উত্তুরে বাতাসে কেমন যেন একটা মাদকতা মিশে থাকে। গাছে গাছে পাতায় পাতায় কীসের যেন অজানা শিহরণ। সদ্য যৌবনার মতো রহস্যময় লুকোনো পদচারণ...ফিসফিসিয়ে কানাকানি। আর অকারণে হেসে লুটিয়ে পড়া ঝঙ্কারের মতোই ব্যস্ত হাওয়ারা শব্দ তোলে শনশন। সেই শব্দের সাথে ভেসে আসে হারিয়ে যাওয়া প্রিয় কোনো মুখ। খুলে যায় লুকিয়ে রাখা স্মৃতির সিন্দুক। গফুর মাস্টার শীতের এই হাওয়াটিকে ভীষণ রকম ভয় পান। একে তো স্মৃতি নিয়ে টানাহ্যাঁচড়া চলতে থাকে মনের ভেতর, তার ওপরে বয়স্ক হাড়ে হিড়হিড়ে ঠান্ডাটা একেবারে কেটেকেটে বসে যায়। লেপের ওমেও শরীর যেন সবটুকু উষ্ণতা খুঁজে পায় না। ঘাপ্টি মেরে পড়ে থাকেন ঠিকই, তবু নিস্তার মেলে না শীতের আগ্রাসী ছোবল থেকে। দিনের বেলাতে উত্তুরে বাতাসকে অবজ্ঞা করেই কাজে বেরুতে হয়। বিলের রাস্তাটা দিয়েই প্রতিদিন আসা যাওয়া করেন তিনি। কচুরিপানারা সারি বেঁধে মানববন্ধন করতে করতে নিজেদের সাম্রাজ্য বানিয়ে ফেলেছে পুরোটা খাল। সেদিকে তাকিয়ে থই মেলে না পানির গভীরতার। খাল পার হওয়ার বাঁশের সাঁকোটা বড় বেশি নড়বড় করে এখন। অথচ ছেলে ছোকরাগুলো বই খাতা শুদ্ধ কেমন তরতর করে হাসতে হাসতে পার হয়ে যায় সেই বাঁশের সাঁকো! তিনি বুঝতে পারেন, সাঁকো নড়বড়ে হয়নি। নড়বড়ে হয়েছে তার শরীরের কলকব্জাগুলো। কম তো চড়াই উতড়াই পার হতে হয়নি এতদিন! এই সামনের ডিসেম্বরেই জীবনের পঞ্চান্নটা বছর পুরো হয়ে যাবে। আস্তে আস্তে ধেয়ে চলেছেন অবসরের দিকে। আর তো মোটে ক’টি বছর! অথচ মনে হয় এই তো সেদিন! নতুন চাকরি পেয়ে বাবা-মা’কে মিষ্টি মুখ করালেন। খুশিতে নাকফুল নাচিয়ে নাচিয়ে মায়ের বলা সেই কথাগুলো আজো কেমন কানে ভাসে, ‘আসছে অঘ্যাণেই পোলার বিয়া দিয়া দিমু। বুড়া বয়সে হাত পুড়াইয়া আর রান্ধবার পারুম না! পোলার বউ আইয়া রাইন্ধা বাইড়া খাওয়াক কয়টা দিন!’ এমনই তার পোড়া কপাল! ছেলের বউয়ের হাতের রান্না খাওয়াও বেশিদিন কপালে জুটলো না। হাত পুড়িয়ে সেই তাকেই আজো রান্না করে যেতে হচ্ছে। হাড় জিরজিরে শরীরটা নিয়ে তিনি আজ অব্দি টিকে রইলেন, অথচ ছেলের বউ সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে অকালেই পরপারের পথে রওয়ানা দিয়ে দিল। স্বামী খুইয়েছেন আরো আগে, নাতিপুতি নিয়ে ভর-ভরান্তি সংসার দেখে যাওয়ার প্রকাশ্য আকুতি আর কখনোই সত্যি হলো না। হাজার অনুনয়েও গফুর মাস্টার আর বিয়ে করতে রাজি হলেন না। সন্তান বেঁচে থাকলে হয়ত তার প্রয়োজনেও অন্য কাউকে ঘরে আনার দরকার পড়তো। কিন্তু সেই দায়িত্বটুকুও বউ তার নিজের কাঁধে নিয়েই চলে গেল, মৃত সন্তান প্রসব করে। গফুর মাস্টারের বউটি ছিল ভারী লক্ষী। দিনমান চড়ুই পাখীর মতো তিড়িং বিড়িং করে সংসারের কাজ করতো। শাশুড়ি কিংবা বরের ছোটখাট তিরস্কারে মুখ লুকিয়ে হাসতো। অথচ সেই মানুষটিই আবার বাপের বাড়ির কথা ভেবে কেঁদে বালিশ ভেজাতো। কতোই বা বয়স ছিল বেচারীর! সেই বয়সেই বাপের বাড়ি ছেড়ে আসার শোক সে ভুলতে পারতো না। গফুর মাস্টার খুব ভালোবাসতেন তার পাগলি বউটাকে। শখের জিনিসপাতি কিনে এনে চুপিচুপি কোথাও লুকিয়ে রেখে দিতেন। মেলা থেকে ভাজা, গজা কিনে এনে গৃহকর্মরতা বউএর শাড়ির আঁচলে গিঁট বেঁধে দিতেন। হঠাৎ চোখে পড়ে গেলে বউয়ের চোখে মুখে সে কী খুশির ঝিলিক! দিগবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে কিছুক্ষণ পাক খেয়ে নিত। কখনো বা লাজ শরম ভুলে স্বামীকে এসে জড়িয়ে ধরতো। কী সব যে করতো পাগলি! গফুর মাস্টার মুগ্ধ বিস্ময়ে দেখতেন সেই ছেলেমানুষি পাগলামি। চার বছরের মাথায় বউটা পোয়াতি হলো। দেরি হতে দেখে গফুর মাস্টারের মা শিকড় বাকড় নিয়ে এসে খাইয়ে মারতে লাগলো বেচারিকে। বউটাও কোনো কথা না বলে চুপচাপ শাশুড়ির নির্দেশ মানতে লাগলো। মনে অগাধ আস্থা, হয়ত ভালো কিছুই হবে! শিকড় বাকড়ের গুণে না হোক, চারমাসে শুকনো গাছে ফুল ধরলো। শাশুড়ির খুশি দেখে কে! পাড়া প্রতিবেশিরা একত্রিত হয়ে খুশির গীত গাইতে বসলেন। সুখের পায়রা উড়ে বেড়াতে লাগলো এখানে ওখানে। সে সুখ বেশিদিন সইলো না। সব আলো মুছে গিয়ে অন্ধকারে ছেয়ে গেল চারিদিক। দিন গেল, মাস গেল...দেখতে দেখতে বছর। ঘরে ঘোমটা টানা নতুন কোনো মুখ এলো না আর। মায়ের একই কথায় অতিষ্ট হয়ে গফুর মাস্টার ক্ষেদ জানাতেন, ‘সে কী তোমার কেউ লাগতো না মা! এত জলদি তারে কেমনে ভুইলা গেলা!’ মা আঁচলে অশ্রু গোপন করতেন। তার অভিজ্ঞ পোড়খাওয়া দৃষ্টি যতদূর দেখতে পেত, পুত্রের রঙিন পর্দা আঁটা চোখ তা আর দেখতে পেত কই? সেই সময়টাও একদিন অতীত হয়ে গেল। গফুর মাস্টারের বিয়ে করার বয়সও আর পড়ে রইলো না। ভরভরান্তি সংসারের স্বপ্নটাও একসময় চোখের আড়ালে চাপা পড়ে গেল। বৃদ্ধা মা’র ছানিপড়া চোখে এখন শুধুই সুদূরের প্রতীক্ষা। স্কুল থেকে ফিরে মায়ে-ছেলেতে গল্প করতে করতে বেলা পার হয়ে যায়। একসময় গল্প ফুরোয়, দুয়ারে ওঠে সাঁঝের বাতি। বিকেলের দিকে ঘরদোর আর উঠোন ঝাঁট দিতে কুমুদ আসে। বিশ-বাইশ বছরের ছটফটে তরুণী। দুধের শিশুটিকে ঘরে ফেলে রোজ কাজে আসে। তাই সব কাজেতেই অহেতুক ছটফটানি, দৌঁড়ঝাঁপ। উঠোনের এক কানা ঝাঁট দিয়েই দৌড়ে কলপাড়ে গিয়ে কাপড় কাঁচতে বসে। ভরসন্ধ্যায় ভেজা কনকনে কাপড়গুলো উঠোনে বেঁধে রাখা দড়ির ওপরে ঝুলতে থাকে। গফুর মাস্টারের মা তাই দেখে চেঁচামেচি করতে থাকেন, ‘কতদিন কইছি তোরে সকালে আইতে। বিকাল বেলায় কেউ কাপড় ধোয়! যত্তসব অনাসৃষ্টি কাইজ কারবার আমার বাড়িত!’ জানালার ফাঁক দিয়ে গফুর মাস্টার তাকিয়ে তাকিয়ে মেয়েটির দৌঁড়ঝাঁপ দেখেন। চোখের দৃষ্টি যেন স্থির হয়ে গেঁথে যায় অনন্তযৌবনা নারীদেহের অপার রহস্যের মাঝে। সন্তান প্রসবের পরের ভরন্ত যৌবনা শরীর। সেই শরীরের আঁকেবাঁকে গর্জে ওঠা ভরা জোয়ারের উচ্ছ্বাস। অকারণেই সেই জোয়ারের ঢেউ এসে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। কখনোবা বশ মানতে নারাজ বেহায়া অসভ্য দৃষ্টির সামনে মুখ থুবড়ে লুটিয়ে পড়ে। বেসামাল পদক্ষেপে স্খলিত বেপরোয়া আঁচল অবজ্ঞা অনাদরে লুটাতে থাকে মাটিতে। একরাশ ঘণ কেশের মেঘমালা সাপের মতো ফণা তুলে ছোবল মারতে আসে...জানালার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে থাকা কোনো স্থির ঘোরলাগা দৃষ্টিকে। গফুর মাস্টারের মা চাপা গলায় হিসহিস করেন, ‘পিন্ধনের কাপড় সামলাইবার পারোস না পোড়ারমুখী! দূর হ সামনে থাইকা!’ মার চেঁচামেচি, কুমুদের নেচে নেচে সারা বাড়িময় ঘুরে বেড়ানো...এসবের মাঝেই ঝুপ করে সন্ধ্যা নেমে পড়ে। তারপরে আবারো আসে শীতার্ত জমাট রাত। কনকনে উত্তুরে হাওয়ারা বন্ধ জানালার ওপারে কড়া নাড়তে থাকে। গফুর মাস্টার সপ্ত ইন্দ্রিয়ের ঘরে তালা মেরে তীব্রভাবে লুকিয়ে থাকেন লেপের গহ্বরে... বাইরে তখন হাওয়াদের মাতম লেগেছে।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মোঃ মাহামুদুর রহমান সিদ্দিকী
আমার কাছে মনে হয়েছে আপনার এই ছোট গল্পটি বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি তুলে ধরা কোন এক চলচ্চিত্রের অংশবিশেষের মত। মনে হলো গল্পটা পড়লাম, আর ভাবনায় কিছু চরিত্র অভিনয় করলো পুরো ব্যাপারটা। একশব্দে "ভালোলেগেছে"। ধন্যবাদ আপু।
আপা,আমি লেখা শেষ করে অন্ততঃ একবার সবসময় পড়ি। এবারে উপন্যাস শেষ করে একেবারে শেষ মুহুর্তে লেখা দিয়েছি,তবুও। ভুলগুলো বললে ভালো হয়। এমনো হতে পারে, আপনি যেটাকে ভুল বলে মনে করছেন, তা আমার দৃষ্টিতে একেবারে সঠিক। :) ভালোবাসা এই গল্পে অল্প কিছু অংশে এসেছে বৈকি! তবে তা কামনা আর ভালোবাসার পার্থক্য নির্ণয়ে। ভালোবাসার টানে আবদ্ধ জীবন অন্য কোনো সম্পর্কে আর জড়াতে পারে না নিজেকে, কিন্তু কামনা তার পিছ ছাড়ে না! আমি এভাবেই ভেবেছি। দেখি, বিচারক কীভাবে ভাবেন! আপনার জন্যও শুভকামনা আপা।
'চার বছরের মাথায় বউটা পোয়াতি হলো' এরপরের লাইনে আবার লিখলেন'দেরি হতে দেখে গফুর মাস্টারের মা শিকড় বাকড় নিয়ে এসে খাইয়ে মারতে লাগলো বেচারিকে।' এই জায়গাটায় পাঠক হিসাবে খটকা লেগেছে! পোয়াতি হবার আগে শিকড় বাকড় খাইয়েছে? না কী পরে? যদিও 'শিকড় বাকড়ের গুণে না হোক, চারমাসে শুকনো গাছে ফুল ধরলো।' এখানে এসে কিছুটা পরিষ্কার হয়েছে।
'বৃদ্ধা মা’র ছানিপড়া চোখে …গফুর মাস্টারের মা তাই দেখে চেঁচামেচি করতে থাকেন,' আবার এখানে বলা হয়েছে ছানিপড়া চোখ। কিন্তু তিনি আবার চোখে দেখছেন সবকিছুই! এখানেও পাঠক মনে কনফিউশন তৈরি হয়েছে।
এখানে কী লেখাটা অন্যভাবে আনা যেত না? আমার মনে হয়েছে জায়গাগুলোকে আপনি অন্যভাবে লেখার ধাঁচ আনতে পারতেন। হয়ত চোখ এড়িয়ে গেছে।
আর তাই রিভাইস দেবার কথাটা বলেছি। রিভাইস দিলে ছোট ছোট ভুলগুলো যেমন-'মা আঁচলে অশ্রু গোপন করতেন। তার অভিজ্ঞ...' এখানে তার না লিখে তাঁর হবে মাকে সম্মান দেখাতে। এমন বেশ কিছু ভুল লেখকের চোখে ধরা পড়ত। আপনি গল্পকবিতায় বেশ অনেকবার সেরা লেখক হয়েছেন। একজন শুভাকাঙ্ক্ষী পাঠক হিসাবে-এই ছোট ছোট ভুলগুলো আপনার কাছ থেকে আশা করিনা আপা। এই জন্য পরামর্শ দিয়েছি। আর বিচারক কীভাবে নেবেন সেটাতো তাঁর নিজস্ব মতামত। এখানে আমি আমার মতামত তুলে ধরেছি। কথায় কথায় বিচারককে টেনে আনলে ভয় লাগে বুঝেন না কেন? :p বিচারকের মত করে তো আর আমি লেখার মান নির্ণয় করার যোগ্যতা রাখি না। তাই না? এক সময় ভাবতাম লেখায় সমালোচনা লেখকের পছন্দ। এখন দেখছি অনেকে লেখকেরই অপছন্দ! আমার যা মনে হয়েছে আমি তা মন্তব্যে প্রকাশ করেছি। সব সময় তা সত্য হবে বা লেখকের পক্ষে যাবে তা নয়। ভালো থাকুন।
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
বিজ্ঞপ্তি
“জানুয়ারী ২০২৫” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ জানুয়ারী, ২০২৫ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।