হাসু বুড়োর নাকি বয়সের কোন গাছপাথর নেই। পাকু তার বুঝজ্ঞান হবার পর থেকেই হাসু বুড়োকে একই রকম দেখে আসছে। গ্রামে অন্যান্য যে সব বুড়োবুড়ি আছে, তারাও নাকি হাসু বুড়োর হাঁটুর বয়সী, বুঝজ্ঞানের পর থেকে তারাও হাসু বুড়োকে বুড়োই দেখে আসছে।
আজকাল হাসুবুড়োর ঠাটবাট একটু বেড়েছে। বাড়ীওয়ালা বুড়োর ঘর থেকে খাবার পাঠানো হলে হাসু বুড়োর জন্য আগে আলাদা ভাগ রেখে দিতে হয়। রাতে ঘুমোনোর সময় ও হাসু বুড়োর সবচেয়ে ভালো জায়গাটিই চাই। বাচ্চাকাচ্চাগুলো খোঁয়াড়ের ভেতরে এলোপাথাড়ি হেগেমুতে রেখেছে। কিন্তু হাসু বুড়োর শোয়ার জন্য নির্দিষ্ট জায়গাটি একেবারেই সাফসুতরো। ভুলে কোন বাচ্চা সেদিকে গেলেই বুড়ো দাতমুখ খিঁচিয়ে ওঠে। যে কারনে বাচ্চার মায়েরা বাচ্চাদের সামলে সুমলে রাখে। পুরুষরাও হাসু বুড়োকে খুব একটা ঘাটায়না বরং তোয়াজ করে।
তোয়াজ না করে উপায় আছে! হাসু বুড়োর মত মাথাওয়ালা লোক এই তল্লাটে কি দুটো আছে! এই যে কদিন আগে বাড়ীওয়ালা বুড়োর হার্ট এটাক হল- কেউ কি টের পেয়েছিল! হাসু বুড়োই কিভাবে যেন সবার আগে খবরটা পেয়ে বুদ্ধি দিয়েছিল- ‘সামনে খারাপ সময়। যে যা পারোস, খাবার দাবার জমায়া রাখ’।
সত্যি সতিই এরপর গ্রামে তুমুল খাদ্য সংকট দেখা দিল। বাড়ীওয়ালা বুড়োর কাজের মেয়েটা কিছুটা ভুলোমনা ধরনের। প্রায়ই সে খাবার দিতে ভুলে যায়। একবারতো মনের ভুলে ভাঙ্গা টেবিলটার উপর ভাত-কুড়ো ভর্তি গামলাটা রেখেই চলে গিয়েছিল... সে রাতে পাকুদের গ্রামের ছেলে বুড়ো সবাই না খেয়ে থেকেছিল।
এসব কারনে পাকু ও হাসু বুড়োকে কিছুটা শ্রদ্ধাভক্তি করে, সাথে সাথে লেগে থাকে। হাসু বুড়োর ও বোধহয় পাকুর প্রতি কিছু মায়া জন্মেছে, মাঝে মধ্যে পাকুকে তার সঞ্চয় থেকে পুঁইয়ের ডাটা খেতে দেয়, ওয়াজ নসীয়ত করে,
- বুঝলিরে নাতি, কালা কুচ্ছিত হওনের মইধ্যেও কিন্তু একটা কিছু বেনেপিট আছে। এই যে সবাই কয়, রাজহাঁস সোন্দর! রাজহাঁস সোন্দর! হিসেব কইরা দ্যাখ ছাদে এর কত্তগুলা রাজহাঁস ছিল, এখন আছে মাত্র চাইরডা। চাচা মিয়াঁর হাট এটাকের পর তার ছেলেরা ধুমাইয়া রাজহাঁস খাইতাছে- কারোও...ওন, ওগুলা সোন্দর...! হে হে হে ...
- তারপর ধর এই যে মুরগীর কথা। লোকে কওনের সময় কয়- ডিম আগে না মুরগী আগে! ক্যান ভাই! ডিম কি শুধু মুরগীই পাড়ে, হাঁসে পাড়েনা? নাম-যশ-খ্যাতি, সব শুধু মুরগীর! এই খানেও কিন্তু একটা শিখার ব্যাপার আছে। খিয়াল কইরা দেখ, এই দুনিয়ায় যার যত নাম ডাক সৌন্দর্য, মানুষ কিন্তু তার পিছনেই বেশি লাগে, ছারখার কইরা দেয়। মানুষ কিন্তু হাঁস কম খায়, মুরগী বেশি। গোলাপ দেখলে টাইনা ছিঁইড়া ফালাইতে চায়, কচুরিপানার দিকে ফিইরা ও চায়না। এই জন্যই কই, চেহারা খারাপ দেইখা মন খারাপ করিসনা। দেখতেই তো পাইছস, চেহারা খারাপ হওনের মাঝে কত্ত বেনেপিট!
পাকু সমঝদারের মত মাথা নাড়ে, যদিও মনের মাঝে একটু খচখচানি আছে। আর বাকি আছে চারটা রাজহাঁস। এরপর তো ওদের পালা হবার কথা!
চেহারা কুৎসিত হবার কারনেও যে তার মন খারাপ হয়না, তা কিন্তু নয়, হাসু বুড়ো যতই বোঝাক না কেন! মা প্রায়ই আক্ষেপ করে বলে, ‘ তোর বড়বোনের জন্মের পর রাজহাঁসেরা দল বেঁধে আসছিল, দেখার জন্য, এতো সুন্দর! আর তুই কোথা থেকে এমন চাঁড়াল হইলি!’
গোটা গ্রামে তাকে কেউই পাত্তা দেয়না, একমাত্র হাসু বুড়ো ছাড়া। গলাউঁচু ফরসা রাজহাঁসটা তো ওকে দেখতে পেলেই লাথি মারে।
তবে আজকাল পাকু তার চেহারার চেয়ে নিজেদের অস্তিত্ব নিয়েই বেশি ভাবছে। হাসু বুড়ো খবর এনেছে, বাড়ীওয়ালা বুড়োকে অনেকদিন হাসপাতালে থাকতে হবে। বুড়োর ছেলেগুলো সব চাকরি বাকরি নিয়েই ব্যস্ত, কস্মিনকালেও তারা ছাদে ওঠেনা। তবে মাঝে মধ্যে রাতের দিকে বুড়োর রাগী রাগী চেহারার ছোট ছেলেটা ছাদে এসে হাঁটাহাঁটি করে, কখনো কখনো বিরক্ত হয়ে পাকুদের দিকে চেয়ে থাকে।
একদিন হাঁটাহাঁটির সময় গলাউঁচু রাজহাঁসটা হঠাৎ ছোটছেলের সামনে পরে গিয়েছিল। ছেলেটা হয়তো পাশ কেটে চলেই যেত। বজ্জাত রাজহাঁসটা অহেতুকই রোয়াব দেখাতে গিয়ে ঠোকর দিয়েই বিপত্তিটা ঘটাল। রেগেমেগে ছেলেটা বেকুবটার কানের নিচে কষে একটা লাথি বসিয়ে দিয়েছিল।
সেই থেকেই পাকু বুঝে নিয়েছিল সামনে মহাবিপদ অপেক্ষা করছে। বুড়ো বাড়ীওয়ালা লোকটা ভালো ছিল, পশুপাখি- গাছপালার জন্য মনে দয়ামায়া ছিল বিস্তর। লোকটা থাকাকালীন সময়ে গাঁয়ে কোন প্রাণীকে না খেয়ে থাকতে হয়নি, কোন হাঁসকে জবাই করে খেয়ে ফেলা হয়নি।
সে তুলনায় বুড়োর ছেলেগুলো যেন একেবারে পাথরের তৈরি। এতগুলো প্রাণীর রিজিক নিয়ে কারো যেন কোন মাথাব্যথা নেই।
মাঝে মধ্যে কষাই দারোয়ানটাকে পাঠায়, একটা দুটো করে রাজহাঁসের সংখ্যা কমতে থাকে।
একদিন হঠাৎ নিচে ব্যাপক হট্টগোল বেঁধে যায়, মখা পাগলার ভয়ডর বরাবরই কম। বেপরোয়াভাবে সে সিঁড়িঘরটার মধ্যে ঢুকে গিয়ে ঘটনাবৃত্তান্ত জেনে আসে।
- ছুডু পোলার মাথা নাকি খারাপ হয়ে গেছেগা। ওর বাপ আর বড়ভাইরা চাইতাছে ওরে এক মেয়ের লগে বিয়া দিব, আর ওই ভদ্দরলোকে বিয়া করতে চায় অন্য আরেকজনরে। ওই মেয়ে নাকি আবার গরীব ঘরের, দেখতে ও হুনলাম আমরার পাকু’র লাহান কালা।
মখা পাগলা খুশিতে ডগোমগো,
- নিচে ব্যাপক বিনুদুন চলত্যাছে গো নানা। বাড়িওয়ালা বুড়ায় নাকি ঘোষণা দিছে- তার পছন্দ মতন বিয়া না করলে পোলারে ত্যাজ্য করবো। এদিকে ডাক্তারে কইছে- বুড়ারে না চ্যাতাইতে, চ্যাতলে নাকি বুড়ার জান লইয়া টানাটানি পইড়া যাইব। যে কারনে ছুডু পোলায় পড়ছে মাইনকা চিপায়, না পারে বাপেরে না কইতে, না পারে গার্ল ফেরেন্ডরে ছারতে... ব্যাপক বিনুদুন গো নানা, ব্যাপক বিনুদুন!
মখা পাগলা হাত পা নেড়ে, রসিয়ে রসিয়ে বিবরণ দিচ্ছিল, হাঁসতে হাঁসতে সবাই একদম বেদম হয়ে পড়ে।
হাসু বুড়ো গম্ভীরভাবে সব কিছু শুনছিল, জোর ধমক দিয়ে সে সবাইকে থামিয়ে দেয়। সবাই থতমত খেয়ে তার মুখের দিকে তাকায়।
- মালিক ভালো থাকলে তার নিচের মানুষজন ও ভালো থাকে। যে কারনে মালিকের দুর্দশায় কখনো হাসি তামাশা করতে নাই। যা হোক, লক্ষণ কিন্তু ভালোনা। ঝুটঝামেলায় নিচ থিইকা খাওন আসা অনিয়মিত হয়ে গেছে, চৌবাচ্চার পানি ও প্রায় তলানিতে ঠেকছে। রাজহাঁস চাইরডা সুরুৎ কইরা কালকে একটা টান দিলে সেইটা ও শেষ হয়ে যাইব। গরমের মাত্র শুরু... বিপদটা ধরতে পারছো মিয়াঁরা?
খুশির ভাবটা হঠাৎ ই হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। পাকু ঘাড় ঘুড়িয়ে পেছনের দিকে একবার তাকায়। মায়ের চেহারায় হঠাৎ ই বয়সের ছাপ পড়ে গেছে যেন, খেতে না পেয়ে বড় বোনটার গলাটাও যেন ক্রমশ সরু হয়ে যাচ্ছে।
হাসু বুড়োর খুব বেশি ভুলটুল হয়না, আজ ও হয়নি। সামনে আসলেই দুঃসময় অপেক্ষা করছে। একটা কিছু করতে হবে, নাহলে জান বাঁচানোই কঠিন হয়ে পড়বে।
২
অনেক ঝুটঝামেলার পর ছোট ছেলে শেষমেশ তার পছন্দের মেয়েটিকেই বিয়ে করে ফেললো। বাড়িওয়ালা বুড়ো বোধহয় সবার মধ্যে তার ছোট ছেলেকেই বেশি ভালোবাসতো। ছোট ছেলের কাছে এমন কষ্ট পেয়ে বুড়ো একেবারে পাথর বনে গেল।
হাসপাতাল থেকে ফিরে এসে বুড়ো পুরোপুরি শয্যা নিয়েছে, সিঁড়ি ভাঙ্গা বারন। কাজের মেয়েটা আজকাল আর ভুলেও ছাদে আসেনা।
খাবারের চেয়েও বড় কষ্ট পানির। হাসু বুড়োর অবস্থা সবচেয়ে খারাপ। শরীর পুরোপুরিই ভেঙ্গে পড়েছে, আজকাল আর বিছানা ছেড়ে ও উঠে বসতে পারেনা।
সিঁড়িঘরের প্রকাণ্ড লোহার গেটটা যেন চিরকালের মতো বন্ধ হয়ে গেছে, সে সাথে অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে এতোগুলো প্রাণীর ভবিষ্যৎ।
বৃষ্টির দেখা নেই অনেকদিন হল, পরিত্যক্ত কাঠের টুকরোগুলোও ফেটে একাকার। নিচে পানির পাম্প ছাড়লে ধাতব পাইপ দিয়ে রাশি রাশি পানি এসে জমা হয় পুরনো শ্যাওলা ধরা টাঙ্কিটাতে। মাঝে মাঝে পাইপের জোড়ার অংশটি দিয়ে দুই এক ফোঁটা পানি চুইয়ে পড়ে। মখা পাগলা তার দখল নিতে সবার সাথে লড়াই বাধিয়ে দেয়।
ছোট ছেলেটাও নাকি বিয়ের পর আমূল পাল্টে গেছে। সারাদিন কাজেকর্মে ব্যস্ত থাকে, রাতে ফিরে আর আর ছাদে ওঠার কথা মনে থাকেনা।
কুমড়ো মাচায় অজস্র কুমড়ো ধরে সেখানেই শুকিয়ে যাচ্ছে, দেখার কেউ নেই। বাঁশের বেড়ার এপাশটায় পাকুরা দীনহীনের মত দাড়িয়ে থাকে।
এই বেড়াটা অবশ্য প্রথম দিকে ছিলনা। মখা পাগলা একবার বাগানে ঢুকে গাছপালা লণ্ডভণ্ড করার পরই বেড়া বসানো হয়। বাড়িওয়ালা বুড়ো অবশ্য এরপরও মাঝে মধ্যে কুমড়োর কচি ডগা কেটে ওদের খেতে দিতেন।
একদিন খুব প্রভাতে মায়ের চাপা ডাকে পাকু’র ঘুম ভেঙ্গে গেল,
- তাড়াতাড়ি ওঠ, তোর হাসু নানার শ্বাস উঠছে। যদি পারোস একটু পানির ব্যবস্থা কর, হাতে বেশি সময় নাই।
পাকু ধড়মড় করে উঠে বসে তারপর হাসু বুড়োর খোপের দিকে ছুটলো। মা ভুল বলেননি, হাসু বুড়োর বুক থেকে ঘড়ঘড় শব্দ বের হচ্ছে। হাতে আসলেই সময় নেই।
পড়িমরি করে পাকু ছুটলো পাইপের জোড়াটার কাছটায়। জায়গাটা শুকিয়ে খটখট করছে। পাশেই গলাউঁচা রাজহাঁসটা নির্জীব ভঙ্গিতে বসে ছিল, সেও বোধহয় পাকু’র মত একই উদ্দ্যেশে এসেছিল।
পাকু’র চোখে জল আসতে চায়। কতদিন হাসু নানা নিজে না খেয়ে তাকে খাইয়েছেন, কতদিন তাকে নিষ্ঠুর ছেলেছোকরাদের অত্যাচার- বিদ্রুপ থেকে রক্ষা করেছে! আজ তার শেষ সময়ে পাকু কি তার জন্য একফোঁটা পানির ব্যবস্থাও করতে পারবেনা!
পাকু ছলছল চোখে আকাশের দিকে তাকায়। ভোরের সূর্য লাল রঙ দিয়ে সেখানে ইচ্ছেমত ছবি আঁকছে, কিন্তু কোথাও একছিটে মেঘ নেই।
পাকু হতাশভাবে দেয়াল ঘেঁষে বসে পড়তেই ঘটাং করে লোহার দরজাটা খুলে গেল। হালকা গড়নের একটা মেয়ে লঘু পায়ে প্রায় নাচতে নাচতে ছাদে প্রবেশ করলো, পেছনে বাড়িওয়ালার ছোটছেলে।
পাকু বুঝতে পারে এটাই বাড়িওয়ালা বুড়োর ছোট বৌ। লোকে মিথ্যা বলেনি, ছোট বৌকে কোনভাবেই পাকুর চেয়ে ফরসা বলা যাবেনা।
- এত্ত বড় ছাদ তোমাদের! নিচ থেকে তো বোঝাই যায়না!
বোঝা যাচ্ছে ছোট ছেলেকে ঘুম থেকে জোর করে তুলে আনা হয়েছে। ঢুলুঢুলু চোখে সে ছাদটার ওমাথায় একঝলক তাকায়,
- বড় নাকি...! আসলেই তো!
- দেখেছো, ভোরের বাতাস কি মিষ্টি! তুমি তো আসতেই চাওনাই!
ছোট বৌ আপ্লুতভাবে নবীন সূর্যের দিকে তাকিয়ে ছিল। ছেলেটা সে সুযোগে কিছুক্ষণ ঝিমিয়ে নেওয়াটাই সমীচীন মনে করলো।
হাসু বুড়োর ওখান থেকে শোরগোল শোনা যায়। বুড়ো কি মরেই গেল এতক্ষণে! বেপরোয়া পাকু পায়ে পায়ে ছোট বৌয়ের পায়ের কাছটায় এগিয়ে যায়।
- হে মহামান্যা! হে রাজ্যেশ্বরী! সৃষ্টিকর্তার আশীর্বাদে তো আপনাদের কোন কিছুর অভাব নেই... এতো বিশাল দালান, অফুরন্ত শস্য, খাবার- দাবার! আমরা কটা প্রাণী এখানে কদিন যাবত প্রায় না খেয়ে আছি। আর কিছু না হোক মহামান্যা, যদি আমাদের একটু পানির ব্যবস্থা করে দিতেন ... হাসু নানা শেষ নিঃশ্বাস ফেলছে ... আপনার তো দয়ার শরীর ...
পাকুর গলা ধরে আসে, দুচোখ ভেসে যায় জলে।
- এই গাধাটা এই সকাল বেলায় এসব কি শুরু করেছে প্যাঁক প্যাঁক! প্যাঁক প্যাঁক! মারবো নাকি গাধাটার পাছায় একটা লাথি!
ছোট ছেলে উঠে দাঁড়াবার ভঙ্গী করতেই পাকু করুনভাবে দুই পা পিছিয়ে যায়।
- আশ্চর্য তো! তুমি অহেতুক এই নিরীহ প্রাণীটার উপর রুড হচ্ছ কেন? চেহারা দেখেছো এর! এদের কি কেউ খেতেটেতে দেয়না?
ছোটছেলে একটু দ্বিধায় পড়ে যায়, ‘কি জানি! আগে তো বাবা দিতেন, এখন মনে হয় ... ...’
পাকু হঠাৎ খেয়াল করলো ছোট বৌয়ের চোখ দুটো বিশাল। তবে বড় ছোট’র ব্যাপার না, চোখ তো সবার ই আছে, কারো ছোট কারো বড়। ছোট বৌ যেভাবে পাকুর দিকে তাকিয়েছিল, তাতে কিছু একটা ছিল। কেউ কোনদিন তুচ্ছ পাকুর দিকে দিকে এতো মমতা নিয়ে তাকায়নি।
- আচ্ছা, এটা কি পানির হাউজ নাকি?
- সেরকমই তো দেখাচ্ছে।
- এটা কেমন শুকিয়ে খটখট করছে দেখেছো! আমি নিশ্চিত গত একমাসে ও এখানে কেউ পানি দেয়নি। এতোগুলো প্রাণী এখানে এতদিন ধরে কিভাবে বেঁচে আছে- আল্লাহই জানেন। তুমি একটা কাজ কর, চৌবাচ্চাটা ভরানোর ব্যবস্থা কর... কুইক!
‘আচ্ছা, ঠিক আছে- বলে ছোট ছেলে আবার ঢুলতে থাকে।
ছোটবউ দাঁত কিড়মিড় করে সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে, তারপর চেঁচিয়ে ওঠে, রনিই ই ঈ!!!
ছোটছেলে অবশেষে সম্পূর্ণভাবে জেগে ওঠে তারপর ব্যস্তসমস্তভাবে পানির ব্যবস্থা করতে যায়।
৩
কাকতালীয়ভাবে হাসু বুড়ো আবার উঠে দাঁড়িয়েছে। ছোটছেলে অনেকগুলো মাটির মালসা ভরে পানি দিয়েছে, চৌবাচ্চাটাও ভরিয়ে দিয়েছে। হাসু বুড়ো তাতে চুমুক দিয়ে একবার ছোটবৌয়ের দিকে তাকায়, আরেকবার পাকুর দিকে।
সপ্রশংশ দৃষ্টি, পাকু লজ্জা পেয়ে যায়। বাচ্চারা সব চৌবাচ্চার পানিতে ঝাপাঝাপি করছে। তিনটি রাজহাঁস তারপাশে দাড়িয়ে আছে, মুখে বোকা বোকা হাসি (না। নতুন করে আর কাউকে জবাই করা হয়নি, ছোট ছেলের লাথির ভয়ে গলাউঁচা রাজহাঁসটা একটু দূরে দাড়িয়ে ছিল)।
এতো কিছুর ভিড়ে ছোট বৌ পাকুকে আলাদা করে আর খুঁজে পাচ্ছেনা। লাজুক পাকু অবশ্য আর ছোট বৌয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চায়না। আজ একদিনে সে যা পেয়েছে, তাতেই সে ভরে গেছে। একটু আড়াল থেকে সে মুগ্ধভাবে ছোট বৌকে দেখছিল।
গতকালও কুৎসিত বলে পাকুর মনে দুঃখের অন্তঃ ছিলনা। গতকালও সে ভেবেছিল, যদি রুপকথার মতো করেই সে একদিন একটা সুদর্শন রাজহাঁসে পরিণত হয়ে যেত!
আজ নবীন ঊষার এমন নিষ্কলঙ্ক মুহূর্তে ছোট বৌয়ের এমন আনন্দময়ী রূপটি দেখে সে হঠাৎ উপলব্ধি করলো, রুপ, বর্ণ, সৌন্দর্য’র মত ফালতু জিনিষ আর কিছু হয়না। অহেতুকই সবাই এসবের পেছনে ছুটে বেড়ায়, বিভ্রান্তিতে ডুবে থাকে। প্রাণীর সৌন্দর্য তো তার কাজে, উপলব্ধিতে... প্রেমে!
মখা পাগলা উৎসাহের আতিশয্যে চৌবাচ্চার উপর থেকে লাফিয়ে পড়েছিল গলাউঁচু রাজহাঁসটার একেবারে ঘাড়ের উপর। চারজন মিলে আড়ালে নিয়ে গিয়ে মখা পাগলাকে আচ্ছাসে ধোলাই দিয়ে দিল।
ধোলাই শেষে মখা পাগলা বোকা বোকা হাসি নিয়ে ফিরে আসে। ছোটবৌ সেটা দেখে কল কল করে হাসছিল, আর ঠিক তখনই তার পেছনে নবীন সূর্যের যৌবনপ্রাপ্তি ঘটে গেল।