ছায়াপথ

ঘৃণা (সেপ্টেম্বর ২০১৬)

Fahmida Bari Bipu
  • ১৭
  • ৪৭

এক
উত্তরপাড়ার মণ্ডল বাড়ি আজ অনেকদিন যাবত শোকের কালো ছায়ায় আচ্ছাদিত। এই পরিবারের ছেলে মুহিত মণ্ডলকে প্রায় দশ-বারো দিন ধরে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
ছাব্বিশ-সাতাশ বছরের জোয়ান ছেলেটা হঠাৎ বলা নাই কওয়া নাই, একেবারে লাপাত্তা হয়ে গেলো। গ্রামের চৌহদ্দির ভিতরে আর খুঁজে পাওয়া গেলো না তাকে। দশ-বারো দিন ধরে অনেক খুঁজেও যখন জীবিত মুহিতের কোনো সন্ধান পাওয়া গেলো না, তখন মুরুব্বিরা পরামর্শ দিলেন, গ্রামের যত খাল-বিল আছে সবগুলোতে জাল ফেলার। স্পষ্ট ইঙ্গিত। গ্রামে আকছারই ঘটছে এমন ঘটনা। কারো সাথে বনিবনা হলো না, সুযোগ মতো জানে শেষ করে দিলো। তারপর কয়েকদিন বাদেই বিলের পানিতে ভেসে উঠলো পচে গলে যাওয়া লাশ। এই শিবপুর গ্রামেই এমন ঘটনা দু দু’টো ঘটেছে। দুটো ঘটনাই সম্পত্তি নিয়ে রেষারেষি’র সূত্র ধরে। নিজেদের পরিবারের মধ্যেই সম্পত্তি নিয়ে শত্রুতার জের ধরে খুন হয়েছে।
মণ্ডল পরিবারও সাত পুরুষের খানদানি পরিবার। উঁচু বংশ, জমা জমি অনেক। পাঁচ ভাই বিয়ে থা করেও হাড়ি আলাদা করেনি। এখনো মণ্ডল বাড়িতে বিশাল বিশাল হাড়িতে পুরো পরিবারের জন্য রান্না হয়, পাঁচ বৌ আর তাদের আণ্ডা বাচ্চারা মিল-মহব্বত, ঝগড়া ঝাঁটি আর চুলোচুলি করে দিব্বি দিন কাটিয়ে দিচ্ছে। তা, পাঁচ হাড়ি একত্রিত হলে এসব তো অতি মামুলি ব্যাপার। কোন সংসারে না হয়! কিন্তু তাই বলে খুন? এমন কথা পাঁচ ভাইয়ের কেউ স্বপ্নেও ভাবতে পারে না। আর তাছাড়া মুহিত নিতান্তই গোবেচারা বোকা সোকা এক ছেলে। ওকে দিয়ে না হয়েছে পড়াশোনা, না হয়েছে হালচাষ। দিন রাত পড়ে থাকে সমাজ সেবার কাজে। পাড়ার কার ছেলের পা ভেঙ্গেছে, কার পোয়াতি বউকে সদর হাসপাতালে নিতে হবে, কার গরু-ছাগলকে খোঁয়াড় থেকে ছাড়াতে হবে...সব কাজেই মুহিত। মুহিত ছাড়া কারো চলে না। বড় ঘরের ছেলে বলে কোন ঠাঁট বাট নেই। আর দশজনের সাথে মিশে দশজনেরই একজন হয়ে বেড়ে উঠেছে। মণ্ডল বাড়ির অন্য ছেলেরা যখন দামী জামা জুতো পড়ে ফিটবাবুটি সেজে পড়াশুনা করতে শহরে গেছে, কিংবা কেউ কেউ অল্প বয়সেই বাপ-দাদা’র সম্পত্তি রক্ষা করতে জোতদারের ভূমিকায় নেমেছে; মুহিত তখন চাষা ভুসাদের মতন মাঠে কাজ করেছে কিংবা তাদের ঘরে ঘরে গিয়ে জনসেবা করে বেড়িয়েছে।
মুহিতের বড়ভাই সুজিত শহরের কলেজ থেকে বিএ পাশ করে বাবা’র জমিজমা দেখাশোনায় মন দিয়েছে। গ্রামের অনেক চাষা ওদের জমিতে বর্গা খাটে। মুহিত তাদের হয়ে ভাইয়ের কাছে ওকালতি করে। গরীব চাষার মুখের দিকে চেয়ে তাদের ন্যায্য ভাগ ছেড়ে দিতে আবদার জানায়। গ্রামের কারো মেয়ের বিয়েতে টাকা কম পড়লে অথবা কেউ কোনো অভাবে পড়লে মুহিত গিয়ে বাপ-চাচার কাছে ধর্ণা দিয়ে বসে থাকে। মুহিতের বড়ভাই মহা বৈষয়িক ছেলে। তার ভালো লাগে না এইসব ঢঙ এর আবদার। দু’পয়সা আয় রোজগারের মুরোদ নাই, জনগণের দরদে বুক ফেটে যাচ্ছে। মুহিতের অন্য চাচাতো ভাইয়েরাও এসব ব্যাপারে মুহিতের প্রতি বিরক্ত। তাদের কারো কারো শহরে নিত্য আসা যাওয়া ঘটে, পড়াশুনা আর অন্যান্য ব্যবসা পাতির সুবাদে। অবস্থাপন্ন কৃষক তারা। কতোদিন আর শুধু জমিজমা আগলে ধরে বসে থাকবে? নানা দিকে ব্যবসা বাণিজ্য করার ধান্ধায় নামে তারা। মুহিতের এসব দিকে কোন নজরই নাই। সমস্যা হচ্ছে, মুহিতের বাপ-চাচারাও এটা নিয়ে মাথা ঘামানোর কোনো কারণ খুঁজে পায় না। সরল সোজা একটা ছেলে। কারো তো কোন কিছু বিগড়াচ্ছে না ওর জন্য। পরিবারের বাকী দশজনের জন্য যদি দশটাকা লাভ হয়, মুহিতের জন্য না হয় একটাকা ক্ষতিই হল। শুধু দুনিয়াদারী করলেই তো আর চলে না, আখিরাতের কথাও তো ভাবতে হয়। মুহিত না হয় তাদের সেই আখিরাতের সঞ্চয়টুকুই কামিয়ে দিলো!
সেই জনদরদী পাগলাটে মুহিত একদিন এক শীতের রাতে বেমালুম গায়েব হয়ে গেলো। পুরো গ্রাম তন্ন তন্ন করে খুঁজেও যখন মুহিতকে পাওয়া গেলো না তখন গ্রামের সাধারণ লোকেরা ধরেই নিলো, তাদের প্রতি অতি দরদের মাশুল গুনতে হয়েছে ভালোমানুষ মুহিতকে। এ এদের পরিবারেরই ভেতরের কথা। বাইরে যাতে ফাঁস না হয়, সেজন্য অতি কান্নাকাটির ধুম পড়েছে। যদিও কেউ কেউ দ্বিমত দেখালো, কিন্তু তাদের কথা ধোপে টিকলো না। ঠিকই তো, এত বড় পরিবারের ছেলে। গ্রামের কার সাধ্য আছে, মুহিতের গায়ে হাত তোলার? মুহিতের বাপ-চাচা আর দাপুটে ভাইদের চোখ ফাঁকি দিয়ে এ’কাজ করার মতন লোক গ্রামে আর একটিও নাই। কাজেই রক্ত যদি বইয়ে থাকে, তো নিজের লোকই বইয়েছে। মুহিতের বাবা; পরিবারের বড় কর্তা শয্যাশায়ী হলেন। মা’র অবস্থাও প্রায় একই। কথায় বলে, অতি প্রচারিত মিথ্যে কথাও শুনতে শুনতে একসময় সত্যি বলে মনে হয়। মুহিতকে গ্রামের লোকেরা বড় ভালবাসতো। কারো কোন ক্ষতি মুহিত করেনি কখনো। তবে কি লোকে যা বলে তাই ঠিক? মুহিতের চাচাতো ভাইয়েরা দেখতে পারতো না তাকে। কে জানে, ভেতরে ভেতরে চাচাদের মনও ওর প্রতি বিষিয়ে গিয়েছিল কিনা! সম্পত্তি সবার বড় আদরের ধন। সেই সম্পত্তি যার জন্য ঝামেলার মুখে পড়বে, কার ঠ্যাকা পড়েছে তাকে খাতির করার?

দুই
মুহিতের অন্তর্ধানের সূত্র ধরেই সুজিত আর তার বাবা-মার সাথে মণ্ডল বাড়ির সবার সম্পর্কেই ভাটা পড়ে। দেখতে দেখতে পেরিয়ে গেছে তিনটি বছর। মুহিতের ফিরে আসার দূরাশা আর তারা কেউ করে না। তবু দুঃস্বপ্নের মতো ছাপ রেখে গেছে তরতাজা মুহিতের এই হারিয়ে যাওয়া। সম্পর্কের টানাপোড়েনে পাঁচ হাড়িও আলাদা হয়ে গেছে। প্রত্যেকে যার যার সুবিধামতো হেঁসেল বাটোয়ারা করে নিয়েছে। আগের মতো সেই হৈ-হুল্লোড় করে একসাথে রান্না-বান্না, খাওয়া-দাওয়ার পাঠ চুকেবুকে গেছে। কেউ কেউ ঝামেলা কমে যাওয়ায় আড়ালে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে, আবার কেউ বা আড়ালে দীর্ঘশ্বাসও গোপন করেছে। মণ্ডল বাড়ির সাত পুরুষের সেই রমরমা ঐতিহ্যেও আজ ভাটা পড়ে গেছে। একসময় গাঁয়ের লোকেদের কাছে মণ্ডল বাড়ি ছিল সমীহের সাথে উল্লিখিত একটা নাম। এখন এই বাড়ির নাম শুনলেই লোকে আড়ালে কানাঘুষা করে। সেই ভক্তির স্থানটাও হারিয়ে গেছে। দিনে দিনে ভাইয়ে ভাইয়ে দূরত্ব আর ভুল বুঝাবুঝি যেনো বেড়েই চলেছে। লোকে যা বলে এতোদিন তা কেবল লোকের কথাই ছিল, এখন তাদের নিজেদের মাঝেও এই সন্দেহের বীজ রুপ্ত হয়েছে।
প্রথম প্রথম কিছুদিন গ্রামে পুলিশ এসেছিলো। পাঁচ ভাই এবং তাদের ছেলেদের আলাদা আলাদা ভাবে পুলিশস্টেশনে নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। প্রত্যেকেই যার যার নিজের অবস্থানে দাঁড়িয়ে জবানবন্দি দিয়েছে। একজন আরেকজনকে দোষারোপ করেছে। পুলিশ এই কেসের কোনো কুল কিনারা করতে পারেনি। মুহিত গ্রামের গরীব মানুষদের পক্ষ নিয়ে জমি জমার বিষয়ে নাক গলাতো ঠিকই, কিন্তু কারো সাথেই সে বড় কোনো ঝামেলায় জড়ায়নি। বরং অন্য ভাইদের টুকটাক যেকোনো ঝামেলায় সে গায়ে পড়ে মধ্যস্থতা করতো। অতএব কারো বিরুদ্ধেই পুলিশ জোরালো অভিযোগ উত্থাপন করতে পারেনি।
সুজিতের সাথে জমির দেখভাল সংক্রান্ত বিষয়ে অন্য যাদের সমস্যা হয়েছে, মুহিতের বাবা-মা এবং সুজিতের সুপারিশে পুলিশ তাদের বিশেষ খাতিরদারিও করেছে। কিন্তু পরে দেখা গেছে, মুহিতকে নিয়ে তাদের কারোরই কোনো সমস্যা ছিল না। আসলে মুহিতকে কেউ তেমন বিবেচনাতেই রাখতো না। তাকে নিয়ে কেউ কোনো ক্ষতিরও আশংকা করতো না। কাজেই কোনো সূত্র খুঁজে না পেয়ে পুলিশকে এই কেস থেকে একরকম হাত গুটিয়ে নিতে হয়েছে।
লাভের মধ্যে যা হয়েছে তা এই যে, এখন ভাইয়ে ভাইয়ে দেখা হলে পরষ্পর পরষ্পরের কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। আগে উৎসব পার্বন শুরু হতো মণ্ডল বাড়ি থেকে, আস্তে আস্তে তা ছড়িয়ে যেতো পুরো গ্রামে। আর এখন উৎসব পার্বনে মণ্ডল বাড়িতেও আলো জ্বলে ঠিকই, তবে তা জ্বলে বিচ্ছিন্ন, একাকী।

তিন
সুজিতের বিয়ের তোড়জোড় শুরু হয়েছে। আরো আগেই শুরু হবার কথা ছিল, কিন্তু পরিবারের এই দুর্যোগে কেউ আর এ ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করার সুযোগ পায়নি। পাশের গ্রামের ঘটক হাজী তোরাব আলীর ডাক পড়লো। তোরাব আলী আশেপাশের সব গ্রামের সুন্দরী মেয়েদের একটা তালিকা বানিয়ে ফেললো। এমনকি শহরের কিছু ধনী ঘরের সুন্দরী মেয়েদের নামও এই তালিকায় অবলীলায় ঢুকে গেলো। অবস্থাপন্ন, বনেদি মণ্ডল বাড়ির বড় ছেলে, বিএ পাশও বটে। তার জন্য দরকার পড়লে সুন্দরী মেয়েদের লাইন লাগিয়ে দেওয়া যাবে। সুজিতের বাবা-মা সেকেলে মানুষ। তারা এই ব্যাপারে নিজেদের বুদ্ধিবৃত্তির উপর নির্ভর করলেন না। মতামতের জন্য সুজিতের কাছে পাঠিয়ে দিলেন। সুজিত একটা ছবিও না দেখে তোরাব আলীকে ডেকে পাঠালো।
সুজিতের সাথে কথা বলে হন্তদন্ত হয়ে তোরাব আলী ছুটলেন গ্রামের দরিদ্র কৃষক রহিম মিয়ার বাড়িতে। আশ্চর্য, হতবুদ্ধি তোরাব আলী কিছুই মেলাতে পারছেন না। গ্রামের বিপুল ক্ষমতাধর মণ্ডল বাড়ির ছেলে কিনা পছন্দ করে বসে আছে এই গ্রামেরই হতদরিদ্র এক কৃষকের মেয়েকে! এ যে ভাবাই যায় না! মেয়েদের তালিকা তৈরির সময় তাকে শুধু মেয়েদের সৌন্দর্য না, তাদের পিতার আর্থিক সংগতির দিকেও দৃষ্টিপাত করতে হয়েছে। একজন কৃষকের মেয়েকে তালিকায় ঠাঁই দেওয়ার কথা তার চিন্তাতেও আসেনি।
দুই প্রান্তর ছেয়ে থাকা ফসলের ক্ষেতের একপাশে, ক্ষুদ্র এককোণায় তার চেয়েও ক্ষুদ্র রহিম মিয়ার একচিলতে মাটির ঘর। তার স্ত্রী গত হয়েছে অনেক বছর। একমাত্র মেয়ে শাঁওলীকে নিয়ে কোনোমতে দিন চলে যায়। মণ্ডল বাড়ির জমিতে বর্গা খেটেই দুজন মানুষের পেট চলে যায় একরকম ভাবে। রহিম মিয়ার বয়স হয়েছে, আগের মতো পরিশ্রম করতে পারেন না। ভাগে থাকা বর্গা জমিতেও ভাগীদার এসে গেছে। উৎপন্ন ফসলের আধা অংশ চলে যায় জমির মালিকের গোয়ালে। দিন গুজরান করা একরকম অসম্ভব হয়ে পড়েছে রহিম মিয়ার। তার উপরে বাড়িতে সোমত্ত, সুন্দরী মেয়ে। বিয়ে দেওয়ার বয়স প্রায় পার হতে চললো। প্রতি রাতে তার বাড়ির ভাঙা টিনের চালে ঢিল পড়ে, সুর করে ডাক ছাড়ে রক্তচোষা নিশাচরেরা। ঘুমহীন সারারাত এপাশ ওপাশ করে রাত কেটে যায় রহিম মিয়ার।
মণ্ডল বাড়ির হারিয়ে যাওয়া ছেলে মুহিত ছিল এই বৃদ্ধ কৃষকের একমাত্র শুভাকাঙ্ক্ষী। প্রায় সকলেই আসতো সাহায্য দেবার নাম করে অন্য কিছুর মতলবে। সম্পত্তি বলতেই ছিল একটুকরো মাথা গোঁজার ঠাঁই আর তার একমাত্র মেয়ে শাঁওলী। শেষোক্তটার প্রতিই ছিল বেশীরভাগের লালায়িত দৃষ্টি। কণ্যাদায়গ্রস্ত পিতাকে এই দায় থেকে মুক্তি দেবার জন্য অনেকেই অনেক বড় বড় কথা বলতো; কিন্তু কেউই নিঃস্বার্থভাবে এগিয়ে আসতো না। পণের মোটা অঙ্ক শুনে মনে মনে দীর্ঘশ্বাস গোপন করা ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না রহিম মিয়ার।
মুহিত রহিম মিয়াকে আর্থিক সহায়তার আশ্বাস দিতো। মাঝে মাঝে পরামর্শ দেবার জন্য সে তার বাড়িতে আসতো। মুহিত এলে শাঁওলী যেনো একটু বেশিই মোটা করে কাজল টানতো চোখে, হাতের চুড়ি অকারণেই রিনঝিনিয়ে উঠতো। কিন্তু মুহিত কখনো চোখ তুলে শাঁওলীর দিকে তাকিয়েছে কিনা সন্দেহ। রহিম মিয়া ঘরে না থাকলে ঘরের চৌহদ্দিতেও পা দিতো না। রহিম মিয়াকে দুর্দশা থেকে বাঁচানোই ছিল মুহিতের একমাত্র উদ্দেশ্য। তার চাষ করা বর্গাকৃত জমির ফসলের অংশ ছেড়ে দেওয়ার জন্য সুজিত আর তার চাচাদের কাছে মুহিত অনেক চেষ্টা তদবির চালিয়েছে। প্রথমে কেউ তার কথা কানেই তোলেনি। সুজিত নিজে এসে রহিম মিয়ার ভাঙা ঘরবাড়ি দেখে গিয়েছে। তার আর্থিক এবং শারীরিক ভগ্নদশাকে সরেজমিনে নিরীক্ষা করে অনেকটা নিমরাজি হয়ে ফসলের অংশ ছেড়ে দিয়েছে।
মুহিতের কথা মনে হলে রহিম মিয়া এখনো গোপনে চোখের পানি ফেলেন। আহারে! এতো ভালো ছেলেটা! কোন দাবী নাই, হিংসা নাই, লোভ নাই। একেবারে নাই হয়ে গেলো! শাঁওলী বরাবরই কম কথা বলে। মুহিতের নিরুদ্দেশ হবার পরে সে যেনো একেবারেই বোবা হয়ে গেছে। রহিম মিয়া সবই বোঝেন। কিন্তু এই বুঝ তার জন্য বোঝা বৈ অন্য কিছু নয়।
তোরাব আলী এসে রহিম মিয়ার ভাঙা দরজায় অনেকক্ষণ ধরে কড়া নাড়েন। কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে চলে যাওয়ার ঠিক আগমুহুর্তে দরজা খুলে যায়। নিশ্চল তোরাব আলী নির্বাক তাকিয়ে থাকেন সামনে দাঁড়িয়ে থাকা অপরূপ নারীমূর্তির দিকে। শান্ত, স্নিগ্ধ এক অনুভূতিতে ছেয়ে যায় তার মন। এই অপার্থিব সৌন্দর্যকে অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা মানুষ আজো অর্জন করতে পারেনি।

চার
রহিম মিয়া তোরাব আলীর কথা শুনে হতবাক হয়ে যান। কোনো কথা সরে না তার মুখে। শাঁওলীর জন্মের পরে তার রূপ দেখে লোকে বলাবলি করেছে, এ তো রাজকপালী! কোনো কৃষক ঘরে এই রূপ শোভা পায় না। কিন্তু আজ এতোগুলো বছরের অদৃষ্টের খরায় তিনি ভুলেই গিয়েছিলেন মানুষের সেই কথা। রাজকপালীর কোনো নিদর্শন তার এ যাবত চোখে পড়েনি। আজ এই অসম্ভব প্রস্তাবে তিনি বাকরুদ্ধ হয়ে শুধু তাকিয়ে থাকেন।
পাশের ঘরে বসে থাকা শাঁওলীর কানে আসে সব কথা। স্বপ্নাহতের তার মনে পড়ে যায় তিন বছর আগে্র শীতের এক বিকেলের কথা।
সেদিন বিকেলে মুহিত এসেছিলো তাদের বাড়িতে। খোলা উঠোনে বসে রহিম মিয়াকে অনেক বুদ্ধি পরামর্শ দিয়েছিলো। রহিম মিয়া যেন তার বর্গা জমির ভাগ অন্যদের কাছে কিছুতেই ছেড়ে না দেন, সেজন্য মুহিতের বাবা-চাচাদের সাথে কীভাবে কথা বলতে হবে তা রহিম মিয়াকে শিখিয়ে পড়িয়ে দিয়েছিলো মুহিত। কাজের ফাঁকে ফাঁকে সব শুনেছিলো শাঁওলী। আর মুচকি মুচকি হেসেছিলো। এই মানুষটাকে আল্লাহ মনে হয় পাগল করে তৈরি করেছেন। নিজেদের সয়সম্পত্তির উপরে কোনো মায়া নেই! সব মায়া তার অসহায় দরিদ্র মানুষের জন্য! প্রথম প্রথম সব ভান মনে হতো তার। আশেপাশে এসব ভানধারী মানুষ দেখে দেখে তার চোখ পচে গেছে। মুখে এক কথা, মনে আরেক। কিন্তু অল্প কিছুদিনেই সে বুঝতে পেরেছিলো মুহিতের জাত। শাঁওলীর প্রলুব্ধকর উপস্থিতিও এতোটুকু ছায়া ফেলতো না যার মনে। ছোটোবেলা থেকেই রূপের প্রশংসা শুনতে শুনতে বড় হয়েছে শাঁওলী। তার আশেপাশে মধু মক্ষিকার মতো ঘুরে বেড়াবে পুরুষের দল, এটাই মেনে নিয়েছিলো সে।
কিন্তু মুহিত যেনো অন্য গ্রহের মানুষ। গ্রামের অসহায় মানুষের একান্ত আপনজন, যুবকদের গলার জোর আর অনেক তরুণীর স্বপ্নে বাস করা এক অদ্ভুতুড়ে স্বপ্নবাজ মানুষ। এক দুর্নিবার আকর্ষণীয় শক্তি নিয়ে মুহিত তার চারপাশকে ঘিরে রেখেছে।
উঠোনের খোলা দরজা দিয়ে শাঁওলী সেদিন দূরে দাঁড়িয়ে থাকা একটি ছায়াকে লক্ষ্য করেছিলো। অনেকক্ষণ ধরে সেই ছায়া নিঃশব্দে দৃষ্টি রেখেছিলো শাঁওলীদের বাড়ির দিকে। শাঁওলীর তীক্ষ্ণ পোড়খাওয়া চোখ সেই ছায়ার আড়ালে লুকিয়ে থাকা মানুষটাকে চিনতে ভুল করেনি। এই মানুষটা একদিন তাদের বাড়িতে এসেছিলো, তাদের ঘরবাড়ির অবস্থা দেখতে। তাদের প্রতি মুহিতের জোর তদবির কতোটা গ্রাহ্যকর তার খবর নিতে। কিন্তু শাঁওলী জানে, মানুষটার চোখের দৃষ্টি তাদের ঘরবাড়ির অবস্থার দিকে না বরং ঘুরে বেড়িয়েছিলো তারই দিকে। সেই দৃষ্টিকে চেনে শাঁওলী, এমন দৃষ্টির সাথে তার নিত্যই দেখা হয়।
মুহিত চলে যাওয়ার পরেও অনেকক্ষণ ধরে শাঁওলীর মনের মাঝে ঘুরে বেড়িয়েছিল সেই ছায়া। সেই ক্রুদ্ধ ছায়াটাকে সে সেদিনের পর আজতক ভুলতে পারেনি। সেদিনের সেই রাতটাকেও কখনো ভুলতে পারেনি শাঁওলী।
কারণ, সেই রাতেই হারিয়ে গিয়েছিলো মুহিত।



আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মামুনুর রশীদ ভূঁইয়া চমৎকার একটি গল্প ছিল এটি। অবশেষে বিচারকের রায় মেনে নিতেই হচ্ছে। ধন্যবাদ। এরকম গল্প আরো লিখবেন নিশ্চয়ই।
সাবিহা বিনতে রইস কঠিন চিন্তা ভাবনা। এইরকম প্লট আমার মাথায় আসেই না :( খুব ভাল লেগেছে আপু
তোমাকে অনেক ধন্যবাদ সাবিহা।তোমার লেখনী কিন্তু অনেক শক্তিশালী। প্লট নিয়ে আরেকটু চিন্তা ভাবনা করো। তাহলে তোমার কাছ থেকে আমরা অনেক অনেক ভালো লেখা পাবো আশা রাখি।
ভালো লাগেনি ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৬
কেতকী অনেকক্ষণ আগে পড়তে নিয়েছিলাম। একাজ ওকাজ সারতে সারতে রাত পার হবার জোগাড়। কিন্তু ধরেছি যেহেতু পড়েই ছাড়বো।...আমি ভাবছি একজন মেয়ে ঘৃণা নিয়ে সারাজীবন থাকবে একজন পুরুষের সাথে !!!! ব্যাপারটা খুবই কষ্টকর। ভাবনায় থম ধরে যাচ্ছে ! ... ভোট রইল।
ভালো লাগেনি ৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৬
ধন্যবাদ আপনাকে। সেটি মনে হয় ভাবার প্রয়োজন নেই। :) শাঁওলীর বিচক্ষণতা আর দূরদৃষ্টির উপর ভরসা রাখা যেতে পারে।
ভালো লাগেনি ৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৬
প্রভাবশালী মণ্ডল পরিবারের বড় ছেলের পছন্দকে দরিদ্র চাষির মেয়ে ঠিক কীভাবে নিজেকে আড়াল করবে...? গল্পতো সেখানেই শেষ হয়েছে। পাঠক হিসেবে না হয় আমি আমার মতো করেই ভেবে নিলাম...হাহাহা শুভেচ্ছা রইল।
ভালো লাগেনি ৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৬
মোঃ ইয়াসির ইরফান চমৎকার । গল্পের গতি ছিল দারুণ স্বচ্ছন্দ ।
ভালো লাগেনি ৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৬
অনেক অনেক ধন্যবাদ।
ভালো লাগেনি ৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৬
মোজাম্মেল কবির রহস্যটা গল্পের পূর্ণতা দিয়েছে। বরাবরের মতোই স্বকীয়তা রেখেছেন লেখায়। শুভ কামনা ও ভোট রইলো।
ভালো লাগেনি ৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৬
অশেষ ধন্যবাদ মোজাম্মেল ভাই। ব্যাক্তিগত ঝামেলায় আপনার গল্প এখনো পড়া হয়ে ওঠেনি। শীঘ্রই পড়ে ফেলবো ইনশাল্লাহ।
ভালো লাগেনি ৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৬
Lutful Bari Panna আপনার গল্প লেখার হাত খুবই চমৎকার। ঘৃণা শব্দটিকে একবারও না উচ্চারণ করে ঘৃণার সর্বগ্রাসী রূপ ফুটিয়ে তোলা মোটেই সহজ না। আপনি সেটা করেছেন। শেষে যে সংযমটুকু দেখিয়ে পাঠকের উপর ছেড়ে দিয়েছেন সেটাও রিমার্কেবল। গল্পটি আমার তালিকার ওপরের সারীতে থাকবে।
ভালো লাগেনি ৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৬
আপনার মন্তব্যে সত্যিই আপ্লুত হলাম। অশেষ কৃতজ্ঞতা জানবেন।
ভালো লাগেনি ৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৬
সেলিনা ইসলাম বর্তমান সময়ে গ্রামে যে ঘটনাগুলো হচ্ছে তা খুব সুন্দরভাবে উপাস্থাপন করেছেন আপা। খুব ভালো লিখেছেন। সতত শুভকামনা।
ভালো লাগেনি ৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৬
অশেষ ধন্যবাদ আপা। শুভকামনা আপনার জন্য।
ভালো লাগেনি ৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৬
আতাউর রহমান আলিম খুব সুন্দর লিখেছেন। শুভ কামনা রইল।
ভালো লাগেনি ৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৬
ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানবেন।
ভালো লাগেনি ৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৬
পন্ডিত মাহী চমৎকার কাহিনী। যদিও একটু আগে ভাগে শেষটা আঁচ করে ফেলতে পেরেছি
ভালো লাগেনি ৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৬
অশেষ ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানবেন।
ভালো লাগেনি ৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৬
জলধারা মোহনা গল্পের কোন ছায়াপথে যে হারিয়ে গেলাম, নিজেও জানি না। দারুণ লিখেছেন আপু। মুগ্ধতা আর মুগ্ধতা। আমার গল্পে আমন্ত্রণ রইলো :)
ভালো লাগেনি ২ সেপ্টেম্বর, ২০১৬
আমিও হারিয়ে গেলাম তোমার মন্তব্যে। পড়ব ইনশাল্লাহ তোমার গল্প।
ভালো লাগেনি ৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

০১ ডিসেম্বর - ২০১৪ গল্প/কবিতা: ৬৭ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪