মর্গটা একটু দুরে, করিডোরের শেষ মাথায়। সেখানে গিয়ে দেখি জায়গাটা সুনসান করছে। মাথার উপর সিক্সটি ওয়াটের একটা বাল্ব। মর্গের দরজায় বিশাল একটা তালা ঝোলানো, ভেতরে ট্রলিতে শোয়ানো দুটি লাশ। ক্যামেরা পারসন শাহআলম ভাই একটু বিভ্রান্ত - ভাই এখানে তো দুইটা লাশ, কোনটার ছবি নিমু? এতো রক্ত দেখে আমি ও কিছুটা ঘাবড়ে গেছি। মাথার উপরের বাল্বটা কেমন যেন টিমটিম করছে। একটু কোনায় দ্বিতীয় লাশটা একজন বয়স্ক লোকের। মাথায় বিরাট ব্যান্ডেজ। মনে হচ্ছে বাড়ি দিয়ে কেউ মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে। সে তুলনায় সামনে সটান হয়ে শুয়ে থাকা লোকটা একেবারে জোয়ান। মুখের ভঙ্গিতে মনে হচ্ছে শেষ মুহূর্তে কিছু একটা বলতে চেয়েছিল, সুযোগ পায়নি। একটু রাগের ভঙ্গি, হতাশাও আছে। এই রাগ আর কখনো পড়বেনা, মুখের ভঙ্গিটিও একই রকম থেকে যাবে। শাহআলম ভাইকে বললাম- এর ছবিটাই নেন। দুজনের মধ্যে এরই টপ টেরর সালাম হবার চান্স বেশি। চাচার মাথার ইনজুরি দেখে মনে হচ্ছে জমিজমার কেইস, ভাতিজা বাঁশ দিয়ে বাড়ি দিছে, ছেলেও হতে পারে। অসম্ভব কিছুনা... বাল্বটা বোধহয় এবার নিভেই যাবে। যন্ত্রণাকাতর কন্ঠে কে যেন বলল- ওমা! শাহআলম ভাই বোধহয় এতক্ষণে ভয় পেয়েছেন। আমি ও যে খুব বীরপুরুষ – তা কিন্তু না। ভিডিও শেষ হতেই পড়িমরি করে ছুটলাম। ভেতরে উঁকি মারার সময় মর্গের দরজাটায় হাত রেখেছিলাম। সেখান থেকে হাতে রক্ত লেগে গেছে। হাতটা চটচট করছে। অফিসে পৌঁছে ভালো করে হাতটা ধুতে পারলে শান্তি। হাসপাতালের গেট পার হতেই দুজন ঘিরে ধরলো। এরাও সাংবাদিক- চেহারা দেখে মনে হচ্ছে এরাও ভয় পেয়েছে। একজন এসে সরাসরি আমার হাত চেপে ধরলো। আমি কিছু বলার সুযোগ পেলামনা। লোকটা কিছুক্ষণ নিজের রক্তাক্ত হাতের দিকে চেয়ে থাকে। - ভাই ভেতরে কেমন দেখলেন, ছবি নিতে পারছেন? - হ্যা, পারলামতো! - কেউ আটকায় নাই? - নাহ! কে আটকাবে? - আপনে বোধহয় জানেননা। সাংবাদিক আর ডাক্তারদের মধ্যে আবার লাগছে, আপনে ভিতর থিইকা আস্ত বাইর হইলেন ক্যামনে? সত্যি কথা বলতে- আমি নিজেও জানিনা। ডাক্তাররা বোধহয় ভাবেনি, ঝগড়া ঝাটির মধ্যে কোন সাংবাদিক এমন ড্যাংড্যাং করে ভেতরে ঢুকে যাবে। ড্রাইভার হরলাল নতুন চশমা কিনেছে। চশমার কারনে তাকে কিছুটা অধ্যাপকদের মত দেখাচ্ছে। তবে কথা বলতে গিয়ে মুখ খুলতেই তার অধ্যাপকসুলভ গাম্ভীর্য নষ্ট হয়ে গেল। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে সে ঘাড় ঘুড়িয়ে তাকায়- - কই যামু বস? - এক কাজ কর। পলাশীর দিকে যাও। চা খাইয়া নতুন জীবন সেলিব্রেট করি। আরেকটু হইলেতো ডাক্তাররা পিটায়া টপ টেরর সালামের পাশে শোয়াইয়া দিত। ইনপুটের ফোনে কল আসে। শহরে নাকি একদল ছিনতাইকারী বের হয়েছে পিকআপে চড়ে। সামনে যেই পড়ছে, কুপিয়ে সব ছিনিয়ে নিচ্ছে। মাসের বেতন হয়নি, পকেটে অল্প কটা টাকা পড়ে আছে। আমার তুলনায় শাহআলম ভাইয়ের বিপদ বেশি। হাতে তার লাখ টাকার ক্যামেরা। চায়ের দোকানগুলো আজ কেন যেন ফাঁকা। ছাত্রাবাসের ছেলেরা ইতস্তত দুই একজন বসে আছে। তাদের সাথে আছে একদল খেটে খাওয়া মানুষ, একটু তফাতে। হাসপাতাল থেকে বের হয়ে শাহআলম ভাই আর কথা বলেনি। চশমা খুলে পকেটে পুরে হরলালই অর্ডার দিল। সাংবাদিক দেখে দোকানী কিছুটা খাতিরই করলো। চায়ের কাপে আস্ত এলাচ ভাসছে, তার সাথে দ্বারচিনির গুড়ো। তাতে অবশ্য চায়ের বিস্বাদভাবটুকু কমেনি। হরলালতো চুমুক দিয়ে একপ্রকার ক্ষেপেই গেল। - কি মিয়াঁ! চায়ে কি পাত্তি দিছ? তুমি ও কি লাশ চায়ের কারবার কর নাকি? লাশ শব্দটি শুনে বাকিরাও ঘাড় ঘুড়িয়ে তাকায়। এমন গুরুত্বর অভিযোগের জবাব না দিলেই নয়। দোকানী দ্বিগুণ তেজে কাউন্টার এটাক করে। এতোটা হরলাল আশা করেনি। সমর্থনের আশায় সে আমার দিকে তাকায়, ব্যক্তিত্ব ফিরে পেতে চশমাটা আবার পড়ে নেয়। হরলালের মুখে লাশ শব্দটি শুনে আমার মনে পড়লো- হাসপাতাল থেকে বের হয়ে হাত ধোঁয়া হয়নি। সালামের রক্ত চায়ের কাপের উত্তাপে আবার চটচটে হয়ে গেছে। এতকিছুর পর চায়ের আর তেষ্টা থাকেনা। আমি কাপটা নামিয়ে রাখি। পশ্চিমাকাশে একটুখানি রঙ দেখা যাচ্ছে। খেটে খাওয়া মানুষগুলো হঠাৎ করেই নাই হয়ে গেছে। ছাত্রাবাসের ছেলেগুলোও চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে হাই তুলল, ওদের ঘুমোবার সময় হয়ে গেছে। মধ্যাকাশে কালপুরুষ তিরটা ছুড়ে মারতেই আমরা আবার পথে নামলাম। স্বর্গের উদ্যান হতে মৃদুমন্দ বাতাস ভেসে আসে। সূর্যের সাথে পাল্লা দিয়ে শহর জেগে উঠতে থাকে। শুধু এক সালামই জাগতে পারেনা। আবছায়া মর্গের শীতল ট্রেটাতে সে চিৎ হয়ে শুয়ে থাকে। তার যাত্রা আপাতত শেষ হয়েছে। এ জীবনে তার আর কালপুরুষ হয়ে ওঠা হলনা...
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মিলন বনিক
রনিল ভাই..অনেক দিন পর আপনার গল্প পড়লাম....বেশ ভালো লাগলো...চমত্কার গল্প....অনেক শুভ কামনা...
তানি হক
দীর্ঘদিন পর এলেন ...এবং উপলব্ধি করিয়ে দিলেন বাস্তবতা কে ... এমনি তো হয় রনি ভাই । লাশ ঘরে পৌঁছে ও কেউ বেঁচে বেঁচে মারা যাচ্ছে , কেউ আবার পৌঁছানোর আগেই মরে যাচ্ছে । অনেক অনেক ভালো লাগলো । আর সেই চেনা লিখার স্টাইল আপনার কত কত মিস করি কিভাবে বলি । হ্যা গ্যাপ দেন সমস্যা নেই তবে দীর্ঘ গ্যাপ দিয়েন না প্লীজ {পাক্কা এক বছর পর } , অনেক অনেক শুভেচ্ছা ও ধন্যবাদ ভাইয়াকে ।
Fahmida Bari Bipu
আপনার লেখা প্রথম পড়লাম। সত্যিই খুব ভাল লাগল। সহজ সাবলীল ছন্দে গল্প বলার এই স্টাইলটা পাঠককে আকৃষ্ট না করে পারে না। শুভেচ্ছা আপনার জন্য।
শামীম খান
অনেক অনেক দিন পরে এলেন । আপনার লেখা সবসময় খুব মন দিয়ে পড়ি । দারুন লাগে আমার । এ লেখাটিও ভাল লেগেছে । বরাবরের মতই দারুন বর্ণনা । সাবলীল শব্দ সঞ্চারন । বিষয়বস্তুর সাথে কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ হোল সেটা নিয়ে তাই ভাবছি না । শুভ কামনা সতত , ভাল থাকবেন ।
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।