতের মতো আমি উল্টেপাল্টে সেই কণ্ঠস্বরকেই শুধু শুনে যেতে লাগলাম।
তিন
‘এই তুমি সেই সেদিনের মেয়েটি না? তুমি এই বাসায় থাকো?’
সেদিন আমি সত্যি সত্যিই গভীর মনোযোগে বারান্দায় বসে ছবি আঁকছিলাম। আওয়াজটা কানে আসতেই চমকে সামনে তাকালাম। মুহূর্তেই একরাশ উজ্জ্বল আলো এসে ধাঁধিয়ে দিয়ে গেল আমার বিবর্ণ সকাল।
বাসায় পড়া ট্রাউজার আর নীল টি শার্ট পরে ঝকঝকে মুখে সামনে তাকিয়ে আছে জুনায়েদ ভাই। আমাকে দেখে যেন তার বিস্ময়ের সীমা নেই। তার এই বিস্ময় অবশ্য মেকি মনে হলো না আমার কাছে। আমরা এই পাড়ায় এসেছি মাত্র কয়েকমাস। এখনো সবাই আমাদের ঠিকমত চেনে না। সামনাসামনি বাসাতেই থাকি, অথচ জুনায়েদ ভাইও কখনো দেখতেই পায়নি আমাকে!
কিন্তু তাতে কী! আমি তো সেই প্রথমদিন থেকেই তাকে চিনি।
প্রথম দেখার সেই দিনটি ছিল ভারী মজার।
আমরা এই পাড়ায় এসে বাসার গোছগাছ সেরে সবাই মিলে গল্প করছি। এমন সময় ঝনাৎ ঝন শব্দে জানালার কাঁচ ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল। একে তো নতুন পাড়া...কাউকে চেনাজানা কিছু নেই। বাবা একটু ভয়ই পেয়ে গেল। ভয়ে ভয়ে বারান্দার কাছে এসেই অবশ্য বাবার সেই ভয় দূর হলো। মুখভাবে বেশ একটা প্রশান্তিভাব ফুটে উঠলো।
বাবার পিছুপিছু বারান্দায় এসে দেখি, কয়েকজন ছেলে কাঁচুমাচু মুখে আমাদের বাসার জানালা লক্ষ্য করে তাকিয়ে আছে। তাদের দুজনের হাতে ক্রিকেট ব্যাট। বাবাকে দেখেই তাদের মুখ শুকিয়ে গেল। আমতা আমতা করে বললো,
‘আংকেল...এমন হয় না আমাদের...আজ হঠাৎ...আমরা খুব দুঃখিত! আমাদের বলটা কি...ইয়ে... একটু দেওয়া যাবে?’
বাবা কপট রাগ দেখিয়ে বললো,
‘দিতে পারি এক শর্তে। জানালার কাঁচ যে ভেঙ্গেছে তাকে ওপরে উঠে আসতে হবে!’
সেদিন বল নিতে জুনায়েদ ভাই উঠে এসেছিল আমাদের বাসায়।
সঙ্কোচে ভরা তার সেদিনের সেই মুখটি ছিল দেখার মতো। কুণ্ঠা জড়ানো লাজুক চাহনি আর পালিয়ে বেড়ানো ভীরু হাবভাব। বাবার হাসিমুখ দেখেও তা পুরোপুরি কাটছিলো না।
ঐ তুমুল ঝক্কিতে সে হয়ত আমাকে লক্ষ্যই করেনি। আমি কিন্তু সেদিনই দেখে নিয়েছিলাম তাকে। তাকে দেখেই কী জানি এক অজানা অনুভূতিতে ছেয়ে গিয়েছিল মন। চলে যাওয়া মাত্রই ছুটে গিয়েছিলাম নিজের ঘরে। দরজা ভেজিয়ে তাকিয়ে ছিলাম আয়নার দিকে। নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বারবার দেখেও কেন যেন সন্তুষ্ট হতে পারছিলাম না। নিজের চেহারা নিয়ে চিরকালের উদাসীন আমার মনে সেদিনই প্রথম প্রশ্ন জেগেছিল...কেন আমি আরেকটু সুন্দর হলাম না!
আমার জবাব না পেয়ে জুনায়েদ ভাই আবার বললো,
‘তুমি আজিজ স্যারের বাসায় পড়তে যাও না?’
আমার কান দিয়ে তখন গরম হল্কার মতো কিছু একটা বেরুচ্ছে। কোনমতে উত্তর দিলাম,
‘জি।’
‘আরে তুমি এই বাসাতেই থাকো! দেখ জানিই না! তুমি কী করছো এত মনোযোগ দিয়ে?’
জুনায়েদ ভাইয়ের গলার স্বর একেবারেই স্বাভাবিক। ধীরে ধীরে আমিও একটু স্বাভাবিক হলাম। শান্তমুখে বললাম,
‘ছবি আঁকছি।’
‘বাঃ! ছবি আঁকতে পারো? দেখাও তো দেখি কী আঁকছিলে!’
আমাকে তখন অন্যকিছুতে পেয়েছে। জুনায়েদ ভাই আমার ছবি দেখতে চাইছে! তাড়াতাড়ি ঘর থেকে আমার ড্রইং খাতাটা নিয়ে এলাম। দূর থেকেই দেখাতে লাগলাম। জুনায়েদ ভাই কী দেখলো কে জানে। নিখাঁদ বিস্ময়ের সাথেই বললো,
‘আরিব্বাবা! এসব তুমি এঁকেছো? বেশ আঁকো তো! এত সুন্দর পেন্সিল স্কেচ করেছো! আমার একটা স্কেচ করে দিও তো!’
সেদিনের পর থেকে প্রতিদিন রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়ার পরে, আমি একটু একটু করে জুনায়েদ ভাইয়ের স্কেচ আঁকতে থাকি। খুব যত্নে নিখুঁত আঁচড়ে তুলে নিয়ে আসি একটি আরাধ্য মুখ। কল্পনার রঙে দেখা সেই মুখে বাস্তবের আঁচড় টানি। জুনায়েদ ভাই তার স্কেচ আঁকার জন্য আমাকে অনুরোধ করেছে। আমি আমার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ স্কেচটি তার জন্য এঁকে নিয়ে যাবো!
প্রতিদিন একটু একটু করে পূর্ণতা পায় আমার কল্পনার রঙগুলো। আমি প্রতীক্ষা করি সুন্দর কিছু মুহূর্তের। গাছের পাতাগুলো যেদিন তরতাজা সবুজ রঙে ভেসে যাবে...অথবা বৃষ্টি এসে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে নিদাঘ প্রকৃতি...হয়ত সেদিন আমার প্রতীক্ষার দিন ফুরোবে। কাঙ্খিত সেই সুন্দর দিনে আমি স্কেচটি তুলে দিব তার হাতে।
প্রেমপত্র কেমন হয় আমি জানি না। আবেগের প্রকাশ কতটা তীব্র হতে পারে আমার তা শোনা হয়নি কখনো। তবু নিজেকেই নিজে নিরন্তর জিজ্ঞেস করে চলি,
এক টুকরো কাগজে আঁকা এই প্রতিকৃতির কি ভাষা নেই কোনো? সে কি এতটাই বোবা?
চার
সেদিনও বারান্দায় দাঁড়িয়েই কথা হলো আমাদের। আমার স্কেচ আঁকা শেষ হয়েছে শুনে জুনায়েদ ভাই বললো,
‘তাই নাকি? দেখাও দেখি কেমন এঁকেছো!’
আমার আগের সেই সঙ্কোচ এখন অনেকটাই কম। পরিচিত সকলের চোখ বাঁচিয়ে এখন আমি প্রচুর কথা বলি জুনায়েদ ভাইয়ের সাথে। যদিও চোখের দিকে বেশিক্ষণ চেয়ে থাকতে পারি না। কেমন যেন নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে এখনো। জুনায়েদ ভাইয়ের কথায় আমি রহস্য করে বললাম,
‘সামনাসামনি দেখবেন। এতদূর থেকে ভালোমত বুঝতে পারবেন না!’
‘আচ্ছা বেশ! তাহলে কাল আমাদের ক্লাবঘরে একবার এসো বিকেলের দিকে। আমি থাকবো।’
পাড়ার বিশাল মাঠটার সাথেই জুনায়েদ ভাইদের ক্লাবঘর। সেখানে তারা নানারকম ইনডোর গেমস খেলে, আড্ডা মারে।
আমি অধীর আগ্রহ নিয়ে কালকের অপেক্ষা করতে লাগলাম।
আকাশ ছাপিয়ে প্রায়ই এখন অঝোর বর্ষণ। গাছের পাতাগুলোর বিবর্ণতা সরে গিয়ে ঝকঝকে সবুজ প্রলেপ। আমার প্রতীক্ষাকে আর দীর্ঘ না করার পণ নিয়ে প্রকৃতিও যেন একেবারে প্রস্তুত!
পরদিন বিকেল হওয়ার আগেই ক্লাবঘরে চলে গেলাম আমি।
সেদিন দুপুর থেকেই আকাশের গায়ে কালি লেপ্টে আছে। দিগন্ত ছাপিয়ে কালোমেঘের বাড়াবাড়ি রকমের দাপাদাপি। ঝড় না উঠলেই হয়! আমি ব্যগ্রভাবে এদিকে ওদিকে তাকাতে লাগলাম। কোথাও কেউ নেই! আশঙ্কা হলো, এসে ফিরে যায়নি তো?
হঠাৎ কী মনে হতেই একটু যেন ভয় ভয় করতে লাগলো আমার। এভাবে জুনায়েদ ভাইয়ের কথা শুনেই হুট করে চলে আসাটা মনে হয় ঠিক হয়নি। কোনো খারাপ মতলব থাকে যদি!
মা সবসময় বলে, ‘মেয়েদের তৃতীয় চোখ থাকতে হয়। যা অন্যরা দেখে না, তা মেয়েদের দেখতে শিখতে হয়!’
প্রচণ্ড ভয়ে আমি সবেগে বেরিয়ে এলাম ক্লাবঘর থেকে। দ্রুত পায়ে বাসার পথ ধরলাম।
মাঠের এক কোণায় বড় একটা অশথ গাছ। লম্বা ঝুড়িগুলো নেমে এসে গাছটিকে কেমন যেন শতায়ু কোনো বৃদ্ধের রূপ দিয়েছে। যার মুখ ভর্তি লম্বা দাড়ি। ইতিমধ্যে বাতাসের দাপট শুরু হয়ে গেছে। সেই দাপটে ঝুড়িগুলো এপাশ ওপাশে দোল খাচ্ছে। ভারি সুন্দর সেই দৃশ্য! হাঁটার গতি থামিয়ে আমি মুগ্ধ হয়ে সেদিকে তাকিয়ে রইলাম।
হঠাৎ গাছটির আড়ালে কী যেন নড়ে উঠলো।
গুটি গুটি পায়ে সামনে এগুতেই দেখি, গাছের বিশাল গুড়িতে জড়াজড়ি করে বসে আছে দু’জন নরনারী। বসে থাকার ভঙ্গিটিই বলে দেয়, তাদের দুজনের মধ্যকার সম্পর্কের প্রগাঢ় গভীরতা।
আকাশ ছাপিয়ে দাপিয়ে বেড়ানো কালোমেঘের আবছায়ার মাঝে সেই দূর থেকেও আমার বুঝতে অসুবিধা হলো না, ঐ দুজন নরনারী আর কেউ নয়...জুনায়েদ ভাই আর আমারই বান্ধবী মহুয়া!
পাঁচ
‘কী রে যাবি নাকি জুনায়েদ ভাইকে দেখতে? আমাদের পাড়াতেই থাকে এখন! চল একবার দেখা করে আমাদের পরিচয় দিয়ে আসি।’
আমি মৃদু হেসে সুজাতার দিকে তাকিয়ে বিদায় নিলাম। ওর প্রশ্নের কোনো উত্তর দিলাম না। রাস্তায় নেমেই বহুদিন পরে একটা কবিতার লাইন মনে পড়লো।
‘এখনো বিষাদ পাবে বলে
পুরুষ নারীর কাছে যায়
নারীরা নদীর কাছে যায়
নদীরা মাটির কাছে যায়
মাটি আকাশের দিকে চায়...’
সেদিনের সেই ঘটনার পরে আমি হঠাৎ করেই বাবাকে জানাই, আমি ঢাকার স্কুলে গিয়ে ভর্তি হব। বাবা-মা’র সবসময়ই ইচ্ছে ছিল, আমি ঢাকায় পড়ি। সেখান থেকেই স্কুল কলেজ পাশ করি। এতদিন আমিই বাবা-মাকে ছেড়ে যেতে চাইনি। এবার আমিই নিজে থেকে আগ্রহ দেখাচ্ছি দেখে বাবা-মা অবাক হলেও আপত্তি করলো না শেষমেষ।
আমি ঢাকায় চলে আসি। ঢাকার এক বোর্ডিং স্কুলে ভর্তি হই। বন্ধু বান্ধব স্কুলের শিক্ষক সবাই খুব অবাক হয়। প্রত্যেকেই জিজ্ঞেস করে, হঠাৎ এমন সিদ্ধান্ত আমি কেন নিলাম?
আমি কারো কোনো প্রশ্নেরই উত্তর দিই না। ছোটবেলা থেকেই মুখচোরা অভিমানী আমি...নিজেকে আস্তে আস্তে সরিয়ে আনি প্রত্যেকের চোখের আড়াল থেকে।
খুব অল্প বয়সে ঘটে যাওয়া এই ঘটনা আপাতভাবে তেমন কোনোই ছাপ ফেলে না আমার জীবনে। জীবনে ধীরে ধীরে পরিপূর্ণতা আসে...প্রাপ্তি যোগ হয়। তবু মনের কোথায় যেন...খুব গভীরে কোথাও...একটা নিকষকালো বিকেলের ছবি লুকিয়ে থাকে। আমি তাকে জোর করে বের করে দিতে চাই। অনেকবার চেষ্টা করেছি... পারিনি। তার স্থান সে কিছুতেই ছেড়ে দিতে রাজি হয় না।
সুজাতাকে না জানিয়ে একদিন চুপিচুপি গেলাম সেই ট্র্যাভেল এজেন্সির অফিসে। রিসেপশন কাউন্টারে বসে থাকা ঝকঝকে চেহারার লোকটার দিকে তাকিয়ে বহুদিন আগের সেই ঢিপঢিপে অনুভূতিটা ফিরে এলো আমার। ভয়ে ভয়ে তাকালাম লোকটার দিকে। জুনায়েদ ভাই...নাঃ! আশংকা মিথ্যে হয়। লোকটি স্মার্ট ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করে,
‘কাকে চান?’
‘আমি কি জনাব জুনায়েদ সাহেবের সাথে একটু দেখা করতে পারি?’
‘আপনার পরিচয় প্লিজ!’
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলি,
‘আমি একটু পরিচয়টা গোপন রাখতে চাচ্ছি। তবে...উনি আমার পূর্ব পরিচিত!’
লোকটি আর কিছু বলে না। আমাকে বসিয়ে রেখে টেলিফোনে অনুমতি নেয়। তারপর আমার ডাক আসে অন্যপাশের একটা রুম থেকে।
আমি দুরু দুরু পায়ে এগুতে থাকি।
আমার হাতে ধরা সেই এক টুকরো কাগজ...সময়ের ভারে বিবর্ণ, এবড়োথেবড়ো। কাগজের ওপর পাশে নিজের নামটাকে খুব যত্ন করে লিখেছিলাম একদিন, পেন্সিলের আঁচড়ে। এখানে আসার আগে আবার যত্ন করে সেটাকে মুছে দিয়েছি।
নির্ধারিত রুমের কাছে এসে আঁচলে ঘাম মুছি কপালের। তারপর ছোট্ট একটা টোকা দিই দরজায়। ওপাশ থেকে ভেসে আসে সেই ভারী কণ্ঠস্বর... একদিন যার প্রতিধ্বনিতে বিভোর হয়ে ছিলাম সারাটা দিন।
দরজার পাল্লা সরিয়ে ভেতরে ঢুকে ছোট করে একটা নিঃশ্বাস নিই।
সুজাতা ভুল কিছু বলেনি! জুনায়েদ ভাই সত্যিই আগের মতোই আছে। চামড়ার ভাঁজে লুকিয়ে থাকা সূক্ষ্ণ বলিরেখাগুলো প্রায় চোখেই পড়ে না বলতে গেলে! আমার আমিকে নিয়ে অবশ্য চিন্তার কিছু নেই আমার। এই সুদীর্ঘ পঁচিশ বছরে পৃথিবী তার মোটা আঁচড় বসিয়ে দিয়েছে আমার চেহারায়। আজ আমাকে দেখে সেই চৌদ্দ বছরের কিশোরীকে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।
জুনায়েদ ভাই পরিপূর্ণ চোখ মেলে তাকায় আমার দিকে।
সেই চোখে কোনো পরিচিত আর অপরিচিতের দোদুল্যমানতা কাজ করতে দেখি না। বরং চোখেমুখে স্পষ্ট জিজ্ঞাসা। আমার দৃষ্টি আটকে যায় টেবিলের একপাশে সাজিয়ে রাখা ফটো ফ্রেমটার দিকে। দুটি কিশোরের হাসি হাসি মুখগুলোকে ছাপিয়ে চোখ চলে যায় ছবির নারীটির দিকে। ঐটুকু সময়েই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আমি মহুয়াকে খুঁজতে থাকি! পাই না! এই নারী আমার অচেনা...
‘আপনি কি কোনো কাজে এসেছেন? আমার সাথে পরিচয় আছে আপনার?’
‘জি...একসময় আমরা পরিচিত ছিলাম। আপনার একটা জিনিস আমার কাছে ছিল! আপনাকে দেওয়া হয়নি। সেটাই দিতে এসেছি!’ স্পষ্ট গলায় বলি আমি।
‘আমার জিনিস? কী বলুন তো?’ জুনায়েদ ভাইয়ের চোখেমুখে এবার কৌতুহল ফুটে উঠেছে।
আমি ভাঁজ খুলে কাগজটাকে বিছিয়ে দিই টেবিলে। জুনায়েদ ভাই তুমুল আগ্রহে ঝুঁকে আসে সামনে। কয়েকটা মুহূর্ত অপেক্ষা করে আমি সরে আসি সেখান থেকে। তারপরে দ্রুত পায়ে ছুটতে থাকি বাইরে।
সেদিনের মতো নিকষ কালো আঁধার ছেয়ে নেই কোথাও। একটু আগেই ঝকঝকে রোদ লেপ্টে ছিল আকাশের গায়ে। তবু আচমকাই আমার মনে হলো, সেই রোদ পুরোপুরি সরে গিয়ে আকাশ ভরে উঠেছে কালিমাখা অন্ধকারে। জনবহুল পথটা হঠাৎই যেন একেবারে ফাঁকা। আশেপাশে তাকিয়ে কাউকে চোখে পড়লো না আমার।
বাতাসের তুমুল দাপটে এলোমেলো হয়ে গেল আমার শাড়ির আঁচল...খোঁপার বাঁধন আলগা হয়ে একরাশ কোঁকড়া চুল ছড়িয়ে পড়লো পুরো পিঠময়। পুরো রাস্তা জুড়ে আমি একদম একা।
একটু পরেই দ্রুত পদক্ষেপের একটা আওয়াজ ভেসে এলো কানে। পেছনে তাকিয়ে দেখি, চৌদ্দ পনেরো বছরের এক কিশোরী মুখে ওড়না চাপা দিয়ে ব্যগ্র মুখে ছুটে আসছে। আশেপাশে কোনোদিকে চোখ নেই তার। উদ্ভ্রান্ত এলোমেলো পায়ে সে ছুটে চলেছে অনির্ধারিত কোনো গন্তব্যে। হাতে ধরা আছে... সাদা একটুকরো কাগজ। কিশোরীর দু’চোখে অঝোর বৃষ্টির পূর্বাভাষ!
আমি থমকে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করি তার জন্য। একটু পরেই সে আমাকে ধরে ফেলে। তারপরে এগুতে থাকে আমার সাথে পদক্ষেপ মিলিয়ে।
আমি স্মিত মুখে সামনে তাকাই। অশ্রুত মধুর কোনো সঙ্গীত গুনগুনিয়ে ওঠে মনের কোণে। বুক ভরে টেনে নিই মাতাল হাওয়ার অজানা সুঘ্রাণ। আঃ শান্তি! ভেতরের বন্দী কিছুকে আজ এতদিন পরে আমি মুক্তির স্বাদ পাইয়ে দিয়েছি।
সেই শুনশান জনহীন রাস্তায়... নিজের ভেতরে দীর্ঘদিন লুকিয়ে রাখা গোপন সেই মেয়েবেলাকে সঙ্গী করে আমি এগিয়ে যেতে থাকি সামনে।
(একটি কোরিয়ান মুভি দ্বারা অনুপ্রাণিত। কবিতাংশটুকু ‘পুর্ণেন্দু পত্রী’ রচিত।)
লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা
ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য
কৈশোরের প্রথম আবেগ...প্রথম ভালোলাগা। সেই ভালোলাগাতে নেমে আসা প্রথম আঘাত।
অতঃপর আহত সেই ভালোলাগাকে সমাধিস্থ করে জীবনে এগিয়ে চলা।
তারপর...অনেক অনেক বসন্ত পেরিয়ে আবার মুখোমুখি হওয়া কৈশোরের সেই দুরন্ত আবেগের সাথে।
তারপর?
০১ ডিসেম্বর - ২০১৪
গল্প/কবিতা:
৬৭ টি
সমন্বিত স্কোর
৫.৭৪
বিচারক স্কোরঃ ৩.৩৪ / ৭.০
পাঠক স্কোরঃ ২.৪ / ৩.০
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪